#ফাবিয়াহ্_মমো
আকাশ কালো চাঁদরে গা ঢাকা দিয়ে মেঘের সাথে গর্জন করছে। সেই সাথে বড় ফোঁটায় বৃষ্টি হচ্ছে। কালো মেঘে আড়াল হয়ে গেছে তেজালো সূর্য। দিনের আলোটা ধারণ করেছে সন্ধ্যার মতো কালো। পূর্ব বিছানা থেকে উঠতে পারেনা। পা নাড়াতে গেলে প্রচণ্ড ব্যথা হয় ওর। আজ পূর্ণতার জন্য ইচ্ছে করে ব্যথা কামড়ে পা নাড়াতে বাধ্য হয়েছে পূর্ব। সেই থেকে শুরু হয়েছে বীভৎস ব্যথা, যা এখনো কমছেনা। ঘড়িতে বাজে দুপুর বারোটা। পূর্ণতা ভেবেই পায়না এই কয়টা দিন পূর্ব নিজেকে কিভাবে সামলেছে। কিভাবে এই ব্যান্ডেজ পা নিয়ে নিজের সকল কাজ করেছে। অবশ্য বেডের পাশে দুটো স্ক্র্যাচ দেখে এটুকু অনুমান করেছে, পূর্ব বগলে স্ক্র্যাচ চেপে নিজের প্রয়োজন সেরেছে। পূর্ণতা ঘন্টাখানিকের মধ্যে রান্নাটা সেরে পূর্বের ড্রাইভারকে বলে বাসা থেকে লাগেজ আনিয়ে ফেলে। খোদেজা এ নিয়ে নানা প্রশ্ন করলেও পূর্বের এক্সিডেন্টের খবর শুনে আর একটা কথা তোলেনি। পূর্ব বিছানায় শুয়ে আছে। পায়ের নিচে নরম কুশন ও সাদা ব্লাঙ্কেটটা বুক পযর্ন্ত ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পূর্ণতা ওয়াশরুমে বালতি ভর্তি করে পূর্বের পাশে এসে বসে। গোসলের সময় হয়েছে। এই কয়দিন গোসলের জন্য মোমিন এসে সাহায্য করলেও এখন এই কাজটা সম্পূর্ণ পূর্ণতা করতে চায়। চোখ বন্ধ করে থাকা পূর্বের কপালে হাত রাখে পূর্ণতা। নরম কন্ঠে বলে উঠে,
– ঘুমাচ্ছো?
পূর্ব কন্ঠ ও স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকায়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে মাথাটা ‘না’ সূচকে নাড়ায়। পূর্ণতা কপাল থেকে হাত সরিয়ে পূর্বের বাহু চেপে বলে,
– উঠো, গোসল করবে।
পূর্ব প্রথমে আশ্চর্য হলেও পরে বাঁকা হাসি দিয়ে বলে,
– পাজি কোথাকার, লজ্জা দিনদিন নেমে যাচ্ছে। আমাকে গোসল করাবে তুমি? এতো শক্তি তোমার? আচ্ছা আমার হাতটাই ঠিকমতো উঠাতে পারো কিনা দেখো তো।
– তুমি নিজেই গোসল সারবে বুঝলে? আমি দরজার বাইরে থাকবো। তোমার পঁচাশি কেজির বডি টানার শক্তি আমার নেই। উঠো।
– বুঝলাম তো, তুমি আমার সামনে একদম পুচকে। একটু ধরো আমি নিজেই উঠছি।
– আচ্ছা গোসলটা না করলে হয়না? আমি গা মুছে দেই?
– আমি আমার ত্রিশ বছরের জীবনে গোসল ছাড়া থাকার বাজে অভ্যাস করিনি। আমাকে ধরে একটু ওয়াশরুমে নিয়ে যাও পূর্ণ। এতেই চলবে।
.
খাওয়া, গোসল শেষে ঘড়িতে এখন দুইটা বাজে। পূর্বের কড়া আদেশে চারদিনের অভ্যাস ত্যাগ করে শাড়ি পরেছে পূর্ণতা। শাড়িটা খয়েরী রঙের, আচঁলটা কালো। দিনটা এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন। বৃষ্টি একটু বিরতি নিতেই আবার ঝমঝমিয়ে একনাগাড়ে মুষলধারে হচ্ছে। ফ্যানের বাতাসটাও কেমন শীতের মতো হিম বসিয়ে দিচ্ছে। পূর্ণতা চুল ঝেড়ে বিছানায় উঠে পূর্বের মাথার কাছে বসে। কাঁচের স্বচ্ছ জানালার বাইরে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পূর্ব। মুখের উপর আর গম্ভীরতার ছাপ নেই। চারদিন আগের সেই রাগী মুখের বদলে এখন স্থান নিয়েছে একরাশ মায়া। পূর্ণতা জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে বুঝতে পারলো, প্রকৃতি যেনো উন্মত্ত বারিধারায় সকল কিছু ভিজিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে সিক্ত করছে মনের উঠোন। পূর্ণতা আবার চোখ ফিরিয়ে পূর্বের দিকে তাকিয়ে দেখে, চোখদুটো বন্ধ করেছে পূর্ব। শান্ত মুখটা কেমন আদুরে দেখাচ্ছে। পূর্ণতা সাথেসাথে তার শীতল হাতদুটো দিয়ে পূর্বের মাথাটা কোলে তুলে নেয়। আকস্মিক কাজে পূর্ব চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে পূর্ণতা ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিটা কেমন নেশালো, আকৃষ্ট, অদ্ভুত প্রাণঘাতী। পূর্ব ভ্রুঁ নাচিয়ে হাসি মুখে বললো,
– তাকিয়ে আছো কেন? কি দেখছো?
পূর্ণতা সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকানো অবস্থায় ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– তোমাকে দেখছি। এই দেখার সাধ যে আমার কোনোকালেই মিটবেনা, সেটাই ভাবছি।
পূর্ব ওর ছেলেমানুষি কথায় শব্দ করে হেসে দেয়। হাসির আওয়াজ শুনে পূর্ণতা সেই একই ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বলে,
– তুমি এভাবে হাসলে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠে। এটা তুমি বুঝো না?
পূর্ব এবার হাসি থামিয়ে সজাগ চাহনিতে তাকালো। পূর্ণতার ঘাড় চেপে নিচে নুইয়ে নিজের দিকে ঝুঁকিয়ে বললো,
– তোমার আজ কি হয়েছে পূর্ণ? আসার পর থেকেই একটার পর একটা নতুন রূপ দেখাচ্ছো। আমি অসুস্থ না হলে তোমাকে কোলে তুলে পুরো বাঙলো এরিয়া ঘুরে বেড়াতাম। পা-টা ঠিক হোক, দাড়াও।
ঘাড়ে এখনো পূর্বের হাতের চাপ লাগছে। মাথাটা পূর্বের স্নিগ্ধ শান্ত চেহারার উপর আটকে আছে। দূরত্ব সামান্য হলেও অন্তঃস্থল হৃদয়ের সংযোগ যেনো এক হয়ে আছে। পূর্ণতা খানিকটা সময় বাদে বললো,
– তুমি কি খুশি?
পূর্ব প্রাণ উচ্ছ্বসিত হাসিতে বললো,
– বোঝ না তুমি?
আর শোনার বাধ রাখলো না পূর্ণতা। দুহাতে জড়িয়ে ধরলো পূর্বের মাথাটা। শক্ত করে চেপে রাখার অদম্য বাসনার পূর্বকে জড়িয়ে রেখেছে পূর্ণতা। অজস্র ওষ্ঠষ্পর্শ দিয়ে ভরিয়ে তুললো পূর্বের শান্ত নিষ্পাপ চেহারায়। পূর্ণতার উদ্ভট আচরণে না হেসে পারলো না পূর্ব। ব্যঙ্গ হাসিতেই বললো,
– প্রেগনেন্সীতে কেউ রোমান্টিক হয়ে যায়? আসতাগফিরুল্লাহ্! এই অবস্থা করলে তো সমস্যা হবে। কন্ট্রোল, কন্ট্রোল। এই তোমার মুড সুইং হচ্ছেনা কেনো? তোমার সাথে কি পরিমাণ রাগারাগী করলাম, সেই হিসাবে তো আমার গলায় ছুড়ি চালানো উচিত।
পূর্ণতা নির্মল দৃষ্টিতে তাকালো। পূর্বের কপালে হাত রেখে বললো,
– আমি ভয়ে ছিলাম হয়তো তুমি এখুনি এসবের জন্য প্রস্তুত হবেনা। আমার এই কাজের জন্য তুমি খুব রাগ করবে। কিন্তু তুমি খুশিতে কাঁদবে আমি ভাবতেও পারিনি পূর্ব।
– শোনো পূর্ণ, আজ কয়েক ঘন্টার জন্য যদি আল্লাহ্ আমার পা-টা ঠিক করে দিতো তাহলে তুমি দেখতে আমি কতটা খুশি হয়েছি। আমার ভাগ্যটা এতো খারাপ, তোমার জন্য কিচ্ছু করতে পারছিনা। উল্টো তোমার নির্ভর হয়ে পরে আছি।
– বাজে কথা বলছো কেন? আমি কখনো বলেছি তুমি আমার জন্য বোঝা?
পূর্ব মৃদ্যু শ্বাস ছেড়ে পূর্ণতার পেটে হাত রাখলো। অসহায় দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,
– আমি যদি নাও থাকি তখন ও তোমার সঙ্গে থাকবে। আমার শেষ ইচ্ছা এটাই পূর্ণ। দোয়া করবো, আমার যতো বাজে গুণ আছে সেগুলোর বিপরীত গুণ যেনো ও পায়। তোমার আর আমার সব ভালো গুণ নিয়ে ও পৃথিবীর আলো দেখুক। ভাগ্য যদি আমাকে ওকে দেখার সুযোগ না দেয়, ও তোমার আঙ্গুল স্পর্শ করে বড় হোক পূর্ণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে, ও জীবনের সব কায়দা শিখে একদিন আমার চেয়েও অনেক বড় হয়ে দেখাবে। তুমি তো অবশ্যই হেল্প করবে তাইনা?
পূর্ণতা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো পূর্বের দিকে। পরিস্থিতি এমন ছিলো যেনো শ্বাস নেওয়াই ভুলে গেছে পূর্ণতা। কেউ ওর বুকের ভেতর বিষযুক্ত ছুড়ি দিয়ে জমের আঘাত দিচ্ছে। স্থির দৃষ্টিকোণে অজান্তেই পানি জমতে শুরু করেছে ওর। সহসা পৃথিবীর সকল চাকচিক্য এখন মেকি লাগছে পূর্ণতার কাছে। সে ঢোক গিলবে-গিলবে করেও গিলতে পারছেনা। পূর্ব ওর মুখভঙ্গি দেখে সবটা আঁচ করতেই পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে সেখানে চুমু দেয়। পূর্ণতার দুই হাত নিজের বলশালী হাতের মুঠোয় মিলিয়ে হেচকা টানে পূর্ণতার পিঠ জড়িয়ে নিজের বুকের সঙ্গে মিলিয়ে ধরে। পিঠের উপর ছেড়ে দেয়া ভেজা চুল সরিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে উঠে,
– ভয় পেও না। আমি তো জানি আমার পূর্ণ আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। আমার জন্য পূর্ণতা নামের মেয়েটা সব করতে পারবে, সব! তার জীবনের সবচেয়ে দূর্বল দিকটা যে আমি। আমি সেটাও জানি। কিন্তু জীবন তো কারো জন্য থেমে থাকবেনা পূর্ণ। আমি যে পথে আছি, সত্যি বলতে বাঁচি না মরি সেই গ্যারান্টি নেই। একবার যে রাজনীতিতে ঢুকে সে কখনো বের হতে পারেনা। গাড়ির টায়ারটা পায়ের উপর দিয়ে না উঠে যদি আমার শরীরের উপর দিয়ে উঠতো, তখন তুমি কি করতে? আমি তো তখন জানতেও পারতাম না তুমি আমার সন্তান পেটে ধারণ করেছো। দুঃখ তখন কেমন হতো বলো? এখন তো পাশে আছি। টেনশন করো না।
.
ওয়াসিফ ভিলার আবহাওয়া আচমকা বদলে গেছে। চারপাশে তাকালেই এখন বিয়ের রমরমা সাজ। গ্রীষ্মের খরতপ্ত চৌচির মাঠের বুকে বর্ষার বৃষ্টির মতো প্রাণের সন্ঞ্চার হলো যেনো। সবার মুখ এখন খুশিতে পরিপূর্ণ। পূর্বিকার এতোদিনের কাবিননামায় এখন শ্বশুরবাড়ির তকমা জুটছে। পূর্বিকার স্বামী এক সপ্তাহ হলো বিদেশ থেকে ফিরেছে। এখন তোড়জোড় চলছে পূর্বিকার বিদায়ের জন্য। পূর্ব বাবার অনুনয়ের কাছে নত স্বীকার করে ওয়াসিফ ভিলায় ফিরেছে। বিয়ের সকল কার্যাদি জৌলুস মনে করছে সে। পায়ের অবস্থা আগের তুলনা ভালো। ব্যান্ডেজ সরিয়ে ফেলা হয়েছে কিছুদিন হলো। হাটাহাটিও স্বাভাবিক ভাবে করতে পারছে পূর্ব।।সেই সাথে পূর্ণতার ছয়মাস পূর্তি হলো গর্ভধারণের। পূর্ণতার এই খুশির সংবাদে সবাই যেনো আরেকদফায় প্রাণোচ্ছাসে মেতে উঠেছে। একসঙ্গে দুইটা খুশির আবহাওয়া একত্র হয়ে সবার মন ও মেজাজ এখন খুশিতে আত্মহারা করেছে। পূর্বের চাচা পলক ও পরশ ওয়াসিফ যেভাবে খুশির ফোয়ারার আয়োজন করেছে তা নিয়ে পূর্ব অবাক! সবকিছুই যেনো রাজার ভঙ্গিতে সাজিয়ে তুলছে। আফরিন মাঝেমাঝে মুখ গুমড়ে থাকলেও পূর্বিকার খুশিতে আর উদাস হয়ে থাকেনা সে। শেফালীও এখন পূর্ণতার দেখভালের জন্য তৎপর। আচমকাই যেনো শান্তির ভুবনে ডুবে গেছে পরিবারের প্রতিটি সদস্য। কারো মনে কোনো ক্লেশ নেই, দুঃখ নেই, অতীত নিয়ে ভাবনার দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে।
আজ পূর্বিকার হলুদ ছোঁয়া। হলুদ ফুলে সজ্জিত হয়েছে বাড়ির প্রতিটি কোণা। পূর্বের ভয়ে টুকটাক কাজ ছাড়া কিছুই করছেনা পূর্ণতা। পূর্ব পূর্ণতার বাড়ির সকলকে নিমন্ত্রণ করেছে আপির বিয়েতে। তাই বাড়িতে মেহমানে গিজগিজ অবস্থা। সায়মার ন্যাকামি বেড়েছে আজকাল। সেই সাথে ফুয়াদের ঘটনার জন্য এখনো মুখে তালা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় জাওয়াদ। মিথুন এতো জলদি দেশে ফেরার অনুমতি পায়নি। আনিশাও আসতে পারেনি চারমাসের গর্ভধারণের জন্য। পূর্ণতা বিছানায় পা ছড়িয়ে মুখ কুঁচকে বসে আছে। পূর্ব এ নিয়ে প্রচুর ক্ষেপে আছে ওর উপর। দফায় দফায় রাগ ঝারছে পূর্ব। কেনো পূর্ণতা শাড়ি পরবেনা? পেট ফুলেছে তো কি সমস্যা? অন্যদিকে পূর্ণতার উত্তর, শাড়ি পরলে পেটের জন্য মটরশুঁটি লাগবে ওকে। মানুষ ওকে দেখে হি হি করে হাসবে। কথাগুলো শুনেই রাগ চড়ে আছে পূর্বের। ক্লোজেট থেকে হলুদ রঙের শাড়ি বের করে পূর্ণতার সামনে রাখলো পূর্ব। গমগম গলায় বললো,
– এটা যদি না পরেছো আমি কুটিকুটি করে ডাস্টবিনে ফেলবো!
পূর্ণতাও অটল গলায় উত্তর দিলো,
– আমি শাড়ি পরবো না।
– তো কি পরবে? লুঙ্গি পরবে? তোমার বাবার লুঙ্গি আনবো?
– আমার সাথে বাজেভাবে কথা বলবেনা! একদম বলবেনা!
– কি বাজে বলেছি? হলুদের দিন মানুষ শাড়ি না পরে কি পরে? তোমার মাথায় কিসের পোকা ঢুকেছে পূর্ণ?
– তুমি আমাকে পাগল বলছো?
– আশ্চর্য! পাগল কোথায় বললাম?
– বলে অস্বীকার করছো কেন?
– আরে বাপ! মিছেমিছি নিজেকে পাগল বলছো কেন?
– কি! আমি নিজেকে পাগল বলেছি? তুমি আমাকে পাগল বলে এখন কথা ঘুরাচ্ছো? এইদিন দেখার জন্য আমি বেঁচে আছি? আমার উপর থেকে চোখ সরে গেছে তাইনা?
পূর্ব আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে। ‘ক’ থেকে ‘কলিকাতা’ বানাতে টাইম নিচ্ছে না পূর্ণতা। পূর্ব বাধ্য হয়ে পূর্ণতাকে বিছানা থেকে টেনে দাড় করায়। ভয়ংকর রাগ দেখিয়ে ধমক দিয়ে শাড়ি পরতে পাঠিয়ে দেয়। যদি বেশি দেরি করে তাহলে আজ তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিবে পূর্ব। পূর্ণতাও কাঁচুমাচু করে কিছু সময়ের মধ্যে শাড়িটা পরে বের হয়। এসেই দেখে আয়নার সামনে মেরুন রঙের পান্ঞ্জাবী পরে পূর্ব চুলে ব্রাশ করছে। বুকের উপর বোতাম খোলা। পূর্ণতা শাড়ির কুচি ঠিক করতেই ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে জানালার কাছে দাড়ালো। লনে বিশাল লাইটিং করে বড় প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। সবাইকে সেখানে দেখা যাচ্ছে। পূর্ণতা চুলের মাঝে সিথি তুলে চুল খন্ডে দুপাশে এনে আঁচড়াতে লাগলো। পূর্ব ওর পাশে এসে কখন দাড়িয়েছে খেয়াল ছিলো না পূর্ণতার। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, মানুষটা আগের তুলনায় আরো সুদর্শন হয়ে গেছে। চুলের হেয়ারস্টাইলও চেন্জ। কানের দুপাশে ট্রিম কাট। মাথার চুলগুলো জেলের কারনে খাড়া খাড়া। গালের দাড়িগুলোও শেপ। তার উপর মেরুন পান্ঞ্জাবীটা চমৎকার মানিয়েছে। পূর্ণতা চিরুনি করা থামিয়ে পূর্বের দিকে ফিরে বললো,
– তুমি আমার সঙ্গে বাইরে যেও না। আমাকে তোমার সঙ্গে মানাবে না।
পূর্ব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেঁচিয়ে উঠে,
– মানে?
পূর্ণতা মুখ নিচু করে বলে,
– আমাকে দেখতে বিশ্রী লাগে।
একমূহূর্ত যেনো বাতাসের শিরশির আওয়াজ হলো! এরপর পূর্ব ভয়ংকর রেগে গিয়ে পূর্ণতার হাতের চিরুনিটা নিয়ে বাইরে ছুড়ে মারলো। ভারী শরীর নিয়ে ভীতু চেহারায় তাকিয়ে রইলো পূর্ণতা। নিজের দিকে তাকালে পূর্বের পাশে দাড়াতে এখন বড্ড অস্বস্তিকর লাগে, এই তেতো সত্য ওকে কিভাবে বোঝাবে? পূর্ব একপা ওর দিকে এগিয়ে এসে ফোলা পেটের উপর দুহাত রাখে। পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি দিলেও পূর্ণতার চোখ ফ্লোরে আবদ্ধ তখন। পূর্ব শান্ত গলায় বললো,
– কি সমস্যা? কি নিয়ে তুমি সকাল থেকে আবোলতাবোল বলে আমার রাগ উঠাচ্ছো? কেনো এমন করছো বলোতো? শরীর খারাপ লাগছে? যদি বেশি খারাপ লাগে নিচে যেতে হবেনা। আমি আপিকে উপরে এনে হলুদ লাগিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
পূর্ণতা মুখ তুলে পূর্বের চোখের দিকে তাকায়। বিষন্ন কন্ঠে বলে,
– একটা সত্যি কথা বলি? তুমি দয়াকরে মন খারাপ করো না। যেদিন থেকে এসেছি সেদিন থেকেই আমার মনটা কেমন কুকড়ে আছে। জানিনা, কিন্তু আমার মন বলছে কিছু একটা অঘটন ঘটবে।
– কি নিয়ে এমন মনে হচ্ছে? ফুয়াদের জন্য?
– আমি জানিনা। মনের কোথাও জোর পাচ্ছিনা। তুমি আমার কাছে থাকার পরও কেনো যে ভয়টা গ্রাস করেছে, আমি জানিনা। আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই।
– আমাকে কাল দুপুরটুকু সময় দাও??আমি এখানে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েই তোমাকে নিয়ে চলে যাবো।
– আমি আয়মানকে বা ড্রাইভারকে নিয়ে আজই চলে যাই?
– না, অসম্ভব। তুমি আমার সাথে এসেছো। আমার সাথেই যাবে। আচ্ছা এক কাজ করো, তুমি ঘুমাও। তোমার নিচে যাওয়ার দরকার নেই। আমি হলুদটা টাচ দিয়েই তোমার কাছে ফিরে আসছি। থাকতে পারবে তো? শুধু আধঘন্টা? একটু কষ্ট করো?
.
বাড়িতে মানুষশূন্য অবস্থা। সবাই লন সাইডে হৈচৈ করে তীব্র গান বাজনার মধ্যে মেতে উঠেছে। পূর্ণতা রুমের মধ্যে একা আছে। এ খবর পূর্ব ছাড়া আর কেউ জানেনা। পূর্বিকা বহুবার পূর্ণতার জন্য প্রশ্ন করলেও পূর্বের শক্ত অজুহাত ওকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। পূর্ব আধঘন্টার জন্য শুধু পূর্বিকার সঙ্গে থাকার চিন্তা করলেও মন পরে ছিলো পূর্ণতার দিকে। পূর্ণতা কখনো এমন কুসংস্কারগ্রস্ত কথাবার্তা বলেনা। আজ হঠাৎ কেনো এরকম কিছু বললো? পূর্ব নিজেকে বোঝালো হয়তো মুড সুইংয়ের জন্য এমনটার বোধ হচ্ছে। সময় যত এগুচ্ছে ততই ডেলিভারি ব্যাপারটা নিয়ে পূর্ণতা হয়তো মনে মনে ভয় পাচ্ছে। পূর্ব ভাবলো, আজই পূর্ণতাকে নিয়ে কিছু ভালো সময় কাটিয়ে ওর মনে সাহস জুগাবে।। সবচেয়ে ভালো গাইনী ডাক্তার যেহেতু তার মা, তাই খোদেজার উপর ভরসা রাখতে বলবে। এখনো ইলেকশনের প্রচার করতে কিছুদিন বাকি আছে। কাজেই সবদিক মিটমাট করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ালো পূর্ব।
শাড়িটা আর পাল্টায়নি পূর্ণতা। তার ক্ষেপাটে পূর্বটা একবার আসলেই সে অনুমতি নিয়ে শাড়িটা বদলে নেবে তখন। পূর্ণতা চুলে হাতখোপা বাধিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো। পা-দুটো বেশ টনটন করছে। মাঝেমাঝে এমন ফুলে যায় তখন নিরুপায় হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। সবাইকে দেখার জন্য পূর্ণতার মনটা আকুপাকু করছিলো। সে ধীরে ধীরে পা ফেলে জানালার কাছে দাড়ায়। দখিন দিকের জানালায় আসলে লন সাইডের সম্পূর্ণ এরিয়া দেখা যায়। প্যান্ডেলে বাসন্তী রঙের শাড়িতে পূর্বিকা বসে আছে। একে একে সবাই এসে ওকে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। মনোযোগটা সেখানে আটকে গেলে হঠাৎ পেছন থেকে দরজা আটকানোর শব্দ আসলো। পূর্ণতা শব্দটা পেতেই লনের দিকে চোখ ঘুরায়। পূর্ব লনের কোথাও নেই। স্বস্তির ভঙ্গিতে পেছনে ফিরতেই যে দৃশ্য দেখে পূর্ণতার বুকটা ধ্বক করে উঠে! কপাল কুঁচকে চেচিয়ে বলে,
– দরজা লাগালে কেন? আর এখানে কি?
হলুদ পান্ঞ্জাবী পড়ুয়া কাঠিন্য দৃষ্টির মানুষটা কোনো উত্তর দিলো না। নির্লিপ্তে পান্ঞ্জাবীর হাতা কনুইয়ের হাড্ডিতে গুটাচ্ছে। চোখের দৃষ্টিজোড়া পূর্ণতার দিকে। পূর্ণতা নিজেকে সামলে নিলো। ভেতরের ভয়টা কোনোরকমে বাইরে প্রকাশ হতে দিলো না। ঠান্ডায় শীতল হয়ে আসছে পূর্ণতার হাত। বুকে ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে। পূর্ণতা পেটের উপর হাত রেখে মনোবল শক্ত করে বললো,
– তুমি এখানে কি জন্যে এসেছো? জরুরী কোনো কথা আছে?
বাক্যদুটো ছিটকে আসতেই আবারও দরজা খুলে আরেকজন ব্যক্তি ঢুকলো। এবার পূর্ণতার ভয়টা পারদ স্কেলের উচ্চাঙ্গে পৌঁছে গেলো। এখানে আসার পর অবচেতন মনটা অমঙ্গল ব্যাপারে যে হুশিয়ারি দিচ্ছিলো তা এই দুজনের আগমনে স্পষ্ট ঠেকলো পূর্ণতার। একমনে পূর্বকে ডেকে যাচ্ছে পূর্ণতা। সাংঘাতিক বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। হঠাৎ দুজন তেড়ে এলো পূর্ণতার কাছে। সায়মা দৌড়ে জানালাটা বন্ধ করতেই গলা থেকে লেহেঙ্গার ওড়না নিয়ে পূর্ণতার মুখ বেধে দিলো। চিৎকার বা প্রতিবাদের সুযোগটুকু ওরা দিলো না! জাওয়াদ ততক্ষণে পিছু করে পূর্ণতার হাতদুটো রশি দিয়ে বাধছে। পূর্ণতা সমস্ত শক্তি দিয়েও ওদের দুজনের কাছে পারছিলো না। চোখ উপচে পানির ফোয়ারা পরছিলো পূর্ণতার। আকুতি করছিলো চোখ দিয়ে। ভাগ্য ওকে আরেকবার এমন কঠিন পরিস্থিতির কাছে ঠেলে দিবে যেখানে পূর্ব নেই, সেটা অকল্পনীয় ছিলো ওর জন্য! জাওয়াদ কতোক্ষন বিশ্রী চাহনিতে পেটের দিকে তাকিয়ে থাকলে সায়মার ধমক খেয়ে চোখ সরিয়ে ফেললো। সায়মা এগিয়ে এসে ঠাস ঠাস করে পূর্ণতার গালে চড় মারলো। চুলের খোপটা ধরে ক্লোজেটের সাথে ঠেসে ধরতেই পূর্ণতার পেটে হাত দিয়ে চাপ রেখে বললো,
– তুই ভেবেছিস আমরা ফুয়াদের কথা ভুলে গেছি? সেদিন ফুয়াদের সাথে রঙ-তামাশা করতে পারিসনি বলে পূর্বকে বেধড়ক মার খাইয়েছিস। তুই ঠিকই জানতি পূর্ণতা! তুই অবশ্যই জানতি পূর্ব ফুয়াদকে কুকুরের মতো পেটাবে! বল জানতি না?
পূর্ণতার চক্ষুকোল থেকে পানি গড়িয়ে পরলেও সায়মার দিকে শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওই জানোয়ারের জন্য প্রতিশোধ নিতে সায়মা আর জাওয়াদ এসেছে, সেটা পূর্ণতা বুঝে গেছে। পেটের উপর বীভৎস জ্বালা শুরু হলেও সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিলো না। পূর্ণতা আর কোনোক্রমেই ওদের সাথে কথা বলছিলো না। প্রতিশোধ যদি নিতেই চায় সেটা মুখের উপর করুক, এসিড এনে মুখ জলসে দিক! তবুও যেনো পেটে কোনো ক্ষতি না করুক ওরা, মনেমনে তীব্র চেতনায় আওড়াচ্ছিলো পূর্ণতা। কিন্তু ভাগ্য হয়তো দূর্দশা দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলো।জাওয়াদ দুইমিনিটের মাথায় সায়মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পূর্ণতার পেট বরাবর লাত্থি মারলো! সায়মা সোফায় ছিটকে যেতেই জাওয়াদের অপ্রত্যাশিত কাজে চোখ বিরাট বড় করে চিল্লিয়ে উঠে! লাত্থির জোরটা এতো বেশি ছিলো রুমের মধ্যে ঝংকারের বিকট শব্দ হয়! চাপা আর্তনাদ পূর্ণতার মুখ থেকে বেরিয়ে পরতেই ফ্লোরে লুটিয়ে পরে তৎক্ষণাৎ! সায়মা দৌড়ে এসে জাওয়াদকে থাপ্পড় মেরে পূর্ণতার কাছে ফিরে যায়। গালে ঝাকুনি দিয়ে তাড়াতাড়ি পূর্ণতার হাতের রশি খুলে সেটা সোফার তলায় ছুড়ে মারে। মুখের উপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে অনবরত ডাকতে থাকে ওকে। কোনো লাভ হয়না। সায়মা ভীষণ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– পূর্ণতার কিছু হলে পূর্ব আমাদের মেরে ফেলবে ভাই… তুমি এটা কি করলে?
জাওয়াদের চুপটি দেখে সায়মা এবার পাগলের মতো কথা বলতে থাকে,
– পূর্ব আমাদের ছাড়বেনা, ও কখনোই ছাড়বেনা। পূর্ব আমাদের জবাই করে ফেলবে। পূর্ণতার এই অবস্থা দেখলে ও আমাদের জবাই করবে জাওয়াদ। আমাদের বাঁচতে দিবেনা।
জাওয়াদ লাত্থিটা দেয়ার পরেই বুঝতে পেরেছে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা সে করে ফেলেছে! রাগের মাথায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লাত্থিটা দেওয়া ঠিক হয়নি। পূর্ণতা বেঁচে গেলেও পেটের বাচ্চাটা হয়তো ওমন লাত্থির জোরে আর বাচঁবেনা। জাওয়াদ মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,
– মাথা ঠিক ছিলো না। মরেছে কিনা দ্যাখ বাল! নিশ্বাস পরছে কিনা চেক কর তাড়াতাড়ি!
সায়মা পূর্ণতার নাকের কাছে আঙ্গুল রাখতেই থমকে গেলো। জাওয়াদ আরেকবার চেঁচানো সুরে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সায়মা যেনো সৎবিৎ ফিরে পেলো। জাওয়াদের দিকে কেমন নিস্তেজ ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকালো! তাকানোর কয়েক মিনিটের মাথায় ডুকরে কেদেঁ উঠলো সায়মা। প্রচণ্ড ভয়ে গলা দিয়ে আর কিছুই বলতে পারলোনা…
– ‘ চলবে ‘ ……………..
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
#FABIYAH_MOMO