#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_১০
শুভ্র বললো,
‘তুলি, একটু রুমে আসো তো। কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
শুভ্রর আচমকা কথায় আফরোজা এবং তুলি দুজনেই অবাক। আফরোজা বেশ খুশি হলেন যেমন। মৃদু হেসে সোফার হাতলে হেলান দিয়ে বেশ আরাম করে বসলেন। তুলি আড়চোখে আফরোজার দিকে চাইলো। আফরোজা এভাবে তাদের দুজনের দিকে চেয়ে আছেন দেখে তুলি কাতর চোখে আবার শুভ্রর দিকে তাকাল। শুভ্র তুলির তাকানোর অর্থ ধরতে পারলো না প্রথমে। পরবর্তীতে তুলি ইশারায় আফরোজার হাসিহাসি মুখ দেখিয়ে দিলে শুভ্র মায়ের দিকে চেয়ে বুঝতে পেরে কেশে উঠলো। বোকার মতো হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘আম্মু, ওই বলছিলাম তুলি ট্যুরে-‘
শুভ্র থামলো। আর বলা লাগল না তার। আফরোজা সোজা হয়ে বসলেন। তুলির দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
‘তুলি শুভ্রর ঘরের বিছানার চাদরটা ময়লা হয়ে গেছে। এখন গিয়ে চাদরটা উঠিয়ে বিনে রেখে দে তো, বুয়া এসে ধুয়ে দিবে।’
তুলি শুনলো। মনেমনে হাসলো। কী সুন্দর বাহানা! শুভ্র লজ্জা পেলো। মায়ের সামনে শুভ্রর তুলিকে এভাবে ডাকা উচিত হয়নি, বুঝতে পারলো সে। নত মুখে মাথা চুলকে নিজের ঘরে চলে গেলো। তুলিও গেলো কিছুসময় পর। দুজন যেতেই আফরোজা আবার টিভি চালালেন।
তুলি শুভ্রর ঘরের দরজায় টোকা দিলো,
‘আসব?’
শুভ্র ঘরের ভেতরে পায়চারি করছিল। তুলির আওয়াজ শুনতেই হাঁটা থামিয়ে চটজলদি বললো,
‘এসো, এসো।’
তুলি মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে ভেতরে ঢুকলো। শুভ্র তুলিকে দেখেই অপ্রস্তুত গলায় প্রশ্ন করলো,
‘সরি, আসলে আম্মু সামনে ছিলো আমার মাথায় ছিল না।ব্যাপারটার জন্যে আম সরি। নেক্সট টাইম খেয়াল রাখবো।’
তুলি মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। তুলি ভেবেছিল, শুভ্র হয়তো ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিবে। তথাকথিত ঠোঁটকাটা পুরুষের ন্যায় মায়ের সামনে এভাবে বলাকে স্বাভাবিক মনে করবে। কিন্তু শুভ্র তাকে ভুল প্রমাণিত করল। মায়ের সামনে শুভ্র বড্ড নম্র এবং ভদ্র। ঘরের ভেতরে স্বামী-স্ত্রী যেভাবেই থাকুক, কথা বলুক, একে ওপরের কাছাকাছি থাকুক, গুরুজনের সামনে সেসব প্রকাশ করা তুলির ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ নয়। এটা যেমন তুলির পছব্দ নয়, তেমনি শুভ্ররও নয়। তুলির শুভ্রর এই ব্যাপারটা ভালো লাগলো ভীষণ।
তুলি বললো,
‘ঠিকাছে, প্রথম প্রথম ভুল হয়েই যায়। নেক্সট টাইম দুজনেই খেয়াল রাখবো।আচ্ছা বলেন এবার, কী বলতে ডেকেছিলেন?’
শুভ্র বললো,
‘ওহ, হ্যাঁ। তোমার পূজার বন্ধ কবে?’
তুলি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
‘কেন?’
‘কবে থেকে শুরু আর কবে অব্দি, আমাকে বলো।’
তুলি হাতে গুণে দেখলো। তারপর বললো,
‘শুরু হবে পরশু থেকে, ২৩ দিন থাকবে বন্ধ।’
‘ওয়াও, গ্রেট।’
শুভ্রকে খুশি হতে দেখা গেলো ভীষন। সব কেটেকূটে হাতে কমপক্ষে ২০ দিন তো থাকবে। ঘুরতে সর্বোচ্চ লাগবে এক সপ্তাহ। বাকিটা সময় তুলি পড়াশোনায় দিতে পারবে, আর শুভ্রর ছুটি মাত্র ১০ দিন। সবমিলিয়ে ট্যুর পরিকল্পনা করা যেতেই পারে।
শুভ্র এবার তার কথা তুললো,
‘তুলি, কোথাও বেড়াতে যেতে চাও এই বন্ধে, একা আমার সঙ্গে?’
তুলি রীতিমত চোখ বড়বড় করে চাইলো। শুভ্রর কথা বুঝতে তার বেশ সময় লেগে গেলো। যখন বুঝলো, লজ্জায় মিইয়ে গেলো। বিয়ের পর তাদের এভাবে ঘুরতে যাওয়াকে কী হানিমুন বলে আখ্যায়িত করবে তুলি? তুলি উত্তর করলো না, মাটির দিকে চেয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। শুভ্র বুঝতে পারলো না তুলির মতিগতি। শুভ্র ধীর পায়ে দু কদম এগিয়ে এসে বললো,
‘কী তুলি? যেতে চাওনা আমার সঙ্গে?’
তুলি অন্যদিকে চাইল। বুকটা আবার ডিপডিপ করছে। মনে হচ্ছে লজ্জায় কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। তুলি অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আস্তে করে বললো,
‘যাবো।’
শুভ্র তুলির সম্মতি শুনে খুব বেশি খুশি হয়েছে। শুভ্র বললো,
‘আমার বন্ধুরাও যাবে আমাদের সঙ্গে, তাদের ওয়াইফ নিয়ে। ওরা ওদের মতো ঘুরবে, আমরা আমাদের মতো। বাট যাবো একসঙ্গে। তুমি কনফোর্ট ফিল করবে?’
এই যে শুভ্র ‘আমরা-আমাদের’ এই শব্দগুলো বারবার ব্যবহার করছে, তুলির কানে যেন এই শব্দগুলো মধু ছিটাচ্ছে। কানে যে কী আরাম লাগছে, বলা অসম্ভব। তুলি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বললো,
‘আমার সমস্যা নেই। কিন্তু মা রাজি হবেন না এভাবে। উঠিয়ে দেওয়ার আগে এভাবে ঘুরতে যাওয়া-‘
শুভ্র মাথা দুলালো, ‘সেটাও এক কথা। আচ্ছা আমি দেখছি। আন্টি সরি মায়ের নাম্বার তোমার মুখস্ত আছে? আমাকে বল তো। আমি দেখি পারমিশন পাই কিনা।’
শুভ্র যেভাবে বলল, তুলির মনে হলো শুভ্র কোন ছোট বাচ্চা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে। তার পারমিশন নিতে বাচ্চার অভিভাবকের কাছে ফোন দেওয়া হচ্ছে। তুলি হেসে ফেলল। শুভ্র হাসির শব্দে তাকালে, তুলি সঙ্গেসঙ্গে হাসি থামিয়ে ফেলল। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘নাম্বার?’
তুলি নাম্বার বললো। শুভ্র কল দিয়ে কানে ধরলো। ওপাশ থেকে ইয়াসমিন কল রিসিভ করলে শুভ্র সালাম দিলো। ইয়াসমিন শুভ্র কল দিয়েছে শুনে গদগদ হয়ে সালামের জবাব দিলেন। শুভ্র বললো,
‘আন্ট-মা একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে। বলব?’
‘হ্যাঁ বলো শুভ্র।’
শুভ্র তুলির দিকে তাকালো। তুলি উৎসুক চোখে শুভ্রর দিকে চেয়ে আছে। শুভ্র বললো,
‘আমার মেডিকেল থেকে ছুটি দিবে পূজায় ১০ দিনের জন্যে। তুলিরও ছুটি আছে। ভাবছিলাম, আমরা দুজন একটু ঘুরে আসি কোথাও থেকে, যদি আপনি অনুমতি দেন।’
স্বয়ং শুভ্র কল দিয়ে বলছে যাবে। ইয়াসমিন দ্বিধায় পড়ে গেলেন। এভাবে উঠিয়ে দেওয়ার আগে মেয়েকে ঘুরতে যেতে দেওয়া ভালো হবে? ইয়াসমিন বললেন,
‘আমি একবার তুলির বাবার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাচ্ছি শুভ্র।’
‘ওকে মা। রাখি?’
‘ওকে বাবা, রাখো।’
শুভ্র সালাম দিয়ে ফোন কাটলো। শুভ্র তুলির দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
‘কী মনে হয়, আঙ্কে-বাবা দিবেন?’
তুলি শুভ্রর বাবার ‘বাবা-মা’ এসব কথার মধ্যে আটকে যাওয়া দেখে হেসে ফেলে বললো,
‘কষ্ট হচ্ছে না, বাবা-মা ডাকতে?’
শুভ্র হাসলো বোকার মতো। মাথা চুলকে বললো,
‘সেরকম কিছু না। প্রথম প্রথম অভ্যাস নেই, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘জানি, ট্রাই করছেন দেখেই আমার ভালো লাগছে।’
শুভ্র হালকা হাসলো। মিনিট পরেই শুভ্রর ফোনে কল দিলেন ইয়াসমিন। শুভ্র তাৎক্ষনিক কল রিসিভ করে সালাম করলো। ইয়াসমিন বললেন,
‘তোমরা কতদিনের জন্যে যাবে শুভ্র?’
‘এক সপ্তাহ।’
‘আচ্ছা যাও তাহলে। খেয়াল রাখবে দুজনের। কবে যাচ্ছ?’
‘পরশু।’
‘আচ্ছা।’
শুভ্র আরও টুকটাক কথা বলে ফোন কাটলো। তুলি শুভ্রর দিকে চাইলো। শুভ্র বললো,
‘রাজি তারা। তুমি আজ বাসায় গিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিও। আমিও আমার সব গুছিয়ে নিব। কিম্তু আম্মু? আম্মু কোথায় থাকবে? আগের বুয়া তো নেই এখন।’
‘আম্মুকে সাথে নিয়েই যাই। উনার ভালো লাগবে হয়তো।’
‘হ্যাঁ, এটাই করা লাগবে। আমি আম্মুকে বলে দেখছি। দেখি কী বলে?’
শুভ্র তুলিকে রুমে রেখে আফরোজার কাছে গেলো। আফরোজা শুভ্রর আসার আওয়াজ পেয়েই টিভি দ্রুত অফ করে দিলেন। শুভ্র মায়ের পাশে বসলো। আফরোজা বললেন,
‘কিছু বলবি?’
শুভ্র সরাসরি আদেশ করার ন্যায় বললো,
‘সাজেক যাচ্ছি আমি, তুলি আর তুমি, দ্রুত ব্যাগ গোছাও।’
আফরোজা বললেন,
‘তোদের সঙ্গে আমি কেনো যাবো? না না। তোরা যা।’
‘কেন? আমাদের সঙ্গে গেলে কী হয়? ভালো লাগবে তোমার। মেঘের শহর দেখেছ কখনও? খুব সুন্দর জানো?’
‘নারে। এতদূর আমার শরীর সইবে না। আর আমি গিয়ে এসেছি ওখানে তোর বাবার সঙ্গে। এতদূর আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই।’
‘তাহলে কাছে কোথাও চলো।’
শুভ্র এতবার করে বলছে আফরোজা শুভ্রকে মানাতেই পারছেন না। নাছোড়বান্দার মতো করছে শুভ্র। তারপর আফরোজা হাল ছাড়লেন।শুভ্রর চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘শোন শুভ্র। এটা তোর আর তুলির একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়া। এই যাওয়াটা তোদের এখন কাজে লাগানো দরকার। দুজন দুজনকে বুঝবি, জানবি, চেনাজানা হবে। এটাই তো দরকার এখন। আমি তোর বাবার সঙ্গে গেছি, আমরাও একাই গেছি দুজন। তোদেরও তাই এখন একাই যাওয়া উচিত। আমি তোদের সঙ্গে যাবো। তবে এইবার না, আরেকবার। এবার তোরা যা। জেদ করিস না।’
শুভ্রর মন মানলো না। সে মায়ের নিরাপত্তার আশঙ্কায় বললো,
‘তুমি একা কিভাবে থাকবে, আম্মু? আগের বুয়া তো নেই এইবার।’
‘এক কাজ করি, আমি ইয়াসমিনের বাসায় এ কদিন ঘুরে আসি। ইয়াসমিন বারবার বলছিল গিয়ে ক-রাত থাকার জন্যে। এই সুযোগে থেকে আসি কদিন। তোরাও ঘুরে আয়। আমাদের তিনজনের সময়ই ভালো কাটবে এই এক সপ্তাহ তাহলে। আমারও এই ফাঁকে ইয়াসমিনের সঙ্গে সময় কাটানো হয়ে যাবে। কতকাল ইয়াসমিনের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা হয়না, জানিস?’
শুভ্র মায়ের জোরাজরিতে রাজি হলো শেষ অব্দি। আফরোজা ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
‘ঘুরে আয় তোরা, ফিরবি মন খুশি করে। তুলি প্রথম তোর সঙ্গে যাবে, মেয়েটাকে এই বিয়ে, এই সম্পর্ক, আর এই তোকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবি, ঠিকাছে?’
শুভ্র মৃদু হাসলো। লজ্জা পেয়ে মাথার পেছন চুলকে বললো,
‘আম্মু, তোমার না মোটিভেশোনাল স্পিকার হওয়া উচিত ছিল। প্রতিটা ভিডিওর টাইটেল থাকবে, কিভাবে ছেলেমেয়ের সংসার টিকিয়ে রাখা যায়। আম শিউর, এই প্রফেশনে তুমি খুব উন্নতি করতে পারতে।’
আফরোজা বাচ্চাদের ন্যায় হাসলেন। ছেলের হাতে হাত রেখে বললেন,
‘ছেলেরা যদি সংসারে পটু না হয়, তবে মায়েদের স্পিকারই হতে হয়। যা তো এবার, দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নে।’
#চলবে
বেশ বড় পর্ব!
বড়বড় মন্তব্যের খুব করে অপেক্ষায়