সোনালি রোদে ঝলমল করছে জমিদারবাড়ির চারপাশের মাঠ। দূরে দেখা যায় ছোট ছোট খামারবাড়ির সারি, ছবির মতো সাজানো। ঘাসের সবুজ গালিচায় মোড়া মাঠের শেষে কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা গোয়াল, যেখানে গরু-ছাগলের আলতো পায়ের শব্দ ভেসে আসে।
দক্ষিণের খামারবাড়ির পেছনে লুকিয়ে আছে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে ঘরটি হাওয়ার একটা ঝাপটায় ভেঙে পড়বে। কিন্তু এই জরাজীর্ণ বাহ্যিক রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অপ্রত্যাশিত বিলাসিতা। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। নরম তুলোর মতো গদিতে মোড়া একটা বিশাল খাট, দেয়ালজুড়ে টাঙানো দামি ছবি, আর কোণায় একটা ছোট্ট কিন্তু সুসজ্জিত বইয়ের আলমারি। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যের মাঝখানে বসে আছে জাওয়াদ। জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে একটা অদ্ভুত শূন্যতা। সে এখানে থাকলেও তার মন কোথাও অনেক দূরে হারিয়ে গেছে। হাতে একটা বই, অনেকক্ষণ ধরে পাতা ওল্টানো হয়নি। মাঝে মাঝে দূরে জমিদার বাড়ির দিকে তাকায়, তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। সেখানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা আর অনিচ্ছার দ্বন্দ্বে ছটফট করছে তার হৃদয়।
দুই দিন ধরে সে এই ছোট্ট কুঁড়েঘরে আছে। জমিদাররা যখন খামারবাড়ি পরিদর্শনে আসে, তখন এই ঘরে বসেই কর্মচারীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। এখন সে নিজেকে এখানে লুকিয়ে রেখেছে। জমিদার বাড়ির সেই বিশাল ইট-পাথরের অট্টালিকায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তার ওপর গুলনূরের সঙ্গে করা অন্যায়টা তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। অথচ অহংকার তাকে কারো কাছে ক্ষমা চাইতে দিচ্ছিল না। তাই নিজেকে শান্ত করতে, নিজের সঙ্গে একটু সময় কাটাতে চুপিচুপি এই নির্জন কুঁড়ে ঘরে চলে এসেছে। এখানে সে বই পড়ে, মাঝেমধ্যে বনে গিয়ে শিকার করে। কখনো বা শুধু বসে থাকে, নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে।
কিছুক্ষণ পর, সে তিনটে পাকা কলা হাতে নিয়ে আলতো করে খেতে লাগল। খাওয়া শেষে, সে অলস ভঙ্গিতে উঠে কলার খোসাগুলো ঘরের বাইরে ফেলে। তারপর পছন্দের ফতুয়াটি পরে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখ কপালে উঠে গেল। সামনেই দাঁড়িয়ে মনির আর গুলনূর!
মনির আর গুলনূর হাতে খাবারের ঝুড়ি নিয়ে খামারে এসেছে। তারাও জাওয়াদকে দেখে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠেছে। জমিদার পুত্রকে খুঁজে বের করার জন্য বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেছে, আর সে কিনা নির্বিকার চিত্তে উল্টো ফতুয়া পরে খামারবাড়িতে… চারপাশে গরু-ছাগল ছুটে বেড়াচ্ছে!
মনির আর গুলনূর তৎক্ষণাৎ মাথা নত করে সম্মান জানাল। জাওয়াদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে গলা পরিষ্কার করার ছলে একটা কাশি দেয়, যাতে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে পালাতে পারে। ঠিক তখনই একটা গরু এসে জাওয়াদের ফতুয়ার কোঁচা চিবোতে শুরু করে। জাওয়াদ হকচকিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে, “হুর, হুররর।”
সে তাড়াহুড়ো করে গরুটাকে তাড়াতে গেলে নিজের ফেলা কলার খোসায় পা পিছলে যাওয়ার উপক্রম হয়। মনির ছুটে এসে তাকে ধরতে চায়, কিন্তু জাওয়াদ কোনোমতে নিজের ভারসাম্য ফিরে পেয়ে হাত তুলে মনিরকে থামতে ইশারা করে।
গুলনূরের ঠোঁটের কোণে একটি চাপা হাসি ফুটে ওঠে। জাওয়াদ চেষ্টা করে নিজেকে গম্ভীর দেখাতে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে একটু অস্থিরতা ফুটে উঠল। “হ্যাঁ, তো তোমরা এখানে কী করছ?” – প্রশ্নটা করলেও তার চোখ বার বার গুলনূরের দিকে ফিরে যাচ্ছিল।
মনির সবিনয়ে উত্তর দিল, “হুজুর, আমরা কর্মচারীদের খাবার দিতে এসেছি। কিন্তু আপনি… মানে, আপনাকে তো সবাই খুঁজছে…”
জাওয়াদ তখন একটা মহাজ্ঞানীর ভঙ্গি করে বলল, “ওহ, আমি? আমি তো এখানে গোপন তদন্তে এসেছি।”
তখন একটি দুষ্টু বকরি পেছন থেকে এসে জাওয়াদের ফতুয়ার পকেট থেকে ঝুলে থাকা রুমালটা টেনে নিল। জাওয়াদ যখন ঘুরে তাকাল, বকরিটা “ভ্যাঁ” করে ডেকে উঠল, যেন সে বলছে – “মিথ্যুক!”
এই দৃশ্য দেখে গুলনূর আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তার মুখে হাসির ঢেউ খেলে গেল, যা সে চেপে রাখার বৃথা চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত সে মুখ ফিরিয়ে হাসতে লাগল। জাওয়াদ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সেইসাথে সে মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্য করে, গুলনূরের হাসিতে কী অপরূপ প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে। যেন কোনো সুরেলা গান, যা শুনলে মন ভরে যায়, কিন্তু কখনও তৃপ্তি আসে না।
গুলনূরের চোখের তারায় আনন্দের ঝিলিক খেলে বেড়াচ্ছে। তার গোলাপি গাল দুটোতে হাসির ছোঁয়ায় লাবণ্য ছড়িয়ে পড়েছে। জাওয়াদ অবাক হয়ে ভাবল, এই হাসিখুশি মেয়েটিকেই কি না সেদিন সে অন্যায়ভাবে ধমকে, রাগের মাথায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল! গুলনূর যখন হাসি থামিয়ে জাওয়াদের দিকে তাকাল, তখন তাদের চোখে চোখ মিলল। সেই মুহূর্তে দুজনেই বুঝল, তাদের মধ্যে কিছু একটা বদলে গেছে।
রাইহা তখনও নাভেদকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে, চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু বাঁধ ভেঙে পড়ছে। সে ধীরে ধীরে মুখ তুলল, নাভেদের চোখে চোখ রাখল। তার ঠোঁট কাঁপছে, “কাকিমা আমাকে চলে যেতে বলেছে। আমার সব…” কান্নার প্রবল দমকে তার কথা অসমাপ্ত রয়ে যায়। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল বর্ষার ধারার মতো।
নাভেদের ভ্রু কুঁচকে যায়, চোখের তারায় একটা অস্থিরতা, “কেন চলে যেতে বলেছে?” প্রশ্নটা বাতাসে ভারী হয়ে ঝুলে রইল উত্তরের অপেক্ষায়।
হঠাৎ করেই, রাইহার নজর পড়ল জুলফার দিকে। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো যেন সে একটা অদৃশ্য দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছে। উপলব্ধি করল পরিস্থিতির জটিলতা। রাইহা দ্রুত পিছিয়ে এল নাভেদের আলিঙ্গন থেকে। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল গভীর অপরাধবোধ, “দুঃখিত, আমি জানতাম না যে তুমি কারও সঙ্গে আছো।” তার কণ্ঠে একটা বিব্রত ভাব।
জুলফা দাঁড়িয়ে ছিল নিস্তব্ধ। তার চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে সেই অশ্রু আটকে রাখতে। তার ঠোঁট কাঁপছে না বলা কথার ভারে।
জুলফা নিজেকে সামলে নেয়। তার কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত শীতলতা, যেন বরফের টুকরো, “আমি… আমি যাই।” বলেই সে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
নাভেদ আস্তে আস্তে রাইহার দিকে ফিরে তাকায়। এই মুহূর্তে রাইহাকে সান্ত্বনা দেওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। সে ধীরে ধীরে রাইহার কাঁধে হাত রাখে।
“রাইহা,” নাভেদের কণ্ঠস্বর নরম কিন্তু দৃঢ়, “কান্নাকাটি করো না। চোখের জল মুছে ফেলো। আমি তোমার পাশে আছি। এবার শান্ত হয়ে বলো, ঠিক কী ঘটেছে?”
রাইহা গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। তার কণ্ঠস্বরে এখনও কাঁপুনি, “জাওয়াদ… বাড়ি নেই। আমি তার কোনো খবর দিতে পারছি না। এই অজুহাতে কাকিমা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। নাভেদ, তুমি তো জানো আমার অবস্থা। আমি কোথায় যাব? কী করব?”
নাভেদ একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে জানে রাইহার বিপদের কথা।
“শোনো,” নাভেদ আস্তে আস্তে বলল, “আমরা এখন বন্ধু। তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব এখন আমারও। তুমি জমিদার বেগমকে বলো, দুই দিনের মধ্যে তুমি চলে যাবে।”
রাইহার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। “কিন্তু কোথায় যাব আমি? আমার হাতে তো এখনও পাসপোর্টও আসেনি।”
নাভেদের চোখে দৃঢ়তা ফুটে উঠল। “সেটা নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি তোমার থাকার ব্যবস্থা করব। যতদিন না তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিরাপদে পৌঁছে দিতে পারি, ততদিন তুমি আমার আমানত৷ এটা আমার প্রতিশ্রুতি।”
রাইহা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল নাভেদের দিকে। তার চোখে অশ্রু জমা হলেও, সেখানে এবার একটু আশার আলো দেখা গেল। তার কণ্ঠস্বরে বিশ্বাস আর সংশয়ের দোলাচল, “তুমি… তুমি সত্যিই এতটা করবে আমার জন্য? একজন অচেনা মেয়ের জন্য?”
নাভেদ মৃদু হেসে বলল, তার হাসিতে একটা গভীর আন্তরিকতা, “অবশ্যই করব। রাইহা, তুমি আর অচেনা নও। আমরা এখন একসাথে এই লড়াইটা লড়ব। মনে রেখো, তুমি একা নও। আমি তোমার পাশে আছি, আর থাকব। বিশ্বাস রাখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
রাইহার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এবার সেটা ছিল শুধুই কৃতজ্ঞতার। সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, তার কণ্ঠস্বরে গভীর আবেগ, “ধন্যবাদ, নাভেদ। তুমি না থাকলে আমি জানি না কী করতাম।”
“এখন যাও, জমিদার বেগমের কাছে যাও। তাকে বোঝাও, অন্তত দুইদিনের জন্য তোমাকে থাকতে দিতে।”
রাইহার চোখে ফুটে উঠল সংশয়, “তুমি কি মনে করো আমি উনাকে বুঝাতে পারব? উনি তো আমার কথা শুনতেও চান না।”
নাভেদ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, “নিশ্চয়ই পারবে। তোমার মধ্যে সেই শক্তি আছে। শুধু নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো।” তারপর একটু থেমে বলল, “আমি যেতাম তোমার সঙ্গে, কিন্তু দেখো, আমি এখানে একজন ব্যবসায়িক অতিথি। জমিদার বেগমের সঙ্গে এমন ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলা আমার উচিত হবে না। এটা তোমাকেই করতে হবে।”
রাইহা গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল একটা নতুন দৃঢ়তা। সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব।”
নাভেদ উৎসাহের সাথে বলল, “এই তো চাই। যাও, আমি এখানেই আছি।”
রাইহা হেঁটে যায় সামনে। একবার ফিরে তাকায় নাভেদের দিকে, তার চোখে কৃতজ্ঞতা আর নতুন সাহসের আভাস। তারপর সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল জমিদার বেগমের ঘরের দিকে, তার কাঁধে একটা নতুন দায়িত্বের বোঝা।
রাইহার পদশব্দ মিলিয়ে যেতেই নাভেদের মুখজুড়ে ঘটে এক অদ্ভুত রূপান্তর। তার চোখে জ্বলে উঠে অনির্বচনীয় আগুন, যেন কোনো গোপন অভিসন্ধি হঠাৎ করেই জেগে উঠেছে। ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি ঘুরে গেল বিছানার দিকে, যেখানে জুলফার দেওয়া সেই ছোট্ট রুমালটি অসহায়ের মতো পড়ে আছে। নাভেদ মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে আছে একটা অজানা উত্তেজনা। হাত বাড়িয়ে সে তুলে নেয় রুমালটি। আঙ্গুলের স্পর্শে অনুভব করে তার কোমল মসৃণতা। রুমালের ওপর সুতোর কাজে আঁকা বেহালাটির দিকে সে নিবদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটে ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি। সেই হাসিতে মিশে আছে উন্মাদনা, প্রত্যয় আর এক অজানা আশঙ্কার ছায়া। তার চোখে জ্বলে উঠে দুর্বোধ্য আলো। সে আস্তে আস্তে আওড়াতে লাগল, যেন নিজের সাথেই কথা বলছে, “জুলফা… তুমি জানো না তুমি কী। তুমি আমার সবচেয়ে মূল্যবান গুটি। এই দাবার ছকে তুমিই হবে আমার রানি।”
নাভেদের কণ্ঠস্বরে কৌশলী দৃঢ়তা, গোপন উত্তেজনা, আর একটু করুণাও। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল নিশ্চয়তা। এই মুহূর্তের জন্যই সে অপেক্ষা করেছিল, এমন একটা সুযোগই চাচ্ছিল বহুদিন ধরে।
সে আবার বলল, এবার আরও ধীরে, প্রায় ফিসফিসিয়ে, “খেলা শুরু হয়েছে, শব্দর ভুঁইয়া। এই খেলায়… তোর হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী আমার মাস্টার স্ট্রোক।”
চলবে…
~ ইলমা বেহরোজ