বনের মাঝে দুটি বটগাছ। তাদের প্রকাণ্ড আকারের কাণ্ড থেকে ছড়িয়ে থাকা ঘন শাখা-প্রশাখার নিচে জমাট বেঁধে আছে অন্ধকার। সে অন্ধকারে আলোর পরশ ছড়িয়ে আকাশে হাসছে চাঁদ।
চাঁদটা ঠিক বটগাছের মাথার ওপরে ঝুলে আছে।
চাঁদের আলোয় বটগাছের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি মানব দেহের উপস্থিতি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। জুলফা দ্রুত পায়ে সামনে এগোতেই অত্যন্ত পরিচিত একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পেল; বটের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো মা মান্নাত ও ভাই রঞ্জন।
জুলফা আনন্দে ঝলমল করে উঠে।
দৌড়ে গিয়ে মান্নাতকে জড়িয়ে ধরে অভিমানের সুরে বলল, ‘এতদিনে এলি মা! তোর ওপর খুব রাগ জমেছে।’
‘মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কি যখন-তখন আসা যায় ?’
‘আর শ্বশুরবাড়ি বলোনে। ও কাহিনি শেষ।’
রঞ্জন ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চারপাশ দেখে নিল। দিনের আলোয় এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যায় হয়তো। এখন শুধু সারি সারি গাছ দেখা যাচ্ছে৷ অন্ধকারে কতো দূর ই বা আর দৃষ্টি যায়। আশেপাশে মানুষের উপস্থিতি নেই। জামাইয়ের কড়া নিষেধাজ্ঞা, এই বাড়িতে কখনো যেন আত্মীয় হয়ে তারা না আসে। কেউ যদি তাদের একসঙ্গে দেখে প্রশ্ন করে বা সন্দেহ করে; কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
নিজ ঘরে ফেরার উত্তেজনায় জুলফার চোখেমুখে ঝিলিক দিচ্ছে খুশি। তার হাসিখুশি মুখে কালো আঁধার নামিয়ে দিয়ে রঞ্জন বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল, ‘তুই ব্যাগ নিয়ে আসলি যে?’
এহেন প্রশ্নে জুলফা হতভম্ব হয়ে অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকাল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চিকচিকে জ্যোৎস্নার আলো পড়ে তার সর্বাঙ্গে আলো-আঁধারের জাল বুনেছে। চোখের তারায় ছুটে বেড়াচ্ছে শঙ্কা। মা, ভাই তাকে কী নিতে আসেনি?
কষ্ট করে জিজ্ঞেস করতে হলো না তার আগেই মান্নাত বলল, ‘কালিগঞ্জ থেকে মোরা চলে যাইছি তাই তোকে দেখতে এসছি, নিতে আসিনি।’
জুলফা অবিশ্বাস্য সুরে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস মা? আমায় নিবি না? আমায় রেখে চলে যাবি?’
রঞ্জন বলল, ‘তোর আলিশান শ্বশুরবাড়ি আছে সেসব রেখে তুই মোদের সঙ্গে কোথায় যাবি রে?’
জুলফা তীব্র সুরে প্রতিবাদ করল, ‘শ্বশুরবাড়ি বলবিনে। আমি আলিশান বাড়ি চাইনে। মা, তুই বলেছিলি কয়দিন পর মোরে নিতে আসবি। এখন কী বলছিস!’
হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাজ পড়ার মতো তীব্র মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেল তার। এই বাড়িতে সারাজীবন থাকার কথা তো ছিল না। নিজের থেকে বয়সে দ্বিগুণ বড় লোকটার সঙ্গে সে কিছুতেই থাকতে চায় না। নেহাৎ মা-ভাই হাতেপায়ে ধরেছিল বলে তাদের পরিকল্পনার একটা অংশ হয়েছিল। কিন্তু তার পরিবার এভাবে তাকে জলে ভাসিয়ে দিবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না৷ কিন্তু তাদের কথাবার্তা বড় অসংলগ্ন লাগছে।
জুলফা রঞ্জনের দুই হাত চেপে ধরে বলে, ‘তোদের সঙ্গে যাব। এইখানে থাকবনে। এ মা, মোরে রেখে যাসনে।’
‘এ কী কথা বলিস! তোকে বিয়ে দিয়েছি কী সঙ্গে নিয়ে যাইতে?’
জুলফা অনুনয় করে বলল, ‘মোরে নে মা, এইখানে আমি ভালো নেই। আমার ঘুম লাগেনে, আমার খেতে ভালো লাগেনে।’
রঞ্জন বুঝানোর চেষ্টা করে, ‘তুই জমিদারের বউ। এমন করছিস যে, তোর কীসের অভাব?
তোর হচ্ছে রাজকপাল। মোরা তোকে রানি বানিয়েছিরে। তুই কত ভালো থাকবি।’
জুলফা ফুঁসে উঠল, ‘মোরে রানি বানাতে বিয়ে দিয়েছিস নাকি নিজেদের স্বার্থে দিয়েছিস ? মোরে নিয়ে তোরা বিকিকিনি করেছিস।’
মুখের ওপর এহেন কথা বলায় রঞ্জন ভীষণ চটে গেল। বলল, ‘গলা উঁচিয়ে কথা বলবিনে।’
মান্নাত বলল, ‘তুই কি চাসনে তোর ভাইবোন, ভাই পুত, ভাই ঝি ভালো থাকুক? ওদের নিজেদের একটা বাড়ি হোক?’
‘তাই বলে তোরা মোরে বলি দিবি? আমি এইখানে মরে যাচ্ছিরে মা। আমায় সঙ্গে নিয়ে যা। আমি আগের মতো তোদের কামাই করে দিব। নিয়ে যা আমায়, এ মা কথা বল।’
রঞ্জন বার বার চারপাশ দেখছে। সে মান্নাতকে ইশারা করে কথোপকথন দ্রুত শেষ করতে।
মান্নাত বলল, ‘তোকে শেষ দেখতে এসেছিলেম। দেখা হয়ে গেছে, চলে যাচ্ছি। তুই ভালো থাকিস, সুখে থাকিস৷’
জুলফা খপ করে মায়ের হাত ধরে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল, ‘মা, এ মা এমন করিসনে। আমি সুখে থাকবনে। তোরা কোথায় চলে যাচ্ছিস? আমি তো কিছুই চিনিনে মা। তোদের কোথায় পাব?’
‘তোকে আমাদের পেতে হবে না। আমরা তোকে দেখতে আসব।’
‘আমায় নিয়ে যা। এ ভাই, এ মা, আমায় রেখে যাসনে। মোরে ওমন করে চিরজীবনের জন্য বেঁচে দিসনে। তোরা যা বলবি তাই শুনব। মোরে তোদের সঙ্গে নে।’
রঞ্জন মাটি থেকে ব্যাগ তুলে জুলফার হাতে দিয়ে বলে, ‘তোর কারণে মোরা আবার যাযাবর হতে চাইনে। তুই চাইলেই রানি হয়ে থাকতে পারবি। আমরা পারবনে। যা, বাড়ি যা। তোর শ্বশুরবাড়ির কেউ দেখলে তাদের সম্মান যাইবে৷ যা, চলে যা।’
রঞ্জনের পা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল জুলফা, ‘এ ভাই, এমন করিসনে। মোরে রেখে যাসনে। এইখানে থাকতে অনেক কষ্ট হয়, চাইনে আমি আলিশান বাড়ি, চাইনে আমি রানি হতে। আমি তোদের সঙ্গে যেতে চাই।’
বাতাসে সড়সড় শব্দ, কানে আসছে অপরাজিতা নদীর জলের আওয়াজ। বনের ভেতরে জমাট বাঁধা অন্ধকার। জুলফা যেভাবে কাঁদছে যে কেউ এসে যেতে পারে। রঞ্জন জোর করে পা ছাড়িয়ে নেয়, ‘পা ছাড়, চলে যা। কেউ দেখলে তোর শ্বশুরবাড়ির মান যাবে।’
জুলফা রঞ্জনের পা ছেড়ে মান্নাতের পা আঁকড়ে ধরে, ‘মা, মা গো, মোরে রেখে যাসনে। কেমনে পাব তোদের? কোথায় চলে যাবি? আমি তো পথঘাট চিনিনে। আমায় নিয়ে যা।’
জুলফার আহাজারিতে মান্নাতের মাতৃত্ব কেঁদে উঠে। সেই ছোট্ট বেলা পুতুল খেলার মধ্য দিয়ে মান্নাত কন্যার মায়ের আস্বাদে পুলকিত হয়েছিল। প্রথম ছেলের জন্মের পর যখন জুলফার জন্ম হয় শৈশবের সেই ইচ্ছা, সুপ্ত বাসনা বাস্তব হয়ে ধরা দেয়৷ পুতুলখেলার কন্যা সত্যে রূপান্তরিত হয়৷ সে মেয়ের আহাজারি যে আর সহ্য হচ্ছে না।
জুলফা কিছুতেই তাদের ছাড়বে না বুঝতে পেরে রঞ্জন একটা ভয়াবহ কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। জুলফা কিছু বুঝে উঠার পূর্বে তার ঘাড়ে আঘাত করে, সঙ্গে সঙ্গে জুলফার মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে ঝাপসা চোখে দেখতে পায়, রঞ্জন মা কে টেনে নিয়ে বনের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে৷ তাকে ফেলে যাচ্ছে অন্ধকার বনে, জীবনের অতল সমুদ্রে। মানুষের মন্দ স্বভাবের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা। যুগে যুগে মানুষ পরিবার দ্বারা, প্রিয়জন দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়েছে।
এই দাগ মনুষ্য হৃদয়ে সীলমোহরের মতো বসে থাকে আজীবন। পরিবার হলো ভালোবাসার উৎস, যেখানে আমরা সুখ খুঁজে পাই, শক্তি পাই। জুলফা সেই পরিবার থেকে পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার দংশন।
কতগুলো মানুষের স্বার্থে বলি হয়েছে একটা নরম, প্রেমময় মনের। বুকে আগলে রাখার ভরসা দিয়ে ফেলে গেছে জীবনের খোরাস্রোতে৷
জুলফা নামের সুন্দর মেয়েটিকে পরিবার বেঁচে দিয়েছে, আরেকজন কিনে নিয়েছে। জগতে তার আপন বলতে কেউ রইল না।
শেষ রাত্রিরে জুলফার জ্ঞান ফিরল। ঘাড়ে সূক্ষ্ম ব্যথা। শাঁ শাঁ বাতাসে ডালপালা নুইয়ে পড়ছে। বটগাছের মাথার উপর আর চাঁদটা নেই। চারিদিকে শেষ রাতের বিস্ময়।
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে হতেই তার পুরো দুনিয়া নীল বিষে রক্তাক্ত হয়ে উঠল। সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ব্যাগ রেখে ক্লান্ত দুই পা টেনে নিয়ে যেতে থাকে সামনে। উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকে।
হঠাৎ করেই যেন কালো জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল। সাঁতরে যখনই উপরে উঠার চেষ্টা করল কেউ যেন তাকে ঠেলে আবার সেই কালো জলে তলিয়ে দিল। চারপাশে অন্ধকার, বুকে তীব্র ব্যথা।
সামনে ঘনবন, শাল-দেবদারু গাছের ডালপালা নিবিড় হয়ে জড়াজড়ি করে আছে, ভেতরে খুব অন্ধকার। পাতায় পাতায় বাতাস লেগে একরকম অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে।
বিমর্ষ জুলফা হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে বনের নিকটে থাকা ছনের ঘরটিতে নজর পড়ে। ঘরটির সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে দরবেশের আলখাল্লা, মাথায় সাদা টুপি।
জুলফা এলোমেলো পায়ে ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ায়। তখন দৃষ্টি যায় জমিদার বাড়ির ওপর। ওইতো তার শেষ ঠিকানা! সে উল্টো ঘুরে ধীরে ধীরে হেঁটে ফিরে আসে শ্বশুরালয়ে। ঘরে ফিরে নিশ্চুপে শুয়ে পড়ে শব্দরের পাশে।
তাকে অবাক করে তোলে শব্দরের গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ‘ওরা তোমাকে শেষবারের মতো দেখতে আসতেও চায়নি। আমি জোর করেছি বলে এসেছে।’
জুলফা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না।
সে চোখ বুজতেই গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ে।
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/noboralink/
[রোজা রাখার পর রাতে ক্লান্তিতে
বার বার চোখ বুজে আসে,
মনোযোগ ধরে রাখা যায় না৷
তাও যতটুকু পারি লেখার চেষ্টা করেছি।]