# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -২৫
৪৬.
হসপিটালের করিডোরে বসে আছে আরু। “কার্ডিওলজিস্ট স্পেশালাইজ হসপিটাল” — এখানে এর আগেও একবার এসেছে আরু। কিন্তু সেদিন আর আজকের মাঝে অনেক ব্যবধান। পরিস্থিতিগত ব্যবধান। সেদিন ভালোবাসায় সিক্ত ছিলো আরু। হাজারোও রঙে আপ্লুত ছিলো সে। কিন্তু আজ! আজ সেই ভালোবাসাটা নেই। না! হয়তো আছে, মনের খুব গভীরে কোনো সুপ্ত এক কোণায়। এতোটাই গভীরে যেখানে পৌঁছানোর পথটা আরুর নিজেরই অজানা। সেদিন আপ্লুত আবেগে পাগলামো করেছিলো সে কিন্তু আজ পাগলামো নয় আবেগ নয় আপ্লুত কষ্টে নিঃষ্প্রাণ সে। আরুর বাবা, আরমান সাহেব হার্ট অ্যাটাক করেছেন। কিছুক্ষণ আগেই হসপিটালে আনা হয়েছে তাকে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হসপিটাল। আরিফ এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে, আকস্মিক এই বিপদে দিশাহারা সে। কোথায় কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। নিজেকে এতোটা অসহায়, এতোটা দুর্বল কখনো মনে হয় নি তার। বাবা! শব্দটা বড্ড ভারি। সে বাবা অসুস্থ হোক বা মৃত্যুপথযাত্রী, বিপদের মুখে তিনি সবসময়ই একগুচ্ছ সাহস আর প্রখর রোদে স্নেহময় বটগাছ। আরিফের গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজের অসহায়ত্বটাকে চিঁড়ে ফালা ফালা করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। তাদের অসহায়ত্বের কাছে হারতে নেই। তাদের আবেগ প্রকাশের সময় নেই। আরিফও কাঁদে না। ধলা পাকিয়ে গলায় আটকে যাওয়া কান্নাগুলোকে বারবার ঢোক গিলে হজম করে নেয় । ভাইকে এমন অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে উঠে আসে আরু। আরিফের হাতটা টেনে ধরে কাঁপা গলায় বলে,
— ভাইয়া? এখন কি করবি?
আরিফ ফিরে তাকায়। পেছনে দাঁড়ানো আরুকে দেখেই রাগ,ক্ষোভ, কষ্ট সবকিছুই যেন মাথা চাঁড়া দিয়ে ওঠে। হাতটা ঝাড়া দিয়ে রাগী গলায় বলে,
— এখানে কেন তুই? চলে যা এখান থেকে। এক্ষুনি যাবি। লিনা? লিনা?
লিনা চোখের পানি মুছে দ্রুত এগিয়ে আছে। শরীরটা আর চলছে না তার। প্রেগনেন্সির তিনমাস চলছে লিনার। এসময়ে শরীর এমনিতেই দুর্বল থাকে তার মধ্যে দু’দিন যাবৎ বাড়িতে যে হুল্লোড় তাতে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারও গিলতে পারে নি সে। কাঁপা পায়ে কিছুটা এগিয়ে এসে বলে,
— শান্ত হও আরিফ। এখন রাগ দেখানোর সময় নয়। বাবাকে দেখো।
— ওকে যেতে বলো লিনা। ও এখানে থাকলে বাবা বাঁচবে না। আমাদের কাউকে বাঁচতে দিবে না ও। জন্মানোর সময় আমার মাকে কেড়ে নিয়েছে আর আজ বাবাকে কেড়ে নিবে। কাল দেখা যাবে তোমাকেও……ওকে যেতে বলো। যেতে বলো ওকে…
—- আরিফ! বাচ্চা মেয়ে, ছেড়ে দাও না।
ভাইয়ের কথাগুলো যেন সূঁচের মতো ফুটে চলেছে আরুর মনে।যে ভাই নিজের সবটা সুখ আরুর ভাগ্যের সাথে জুড়ে দিয়ে চলেছে সেই ছোট্ট বেলা থেকে। সেই ভাই-ই আজ কতো কঠিন কঠিন কথা বলছে তাকে। সত্যিই তো, সব দোষ তো আরুর। তার জন্মানোটা দোষের ছিলো, রাফিনের প্রতি দুর্বলতাটা দোষের ছিলো, রাফিনকে প্রশ্রয় দেওয়াটা দোষের ছিলো, তার চুপ থাকাটা দোষের ছিলো। এই জীবনটা তার দোষের খাতায় পরিপূর্ণ। এতো এতো দোষের বোঝায় কিভাবে বাঁচবে আরু? এভাবে কি বাঁচা যায়? আরু ফুঁপিয়ে উঠে। ধরা গলায় বলে,
— ভাইয়া,প্লিজ! এভাবে বলিস না। প্লিজ।
কথা বলতে বলতে এগিয়ে এসে আরিফের ডান হাতটা ধরতেই আবারও ঝটকা দেয় আরিফ। আরু ছিটকে যায়। ঝটকাটা যে এতো জোরে হবে নিজেও বুঝতে পারে নি আরিফ। বোনের জন্য মনটা আৎকে উঠে তার। কিন্তু আরু পড়েনি দেখে স্বস্তি পায়। ফ্লোরে নয় অপরিচিত কারো বুকের উপর গিয়ে ঠেকেছে আরু। অপরিচিত লোকটি আকস্মিক ঘটনায় খানিকটা চমকে ওঠে। আরুকে না ধরে হাতদুটো হালকা উঁচু করে ভ্রু কুঁচকে বলে,
— এক্সকিউজ মি? এটা কোনো গার্ডেন নয়। মাথা তুলে দূরে গিয়ে দাঁড়ান প্লিজ।
আরু ঝটপট সরে দাঁড়ায়। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে তাকায় সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই চমকে উঠে। রাফিনের গায়ে অপারেশন থিয়েটারের কাপড়। বামহাতে গ্লাভস। হয়তো মাত্রই অটি থেকে বেরিয়েছে সে। আরু মনে করার চেষ্টা করছে আজ কি বার। শনিবার ছাড়া তো হসপিটালে থাকার কথা নয় রাফিনের। তবে কি আজ শনিবার? আরু অনেক চেষ্টা করেও আজকের বারটা মনে করতে পারছে না । এতো এতো টেনশনে মাথাটা হয়তো জমে গিয়েছে। আরু দ্রুত ভাবে, আচ্ছা? মাথা কি জমে যায়? কঠিন পদার্থ কি জমে? রাফিন খানিকটা এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে তাকায়,
— হোয়াট হ্যাপেন্ড? হচ্ছেটা কি? তোমার কপালে রক্ত কেন? এক্সিডেন্ট টেক্সিডেন্ট করেছো নাকি?
আরু কিছু বলে না। রাফিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। ভ্রু দুটো আরো খানিকটা কুঁচকে আসে,
— এক্সিডেন্ট তো নয়। গালে হাতের ছাপ দেখা যাচ্ছে। চুরি করতে গিয়ে মার খেয়েছো নাকি?
আরু নিশ্চুপ। রাফিন স্বাভাবিক গলায় বলে,
— কথা বলছো না কেন? এই ছেলেটা মেরেছে?
আরিফকে ইশারা করে আরিফের সামনে এগিয়ে যায় রাফিন। সবাইকে চমকে দিয়ে চড় বসিয়ে দেয় আরিফের গালে। আরু হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। রাফিন আরো কয়েকটা চড় বসাতেই ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে আসে আরিফের। লিনা ছুটে গিয়ে আটকায়। চোখের সামনে স্বামীকে মার খেতে দেখতে পারে না সে। কিন্তু রাফিনকে আটকানো দুর্বল লিনার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। ছিটকে পড়ে ফ্লোরে। আরু এবার দৌড়ে এসে আরিফকে জড়িয়ে ধরে। রাফিনের হাত আটকানোর চেষ্টা করে বলে,
— ভাইয়াকে মারছেন কেন আপনি? ছাড়ুন ওকে।
রাফিন থেমে গিয়ে সরু চোখে তাকায়। আগের থেকেও স্বাভাবিক গলায় বলে,
— ওহ্ তোমার ভাই নাকি? চেহারায় মিল আছে।
কথাটা বলে আরেকটা চড় মেরে খানিকটা সরে দাঁড়ায় সে। আরিফ আরুকে ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে লিনাকে তোলে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
— ঠিক আছো তুমি?
লিনা কান্নায় বাকরুদ্ধ। চোখের সামনে স্বামীর এই অসম্মান মানতে পারছে না সে। হসপিটালের অনেকেই আড়চোখে তাকাচ্ছে। রাফিন তার একটা চড়ের বিপরীতে কতোগুলো জীবনের গতিপথই পাল্টে দিয়েছে অথচ আরিফকে করা অপমান তার কাছে অতি তুচ্ছ! মধ্যবিত্ত সমাজ বলে কথা। এদের কি আর মানসম্মান থাকে? রাফিনের হয়তো জানা নেই, মধ্যবিত্তদের মানসম্মানবোধ ষোলআনা। তারা এই আত্মসম্মানের জন্য জীবনটাও দিতে পারে যা হয়তো টাকার গালিচায় শুয়ে থাকা উচ্চবিত্তরা পারে না। রাফিন বিরক্তমুখে সেখান থেকে সরে যেতে নিতেই একজন মেয়ে ডক্টর ছুটে আসেন। মেয়েটার মুখ-চোখ শুকনো। রাফিনকে যে সে যথেষ্ট ভয় পায় তা চোখে মুখে স্পষ্ট। মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বলে,
— নিউ হার্ট প্যাশেন্ট এডমিট হয়েছে,স্যার। ইট’স ইমার্জেন্সি।
রাফিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
— প্রবলেমটা কি?
— হার্ট অ্যাটাক।
— এনজিওগ্রাম করা হয়েছে?
— ইয়েস ডক্টর। তিনটা ব্লক ধরা পড়েছে।
— ওহ্।আপনারা ম্যানেজ করুন ডক্টর সারা। আজ আমার হসপিটালে আসার ডেট ছিলো না। সো, আই এম বিজি।
ডক্টর সারা সাহস নিয়ে বলে ওঠে,
— প্লিজ ডক্টর। রোগীর অবস্থা খারাপ। কেইসটা আপনি দেখলে হয়তো বেঁচেও যেতে পারে। এটা একটা জীবনের প্রশ্ন!
রাফিন বাঁকা হেসে বলে,
— সুন্দরী মেয়েদের কথা কখনোই শুনি না আমি। আর কাউকে বাঁচানোর নূন্যতম ইচ্ছেও আপাতত নেই আমার। তবু, ফাইলটা কেবিনে পাঠান। সাথে পেশেন্টের রিলেটিভকেও।
কথাটা বলে একমুহূর্ত দাঁড়ায় না রাফিন। হঠাৎই বাপ নামক ব্যাক্তিটার কথা মনে পড়ে যায় তার। সবার মতো বাবার কথা মনে হলে কান্না পায় না রাফিনের। তবে, কোথাও একটা ব্যাথা করে। শুধুমাত্র বাবার জন্যই মাফিয়া হয়েই “সার্জন” সে। ডাক্তার বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো ছেলেও ডাক্তার হবে তার। বিখ্যাত ডাক্তার। রাফিন চেয়ারে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে। বাবার চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। এতো বছরে চেহারাটাও ভুলে গেছে সে। শুধু মনে রয়ে গেছে নাম। আর একটা খেতাপ,ডাক্তার! রাফিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মেলে তাকায়। টেবিলে রাখা ফাইলটায় চোখ বুলায়। কিছুক্ষণ পরই দরজায় টোকা পড়ে। রাফিন ফাইলে চোখ রেখেই বলে,
— কাম ইন!
লোকটি ভেতরে আসতেই চোখ তুলে তাকায় সে। সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে অবাক হয় না রাফিন। অনুভূতিশূন্য গলায় বলে,
— বসুন।
আরিফ বসে। ঠোঁটের কোণায় এখনও রক্ত লেগে আছে তার। মুখে অপমানের চিন্হ। বাবা জনিত সমস্যা না হলে এখানে এক মুহূর্তও দাঁড়াতো না আরিফ। কিন্তু, বাবা! শব্দটাই আটকে দেয় বারবার। আরিফ ভেবেছিলো রাফিন নিশ্চয় গা জ্বালানো কিছু বলবে। কিন্তু রাফিন তেমন কিছুই বললো না। একজন প্রফেশনাল ডক্টরদের মতো বললো,
— আপনার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে সেটা তো জানেন। উনার হার্টটে তিনটি ব্লক ধরা পড়েছে। হার্ট অ্যাটাকের আগে শ্বাস কষ্ট, বুক ব্যাথা, ঘাম এসব কিছু হয় নি?
আরিফ মৃদু গলায় বললো,
— কাল থেকে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। বাবার প্রায়ই শ্বাসকষ্ট হয় তাই তেমন একটা গুরুত্ব দেই নি।
— ভুল করেছেন।”হার্ট অ্যাটাক আকস্মিক “—এই কথাটা অনেকাংশেই ভুল। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার একমাস আগে থেকেই শরীরে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। বলতে পারেন সাইন। ব্যাপারটা অনেকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আবার অনেকের ক্ষেত্রে নয়। তবে, হার্টের রোগীদের এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত নয়। যেমন, বুকে ব্যথা, বুকের এক পাশে বা পুরো বুক জুড়ে ভারী ব্যথা, মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম করা, ঘাম হওয়া,নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, বমি ভাব হওয়া ইত্যাদি। আপনাদের দুর্ভাগ্য যে সাইন পাওয়ার পরও কোনোরকম এ্যাকশন নিতে পারেন নি আপনারা। তৎক্ষনাৎ হসপিটালাইজ করলে হয়তো এনজিওপ্লাস্টি করলেই হয়ে যেতো। (এনজিওপ্লাস্টির ক্ষেত্রে ছোট হয়ে যাওয়া ধমনিতে প্রয়োজন অনুসারে মাইক্রো রিং পড়িয়ে দেওয়া হয়)বাট আপনার বাবার ক্ষেত্রে এখন তা কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। এন্ড খুব তাড়াতাড়িই করতে হবে। এবার ডিসিশন আপনাদের হাতে।
আরিফের হৃদস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে আসছে।ডান হাতের পিঠ দিয়ে মুখের ঘামগুলো মুছে নেয় সে। কাঁপা গলায় বলে,
— কষ্ট কেমন পড়বে ডক্টর?
রাফিন বাঁকা হেসে বলে,
— আপনাদের সরকারি হসপিটালে যাওয়া উচিত ছিলো। সরকারি হসপিটালেই ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য দেড় লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। আর এটা তো প্রাইভেট হসপিটাল। ৩ লাখ টাকা তো লাগবেই।
আরিফ আৎকে উঠে। এতো টাকা কোথায় পাবে সে? নিজেকে সামলে নিয়ে রাফিনের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে । লিনার মুখটাও শুকিয়ে আছে। আরিফ ধীর পায়ে লিনার পাশে গিয়ে বসে। একঘন্টার মাঝে এতোগুলা টাকা ধারই বা কে দেবে তাকে? তবে কি বাবাকে আর বাঁচাতে পারবে না সে?
৪৭.
মৃন্ময়ের রুমে ঠোঁট কামড়ে, কপাল কুঁপকে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে রোজা তীর্থ। দৃষ্টি ল্যাপটপের পর্দায় স্থির। এক পর্যায়ে, নিচের ঠোঁট চিমটে বলে উঠে তীর্থ,
— “Savory Pizza. Co” এটা তো কোন পিৎজা কোম্পানির নাম মনে হচ্ছে, স্যার। তারমানে রেইনকোটটা কোনো পিৎজা কোম্পানির? রেইনকোটের গায়ে ট্যাগটা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।
রোজা এবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চিন্তামগ্ন গলায় বলে,
— তাহলে কি আমাদেরকে ফলো করা লোকটি একজন পিৎজা ডেলিভারি বয়? একজন পিৎজা ডেলিভারি বয়ের আমাদের পিছু নিয়ে কি লাভ হতে পারে?
তীর্থ ডিভানে বসে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলে,
— সেটা তো এই কোম্পানিতে গিয়ে খুঁজ নিয়েই জানতে পারবো আমরা। স্যার? আমাদের নেক্সট প্ল্যান কি এই “Savory Pizza. Co”? আমার মনে হয় এখানে গেলেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবো আমরা।
মৃন্ময় এবার এগিয়ে আসে। রোজার পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপের উপর খানিকটা ঝুঁকে পড়ে। সাথে সাথেই শরীরটা কেঁপে উঠে রোজার। মৃন্ময় স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
— ডানপাশে জোম করো তীর্থ। ঝোপের আড়ালে লোকটির জুতো দেখা যাচ্ছে। একদম কোণায় খেয়াল করো। হ্যাঁ! ওই জুতোটাই জোম করো।
মৃন্ময়ের কথা মতো জুতোর উপর জোম করে তীর্থ। জুতোটা তার চোখেই পড়ে নি। এই মৃন্ময়ের চোখগুলো কি অণুবীক্ষণ যন্ত্র নাকি? কথাটা ভেবে আড়চোখে মৃন্ময়ের দিকে তাকায় তীর্থ। মৃন্ময় ল্যাপটপে নজর রেখেই বলে,
— কি বুঝলে?
রোজাও খানিকটা ঝুঁকে আসে। মৃন্ময়ের বাহুর সাথে আবার ছোঁয়ে যায় তার শরীর। মৃন্ময় স্বাভাবিক থাকলেও রোজার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় হাজারগুণ। তীর্থ ঠোঁট উল্টে মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলে,
— কি বুঝবো, স্যার? জুতো দেখে বুঝার মতো কি আছে?
মৃন্ময় ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
— জুতোর নিচের দিকে একটা ট্যাগ আছে দেখো। সেখানে লেখা, ” Air Max”
তীর্থ ভ্রু কুঁচকে বলে,
— তো?
— তো, লোকটি যে জুতো পড়েছে তা “Nike Air Max extreme Sneaker” খুবই এক্সপেন্সিভ জুতো। কম হলেও ১২০ ইউএস ডলার তো হবেই। যা বাংলাদেশের টাকায় ১০২৪৪ সামথিং। তোমার মনে হয় না? একজন পিৎজা ডেলিভারি বয়ের জন্য এতো দামি জুতো পড়াটা একটু বেশিই কাকতালীয়?
রোজা আবারও সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ভ্রু কুঁচকে সরু চোখে তাকায়।
— আপনি বলতে চাইছেন লোকটি পিৎজা ডেলিভারি বয় নয়? এটা আমাদের ডিসট্রেক্ট করার প্রচেষ্টা মাত্র?
মৃন্ময় ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
— হতে পারে। তাদের দুটো মোটিভ থাকতে পারে।
এক. আমাদের ডিসট্রেক্ট করে আমাদের উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে বাঁধা দেওয়া বা আমাদের আগে সেখানে পৌঁছানো এবং সব প্রমান মুছে ফেলা।
দুই. আমাদের থ্রো গন্তব্যে পৌঁছানো। যদি প্রথমটি ঠিক হয় তাহলে তারা চাইছে আমরা পিৎজা কোম্পানিতে গিয়ে লোকটির খোঁজ নিই এবং সময় নষ্ট করি।আর তারা খুব ইজিলি নিজের কাজটা কমপ্লিট করে নিক।
তীর্থ এবার উঠে দাঁড়ায়। মাথায় হাত রেখে বলে,
— ওরে,ব্যাস! কি কূটনীতি রে মামা।
রোজা তীর্থের কথায় পাত্তা না দিয়ে মৃন্ময়কে উদ্দেশ্য করে বলে,
— তাহলে আমাদের নেক্সট প্ল্যান কি? শ্রীমঙ্গল?
মৃন্ময় ডান হাতে নিজের চুলগুলো ঠিক করে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। চোখের ঘন পল্লব ঝাঁকিয়ে বলে,
— ইয়েস। আজ রাতেই বেরিয়ে যাবো আমরা। যেতে ১ থেকে দেড় ঘন্টা লাগবে। আজ রাত শ্রীমঙ্গল হোটেলে কাটিয়ে কাল ভোরে নিরালা খাসিয়াপুঞ্জির উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে আমাদের। ইউ গাইস রেডি?
তীর্থ-রোজা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়। মৃদু কন্ঠে বলে,
— ইয়েস স্যার।
মৃন্ময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বামহাতটা সামনে এনে ঘড়িতে চোখ রাখে —- ৩ঃ৪০। ঘড়ি থেকে চোখ তুলে বলে,
— বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে এখনোও লাঞ্চ করা হয় নি আমাদের। সবাই ফ্রেস হয়ে নিন, ২০ মিনিট পর লাঞ্চ করতে বেরুবো। তারপর প্যাকিং। এখানে আর ফিরছি না আমরা।
কথার মাঝেই ফোন বেজে উঠে মৃন্ময়ের। রোজা-তীর্থকে যাওয়ার জন্য ইশারা করে ফোনটা রিসিভ করে সে। শান্ত কন্ঠে বলে,
— আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
ওপাশে নীরবতা। কয়েক সেকেন্ড পর ইতস্তত গলায় বলে ওঠে,
— আসসালামু আলাইকুম স্যার। স্যার আমি আরিফুল ইসলাম আরিফ। সিকিউরিটি অফিসার…
মৃন্ময় হাসিমুখে বলে,
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ বলুন, চিনতে পেরেছি। কোন সমস্যা মিষ্টার আরিফ?
আরিফ থমকে যায়। কথা খুঁজে পায় না। আমতা আমতা করে বলে,
— আসলে স্যার…
— জি বলুন।
আরিফ দম নেয়। সাহস নিয়ে বলে ওঠে,
— আমার বাবা অসুস্থ স্যার। হসপিটালে এডমিট। আট্যাক করেছেন। আসলে…
“আমার বাবা অসুস্থ ” চরম বিরক্তি তৈরিতে এই ছোট্ট কথাটুকুই যথেষ্ট। কেউ-ই তার স্টাফের অসুস্থ বাবার খবর নেওয়ার আগ্রহ দেখায় না। আর প্রয়োজনও বোধ করে না উল্টো বিরক্ত হয় কিন্তু মৃন্ময় বিরক্ত হয় না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আরিফের কথায় মনোযোগী হয়। আরিফের অস্বস্তি বুঝতে পারে । কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের দম ফাটলেও মুখ ফাটে না।মৃন্ময়ের ধারনা আরিফও এমন একজন মানুষ। খুব বিপদে না পড়লে কারো কাছে হাত পাতার ছেলে আরিফ নয়। মৃন্ময় তার অস্বস্তি কমাতেই নরম গলায় বলে,
— মিষ্টার. আরিফ? আপনার একাউন্ট নাম্বার আর এমাউন্টটা ম্যাসেজ করে দিন। আপনার একাউন্টে টাকা পৌঁছে যাবে। চিন্তা করবেন না। বাবা ঠিক হয়ে যাবে।
আরিফ আকস্মিক কেঁদে ফেলে। সে ভাবতেই পারে নি সম্পূর্ণটা না শুনেই এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে মৃন্ময়। মৃন্ময় এবার অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কান্নারত কোনো পুরুষকে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় জানা নেই তার। আরিফ নিজেকে সামলে নিয়ে ধরা গলায় বলে,
— থেংকিউ স্যার। আমি লোন হিসেবে শীঘ্রই টাকাটা পরিশোধ করে দিবো স্যার।
মৃন্ময় হাসে।
— এখন টাকা হিসেব করার সময় নাকি আরিফ সাহেব? এটা আমার দায়িত্ব ছিলো আর আপনার অধিকার। গিয়ে বাবার খেয়াল রাখুন। বাবা কিন্তু একটাই হয়। বাবাকে ধরে রাখতেই হবে। গো…আল্লাহ হাফেজ।
ফোন কেটে সোহেলকে ফোন দিয়ে আরিফের একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করতে বলে ফ্রেশ হয় মৃন্ময়। কালকের দিনটা খুবই দীর্ঘ হতে চলেছে তাদের।
বিকাল ৪ঃ০০ টা। লাঞ্চে করতে বসেছে তীর্থ,রোজা আর মৃন্ময়। তীর্থ- রোজা টুকটাক কথা বললেও মৃন্ময় নিশ্চুপ। হঠাৎ করেই মৃন্ময়কে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে রোজা,
— মিষ্টার হিরো? আমরা তো রাতেই চলে যাচ্ছি। এখানে কি আর ফিরবো না? কতকিছু দেখার আছে। বিছানাকান্দি,রা
তারগুল, জাফলং… আরও কত্তোকিছু। এসব জায়গায় কখন ঘুরবো আমরা?
মৃন্ময় খেতে খেতে জবাব দেয়,
— আপনি হানিমুনে আসেন নি মিস.রোজা। নেক্সট টাইম যখন হানিমুনে আসবেন তখন না হয় হাজবেন্ডকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। এবার আপাতত হচ্ছে না।
মৃন্ময়ের শান্ত কন্ঠের অতি সত্য কথাগুলোই রোজার রেগে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। রোজা রেগে তাকায়। তীর্থ খাবার মুখে দিয়েই ফিক করে হেসে উঠে। রোজা..
# চলবে…