#ফাবিয়াহ্_মমো
হাত থেকে ফোন পরে গেলো পূর্ণতার! চোখেমুখে ভারী বিষ্ময় এবং কপাল ঘেমে একাকার। বুকের হৃৎপিন্ড এখন বেগতিক ধারায় ছুটছে, হাতের শিরাগুলো টগবগ করে রক্ত চালনা করছে। নিজের দৃষ্টি যদি অন্ধ হতো তাহলে মেসেজের লিখাগুলো হয়তো অবিশ্বাস করা যেতো। কিন্তু এমন অদ্ব্যর্থক মেসেজের মানে কি? যেখানে পূর্ব নিজেই টাইপ করে জানিয়ে দিয়েছে আজ সে বাড়ি ফিরতে আগ্রহী না। কেনো আগ্রহী না? সে কেন করতে চাইছে এখন? কি লুকিয়ে বেড়াচ্ছে মনের অন্তঃস্থলে? পূর্ণতা কিছুতেই মাথা খাটিয়ে ভাবতে পারছেনা। তার শরীর প্রচণ্ড দূর্বল অনুভব হচ্ছে, মাথা কেমন ভার-ভার লাগছে, বুকের অবস্থা যেনো অবর্ণনীয় অবস্থায় ধুকপুক করছে। হালকা গোলাপীর ঢোলা ম্যাক্সিটা সচরাচর বেশ আরামদায়ক হলেও আজ সেই ম্যাক্সিটা মাত্রাতিরিক্ত ঘেমে উঠছে। মনেহচ্ছে এখুনি মাথা ঘুরে পূর্ণতা ফ্লোরে লুটিয়ে পরবে। সে নিজেকে স্থির করার জন্য দ্রুত বেডের উপর বসে পরে। জোরে জোরে কয়েক মিনিট লম্বা শ্বাস টেনে পরক্ষনে নিজেকে শান্ত করে। পেটের ভেতর আবারও সেই পুরোনো ব্যথাটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। পূর্ণতা সাথেসাথে দুইঠোঁট টিপে চোখ কুঁচকে ব্যথাটা হজম করার চেষ্টা করে। এই মূহুর্তে নিজেকে প্রতিকূল অবস্থায় ফেলার কোনো মানে নেই। যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে ঠান্ডা করা উচিত। পূর্ণতা চোখ কুঁচকে ওই অবস্থায় কিছুক্ষণ অটল হয়ে বসে রইলো। ব্যথাটা ধীরে-ধীরে কমে গেলে নিজের কুঁচকানো চোখ খুলে ফেললো। বুকভর্তি লম্বা নিঃশ্বাস টেনে শব্দ করে মুখছিদ্র(ওষ্ঠ) পথে নিশ্বাস ছেড়ে দিলো। মাথায় খোঁপা করা থাকলেও চুলের গোড়ায় গোড়ায় যেনো ঘামে ভিজে ঠান্ডা লাগছিলো। বুকের ধুকধুকনি তখনও কমেনি, ধড়াস-ধড়াস করে হৃৎযন্ত্র ছুটছিলো। পূর্ণতা হাতের উল্টোপিঠে কপাল ও গলার ঘাম মুছে বেড থেকে খুব আস্তেধীরে উঠে দাড়ালো। একগ্লাস পানি খেতেই তার মনের গোচরে মেসেজের লিখাগুলো আনমনে ভাবতে লাগলো। পূর্ব সেই মেসেজে সবসময়ের মতো ইংরেজি বাক্যে কিছু জরুরী কথা লিখেছিলো, যা পূর্ণতা বাংলানুবাদ করে গভীর চিন্তায় মশগুল ছিলো।
আমি জেল থেকে বের হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ আমি সুস্থ আছি। আমি খুশি হয়েছি তুমি আমাকে নিতে বাড়ি থেকে বের হওনি। খবরদার বাড়ির বাইরে একপা বের করবেনা। আমাকে পিক করার জন্য আয়মানকে পাঠিয়েছো বলে আমি খুশি। আজ আমি বাড়িতে ফিরছিনা। নিজের খেয়াল রাখো। আমি শীঘ্রই তোমার কাছে আসছি। আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবেনা। সময় ও সুযোগ বুঝে আমি তোমার সামনে আসতে একসেকেন্ডেও দেরি করবো না। আবারও অনুরোধ করছি দয়াকরে নিজের খেয়াল রাখো। আমি অবশ্যই দ্রুত ফিরবো। বন্দিজগত থেকে যেহেতু বের হতে পেরেছি, নীড়ের মাঝে ফিরতে আর বেশি দেরি নেই।
তোমার,
ওয়াসিফ পূর্ব।
( কারাগার থেকে মুক্ত )
পূর্ণতা ফ্লোর থেকে ফোন তুলে সব জোড়া লাগিয়ে ঠিকঠাক করলো। আয়েশার কাছে গিয়ে পূর্বের মেসেজটা দেখাতেই আয়েশার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা অন্ধকারের মতো কালো হয়ে গেলো। আয়েশা স্তব্ধ দৃষ্টিতে কয়েক মিনিট চোখ নিচু করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছিলো। ছেলের এমন বার্তা দেখে তিনি প্রচণ্ড মাত্রায় আশ্চর্য। ছেলের আগমন শুনে মনের মধ্যে খুশির যেই আনন্দ-ধারা বয়ে চলছিলো সেটা যেনো হঠাৎ বাধা পেয়ে দুঃখের সাগরে পরিণত হলো। এই দুঃখে আয়েশা রাতের খাবারটাও মুখে তুললেন না। বিমর্ষ মুখ করে রুমে চলে গেলেও একচুল ঘুমাতে পারলেন না। এদিকে প্যারালাইসিস হয়ে শুয়ে থাকা পলাশ ওয়াসিফ অধীর অপেক্ষায় থাকার পরেও ছেলের দেখা পেলেন না। তিনি আয়েশার মুখের দিকে তাকিয়ে ছটফট করতে লাগলেন। কিছু বলার জন্য গোঙাতে থাকলেন, কিন্তু কিছুই তিনি বলতে পারলেন না। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো উনার।চোখের দুই কোণা থেকে তুমুল মেঘের মতো বর্ষন শুরু হলো আবার। অর্থব হয়ে শুয়ে থাকা পলাশ ওয়াসিফ অজস্র ব্যথা মুখ বুজে সহ্য করে নিলেন। হয়তো মনের বন্ধ দরজায় কড়া নেড়ে চিৎকার করছেন, আমার ছেলেটা কেনো আসলো না? ও আজ কেনো আমার কাছে ফিরলো না? আমার মতো অথর্ব দুনিয়ায় কেনো নিশ্বাস টানছে? দমটা কবে ফুরিয়ে আমাকে জগত থেকে মুক্তি মিলবে? পলাশ ওয়াসিফ নিজেকে ব্যর্থ পথিকের মতো তাচ্ছিল্য করতে লাগলেন। কিন্তু ছেলের দেখা আর পেলেন না।
রাত দুইটা বেজে চলছে। রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখে ছিটেফোঁটা ঘুম নেই পূর্ণতার। অপেক্ষমাণ সময়গুলো খুবই কষ্টের, খুবই দুঃসহ। পূর্ব কেনো আসলো না এটা নিয়ে প্রচণ্ড মাথা খাটাচ্ছে পূর্ণতা। কিন্তু নানা ভাবে সমীকরণ মিলালেও ফলাফল শূন্য হিসেবে দাড়াচ্ছে। পূর্ব জেল থেকে বেরিয়ে সবার প্রথম এখানে আসবে, অথচ সেটা না করে সে এখন কোথায় যাবে? পূর্ণতা হাঁশফাশ করতেই ঠিক করলো আয়মানকে এই মূহুর্তে একটা মেসেজ পাঠাবে। যদি আয়মান জেগে থাকে তাহলে নিজ থেকেই কল দিয়ে পূর্ণতার সাথে কথা বলবে। পূর্ণতা ঠিকই মেসেজ পাঠানোর দুই মিনিটের মাথায় আয়মান কল দিলো। পূর্ণতা বালিশ থেকে মাথা তুলে বিছানার হেড সাইডে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। আগ্রহ সুরে প্রশ্ন করে বললো,
– তুই জেগে আছিস? রাতে ঘুমাসনি? কি করিস এতো রাতে? রাত কয়টা বাজে দেখছিস?
আয়মান ওপাশ থেকে মৃদ্যু একটা নিশ্বাস ছাড়লো। সেই নিশ্বাসের সুরটা যেনো হতাশার মতো ছিলো। কিছু একটা নিয়ে ভীষণ আক্ষেপ পুষে দিনের পর দিন বিষণ্ণতা ছেয়ে ছিলো। আয়মান তার বিষাদের সুরেই হালকা হেসে বললো,
– রাতে দুই ঘন্টার বেশি ঘুমাই না। আবার ভাবিস না হেনতেন করি। আসলে ঘুম ধরেনা এইজন্য ঘুমাই না। ল্যাপটপ নিয়া কাজ করতাছিলাম। দেখি, তুই ফোনে মেসেজ দিলি। এখন বল কি নিয়া টেনশন করতাছোস? তোর জামাই তো জেল থেকে আউট হইয়া গেছে। টেনশন কি নিয়া করোস?
আয়মানের প্রশ্ন শুনে পূর্ণতা একটু সতর্ক হয়ে ভাবলো। পূর্বকে জেল থেকে আনার দায়িত্ব ছিলো আয়মানের। সেখানে পূর্ব ওর সাথে না এসে, আয়মানের ফোন দিয়ে মেসেজ পাঠিয়ে নিজে উধাও হয়ে গেছে বিষয়টা খুবই আশ্চর্যজনক। পূর্ণতা এদিকে চুপ করে চিন্তাভাবনায় ডুব দিলে ওপাশ থেকে আয়মান প্রচুর প্রশ্ন করতে থাকে। একপর্যায়ে পূর্ণতা সৎবিৎ ফিরে পেলে আয়মানের কথায় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে বলে,
– তুই কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস?
প্রশ্ন শুনেই শক্ত হয়ে গেলো আয়মান। কয়েকবার গলায় ঢোক গিলে গলা ভিজালো ও। এরপর আমতা-আমতা করে হাসি টেনে বলে উঠলো,
– আজব মাইয়া! লুকানোর কি আছে? কি লুকামু আমি? তুই কি আমার উপর ডাউট করতাছোস নাকি?
পূর্ণতা এই উত্তর শুনে একটু যেনো নিভলো। আয়মান নিশ্চয়ই জানেনা পূর্ব কোথায়। কারন, পূর্ব ওকে নির্ঘাত কিছু জানিয়ে যাবেনা। তবুও পূর্ণতার ব্যকুল মন পূর্বের অবস্থা জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। আয়মানকে অস্থির গলায় প্রশ্ন করলো,
– দোস্ত তুইতো ওকে দেখেছিস তাইনা? ও কেমন আছে? শরীরের অবস্থা কিরকম? ওর হাতটা কেমন ছিলো? দ্যাখ আয়মান, প্লিজ আমার কাছে কিছু মিথ্যা বলিস না। আমি এমনেতেই কিছু ভাবতে পারছিনা। আমার অবস্থা তো তুই জানিস, এই গর্ভাবস্থায় আমি ওর খোঁজে বেরুতে পারবো না। দোস্ত, দোহাই দোস্ত। প্লিজ বল, ওর অবস্থা কেমন আছে?
এতোগুলো প্রশ্ন করে পূর্ণতা হাপিয়ে উঠে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো। ওপরপাশে আয়মান নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। কয়েক মূহুর্ত নিরবতা চলতেই আয়মান উত্তরের ঝুলি নিয়ে বললো,
– তুই জানোস আমার কাছে পূর্ব ভাই কি বলছে? তুই যে এতো টেনশন করোস এই টেনশান থিকা দূরে থাকতে বলছে। একটু শান্ত হ পূর্ণতা। ভাই ভালোই আছে। আমার দুই চক্ষু দিয়া ভাইরে আমি ভালোই দেখছি। বাকিটা ভাই আসলেই বুঝতি পারবি। কিন্তু তোরে শুধু একটা কথাই বলতে চাই, ভাই অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। কথা-টথা কম বলে।
পূর্ণতা এ কথা শুনে ফট করে চকিতে জিজ্ঞেস করে,
– ও কথা কম বলে মানে? তোর সাথে কম বলবে কেন? দোস্ত পূর্ব কি সুস্থ আছে? মিথ্যা বলবিনা তুই! আমার মন বলতেছে তুই ঠাডা মিথ্যা বলতেছিস!
আয়মান প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে রাগান্বিত স্বরে বললো,
– ঠাস কইরা এই থাবড়া মারমু! এদিকে মিথ্যা বইলা আমার কি লাভ? তোগো মিয়া-বিবির তালবাহানা দেখলে গা রি রি কইরা জ্বলে। ভাই যদি অন্যখানে যাইতে চায় এইখানে আমার কি দোষ?
পূর্ণতা হতবুদ্ধির মতো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। ফোনের ওপাশে আয়মান যা-তা ভাষায় কথা শোনাতে লাগলো, কিন্তু একটা শব্দও পূর্ণতার কান দিয়ে ঢুকলো না। যখন আয়মান আবোলতাবোল ভাষায় বকতে লাগলো তখন পূর্ণতা অন্যমনষ্ক হয়ে শান্ত সুরে হতভম্ভ ভঙ্গিতে বললো,
– ও কি খারাপ কিছুতে জড়িয়ে পরলো?
আয়মান ওই মূহুর্তে কিছু কঠিন কথা বলতে যাবে তৎক্ষণাৎ সে পূর্ণতার কথা শুনে থমকে গেলো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে কপাল কুঁচকে আশ্চর্য কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো,
– তুই ভাইরে ডাউট করতাছোস পূর্ণতা? ছিঃ! কেমনে এইসব ভাবতে পারলি? ভাই তোরে ছাড়া অন্য কারোর দিকে কোনোদিন নজর দিছে? কোনো সুন্দরী মাইয়ার পিছে রঙোসঙো করছে? বইন তুই মাথা ঠান্ডা কর। উল্টাপাল্টা কিচ্ছু ভাবিস না। ভাই এইসব শুনলে কষ্ট পাইবো!
উত্তেজনায় গা ফেটে যাচ্ছিলো আয়মানের। পূর্ণতা এসব কি হাবিজাবি ভাবতে লেগেছে সে কিছুই বুঝতে পারছেনা। মেয়েমানুষের মাথায় উনিশ-টু-বিশ হলেই সন্দেহের পোকা ঢুকে কিলবিল করে। কিন্তু তাই বলে বিশ্বাসের ডোর এতো হালকা হয়ে যাবে? আয়মান দ্রুয় স্টাডি-টেবিল থেকে উঠে বারান্দার দিকে চলে গেলো। সেখানে সাবিহা দাড়িয়ে কালো আকাশের নক্ষত্রালোক দেখছিলো। আয়মানকে দেখে সে না-দেখার ভান করে অন্যদিকে মগ্ন হলো। আয়মান কানে ফোন ধরে রেলিংয়ে উঠে বসতেই শান্ত কন্ঠে বললো,
– তুই কাঁদিস না পূর্ণতা। ভাই খারাপ কাজ করতে যায়নাই। কিছু জরুরী কাজ আছে ওইগুলা দেখতে গেছে। তুই যদি এমন কইরা সন্দেহ করোস ভাই কি ভালো থাকবো? আমারে বারবার বইলা গেছে তোর প্রতি খেয়াল রাখতে। খোদেজা আন্টির কাছে চেকআপ করতে নিয়া যাইতে। এসবের মানে কি তুই বুঝোস? ভাই উনার দিকে ধ্যান না দিয়া আগে তোর দিকে খেয়াল রাখতে বলছে। নিজেরে সামলা। আর মেসেজটা ডিলিট দে। রাতে জাগিস না। আমরা জামাইবাবা শান্তিতে দুনিয়ায় আসতে পারবো না। তোর মতো জল্লাদ ওরে কষ্ট দিবো। দেখ ছেড়ি, ঘুমা কইতাছি।
অনেকক্ষন পর পূর্ণতার হাসির আওয়াজ পেলো আয়মান। স্বস্তিতে বুকের উপর থেকে ভারী বোঝা নেমে গেলো ওর। পূর্ণতাকে ঘুমাতে বলে ফোন কেটে দিলো। রেলিং থেকে নামতে যেয়ে সাবিহার দিকে চোখ পরলো আয়মানের। সাবিহা আজ গাঢ় বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে। বাতাসে খোলা চুলগুলো রেশমি-সুতার মতো উড়ছে। আবছা অন্ধকারে এপাশের গালটা যেনো চকচক করে জ্বলছে। সাবিহার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কয়েকবার আপাদমস্তক চোখ ঘুরালো আয়মান। শেষে চোখ ছোট করে সাবিহার উদ্দেশ্যে জোর গলায় বললো,
– কাকে দেখার জন্য এখানে দাড়িয়ে আছো? রাস্তার দিকে পইপই করে কাকে খুঁজছো, হ্যাঁ?
প্রশ্নটা ছুড়তেই আয়মান কপাল কুঁচকে নিলো। অহেতুক বার্তা শুনে সাবিহা সাথেসাথে আয়মানের দিকে বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকালো। ঠোঁট শক্ত করে সাবিহা কিছু ভয়াবহ কথা বলবে ওমনেই আয়মান হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকলো। সাবিহা শক্ত মুখে বাধ্য মেয়ের মতো ওর সামনে যেয়ে দাড়াতেই আয়মান জিজ্ঞেস করলো,
– কিছু জিজ্ঞেস করেছি, ওখানে তাকিয়ে কি দেখছো? আর ইদানিং দেবদাসের ফিমেল ভার্সনের মতো মুখ কালো করে থাকো কেন? তোমার স্বামী কি গান্ঞ্জাখোর? না নেশাখোর? কি নিয়ে দুঃখ তোমার?
সাবিহা চট করে শক্ত মুখে স্থিরদৃষ্টিতে জবাব দিলো,
– সে অনুভূতিশূন্য, রসকসহীন মানব, ভ্যাবলাকান্ত হাবলা কোথাকার।
আয়মানের চোয়াল ঝুলে গেলো তৎক্ষণাৎ। কপালের ভাঁজ আরো গাঢ় করে ঠোঁট কুঁচকে ফেললো। সাবিহা তখনও অটলভাবে তাকিয়ে ছিলো, কিন্তু পরবর্তী অবস্থার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। আয়মান রেলিংয়ে বসা অবস্থায় সাবিহার হাত টান মেরে মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেললো। সাবিহা চক্ষুকোটর বিশাল বড় করে মুখ হা করে ফেললে আয়মান ওর ঘাড়ে চাপ দিয়ে মুখটা কাছে টানলো। নাক ফুলিয়ে আয়মান যখন তপ্তকর নিশ্বাস ছাড়ছিলো তখন নিশ্বাসের উষ্ণ বাতাস সাবিহার মুখের উপর পরছিলো। এতোটা কাছে, এতোটা নিকটবর্তী হওয়ার কারনে সাবিহার ভেতরে কালবৈশাখীর মতো তোলপাড় হচ্ছিলো। আয়মান ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
– আরেকবার যদি ওইসব কথা বলতে শুনি থাবাড়ায়া এই চাপার দাঁত ওইপাশে, ওই চাপার দাঁত এইপাশে ঘুরায়া ফেলমু! তারপর দেখি কলিজায় কতো সাহস থাকে!
সাবিহা চোখ বড় করে ঠোঁট কাঁপিয়ে মৃদ্যু ভঙ্গিতে কাঁপছিলো। কিছুদিন আগে আয়মানের ভয়ংকর রাগটা সাবিহা দেখেছে। আয়মানের জরুরী ফাইলের উপর চা ফেলে দেয়াতে চাকরকে কিছু না করে রুমে এসে রাগ ঝেরেছে। রুমে থাকা সব কাঁচের বস্তু এক-এক করে ভেঙ্গে ফেলেছে। স্টাডিটেবিলের কাঁচটাও বাদ যায়নি এতে। সেদিনের সেই দৃশ্য দেখে সাবিহা এখন চুপসে থাকে। আয়মানকে দেখলেই ভাঙচুরের তান্ডবটা চোখের পাতায় ভাসে। সাবিহার ভয়ার্ত চাহনি এবং থরথর কাপুনি থেখে আয়মান কিছুটা অবাক হলো। রাগান্বিত মুখটা ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক করতেই সাবিহার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
– তুমি কি আমার কোনো আচরণে আঘাত পেয়েছো?
আয়মানের শুদ্ধ ভঙ্গিতে কথাবার্তা দেখে সাবিহা একটা স্বস্তির ঢোক গিললো। কিন্তু চোখের কোটরে ভয়ের ছাপটা তেমন কমলো না। সাবিহা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলে আয়মান একবার ওর ঠোঁটদুটো দিকে তাকালো। তারপর চোখের দৃষ্টি সাবিহার চোখের দিকে তাক করতেই আয়মান নিচু স্বরে অদ্ভুত মাদক কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমি একসময় পাগলা প্রেমিক ছিলাম। আমার অজান্তা প্রেমিকার জন্য প্রচুর অনুভূতি পুষেছিলাম। তার চুড়ি, ওড়না, কলম থেকে শুরু করে তার ব্যক্তিগত রুমালটাও আমি সংগ্রহ করেছিলাম। প্রতিদিন সেই রুমাল মুখের উপর ঢেকে তারপর রাতে ঘুমাতাম। কি সুন্দর ঘ্রাণ ছিলো! আমার ইচ্ছা ছিলো যখন তাকে বিয়ে করবো, আমার সব পাগলামির কথা তাকে জানাবো। আমি ধীরেসুস্থে তাকে সব ঘটনা একটু একটু করে বলবো। আমার সবকিছু শুধু তার হবে। কিন্তু আমার অজান্তা প্রেমিকা আজীবন অজানায় থেকে গেলো। ও তো আর ফিরবেনা। আর যাকে হামেশার জন্য আমার পাশে পেলাম, সে আমার কাছে আসতে ইচ্ছুক নয়। আমার উদাস ভাব কাটাতে সে একটুও শ্রম দিতে চায়না।
কথা শেষ করতেই আয়মান চোখ বন্ধ করে ফেললো। কিন্তু সাবিহার ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে ওকে দূরে ঠেললো না। প্রকৃতির নিরবতা এবং ঠান্ডা মৌসুমের সরবতা দুটোই যেনো আষ্টেপৃষ্ঠে আকড়ে ধরলো দুজনকে। সাবিহার চোখ ভয়ের আক্রোশ থেকে শান্ত হয়ে উঠলো নিরবে। যাতাকলের মতো সকল ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে দাবিয়ে রাখলেও সেগুলো আজ বহুদিন পর যেনো বাইরে বেরুতে চাচ্ছিলো। সাবিহা সকল সুপ্ত অভিব্যক্তি ব্যক্ত করার জন্যে শুকনো গলায় ছোট্ট ঢোক গিললো। নিজেকে প্রস্তুত করে শান্ত কন্ঠে বললো,
– জানেন, আমি চাইলেও আপনার উপর অধিকার ফলাতে পারিনা। চাইলেও আমার সামনে দু-একটা ভালোবাসার কথা বলতে পারিনা। আমার এ নিয়ে কোনো কষ্ট নেই। সত্যিই কষ্ট নেই। কিন্তু আমি জানিনা এই কথা বলতে যেয়ে কেনো আমি ফুপিয়ে কাঁদছি। বিশ্বাস করুন আমি কষ্ট পাচ্ছিনা। আমি জানি আপনার মনে শ্রেয়া আপু-ই সবসময় থাকবে। উনি সবসময় যেনো থাকুক এটাই চাই। আমি চাইনা আপনি কখনো উনাকে ভুলে যান। সে তার ভুলের জন্য খুব বড় ধরনের মাশুল গুনেছে। কিন্তু জানেন? কারো জীবনে সেকেন্ড অপশন হিসেবে আসাটা খুব কষ্টের। খুব যন্ত্রণার হয়। আপনি যতোই প্রিয় মানুষটার জন্য সর্বোচ্চটা করুন না কেনো, সেই মানুষটা তার প্রিয় মানুষের কথা ভেবে আপনার সাথে তুলনা করে। আমি প্রথম ভালোবাসা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি কোনো ভালোবাসা-ই দিনশেষে হতে পারিনি। না প্রথম, না শেষ। হয়ে গেছি দ্বিতীয়, তাও সেটা থাকা-না-থাকা একসমান। আসলে মেয়ে মানুষ তো, তাই আমার আবেগটা বেশি। আপনি আমাকে কষ্ট না দিলেও অকারনে কষ্ট পেয়ে বসি। আমাদের জীবনটা না খুব ছোট। এই জীবনে দুঃখের প্রহর যদি বেশি হয় তাহলে এতো যন্ত্রণা হয় যে, তখন আর দুনিয়ায় টিকতে ইচ্ছা করেনা। শরীরের অসুখ হলে চিকিৎসা হয় কিন্তু মনের অসুখ হলে মুখ বুঝে সহ্য করা লাগে। জানেন, আমাকে কেউ পছন্দ করেনা। আমি যখন হই, আব্বা নাকি চারদিন আমার মুখ দেখেনি। আমি মেয়ে হয়েছি বলে অলুক্ষন নিয়ে জন্মেছি। বড় হলে তাদের মাথার উপর ঋণের বোঝা চাপাতে দুনিয়ায় এসেছি। আম্মা আমাকে আগলে ধরে বড় করলেও বড় ফুপু আমাকে সবচেয়ে আদর করতো। ফুপা অনেক আগেই আলসার রোগে ফুপুকে একা রেখে মারা যায়। ফুপু ফুপার দেয়া সেই কানের ঝুমকা বিক্রি করে আমাকে পড়াশোনার জন্য ঢাকা পাঠালো। আমার কাছে ঢাবির ফর্ম ফিলাপেরও টাকা ছিলো না। ফুপু আর আম্মা নিলে সেই টাকা কিভাবে-কিভাবে যে জোগাড় দিলো আল্লাহ্-ই সাক্ষী। আমার এখনো মনে আছে, যেদিন আমি বিদায় নিতে আব্বার কাছে গেলাম সেদিন আব্বা আমাকে থাপ্পড় হিসেবে বকশিশ দিয়ে গলাধাক্কা মারলো। ময়মনসিংহ স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে কমলাপুর স্টেশনে অনেক দুঃখ নিয়ে নেমেছি। আমি তখন গেঁয়োভূত ছিলাম। শহুরে মেয়েদের সাথে কিভাবে চলাফেরা করবো এগুলো নিয়েই একদিন কেদেঁ দিয়েছি। তারপর তাকদির আমাকে একটা ঢাবির একটা মহিলা শিক্ষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। জাহানারা ম্যাম বাংলা পড়াতো। ম্যাম-ই হোস্টেলের ব্যবস্থা, দুইটা টিউশনি আর নিয়মকায়দা শিখিয়ে দিলো। আজ যে আমি আপনার সামনে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারছি সেটার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব জাহানারা ম্যামের। আমি কোনোদিনও আপনার যোগ্য হতে পারবো না। আমি সবসময় একটা খ্যাত ছিলাম, আজীবন খ্যাত-ই থাকবো। গ্রামের নিম্নপরিবারের মেয়েরা বড়লোক পরিবারের ছেলেদের মনে ভালোবাসা পায়না। তারা যদি সেটা পেয়েও থাকে তাহলে…
সাবিহা তার চলমান কথাটা আর শেষ করতে পারলো না। আকষ্মিক একটা ঝোঁক এসে সাবিহার দুই চোখ বন্ধ করে কথার মাঝে দাড়ি বসিয়ে দিলো। সাবিহা যখন চোখের পাতা খুললো তখন অন্ধকারের জন্য প্রথম-প্রথম কিছুই দেখতে পেলো না। সেই আবছা অন্ধকারে যখন চোখ সয়ে গেলো, তখন আয়মানের বদ্ধচোখ জোড়াটা স্পষ্ট যেনো দেখতে পেলো। তৎক্ষণাৎ সে অনুভব করলো আয়মান ওর ওষ্ঠাধরে ঠোঁট মিলিয়ে দিয়েছে। বুকের সাথে সাবিহাকে কাছে টেনে পিঠ আকড়ে জড়িয়ে ধরে আছে। সাবিহা আশ্চর্যের ধাপগুলো বিষ্ময়সূচকে অতিক্রম করতে থাকলে আয়মান অনেকক্ষন পর ওকে ছেড়ে দেয়। অন্ধকার রাতের স্তব্ধ নিরব মূহুর্তে সাবিহার ছলছল হয়ে আসা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওই দৃষ্টিতে আবদ্ধ হয়ে আয়মান তার কালো জ্যাকেটের জিপারটা খুলে রেলিংয়ে বসা অবস্থায় সাবিহার দুইবাহু টেনে উষ্ণ বুকের সাথে মিলিয়ে নেয়। জ্যাকেটের দুইপ্রান্ত টেনে সাবিহাকে সহ নিয়ে জ্যাকেটের চেইন আটকে নেয়। নিজের মোহবিষ্ট শান্ত চাহনির মাঝে সাবিহার অশ্রুময় নয়ন মিলিয়ে আয়মান নির্লিপ্তে খোলা চুলের মাঝে হাত ঢুকিয়ে ঘাড়ে শক্ত করে হাত রাখে। গলা ও গালে অধর স্পর্শের উন্মুত্ততায় সাবিহার চোখে জমায়েত হওয়া অশ্রুধারা গাল ছাপিয়ে পরতে থাকে। জ্যাকেটের মাঝে আবদ্ধ সাবিহার হাত দুটো ধীরগতিতে আয়মানের দেহ স্পর্শ করে। ওমনেই সাবিহা মৃদ্যু ধাক্কার ভঙ্গিতে চট করে আয়মানের পিঠ আকড়ে কাধে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে উঠলে আয়মান তৎক্ষণাৎ রেলিং থেকে ব্যালেন্স সামলে হাস্য সুরে চেঁচিয়ে উঠে,
– কি সর্বনাশ ! এখুনি পরে যেতাম তো!আমি তো পরতাম-পরতাম, আমার সাথে তুমিও টপকে যেতে।
আয়মানের কথা বিশেষ প্রভাব ফেললো না সাবিহার উপর। সাবিহা দুহাতে আয়মানকে ঠেসে ধরে আছে তখন। আয়মান নিজেই রেলিং থেকে নেমে সাবিহার কোমর চেপে একটু উঁচুতে তুলে রুমের দিকে নিয়ে বেডে শোয়ালো। জ্যাকেট খুলে পাশে রাখতেই সাবিহার উপর ঝুঁকে ওর অশ্রুসিক্ত গালে গাঢ় চুমু খেয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি হিরাকে হারিয়েছি বলে কোহিনূর হারানোর ভুল করবো না সাবিহা।
কথাটুকু শেষ করতেই আয়মান সাবিহার কপালে পরম আবেশে অনেকক্ষন যাবৎ উষ্ণ ছোঁয়া বসিয়ে রাখলো। এক-এক করে দুইচোখের পল্লবে ওষ্ঠ স্পর্শ করতেই আয়মান পেটের কাছে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বললো,
– আমার জামাইবাবা আসতে বেশি দেরি নেই। আমার একটা ওয়াসিফ বাড়ির বউ চাই। তোমার এই ছোট্ট পেটের গর্ভস্তরে আমার মেয়ের কি জায়গা হবে? আমার এই অসভ্য ধরনের কথাবার্তার জন্য দুঃখিত। কিন্তু আমি একটি মেয়ের বাবা হতে চাই। তার কন্ঠ থেকে আধো-আধো সুরে ‘বাবা’ ডাক শুনতে চাই। স্বর্গীয় সুখটা পেতে চাই সাবিহা। আমার জীবনে আরেকটি মেয়ের অস্তিত্ব চাই।
সাবিহা এই প্রশ্নোত্তরে ‘ হ্যাঁ ‘ বা ‘ না ‘ কিছুই বললো না। পেটের উপর থেকে আয়মানের ডান হাতটা টেনে চুমু খেলো খেলো সাবিহা। উত্তরের আশায় চেয়ে থাকা আয়মান অব্যক্ত ইশারাটা বুঝতে পারলো। মুচকি হেসে সাবিহার মাঝে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন্য তৎপর এবং একাগ্র হয়ে উঠলো। ঐশ্বর্যশালী মহান সৃষ্টিকর্তা যা ছিনিয়ে নেয়, তা হয়তো উত্তমরূপেই ফিরিয়ে দেয়। আয়মান তার দীর্ঘদিনের মায়াটা সঙ্গী করেই নতুন পথচলায় পা বাড়ায়। পৃথিবীর বুকে কেউ কখনো থেমে থাকেনা। না সময়, না মূহুর্ত, না মানুষ, না উড়ন্ত ফানুস। সবকিছুই চলমান, সবকিছুই নিজ-নিজ জায়গা থেকে ক্ষনিকের জন্য পথ হারিয়ে দুঃখ বয়ে আনে। দিনশেষে দুঃখের আধার কাটিয়ে সুখের আলোতে আবার জীবনের গতিপথ ফিরে আসে। কিন্তু,
‘ মানুষ সুখ খুঁজতে গিয়ে সর্বদা দুঃখ বয়ে আনে। ‘
.
ক্যালেন্ডারের দিনগুলো সময়ের তালে-তালে পেরিয়ে যেতে লাগলো। মাসের-পর-মাস শূন্য ওয়াসিফ ভিলা তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো একফোঁটা পানির আশায় সদর দরজায় তাকিয়ে থাকতো। প্রতিদিন ঘুম থেকে আশা নিয়ে উঠতো আজই বোধহয় পূর্ব তার কাজ শেষ করে ফিরবে। আজই সবাইকে চমকে দিয়ে আনন্দে কাঁদিয়ে দিবে। আজই পূর্ব তার রাশভারী মুখটা নিয়ে পূর্ণতার সামনে আসতেই সোজা বুকের মাঝে টেনে নিবে। আয়েশার সাথে কড়া-কড়া কথা বলে শেষমেশ জাপটে ধরবে। বাবার বিছানায় বসে কিছুক্ষণ আলাপালোচনা করবে। কিন্তু দিনশেষে রাতের আধারে পৃথিবী ছেয়ে গেলে সব স্বপ্নই যেনো ঠুনকো লাগে। পূর্ণতা অনেক চেষ্টা করেছে পূর্বের খোঁজ করার। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে আয়মানকে, পূর্বের সম্বন্ধে কিছু জানে কিনা। কিন্তু ভাগ্য যেনো সহায় হয়না। সাগ্রতকে পূর্বের না আসা নিয়ে বলার পরও সাগ্রতও যেনো মুখ লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কিছুই ওর কাছে বলতে চাইছেনা। পূর্বের ব্যাপারে সুক্ষ তথ্যও জানাতে চাচ্ছেনা। এক গুমোটপূর্ণ রহস্যের ভেতর পূর্বের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সত্য এবং বাড়ি না ফেরার ঘটনাটা গোপনীয় আছে। এদিকে প্রেসন্যান্সী নিয়ে পূর্ণতার মনে ভয়ংকর বাসা বাঁধে। জাওয়াদের সেই আঘাতের কারনে মাঝেমাঝে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা উঠে। অনেকক্ষন সেই ব্যথা সহ্য করতেই পূর্ণতা আঁতকে উঠে। তখন বাধ্য হয়ে খোদেজাকে ডাকা হয় রাত-বিরাতে। খোদেজা পূর্ণতাকে অনেক আকুতি-মিনতি করেছে বাপের বাড়িতে এই সময়টুকু থাকতে। কিন্তু পূর্ণতা সম্পূর্ণ না করে দিয়েছে সে ওয়াসিফ ভিলা ছেড়ে কোত্থাও পা দিবেনা। এদিকে ডেলিভারির ডেট এগিয়ে এলে কোনো এক শুক্রবারে লেবার পেইন উঠে পূর্ণতার। প্রচণ্ড বেদনায় মুখ লাল হয়ে উঠে ওর। আয়েশা সেই দৃশ্য দেখে দ্রুত গাড়ি রেডি করে খোদেজার হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। সময় তখন সকাল নয়টা বাজে। পলাশ তার গোঙানো সুরেই আয়েশাকে আদেশ দেয় পূর্ণতার সাথে থাকতে। এদিকে আয়েশা পূর্ণতাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলে বাড়ির সবচেয়ে বিশ্বস্ত মেয়ে চাকর ময়নাকে বলে যায় পলাশকে নাস্তা খাওয়াতে। পূর্ণতা আজ বোরখা পড়ার মানসিকতায় ছিলো না। আকাশী রঙের ঢোলা ম্যাক্সির উপর সাদা রঙের বড় একটা ওড়না পেচিয়ে পুরো শরীর ঢেকে নিয়েছিলো। মুখে মাস্ক না লাগিয়ে ওড়নার শেষ অংশটুকু দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো। পুরো রাস্তায় ক্ষণেক্ষণে ঠোঁট কামড়ে চোখ কুঁচকাচ্ছিলো পূর্ণতা। আয়েশা ওর পিঠে ও মাথা হাতায় অনবরত হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। ড্রাইভারকে তাগাদা দিচ্ছিলেন দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে। পথিমধ্যে হঠাৎ আয়েশার ফোনে ময়নার কল আসলে তিনি পূর্ণতাকে বামহাতে আগলে ধরে ডানহাতে ফোনটা কানে ধরেন। বৈরী অবস্থায় অস্থির ভাবভঙ্গিতে আয়েশা ময়নার উদ্দেশ্য কিছু বলবে তার আগেই ময়না সন্দেহজনক সুরে বললো,
– খালাম্মা একটা বেডা আইছে। এই বেডায় ভাবির কথা জিগাইতাছে। কয়, ভাবিরে ডাকতে। এই বেডারে কি কমু এহন?
আয়েশা কানে ফোন আঁটলেও তার সম্পূর্ণ মনযোগ পূর্ণতার দিকেই ছিলো। তিনি বারবার পূর্ণতার মুখে নানা আমল পড়ে ফুক দিচ্ছিলেন। অনেকটা অবচেতন মনে না চিন্তা করে ময়নার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
– বলে দে হাসপাতালে আছি।
আয়েশা তাড়াতাড়ি কল কেটে পূর্ণতার মুখে পানির বোতল তুলে দিলেন। তিনি একদম ভুলে গেলেন ময়না একজন অজ্ঞাত মানুষের জন্যই অনুমতি নিতে চাচ্ছিলো। সেই মানুষ কে, তা না জেনে তিনি তথ্য দিয়ে দিলেন।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO
#তোক_ঘিরে
#পর্ব_৬৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো
( অংশ – ০২.)
প্রচণ্ড ব্যথায় সারা মুখ লাল হয়ে উঠেছে পূর্ণতার। সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে চোখমুখ খিচে রয়েছে সে। পেটের যন্ত্রণা প্রসববেদনা হলেও দ্বিতীয় ব্যথাটিও তীব্রভাবে যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যথাটার জন্য মনেহচ্ছে নাড়িভুঁড়ি ছিড়ে যাচ্ছে। এদিকে ব্যস্ত সড়কের তুমুল ট্রাফিক জ্যামে গাড়ি যেনো এগুতে পারছেনা। আয়েশা প্রায় হন্য হয়ে গিয়েছেন এমন বিকট পরিস্থিতি দেখে।মাথা চাপড়ানো বন্ধ করে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। ড্রাইভার সৈকত আহত মুখে কিছুই করতে পারছেনা। যানজটের বৈরী অবস্থা দেখে অশ্রাব্য ভাষায় কিছুক্ষণ গালিগালাজ করলো ঠিকই, কিন্তু উপায় হিসেবে কিছুই সে করতে পারলোনা। পূর্ণতা নিজেকে অটল রাখার জন্য প্রচুর চেষ্টা করছে।একসাথে দুটো ব্যথার যন্ত্রণায় ঠোঁট ভেদ করে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। হঠাৎ চোখ খুলে গাড়ির সিলিংয়ের দিকে সে তাকালো। মাথাটা তখনো সিটের পেছনে হেলানো। ডানপাশ থেকে ডানহাতটা আয়েশা ধরে রয়েছে। পূর্ণতার দুই চক্ষুকোলের কোণা থেকে টপটপ করে পানি পরছে। সে মাথাটা ধীরগতিতে ডানে ফিরিয়ে আয়েশার বিহ্বল মুখের দিকে তাকালো। আয়েশার চোখ তখন ছলছল হয়ে দৃষ্টি নত ছিলো। পূর্ণতা গলাটা ভিজিয়ে ব্যথাতুর কন্ঠে খুব আস্তে করে বললো,
– মা, হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে যদি আমার দম চলে যায় তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।
বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো চমকে গেলেন আয়েশা। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে পূর্ণতার হাতটা নির্লিপ্তে কখন ছেড়ে দিলেন খেয়ালও হলোনা। শুধু দরদর করে চোখ থেকে পানি পরতে লাগলো উনার। পূর্ণতা তখনও ব্যথায় নিচের ঠোঁট কামড়ে আয়েশার দিকে শান্তদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো। চোখের ভেতর নোনাজল ভর্তি হয়ে ঝাপসা হতে লাগলো ওর। আয়েশা কিছু কড়াকথা বলার জন্য মুখ খুললেন ঠিকই, কিন্তু গলার কাছে শব্দগুলো জট পাকিয়ে আটকে গেলো। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে ধাতস্থ সুরে বললেন,
– তোমার তো কিছু হবেনা পূর্ণতা। কেনো এসব আবোলতাবোল বলছো? এভাবে বলেনা মা। এগুলো বলতে নেই। চুপ করো, তুমি চুপ করে থাকো। আল্লাহ্ ব্যবস্থা করবেন তো!! এমন কথা বলে কেনো আমাকে কষ্ট দিচ্ছো?
পূর্ণতা নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই সহসা ব্যথার তীব্রতায় চোখ খিচ মেরে বন্ধ করলো। অসহায় ভঙ্গিতে নিঃস্ব পথিকের মতো আয়েশা পূর্ণতার হাতটা আবার কাছে টেনে নিলেন। শাড়ির ব্লাউজে চোখ মুছে জানালার বাইরে একটু তাকাতেই তিনি প্রচণ্ড চমকে উঠে দুই ভ্রুর মাঝে অনেকগুলো ভাঁজ ফেললেন। তিনি বুঝতে পারলেন না কি হচ্ছে এখন! সবকিছু এলোমেলো লাগছিলো যেনো! থেমে থাকা গাড়িগুলো হঠাৎ এক-এক করে স্থির অবস্থা ছেড়ে দিয়েছে। অজানা এক অস্থিরতায় উতলা হয়ে আয়েশা চারপাশের চলন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে গেলেন। এদিকে নিজেদের গাড়িটাও শান বাজিয়ে ছুটার জন্য ইন্ঞ্চিন চালু হয়ে গেছে। আয়েশার বারবার মনে হচ্ছিলো এই বিশাল জ্যামটা কেউ নিজের হাতে ছুটিয়েছে। কেউ তো এগিয়ে এসেছে এমন জায়গায়। মনের ভেতর তীব্র অস্থিরতায় ফেটে পরলেও কারনটা জানার আর উপায় ছিলো না। ড্রাইভার সর্বোচ্চটা দিয়ে গাড়ি খুব কায়দা করে চালাতে লাগলো। কিন্তু আয়েশার ব্যকুল মন জানালার বাইরে সেই কারণ উদ্ঘাটনের জন্য যখন চোখ রাখলো, তখন তিনি দেখলেন ট্রাফিক পুলিশের স্ট্যান্ডপোস্টের ওদিকে গোল করে ভিড়। কিন্তু সেখানে কি হচ্ছে দ্রুত গাড়ি টানার জন্য সেটা দেখা যায়নি।
রাস্তার জ্যামটা কেটে গেলে গাড়িটা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসে। একটু আগের ঘটনা নিয়ে আয়েশা প্রচণ্ড উদ্বেগপূর্ণে জর্জরিত হয়ে তালগোল হারিয়ে ফেলছেন। তিনি গাড়ি থেকে বেরুতেই হাতের ফোনটা সেখানে ফেলে এলেন। পূর্ণতাকে গাড়ি থেকে বের করে একটা নার্স দ্রুত ডেক ওকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। নার্সটা চেয়ার ঠেলে জলদি পায়ে পূর্ণতাকে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো। গাড়ি থেকে হাসপাতালের রিসেপশন পযর্ন্ত আসতেই আয়েশার হাঁটুতে মারাত্মক টনটন করে উঠলো। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আয়েশা তৎক্ষণাৎ হাঁটু ধরে নিচে ঝুঁকলো। হাঁটুর গিটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে আবার। বিদ্যুতের মতো ঝিমঝিম করে উঠছে। তিনি কয়েক মিনিট নিরব থেকে আবার শক্তি সন্ঞ্চার করে সোজা হয়ে দাড়ালেন। চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ছাড়তেই উনার খেয়াল হলো গাল গড়িয়ে কিছু একটা পরছে। তিনি গালের উপর আঙ্গুল বুলাতেই বুঝতে পারলেন সেগুলো নোনাপানির ফোঁটা ছিলো, যা চোখ থেকে টুপটাপ বৃষ্টির মতো অজান্তেই গড়িয়ে পরছে। ভারাক্রান্ত দেহটা খুব দূর্বল লাগছে। তবুও তিনি শক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত আটকে রিসেপশনে গিয়ে ফর্মালিটিস পূরণ করতেই সেখানকার টেলিফোন থেকে খোদেজাকে খবর পাঠান। খোদেজা সবকিছু ফেলে দ্রুতপায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে পূর্ণতাকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠায়, এরপর আয়েশাকে লিফটে করে ওটির সামনে এনে সিটে বসায়। তিনি আয়েশাকে শান্ত হতে বলে একজন পরিচিত নার্সকে বললেন আয়েশার দিকে খেয়াল রাখতে। আয়েশা নিজের শূন্য হাতের দিকে লক্ষ করতেই হঠাৎ মনে পরে উনি ফোনটা গাড়িতে ফেলে এসেছেন। এই মূহুর্তে আয়মান ও সাবিহাকে ফোন দেওয়া দরকার। আয়েশা চটজলদি নার্সের কাছ থেকে ফোন চেয়ে আয়মানকে কল করে সব জানিয়ে দিলেন। একটু স্বস্তির নিশ্বাস অনেকক্ষন পর ছাড়তেই আবারও সেই চাপা অস্থিরতা শুরু হলো। বারবার মনে হচ্ছিলো সেই স্ট্যান্ডপোস্টের ভিড়টা অর্নথক ছিলো না। কেউ বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যে জ্যাম সরাতে ঝাঁপিয়ে পরেছিলো। কিন্তু কে ছিলো সেই ব্যক্তি এসব নিয়ে চিন্তামগ্ন হতেই খোদেজা কেবিন থেকে ওটির পোশাকে পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে বের হলেন। হাতে হলদে গ্লাভস টেনেটুনে পরতেই আয়েশাকে অস্থির কন্ঠে বললো,
– আমি ভেতরে যাই বেয়াইন। দোয়া করবেন। আল্লাহ্ যেনো সব বালা-মসিবত দূর করে দেন। পূর্ব যে আসলো না এখন কি হবে বলুন? বারবার নাকি আওড়াচ্ছে ও মরে যাবে, আমার সামনে এ কথা বললে আমি কিভাবে থাকবো বেয়াইন? ওর কিছু হলে…
খোদেজার গলা ও কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো।ছিটকে আসা কান্নাটা তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে এক প্রকার পালিয়ে যাওয়ার মতো ওটিতে ঢুকলেন।। আয়েশা জীর্ণ মুখে চুপ করে বসে রইলেন সিটে। থরথর করে কেপে উঠা ঠোঁট এবং ছলছল করে আসা চোখ দুটোই সামলানোর জন্য তিনি তখন ব্যতিব্যস্ত।
.
ঘন্টাখানেকের মধ্যে হাসপাতালের ভেতর আয়মান ও সাবিহা চলে এলো। ঠিক পনের মিনিটের মাথায় কবিরও সব কাজকর্ম ছেড়ে হাসপাতালে ছুটে এলো। সবাই যখন একত্র হয়ে ওটির সামনে জমায়েত হলো তখন সবার মধ্যে প্রচণ্ড চিন্তা এবং উদ্বেগের দীর্ঘশ্বাস দেখা দিচ্ছিলো। তীব্র উৎকন্ঠায় সবার প্রাণই যেনো আটকে আছে। দম নেবার ফুরসত নেই, সব যেনো পানসে লাগছে। কবির একটু পরপর মাথার পাক খাওয়া সাদা চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালাচ্ছে। আয়মান লম্বা পথটুকুতে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে অনবরত পায়চারী করছে। সাবিহা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিশব্দে চোখের পানি ফেলছিলো, কিন্তু কান্নার সুরটা যখন নিচু থেকে উঁচুতে চড়লো তখন আয়মান পায়চারী থামিয়ে ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বললো,
– তোমাকে এই টাইমে ভ্যা ভ্যা করতে করতে বলছে কে? চুপ করতে পারো না?
আয়মানের ক্রুদ্ধ আওয়াজে সাবিহা একটু মিইয়ে গেলো। সকলের সামনে এভাবে বলাতে সাবিহার মনে সুক্ষ অভিমান জমলো।সে হালকা গোলাপীর সুতির আচঁলটা টেনে ভেজা গালটা যখন মুছে নিচ্ছিলো, ঠিক ওই মূহুর্তে লিফটের দিকে চোখ আটকে গেলো ওর। হাত থেকে আঁচলটাও ধীরে-ধীরে খসে পরলো। অজান্তেই মুখের চোয়াল হা হয়ে গেলো ওর। চমকিত চাহনিতে কিছু বলতে যেয়ে তোতলাতে লাগলো সাবিহা। আয়মান এতোক্ষন খেয়াল না করলেও হঠাৎ সাবিহার তোতলামি শুনে সে দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখলো, সাবিহা প্রচণ্ডরূপে আশ্চর্য হয়ে চোয়াল কাঁপিয়ে তোতলাচ্ছে। ওর তোতলানো একটা কথাও স্পষ্ট না। আয়মান সাবিহার দিকে লক্ষ রেখে পিছু ফিরে তাকাতেই মূহুর্ত্তের মধ্যে ঝড়ের যেনো প্রবল ঝাপটা লাগলো। আয়মান হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকলে ততক্ষণে লিফট থেকে আগত মানুষটা ওর সামনে এসে দাড়াল। সেই গাম্ভীর্যে ভরা মুখ, শক্ত চাহনির দুইচোখ, গায়ের সেই শুভ্র আর্দশের পান্ঞ্জাবীটা দেখে সকলের ভারাক্রান্ত দৃষ্টি যেনো কৌতুহলে বশীভুত এখন। আয়েশা প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে সিট থেকে দাড়িয়ে পরেছেন, কবিরের মুখ হতবাক, সাবিহা এখনো নিজের জড়তা কাটিয়ে শান্ত হতে পারেনি।। ক্ষণিকের জন্য সকলের স্থবির দৃষ্টি দেখে শক্ত চাহনীর মানুষটা এক-এক করে সবার দিকে তাকালো। সবাই হতভম্ব, সবাই স্তব্ধ। হয়তো কেউ আশা করেনি পূর্ব আজ আসবে, এই মূহুর্তে উপস্থিত হবে, ঠিক হাসপাতালে ও আগমন করবে। নিরবতার ক্ষণকাল চিড়ে সবার আগে সাবিহাই বিষ্ময়সূচকে তোতলিয়ে বলে,
– ও-য়া-সি-সি-ফ পূ-র্ব … এ-এখানে?
সাবিহার ওইটুকু কথাতে সবার সৎবিৎ যেনো ফিরে এলো। পূর্ব তখনও চুপ করে দাড়িয়ে ছিলো। তার বাম কপালের কোণে ক্রস করে দুটো সাদা ব্যান্ডেজ লাগানো। আজ ব্যতিক্রম হিসেবে পান্ঞ্জাবীর হাতা কনুইয়ে গুটায়নি পূর্ব। ফুল স্লিভ ছেড়ে দেওয়ার কারনে কবজি পযর্ন্ত ঢেকে আছে। পূর্ব গম্ভীর কন্ঠে আয়মানকে ছোট্ট প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে,
– ও ভেতরে?
‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়লেও চুপ করে তাকিয়ে রইলো পূর্বের দিকে। আয়েশা নিজের আবেগান্বিত অবস্থাকে সংযত করে পূর্বের সামনে এসে কঠোর গলায় ঝাঁঝিয়ে বললেন,
– আজ কেনো এলি? তুই তো জেল থেকে আজ বের হসনি, তাহলে এতোদিন পর কেন এলি? স্বার্থপরের মতো কেনো নিজের চেহারা দেখাচ্ছিস! তুই আমাকে শেষ করে দিলি পূর্ব! তুই আমাকে তিলেতিলে শেষ করে দিলি! নিজের গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে তুই অন্য জায়গায় মাসের পর মাস কাটালি, অথচ একদিনও বাড়িতে এসে দেখা করে গেলিনা। তোর কোন্ ইচ্ছাটায় আমি মই দিয়েছি বল? তোর কোন্ চাওয়া আমি অপূর্ণ রেখেছি? তুই কিভাবে পারলি নিজের বউকে একা ফেলে এতোদিন দূরে থাকতে? আমি কি নিষ্ঠুর ছেলে পেটে ধরেছিলাম? আমাকে তুই কি উপহার দিলিরে পূর্ব?
আয়েশার রুদ্ধ কন্ঠস্বর কান্নায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। হু হু করে তিনি কেদেঁ উঠলেন ওই মূহুর্তে। বয়সের ভারে ভেঙ্গে আসা শরীরে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না তখন। ভেতরে সকল দুঃখ যাতনা তীব্র অশ্রুধারায় প্রকাশ করলেন তিনি। পূর্ব এতোটা চুপ হয়তো আগে কখনোই থাকেনি। আজ নিজের চোখের সামনে মাকে কাঁদতে দেখেও সে আড় ভেঙ্গে কথা বলেনি। সেইযে কঠোর দৃষ্টি নিয়ে এখানে আসলো, শেষ পযর্ন্ত ওইভাবেই দৃষ্টিকোণ বজায় রেখেই চললো। সবার সাথে ভালোমন্দ কথাবার্তা যা একটু বললো, তাও খুবই মাপযোগ করে স্বল্প উত্তরে সারলো। আয়েশা তখন একটু শান্ত হয়ে ক্লান্ত দেহে সিটে বসে পরলেন। পূর্ব আয়েশার সাথে কথা বলতে এলে তিনি মুখ ঘুরিয়ে না-শোনার ভান করে সাবিহার সাথে কথা বলেন। এদিকে কবিরের সাথে টুকটাক কথা সারতেই পূর্ব যখন প্রস্তুত হলো ঠিক তখনই ওটির দরজা খুলে খোদেজা বাইরে বেরুলো। লাবণ্যহীন মুখে খোদেজা মাথার টুপিটা যখন খুলতে গেলো সেও পূর্বকে সামনে দেখে থতমত খেয়ে হা হয়ে গেলো। কৌতুহল চাপতে না পেরে তিনি সবাইকে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
– ওও ককখন এলো?
কথাটা তালগোল পাকিয়ে গেলো উনারও।আয়মান উত্তরটা দেওয়ার জন্য তৎপর হলে তার আগেই পূর্ব নিজের কথাটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পেশ করে বললো,
– ভেতরে যেতে পারবো?
খোদেজা আশ্চর্য ভঙ্গিতে একবার পূর্বের দিকে তাকাচ্ছেন, আরেকবার দৃষ্টি ফিরিয়ে সকলের শান্ত চাহনি দেখছিলেন। কিন্তু আগামাথা কিছুই তিনি ওই মূহুর্তে ঠাহর করতে পারছিলেন না। কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে পূর্ব আবার জিজ্ঞেস করলো,
– আমি কি ভেতরে যাবো?
এবারটা প্রশ্নটা ঝাঁজালো সুরে বললো পূর্ব। খোদেজা মৃদ্যু কায়দায় শিউরে উঠতেই অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে এক-বারের জায়গায় ছয়বার মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। পূর্ব দাম্ভিকতাপূর্ণ পদচারনায় খোদেজার পাশ কাটিয়ে ওটির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। এদিকে খোদেজা পূর্বের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে বেশ অবাক হলেন। কখনো উঁচু স্বরে কথা বলা তো দূর, সে নিচু কন্ঠেই চুপচাপ থাকা পছন্দ করে। ওটির বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে এরপর দৃষ্টি ঘুরালো সবার দিকে। সবার চোখেই কৌতুহল, সবার চোখেই উদ্বেগ।
.
কেবিনের কামড়ায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে পূর্ণতা। সাদা রঙের পাতলা কম্বল ওর গলা পযর্ন্ত ঢাকা। কতক্ষণ পর সে চোখের পাতা খুললো তা অবশ্য অনুমান করা যাচ্ছেনা। পূর্ণতা চোখ খুলতেই বুঝতে পারলো সে এখন ওটির কামড়ায় নেই। নরমাল কেবিনের নরম বেডে সে শুয়ে আছে। শরীর খুব পাতলা এবং ক্লান্তিকর লাগছে। মাথাটা বেশ ভারী মনেহচ্ছে। একা কেবিনে থাকার যন্ত্রণাটা খুব কষ্টের। কেউ পাশে থাকেনা একটাবার হাত ধরার জন্য। সাহস ও বিশ্বাস বাড়ানোর জন্য কেউ হাসিমুখে কেবিনের ভেতর ঢুকেনা। আজ পূর্ব নামক মানুষটার ইচ্ছা পূরণ করে দিলো পূর্ণতা। তবুও কেনো সৃষ্টিকর্তা ওকে বাঁচিয়ে রাখলো? পূর্ণতা অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে চোখ বন্ধ করতেই টুপ করে বালিশের উপর অশ্রুজল পরলো। নিঃশব্দে একের-পর-এক বড় বড় অশ্রুফোঁটা বর্ষনের মতো ঝরতেই হঠাৎ পাশ কেউ বলে উঠলো,
– কাঁদছো কেন?
সমস্ত গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠে পূর্ণতা। তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে সে শব্দউৎসের দিকে তাকায়। দূর্বল শরীরটা রক্তশূন্যের মতো ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। বুকের ভেতর সবকিছু নিংড়ে ছিড়ে আসছে। কান্নার স্ফুলিঙ্গ যখন দুই ঠোঁট চেপে আটকানোর জন্য তুমুল চেষ্টা করা হচ্ছিলো তখন সেই কন্ঠটা আবারও বলে উঠলো,
– খারাপ লাগছে তোমার?
টলটল করে দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রু-বর্ষন চলতে লাগলো পূর্ণতার। পাশে বসা ব্যক্তির কোলে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে দেখে পূর্ণতা চোখ কুঁচকে কেদেঁ দিলো। কান্নার হিড়িকে পূর্ণতা ফুপিয়ে উঠলো তখন। শরীরের দূর্বলতার দিকে আর পরোখ করার সময় ও পেলো না। যার জন্য মাসের-পর-মাস সে অপেক্ষা করতে-করতে ভেঙ্গে পরেছে, সে আজ চোখের সামনে এইভাবে উপস্থিত! পূর্ব পূর্ণতার মাথার কাছ থেকে সরে এসে ওর নেতানো হাতের কাছে বসলো। পূর্ণতার মুখোমুখি হয়ে দুহাতের ডোরে রাখা নবজাতকের কপালে চতুর্থ চুমুটি খেলো পূর্ব। ঘুমন্ত নবজাতকের দিকে তাকিয়ে থাকতেই পূর্ব তৎক্ষণাৎ ঝাপসা দৃষ্টি নামিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে নিচু সুরে বললো,
– আমার ছেলে…
– চলবে
#FABIYAH_MOMO
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক