বিয়ের চাপ
৭ম পর্ব
——————————
আজ মলির বিবাহ।গতকাল খালা সবাইকে হুমকি দিয়ে বলেছেন,আমাদের পরিবার থেকে কাউকে উনি এই বিয়েতে যেতে দেবেন না।উনার মানা না শুনে কেউ যদি যাওয়ার চেষ্টা করে,তবে তাকে নাকি উনার লাশের উপর দিয়ে যেতে হবে।অথচ আজ সকাল থেকে দেখা গেল বিয়েতে যাবার ব্যাপারে উনার আগ্রহটাই এখন সবচেয়ে বেশি।সবার আগে উনি বিপুল উৎসাহ নিয়ে সেজেগুজে বসে আছেন।তবে সমস্যা হচ্ছে একটু পর পর উনি সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে মলির জন্য বদদোয়া করছেন।উনার বদদোয়াটি শুনলে যে কারও মনে হবে, উনি বদদোয়াটি আগে কাগজে লিখেছেন,তারপর মুখস্থ করেছেন।কারণ প্রতিবারই উনি হুবুহু একই কথা বলছেন।খালা আবার তার বদদোয়া শুরু করলেন,
-হে আল্লাহ ,হে মাবুদ আপ বহুত শক্তিমান হো।আপ চাহা তো সবকুছ হো সাকতা হে। আপ চাহা তো হিমালয় গলে লাচ্ছি হো সাকতা হে।আপ চাহা তো বাংলাদেশ আমেরিকা হো সাকতা হে।এখন আপ আপকা শক্তি দেখাও। মলির বিয়া ভাঙি দাও।মলির হবু জামাই যাতে অন্য মেয়েকে লে কর পালায় যায় এমন ব্যবস্থা করে দাও।ম্যায় মলির চোখে পানি দেখতে চাই।আপনি মেরা দোওয়া কবুল করে দিন।মে ইসকে বদলে মে হিন্দি বলনা ছোর দুঙ্গা।
অনেকবার শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে বললাম,
-খালা তোমার সমস্যা কি।তুমি খামাকা একজন মানুষের জন্য বদদোয়া করছ কেন ? একটা মানুষের বিবাহের আগেই তাকে বিধবা হওয়ার জন্য দোওয়া করছ।এটাতো অন্যায়।
-মে তুঝে বহুত বার বলছি,তু মঝে উপদেশ নেহি দেগা।মাগার তু নেহি শুনতা।সিরিয়াসলি, আমি কিন্তু তোকে চাকরিছে নিকাল দুঙ্গা।
-খালা আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি না।আমি শুধু বলছি বদদোয়া দিও না।এখন মলি যদি দোওয়া করে, তুমি বিধবা হয়ে যাও।তাহলে তোমার কেমন লাগবে ?
-দেক কোনো সমস্যা নাই।আমি জানি,তোর খালু নেহি মরেগা।কিউকি শয়তান মানুষ জলদি নেহি মরতা।
আমি হা করে খালার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমাদের বাসার সবাই মোটামুটি বিয়েতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেছি।বিয়েতে যাচ্ছি আমি,মা,খালা,আপা আর দুলাভাই।বাবা যাচ্ছেন না।যদিও তিনি এখন অনেকটা সুস্থ।তবুও কোনো এক অজানা কারণে উনি যাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
বিয়ের অনুষ্ঠান হবে সন্ধ্যায় উত্তরার এক কমিউনিটি সেন্টারে।তবে আমরা এখন কমিউনিটি সেন্টারে যাচ্ছি না। আমরা যাচ্ছি মলিদের উত্তরার বাসায়।সেখান থেকে সন্ধ্যার সময় আমরা কনের সাথে একত্রে কমিউনিটি সেন্টারে যাব।
আমরা মলিদের বাসায় পৌঁছলাম বেলা এগারোটার দিকে।বাসায় শুধু মলির দুজন বান্ধবী আর কিছু নিকট আত্মীয় উপস্থিত রয়েছেন।বাহিরের মানুষ বলতে শুধু আমরা। আসলে মলির পরিবার আমাদের পরিবারকে তাদের পরিবারের অংশ হিসেবেই সম্মান দিচ্ছেন।মলিদের বাসায় পৌঁছার পর মলির পরিবার আমাদেরকে যথেষ্ট সম্মান ও আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানাল।
বাসায় ঢুকে মলিকে কোথাও দেখলাম না। শুনলাম ভিতরের কোনো এক রুমে বিউটিশিয়ান মলিকে সাজাচ্ছেন।মা-খালা বাসায় ঢুকেই মলির মায়ের সাথে গল্প জুড়ে দিল।আর আপা তার বান্ধবী মানে মলির বড় বোনের সাথে আড্ডায় মেতে গেল।আমি আর দুলাভাই কোনো কাউকে খুজে না পেয়ে বাসার সামনের ছোট বাগানে ঝুলানো দোলনায় যেয়ে বসলাম।দুলাভাই আর আমি দোলনায় ঝুলছি।এসময় হঠাৎ করেই দুলাভাই এর সাথে মজা করতে ইচ্ছে হলো।আমি দুলাভাইকে বললাম,
-দুলাভাই একটা রোমান্টিক গান গানতো।
-গান শুনবা ? আমার তো গলা ভালো না।বেসুরো গলা।
-সমস্যা নাই।আমার আসলে এখন বেসুরো গলার গানই শুনতে ইচ্ছে করছে।এদিক থেকে আপনিই বেস্ট।
-আসলে দিপু তুমি যে আমাকে এতটা সম্মান দাও,সেটা ভাবলেই চোখ ভিজে যায়।
-দুলাভাই ঢং না করে গান শুরু করেন।আর শোনেন রোমান্টিক গান গাইবেন,উল্টা-পাল্টা গান গাইবেন না। আপনি তো আবার সঠিক জিনিস বাছাই করতে জানেন না।বলেন একটা আর উদাহরণ দেন আরেকটা।
-এটা কি বললা ? একটু আগে সম্মান দিয়া এখন আবার অপমান করতেছ ? যাও গাইলাম না।
-সরি দুলাভাই।অপমান করছি না।আপনি হচ্ছেন আমার প্রিয় দুলাভাই।নেন শুরু করেন।আবারও বলছি, হান্ডেড পারসেন্ট রোমান্টিক গান গাইবেন।
-কেন,তোমার কি মলির বিয়ে হচ্ছে বলে কষ্ট লাগছে ?
-আরে না।আসলে আপনার সাথে এখন দোলনায় ঝুলছি।বিষয়টা আমার কাছে অনেক রোমান্টিক লাগছে।তাই এমন একটা রোমান্টিক আবহে একটা রোমান্টিক গান শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।এছাড়া আর কিছু না।
-ঠিক আছে,তাহলে তোমাকে একটা সুন্দর গান শুনাই।
দুলাভাই দুবার খুক খুক করে কেশে তার রোমান্টিক গান শুরু করলেন।
“আলাল ও দুলাল
আলাল ও দুলাল,
তাদের বাবা বাজি চান
চানখা পুলে প্যাডেল মেরে পৌছে বাড়ি
আলাল ও দুলাল….
এটুকু গেয়ে দুলাভাই আমার ভুরু কুঁচকানো চেহারা দেখে গান থামিয়ে দিলেন।গান থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-এভাবে তাকায় আছ কেন ? গান কি ভালো হচ্ছে না ?
-আমি আপনাকে বললাম একটা রোমান্টিক গান গাইতে।আর আপনি এটা কি গান গাচ্ছেন ? নেন অন্য একটা গান শুরু করেন।
-ঠিক আছে অন্য একটা গাইছি।
বলেই দুলাভাই আবার দুবার কাশলেন।তারপর গলার স্বর করুণ করে গাইলেন।
“আমি তোমার বধূ
তুমি আমার স্বামী
খোদার পর তোমায় আমি বড় বলে জানি….
গান শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেল। মনে মনে বললাম,এই লোকটার সমস্যাটা কি ? এ লোক কি জীবনেও সঠিক উদাহরণ,সঠিক গান নির্বাচন করতে পারবে না ? দুলাভাই এর গান শুনে মাথায় শয়তানি বুদ্ধি এলো।ভাবলাম এরে একটা উচিত শিক্ষা দেই।আমি দুলাভাই এর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসে গলায় বললাম,
-দুলাভাই আমাকে একটু জড়িয়ে ধরেন তো।
-কেন ? তোমার কি মাথা ঘুরতাছে ?
-না,আসলে আপনার এই রোমান্টিক গান শুনে মনে কেমন যেন একটা রোমান্টিক অনুভূতি হচ্ছে।মনে হচ্ছে আপনাকে জড়িয়ে ধরে দোল খাই আর আপনার গান শুনি।আর একটু ভালোবাসাবাসি করি।
-নাউজুবিল্লাহ নাইজুবিল্লাহ।এই বদমাস বলে কি !
বলেই দুলাভাই লাফ দিয়ে দোলনা থেকে নেমে গেলেন।
আমি গলার স্বরে মাদকতা মিশিয়ে বললাম,
-এই দুষ্টু নেমে গেলেন কেন ? কাছে আসেন না….
দুলাভাই হা করে তাকিয়ে রইলেন। তার চেহারা দেখে মনে হলো,তিনি আসলেই ভয় পেয়েছেন।আমি দুলাভাই এর চেহারা দেখে হো হো করে হেসে উঠলাম।কিছু বলতে যাব, এসময় একটা ছোট্ট মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল,
-আংকেল আংকেল আপনাকে মলি আন্টি যেতে বলেছে।
-কোথায় ?
-আসেন আমার সাথে।
বলেই বাচ্চাটি আমার হাত ধরে টানতে লাগল।
মলিদের দোতালা বাসার ছাদের উপর একটা রুম আছে, ঐ রুমেই মলিকে সাজানোর আয়োজন চলছে।সাজ এখনো শুরু হয়নি।রুমে ঢুকেই দেখলাম,মলি একটা চেয়ারে বসে আছে।সম্ভবত একটু আগেই গোসল করে এসেছে।সদ্য গোসল করে আসা মেয়েদেরকে দেখলেই কেন জানি আমার মনে হয়,মেয়েটি এইমাত্র শরৎচন্দ্রের বা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের পাতা থেকে বের হয়ে এসেছে।
রুমের টেবিলের উপর মেকাপের বিভিন্ন জিনিস রাখা।দুজন বিউটিশিয়ান প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের কাজ শুরু করার।আমি ঢুকতেই মলি বলল,
-আপনার একটু সাহায্য দরকার,সেজন্য ডেকেছি।আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন ?
-বলেন কি করতে হবে ?
-উনারা দুজন আমাকে সাজাবেন।উনারা বললেন, চুল আর মুখ সাজাতেই নাকি কয়েক ঘন্টা চলে যাবে।এতক্ষণ চুপচাপ করে কি বসে থাকা যায় ? বিষয়টা বোরিং না ? তার উপর আমার আবার এসব ভারী সাজ ভালো লাগে না।
-তা আমাকে এখন কি করতে হবে ? উনাদের দুজনকে পিটিয়ে ভাগাতে হবে ?
-আরে না ,আপনি এখন এখানে বসে থাকবেন,আর আমার সাথে কথা বলবেন।আর সারাক্ষণ আমাকে দেখবেন।
-কথা বলা সমস্যা না।তবে তাকিয়ে থাকা সমস্যা। আমি মেয়েদের মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনা।কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে।
-দম বন্ধ হলে হোক,তারপরও আপনাকে তাকিয়ে থাকতে হবে।কারণ এটাই আপনার শাস্তি।আমি চাই আপনি আমাকে দেখবেন আর এই ভেবে কষ্ট পাবেন যে, আহ আমি কি হারালাম।
-আপনি হয়তো জানেন না,আমার বুকে আল্লাহ কষ্টের এ্যাপসটা ইনস্টলই করেননি। হা হা হা ….
-সারাক্ষণ হা হা হা করবেন না।যে মেয়েটি আপনার বউ হতে পারতো,সেই মেয়েটির আজ বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।আর কয়েক ঘন্টা পর সে অন্যের বউ হয়ে যাবে।কোথায় কষ্টে ঘুমের বড়ি খাবেন,বা নেশার কিছু খেয়ে কোনো চিপায় বসে কাঁদবেন তা না। হা হা হি হি করছেন।
মলির কথা শেষ হতেই আমি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।মলি অবাক হয়ে বলল,
-কোথায় যাচ্ছেন ?
-ঘুমের বড়ি কিনতে।আচ্ছা শুনেছি প্রেসক্রিপশন ছাড়া নাকি ঘুমের বড়ি বিক্রি করে না ? তবে আমার ধারণা ঘুষ দিলে মনে হয় দেবে,কি বলেন দেবে না ?
-ফাজলামি করবেন না। চুপচাপ বসে থাকেন আর আমাকে দেখেন।
একথা বলেই মলি চেয়ার থেকে উঠে এসে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।এরপর বলল,
-বের হবার চেষ্টা করলে একেবারে ঠ্যাং ভেঙে দেব।
আমি চুপ করে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম।আর বসে বসে পাগল মেয়েটির সাজ দেখতে লাগলাম।দেখলাম আস্তে আস্তে একটি পরি কিভাবে মিষ্টি বউ এ রূপান্তর হয়ে যাচ্ছে।
-জানেন আমি ভেবেছিলাম,আপনি আমার বিয়েতে আসবেন না।আপনি না এলে আমার মনের কষ্টটা একটুও কমত না।আপনি এসেছেন আর আমার কষ্টটা এখন একটু একটু করে কমছে।
-আমি আসাতে আপনার মনের কষ্ট কমছে ? সেটা কিভাবে ?
-এই যে আপনি আমাকে দেখে অভিভূত হচ্ছেন।আর আমাকে না পাবার জন্য মনে মনে কষ্ট পাচ্ছেন।এটা ভেবেই আমার মনের কষ্ট কমছে।
-আমি কষ্ট পাচ্ছি আপনাকে কে বলল ?
-কাউকে বলতে হবে না।মেয়েরা সহজেই এসব বুঝতে পারে।এই বুঝতে পারার এ্যাপসটি আল্লাহ প্রত্যেক মেয়ের ভেতর ইনস্টল করে দিয়েছে।হি হি হি….. ।
বিউটিশিয়ানরা এখন মলিকে কথা বলতে নিষেধ করলেন। কারণ তারা এখন মলির মুখে মেকাপের কাজ শুরু করবেন।আমি চুপচাপ বসে রইলাম।মলির মুখ ও চুলের কাজ শেষ হবার পর মলি বলল,
-আপনি ছাদের ঐপাশে একটা দোলনা আছে,ওখানে যেয়ে বসুন।ওরা এখন আমাকে শাড়ি পরাবে।
-আপনি না বললেন,আমাকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হবে। তাহলে বের করে দিচ্ছেন কেন ?
মলি আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড গভীরভাবে তাকিয়ে রইল।তারপর হাসতে হাসতে বলল,
-আপনি আসলেই থাকতে চান ? আপনি না বললেন মেয়েদের মুখের দিকে তাকালে আপনার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমি তো শিওর আপনি আমার শাড়ি পরা দেখলে হার্টফেল করবেন।আমি চাইনা আমার বিয়ের দিন,আমার বাসায় একটা লাশ নিয়ে টানাটানি হোক।হি হি হি…।
আমি রুম থেকে বের হয়ে এলাম।এসে দোলনায় বসলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর মলি এলো।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।তাই চোখ সরিয়ে নিলাম।মলি সামনে এসে বলল,
-আমাকে কেমন লাগছে ?
-পরির মতো।
-আফসোস,এই পরিটা আপনার হতে পারত ? কিন্তু হেলায় আপনি সুযোগটা হারালেন। অবশ্য দোষ আপনার না। একজন খুবই জ্ঞানী মানুষ বলেছেন,কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না ।হি হি হি….।
আমি কপট রাগে বললাম,
-আপনি আমাকে কুকুর বললেন ?
-আচ্ছা আমি কি আপনার পাশে একটু দোলনায় বসতে পারি ?
-আপনার বাসা,আপনার দোলনা আপনি অনুমতি চাইছেন কেন ? বসুন।
-জানেন আমার স্বপ্ন ছিল আপনার সাথে এই দোলনায় বসে জোছনা দেখব।আর সারা রাত আপনার কাঁধে মাথা রেখে গল্প করব।
-সমস্যা কি এখন জয় সাহেবের সাথে তা করবেন।
-হুম।
এরপর বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলাম।হঠাৎ করেই মলি উঠে দাঁড়াল। আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলল,
-আসেন আমার সাথে।আপনাকে একটা জিনিস দেখাই।
আমি অবাক হয়ে মেয়েটির পাগলামি দেখছি। মলি টানতে টানতে আমাকে দোতালার একটি রুমের সামনে নিয়ে এলো।বলল,
-এই রুমটি আমার।আমার যখন মন খুব খারাপ থাকে, তখন আমি এই রুমে চলে আসি।এসে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করি।তারপর কিছুক্ষণ সোজা হয়ে ফ্লোরে চুপচাপ শুয়ে থাকি।এরপরই আমার মন ভালো হয়ে যায়।বলতে পারেন এটি আমার কান্নার রুম।এটি আমার মন ভালো করার রুম।
-ইন্টারেস্টিং।
-জানেন এই রুমে পৃথিবীর কেউ কখনও ঢোকার সুযোগ পায়নি,আর পাবেও না।আমি যখন বাসায় থাকিনা।তখন তালা মেরে রাখি। অবশ্য তালা মারা না থাকলেও কেউ ঢুকবে না।
-আপনার বাবা-মা বা আপনার বোন কেউ ঢোকেনি ?
-না।সবাই জানে এটি আমার পছন্দ না।আমি ওদেরকে বলেছি,এই পুরো পৃথিবীর কোনো কিছুই আমার না।কিন্তু এই রুমটি শুধুই আমার।এটি আমার রাজ্য।এটিই আমার রাজত্ব্য।এই রুমটি আমি আমার নিজ হাতে সাজিয়েছি।এই রুমে প্রথম যে মানুষটি ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে সেটি হচ্ছেন আপনি।
-আমি সম্মানিত বোধ করছি।বিয়ের পর জয় ভাইকে ঢুকাবেন না।
-না।
মলি দরজার লক খুলে ভেতরে ঢুকল।আমি রুমের ভেতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম।ছোট্ট একটি রুম।মেঝেতে একটি মাদুর বিছানো।সম্ভবত কান্না শেষে মলি এই মাদুরেই লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে।রুমের মধ্যে বিভিন্ন খেলনা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবগুলো খেলনার গায়ে কাগজের স্টিকার দিয়ে কোনটি কোন ক্লাশের খেলনা এবং তা কে দিয়েছে সেটি লেখা।পুরোটা দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধাই করা শুধু ছবি আর ছবি।মলির জন্মের পর থেকে আজকের বয়স পর্যন্ত প্রতিটি বছরের ছবি আছে সেখানে।প্রতিটি ছবিতেই ছবি তোলার তারিখ লেখা আছে।দেওয়ালের সর্বশেষ ছবিটি আমার আর মলির গায়ে হলুদের ছবি।ছবির নিচে লেখা, আমার স্বপ্নের রাজপুত্র।
-জানেন আমি ঠিক করেছি,এই ছবিটার পর আর কোনো ছবি এই রুমে টাঙাব না।কারণ এটাই আমার জীবনের শেষ আনন্দের ছবি।আপনি পালিয়ে যাওয়ার পর আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম।এই রুমে এসে কষ্টে অপমানে অনেক কেঁদেছি।
-আমি সরি।
-সরি হবার কিছু নেই।আমি এখন আমাকে বদলে ফেলেছি।এখনকার এই আমি অন্য আমি।আপনি হয়তো ভাবছেন,আমি আপনাকে এই রুমে এনে,এসব কথা বলে আপনাকে দূর্বল করতে চাচ্ছি।তা কিন্তু না।আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল,আমার প্রিয় মানুষটিকে আমি এই রুমে নিয়ে আসব।আমার ছোটবেলার সময়গুলোর সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেব।আপনি হয়তো ভাবছেন এই অল্প কয়দিনেই কিভাবে আপনি আমার প্রিয় মানুষ হলেন।আসলে আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবার পর পরই আমি আমার পুরো রাজ্যটা আপনাকে দিয়ে দিয়েছিলাম।
-আমি আসলেই সরি।
-বললাম তো সরি বলতে হবে না।শোনেন আপনাকে বিব্রত করার জন্য আমি এসব বলছি না।অথবা আপনাকে দূর্বল করে আপনাকে পাবার চেষ্টাও আমি করছি না।কারণ সে সুযোগ আর নেই।আর কয়েক ঘন্টা পরই তো আমার বিয়ে।আসলে ভাবলাম বিয়ের আগে আপনাকে সবকিছু জানিয়ে একটু হাল্কা হই।
-শুধুই কি হাল্কা হওয়ার জন্য ? আর কোনো কিছু না ?
-আর একটা কারণ অবশ্য আছে।সেটা হলো আপনাকে বোঝানো যে,একটা মেয়ে আপনাকে তার স্বপ্নের কোথায় রেখেছিল।অথচ আপনি কি করলেন ? আপনি তার মূল্য বুঝতে না পেরে মেয়েটির স্বপ্নটাই তছনছ করে দিলেন।
বলেই মলি আমার চোখের দিকে তাকালেন।আমিও ওর চোখের দিকে গভীরভাবে তাকালাম।সাধারণত মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।অথচ আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম,এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে না।মলি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
-এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন ? কি ভাবছেন আপনি ?
-ভাবছি আপনার কাহিনী নিয়ে একটা গল্প লিখব।তারপর সেই গল্প দিয়ে একটা বাংলা সিনেমা বানাব।সিনেমার নাম দেব,মলির সংসার।
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র মলি হাসিতে ফেটে পড়ল।হাসতে হাসতে বলল,
-আমি আপনার মতো পাগলের কাছ থেকে এমনই কিছু একটা শুনব বলে আশা করেছিলাম।শুনেন আমাকে আর হাসাবেন না।একটু পর আমার বিয়ে। আমি হেসে-কেঁদে আমার মেকাপ নষ্ট করতে পারব না।তাহলে ছবি সুন্দর হবে না।আপনি কি চান আমার বিয়ের ছবি পঁচা হোক ?
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আমরা সবাই কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠলাম।কমিউনিটি সেন্টারটি মলিদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে না।
চলবে…