ইলমা বেহেরোজ
পদ্মজা ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলল, ‘একসঙ্গে খাব।’
মেঝে ঝকঝকে দেখে আমির বলল, ‘চাচী এসেছিলেন?”
‘হুম। গোসল সেড়ে নিন, আমি খাবার প্রস্তুত করছি।’
‘মনা কবে আসবে?’
‘বড় বোনের বিয়ে, গ্রামে গেছে। কিছুদিন তো লাগবেই।’
‘কাউকে নিয়ে আসব কাজে সাহায্য করার জন্য?”
‘প্রয়োজন নেই, কিছুদিনের ব্যাপারই তো। চাচী এসে সব ধুয়েমুছে দিয়ে যান। বাজার করেন তারিকুল ভাই। আমার কাজ তো শুধু রান্না করা।’
আমির গোসল করে নিশ্চুপে রাতের খাবার খেল। টুকটাক যা কথা বলল, তাতেও নির্জীবতা। চঞ্চল মানুষটা হুট করে গম্ভীর আর শান্ত হয়ে গেছে। পদ্মজা অবগত নয় আমিরের সমস্যা সম্পর্কে। তবে এটা বুঝতে পেরেছে, কিছু একটা ঘটেছে। এই মুহূর্তে প্রশ্ন করা ঠিক হবে না। প্রথমে মানুষটার ঘুমের প্রয়োজন। ঘুম মস্তিক্ষকে সতেজ করে, শক্তি দেয়। মধ্যরাত অবধি আমির শুধু এপাশ-ওপাশ করল। কিছুতেই ওর দুই চোখের পাতা এক হচ্ছে না। এমন দুজন তার দূর্বলতা জেনে গেছে, যাদের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন হবে। রফিক মাওলা আর এমপি কুতুবউদ্দিনকে হত্যা করার কথা সে ভেবেছে। কিন্তু কীভাবে? এছাড়া আর কী উপায় আছে ফাঁদ থেকে বাঁচার?
আমির বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় চলে যায়। ওর পরনে হালকা রঙের ছোট প্যান্ট, খালি গা। রাতের আকাশে গোল বৃত্তের মতো চাঁদ। সে সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল; তা স্পষ্ট শুনতে পেল পদ্মজা।
ভাবল, ‘এতোটা ভারী হয়ে আছে মানুষটার মন? কীসের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে? কীসের চাপ সহ্য করছে?
পদ্মজা শাড়ির আঁচল বুক থেকে নামিয়ে কোমরে গুঁজল। কাচের একটা বাটিতে ঢালল ঠান্ডা তিলের তেল। টুংটাং শব্দ
শুনে আমির রুমে উকি দেয়।
মৃদু আলোর নিচে পদ্মজা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে
তেলের বাটি। সে রুমে এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। পদ্মজা হাতে তেল নিয়ে তার পায়ের পাতা থেকে ম্যাসাজ শুরু করে। ভালো করে তেল দিয়ে পায়ের পাতা একটু সামনে পিছনে করে ম্যাসাজ করে, চাপ দেয়। তারপর হাতের আঙুল দিয়ে পায়ে চাপ দিয়ে ম্যাসাজ করে করে একবার পায়ের নিচ থেকে ওপরে গেল আবার ওপর থেকে নিচে ম্যাসাজ করল। এভাবে কয়েকবার করার পর পা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে দিল।
পালঙ্কের ডানপাশের দেয়ালে একটা বড় আয়না টানানো। আমির সেদিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে, পদ্মজাকে দেখছে। এলোমেলো চুল, শাড়ি পুরোটা কোমরে গুঁজে রাখা, উপরিভাগে শুধু প্রিন্টের ব্লাউজ; এ যেন হাতে আঁকা কোনো মনোহর চিত্রা শরীরের সাথে সাথে আমিরের চোখ দুটি শীতল হয়ে আসে। প্রচন্ড মানসিক চাপে অতিষ্ট হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক আরামদায়ক ম্যাসাজে ধীরে ধীরে ঝরঝরে হয়ে উঠছে। শরীরে এসে ভর করছে রাজ্যের ঘুম। পদ্মজা আয়নায় তাকায়, দুজনের চোখাচোখি হয়। কত প্রেম পদ্মজার ওই দুটি চোখো আমির আবেগপ্রবণ হয়ে বলে উঠল, ‘যেদিন তোমার চোখে ঘৃণা দেখব, সেদিন থেকে আমার বাঁচার কোনো কারণ থাকবে না।’আমিরের মুখ থেকে নিঃসৃত ভারী কথাটাকে পদ্মজা হালকাভাবে নিয়ে বলল, ‘আপনার মতো মানুষকে কেউ ঘৃণা করতে পারে না। আমিতো নই-ই।’
‘কতোটা ভালোবাস আমায়?’
এহেন প্রশ্নে পদ্মজা অবাক হয়ে দর্পণের দিকে তাকাল।
তেলের ম্যাসাজ দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে আমিরের মন ও শরীরকে। উত্তর শোনার পূর্বেই হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে। পদ্মজা তেলের বাটি রেখে ঘুমন্ত আমিরের গালে, কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কত যে ভালোবাসি কী করে বুঝাই?’
অফিসে ঢুকতেই সেক্রেটারি আমিরের কাছে একটা ছোট চিরকুট নিয়ে এলো, ‘স্যার, জনৈক ভদ্রলোক দিয়ে বললেন, এটা জরুরি। আপনাকে যেন দেয়া হয়।।’
আমির হাত বাড়িয়ে চিরকুটটি নিয়ে খুলল। তাতে লেখা- মুখোশ উন্মোচন পর্ব শুরু।ও দাঁতে দাঁত খিঁচে চিরকুটটি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। জানালার পর্দা তুলে রাস্তায় সন্দেহভাজন দুজন লোককে দেখতে পায়। পদ্মজা কখন কোথায় যায় জানার জন্য কুতুবউদ্দিন লোক লাগিয়েছে! আমির ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবল। দুপুর হতেই ড্রাইভারকে ডেকে বলল, ‘পদ্মজাকে ওর অফিস থেকে বাড়ি নিয়ে যান। যত যাই ই হোক রাস্তায় গাড়ি থামাবেন না। কারো সঙ্গে যেন পদ্মজার কোনো কথা না হয়।’
ড্রাইভার বাধ্যের মত মাখা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘জি স্যার।’
ড্রাইভার চলে গেল। সে টেলিফোন করে সেক্রেটারিকে বলল, সাদিক, সুরুজ এবং কবিরকে পাঠাতে।
তারা অফিস রুমে ঢুকেই পাশাপাশি সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
আমির প্রথমে সাদিককে বলল, ‘কুতুবউদ্দিন আর রফিক মাওলাকে অনুসরণ করতে হবে। ওদের প্রতিদিনকার তথ্য চাই। কখন কোথায় যাচ্ছে? কার সাথে কথা বলছে? পরিবারে কী চলছে? পরিবারের সব সদস্যদের সম্পর্কেও যাবতীয় তথ্য, সব জানতে চাই।
সুরুজকে বলল, ‘মুজ্জা কলোনিতে শুকতারা নামে
যে বাড়িটা আছে সেখানে পরনো কিছু আসবাবপত্র গুছিয়ে রেখে আসবে। বুকশেলফে কিছু পুরনো বই রাখবে। পদ্মজার সামনে এরকম আচরণ করবে, যাতে ও বুঝে বাড়িটি তোমার পৈতৃক বাড়ি।’
কবিরকে বলল, ‘মুজ্জা কলোনির চারপাশে তোমার লোকদের রাখবে, চারপাশের সবকিছু সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার জন্যয় আগামীকাল থেকে পদ্মজাকে নিয়ে আমি মুজা কলোনিতে থাকব। শুকতারাকে প্রতিটি মুহূর্তে দূর থেকে পাহারা দিতে হবে।’
ওরা তিনজন আমিরকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে যায়। উত্তেজনায় আমিরের কপালের রগগুলো দপদপ করছে। পদ্মজাকে কখনো কিছু জানতে দিবে না সে, কখনো না।
পদ্মজা বাড়ি ফিরে দেখে তারিকুল গেইটের পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, মাখা থেকে রক্ত আসছে। সে ড্রাইভারকে নিয়ে দ্রুত গাড়ির থেকে নামল। উৎকণ্ঠা নিয়ে তারিকুলকে ডাকল, ‘তারিকুল ভাই? শুনছেন? তারিকুল ভাই।’
ড্রাইভার তারিকুলের গালে থাপ্পড় দিয়েও যখন সাড়া পেল না বলল, ‘পানি লাগবে ম্যাডাম।’
পানি আনার জন্য বাড়ির ভেতর ঢুকে আঁতকে উঠে পদ্মজা। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে কাচের অসংখ্য টুকরো। চেয়ার, টেবিল, সোফা, আলমারি সব জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে। কেউ তার গুছানো সংসারকে তছনছ করে ফেলেছে। পাশের দেয়ালে লাল রং দিয়ে আগন্তুক লিখে রেখেছে- মরবে।
কে করেছে এসবা পদ্মজা আতঙ্কে দ্রুত আমিরের কাছে টেলিফোন করল, ‘হ্যালো… হ্যালো, এখানে তাণ্ডব ঘটে গেছে।’
ওপাশ থেকে রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘কী হয়েছে?”
‘বাড়িতে কেউ হামলা করেছিল। সব জিনিসপত্র চুরমার করে ফেলেছে। আপনি দ্রুত আসুন।’
‘তুমি… তুমি ঠিক আছো? পদ্মবর্তী, পদ্মবতী? আমির হন্তদন্ত হয়ে অফিস থেকে বের হয়। গাড়ি নিয়ে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি ফিরে চারপাশের অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। হামলাকারীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার চেঁচামেচি করে, পুলিশকে কল করে। তারিকুলের অবস্থা বেগতিক, রক্তপাত হচ্ছে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ইন্সপেক্টর শাহিন মাহফুজকে আসতে দেখে পদ্মজাকে আড়ালে যেতে বলে আমির। পদ্মজা পর্দার আড়াল থেকে শুনে তাদের কথপোকথন।
ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কাকে সন্দেহ করছেন?’
‘আমি জানি না। আমার সন্দেহ করার মতো কেউ নেই। নির্ভেজাল মানুষ আমি।’
‘গত কয়দিনে সন্দেহভাজন কিছু ঘটেছে?”
আমিরকে দ্বিধান্বিত হতে দেখা গেল। বলল, গতকাল আমার কাছে একটা হুমকি এসেছিল, আমি যদি নীট ওয়ারের চুক্তিপত্রটি বাতিল না করি আমার স্ত্রীকে হত্যা করা হবে।’
‘কীসের মাধ্যমে হুমকি এসেছিল?’
‘একটা চিরকুটে লেখা ছিল।’
পদ্মজা অবাক হয়ে যায়। আমিরের দুশ্চিন্তার কারণ তবে এই ছিলা
ইন্সপেক্টর ভেবে বললেন, ‘শুনেছি, সম্প্রতি আপনি কুয়েত থেকে ফিরেছেন। সেখানে ব্যতিক্রমী কিছু বটেছিল? বা ফেরার পর অফিসে কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘অফিসে হয়নি। তবে কুয়েতে আলী আকবর নামে এক ব্যবসায়ীর নীট ওয়ারের একটা অর্ডার পাওয়ার কথা হয় কিন্তু কর্তৃপক্ষ শেষ অবধি অর্ডারটি আমাকে দিলেন। বাকিসব সাধারণ ঘটনা ছিল।’
‘হয়তো তিনি ক্ষোভের বশে আপনার ক্ষতি করতে চাচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে, নীট ওয়ারের চুক্তিপত্র বাতিলের সঙ্গে একমাত্র উনারই ফায়দা আছে।’
আমির ভারাক্রান্ত মনে বলল, ‘উনি ভীষণ ভালো মানুষ।’
ইন্সপেক্টর হাসল, ‘ভালো মানুষের আড়ালেই শয়তান থাকে। কিন্তু হাতে যেহেতু প্রমাণ নেই আমরা উনাকে ধরতে পারব না।’
আমির অনুরোধ করে বলল, ‘আমার স্ত্রী বাড়িতে একা থাকে। ভাগ্যিস আজ বাড়িতে ছিল না, নয়তো কী হতো’ আমির চোখ বুজে ভয়ে মাথা ঝাঁকায়।
জোর দিয়ে বলে, দ্রুত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন, প্লিজ।’
ইন্সপেক্টর গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন।
আমির উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে কিছু শোনার জন্য।
ইনস্পেক্টর বললেন, ‘আগন্তুক কে আমরা জানি
না। যেহেতু হুমকি পেয়েছেন আবার বাড়িতেও
হামলা হয়েছে ব্যাপারটা খুব জটিল। ভালো হয় যদি আপনার স্ত্রীকে কিছুদিন নিরাপদ কোনো জায়গায় রাখেন। ততদিনে আমরা আলী আকবর সম্পর্কে প্রমাণ বের করে তাকে এরেস্ট করার ব্যবস্থা করব।’
আমির চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, ‘কী বলছেন? বাড়ি ছাড়তে হবে কেন? আপনি বাড়ির বাইরে পুলিশের টহল রাখলেই তো পারেন।’
‘দেখুন, আলী আকবরই যে খুনের চেষ্টা করছে সেটা তো নিশ্চিত না। এমনও হতে পারে আপনার কোনো আত্মীয় বা চেনা কেউ এই কাজ করেছে। আপনারা যদি এখানে থাকেন, তাহলে আত্মীয়রা আসবেই, আটকাতে পারবেন না। কখন কী ঘটে বলা যায় না। আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে সমস্যা নেই। আমি শুধু একটা উত্তম উপায় জানালাম। আগন্তুক ধরা পড়া না অবধি আপনি আপনার স্ত্রীকে সবার থেকে আড়ালে রাখুন। শুধু যে আপনার স্ত্রীর প্রাণের হুমকি তা নয়, আপনারও আছে।’
পদ্মজা আর নিজেকে আটকাতে পারল না। পর্দার
আড়াল থেকে বলল, ‘দুঃখিত মাঝে কথা বলার জন্য।
#চলবে
সম্পূর্ণ গল্প