কৃষ্ণচূড়ার কাব্য (পরিবর্তিত নাম)
ইলমা বেহরোজ
শঙ্খিনী হাঁক দিল, “বেগম সাহেবা, কেউ একজন আইছে।”
জুলফা ভেতর থেকে উৎসুক চোখে এগিয়ে এল।
“কোথায়?”
শঙ্খিনী ইশারা করল বারান্দার দিকে। “ওই দেখেন, বড় বারান্দার ধারে।”
“কে এলো?” বলতেই সামনে পড়ল কোহিনূর।
জুলফা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। কোহিনূরের পরনে ভারি বেনারসি শাড়ি, গলায় ঝলমলে সোনার হার, চোখে মোটা সুরমা। বয়সের ছাপ থাকলেও চেহারা রাজরানির মতো।
কোহিনূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন জুলফার দিকে। তার পরনের শাড়ি আর হাতের বালা দেখে অনুমান করলেন এই তার ভ্রাতুষ্পুত্র শব্দরের বউ।
স্বগতোক্তি করে বললেন, “এই বুঝি শব্দরের বউ?”
জুলফা বুঝতে না পেরে বলল, জি?
কোহিনূর কর্কশ গলায় প্রশ্ন করলেন, “নাম কী তোমার?”
“জি… জি, জুলফা।”
“চুল খোলা রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছ? এ বাড়ির প্রত্যেক ইট-সুরকি জানে কতটা শালীনতা নিয়ে এখানকার মেয়েরা চলাফেরা করে। আর তুমি…” কুহিনূর থামলেন। জুলফার এলোমেলো চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বুলিয়ে নিলেন। “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে হাটের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছ। এই কি তোমার শিক্ষা? এই কি তোমার সংস্কার?”
জুলফা তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে গিয়ে আরও এলোমেলো করে ফেলল।
পেছন থেকে শঙ্খিনী ফিসফিস করে বলল, “জমিদারদের ফুফু। আপনার ফুফু শাশুড়ি।”
শোনার সঙ্গে সঙ্গেই জুলফার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। “জি… জি, মাফ করবেন।”
কোহিনূর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “এই বাড়ির বউরা অপরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে মাথায় ঘোমটা টেনে সালাম দেয়।”
জুলফা হকচকিয়ে ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে বলল, “আস… আসসালামু আলাইকুম।”
কোহিনূর চোখ সরিয়ে শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বাবার বাড়ি কোথায়?”
“জি, পুষ্পনদীর নীলতরু গ্রামে।”
“ঠিক আছে,” সামনে হেঁটে যেতে যেতে বললেন, “তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে।”
কোহিনূর চলে যেতেই জুলফা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শঙ্খিনীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করল, “তুই ওনাকে চিনিস?”
শঙ্খিনী বলল, “কয়েক বছর আগে দেখছিলাম। এরপর আর আসেন নাই।”
জুলফা বারান্দার থামে হেলান দিয়ে ভাবল, ভারী রাশভারী মহিলা! কতদিন থাকবে এখানে?
দূরে কোথাও উদাস করা ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে।
সুফিয়ান দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন কুহিনূরের দরজার দিকে। সূর্যের শেষ আলোটুকু তখন বারান্দার মেঝেতে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে ডাক দিলেন, “ফুফুজান!”
ভেতর থেকে কোনো সাড়া এল না।
সুফিয়ান আবার ডাকলেন, এবার আরও বিনয়ের সঙ্গে, “ফুফুজান, আমি সুফিয়ান।”
মুহূর্তের নীরবতা। তারপর দরজার ওপাশ থেকে কোহিনূরের গলা শোনা গেল, “আমি এখন ক্লান্ত। পরে আসো।”
সুফিয়ান পিছু হটলেন। এক মুহূর্তের জন্য তার চোখ দরজার হাতল থেকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আসাদের দিকে গেল। আসাদ নিচু মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি ধীর পায়ে জায়গা ছেড়ে সরে গেলেন। তার ভারী চপ্পলের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল লম্বা বারান্দায়।
রৌদ্রদগ্ধ জমিদার বাড়ি। চারপাশে ঝাঁ ঝাঁ করছে উত্তাপ। জুলফা খাস মহলের নির্জন কোণে বসে আছে। মাথার মধ্যে কিলবিল করছে চিন্তাকীটগুলো।
গত রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। মরুভূমির মধ্যে তার ছোট্ট ভাতিজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বাচ্চাটার মুখ থেকে থেমে থেমে রক্ত ঝরছে। সে দিশেহারা হয়ে তাকে কোলে নিয়ে ছুটছে, চিৎকার করছে, সাহায্যের জন্য আকুল হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই।
ঘুম ভাঙার আগ পর্যন্ত সে দুঃস্বপ্নে আটকে ছিল। শব্দর জড়িয়ে ধরতেই ঘুম ভাঙল। উঠে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেল। তবুও সেই দুঃস্বপ্নের ভয়াবহতা কিছুতেই কাটছিল না।
সেই থেকে বুকের মধ্যে একটা শূন্যতা জমাট বেঁধে আছে।
পেটে ধরে মা না হলেও, ভাতিজার জন্মের পর থেকেই সে দ্বিতীয় মা হয়ে উঠেছিল। কত ভালোবাসা দিয়ে, যত্ন করে ছোট্ট শিশুটাকে বুকে আগলে রাখত। কোলে নিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়াত। ছোট্ট ভাতিজার একরত্তি মুখটা মনে হতেই আবার বুকটা ভেঙে এল।
কোকিল ডাকছে। সেই ডাক অনুসরণ করে বাইরে তাকিয়ে জুলফা আনমনা হয়ে যায়। কতদিন হলো, মা, ভাই, ভাবি, ভাতিজা কাউকেই দেখে না। কেমন আছে তারা? কোথায় আছে? কিছুই জানে না।
জমিদারের সঙ্গে বিয়ে দিলে জীবন সুখের হবে—এই প্রলোভনে তার পরিবার তাকে বেচে দিয়েছিল। তাদের ভাগ্য বদলেছিল। কিন্তু সে? সে তো বন্দী হয়ে গেছে এই সোনার খাঁচায়।
যদিও এখন আর নিজেকে বন্দী মনে হয় না। এখানকার জীবন মন্দ নয়। শব্দর একজন চমৎকার স্বামী।
“কেমন আছেন?”
চমকে উঠল জুলফা। দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তার থেকে তিন হাত দূরে নাভেদ দাঁড়িয়ে আছে। অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা নামিয়ে নিল। কয়েকদিন ধরেই নাভেদকে এড়িয়ে চলছে সে, সেটা নাভেদ টের পেয়েছে কি না বুঝতে পারল না।
নাভেদ এগিয়ে এসে আবার জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন, জুলফা?”
জুলফা মাথা নিচু করে নরম স্বরে বলল, “ভালো।” নিজের ভেতরের অস্থিরতা চেপে রেখে বলল, “সন্ধ্যা হয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি। এখন উঠতে হবে।”
ঘুরে দাঁড়াতেই নাভেদের গলা শুনতে পেল, “কেন এড়িয়ে চলছেন? আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
পা থেমে গেল জুলফার। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। তার চোখে এক চিলতে দ্বিধা। নাভেদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভুল? কিসের ভুল?”
জবাব না দিয়ে হাসল নাভেদ। জুলফার চোখ পড়ে নাভেদের ডান হাতের কাটা দাগটির দিকে। ক্ষতটা দেখে মনে হচ্ছে দুই-তিন দিন আগের। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আপনার হাত কীভাবে কেটেছে?”
“কাজ করতে গিয়ে। তেমন কিছু নয়।”
জুলফার ভ্রু কুঁচকে গেল, “ঔষধ দিয়েছেন?”
তার চোখে চোখ রেখে নাভেদ গাঢ় স্বরে বলল, “আপনাকে আমার খুব মনে পড়েছে।”
অপ্রত্যাশিত কথায় জুলফা হকচকিয়ে গেল। কিছু বলার আগেই নাভেদ যোগ করল, “আপনার চেহারাটা আমার মায়ের মতো। আমি আপনার জন্যই এসেছি। শুধু আপনার জন্যই থেকে গেছি।”
নাভেদের চোখেমুখে মন কেমন করা আকুলতা। প্রাণখোলা আগ্রহ। যেন বহু বছরের আরাধনার পর কাঙ্খিত কিছু পেয়েছে।
জুলফা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
“আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?” নাভেদের গলা কাঁপল।
জুলফা কোনো উত্তর দিতে পারল না। শব্দগুলো তার গলার কাছে আটকে গেছে। হঠাৎ আশেপাশে কোথাও এক ঝাঁক কাক কা-কা করতে করতে উড়ে গেল। সেই শব্দে সম্বিত ফিরে পেল সে।
“আমাকে যেতে হবে।”
তাড়াহুড়ো করে কোনো দিক না তাকিয়ে দ্রুতপায়ে চলে গেল জুলফা।
সেদিন রাতেই জুলফা শব্দরকে কিছুটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলল, “একজন পর-পুরুষ বাড়িতে থাকে, ব্যাপারটা কেমন দেখায় বলুন তো?”
শব্দর অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “কাকে বলছ? নাভেদ পাটোয়ারী? কিছু ঘটেছে নাকি?”
জুলফা একটু থেমে বলল, “না, কিছু হয়নি। এমনি বলছিলাম। আমি তো আছিই, আবার রাইহাও জোয়ান মেয়ে।”
“নাভেদ পাটোয়ারী ভাইজানের খুব বিশ্বাসী লোক, ছেলের মতো দেখেন। তাছাড়া লোক ভালো। সৎ, সাহসী, পরিশ্রমী। কোনো সন্দেহ বা আপত্তি থাকলে বলো। তবে আমার মনে হয়, এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। সে তো অতিথি ভবনেই থাকে।”
জুলফা দ্রুত বলল, “না না, কোনো সমস্যা নেই। জানেনই তো, টইটই করে ঘুরি সারাক্ষণ। অচেনা লোক দেখলে অস্বস্তি লাগে—এমন বড় কিছু না। সমস্যা নেই।”
কথাগুলো বলে সে দ্রুত প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিল।
যে মানুষটিকে বাড়ির প্রধান কর্তা সুফিয়ান ভূঁইয়া নিজেই এমন নির্ভরতায় রেখেছেন, তাকে কি আর শব্দর সরাতে পারবে? তাছাড়া কী কারণ দেখাবে সে?
নাভেদ পাটোয়ারীকে নিয়ে নিজের মনের টান কারো কাছে স্বীকার করতে পারবে? নাভেদকে দেখলেই তার বুকের ভেতর ধড়ফড় করে, গলা শুকিয়ে যায়।
এই অনুভূতিগুলো কি কারো সামনে বলা সম্ভব? এমনকি নিজের কাছেই কি এ কথা বলা যায়?—না, কখনোই নয়।
আমরা সবাই চাইলেই কি নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু করতে পারি? পারি না। ঠিক তেমনই, জুলফাও পারল না নাভেদকে এড়িয়ে যেতে। নাভেদের নীরব যত্ন আর ভালোবাসার ছোঁয়া বারবার জুলফার হৃদয়কে নাড়া দিতে লাগল। তার ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ যেকোনো নারীর মন জিতে নেওয়ার মতো।
প্রতিদিন সকালে ছাদে উঠেই জুলফা দেখে, কেউ একজন তার জন্য ফুল দিয়ে তোড়া সাজিয়ে রেখে গেছে। নিচে তাকালেই দেখা যায় নাভেদকে।
একদিন সুফিয়ান, শব্দর, জুলফা, কোহিনূর আর দুই দাসী মিলে পাটের কাজ দেখতে গেল।
মহিলারা নিপুণ হাতে পাট দিয়ে নানা জিনিস বানাচ্ছে। জুলফার চোখ পড়ে পাটের মখমলি হাতপাখায়। তাতে লাল আর সোনালি রঙের সূচিকর্ম, পাতার নকশা করা। সূক্ষ্ম কারুকাজে মোড়া পাখাগুলো থেকে চোখ সরানোই দায়।
সে একটা পাখা হাতে নিয়ে শব্দরকে বলল, “পাখাটা খুব সুন্দর। একটা নিয়ে যাব।”
শব্দর একটু ইতস্তত করে উত্তর দিল,
“তোমার ইচ্ছের মান আমি সবসময় রাখি। তবে এই পাখাগুলো এখনই কলকাতায় যাবে। হিসেব করেই বানানো হয়েছে। কোনোটা কম পড়লে বড় সমস্যায় পড়তে হবে।”
জুলফা জেদ ধরল।
পাশ থেকে কোহিনূর বললেন, “শখ তো সবারই থাকে। কিন্তু জমিদারবাড়ির নারীরা শুধু নিজের শখ নয়, পরিবারের মর্যাদা আর দায়বদ্ধতার কথা আগে ভাবে। তোমার কাছ থেকে এই ত্যাগ আশা করা অন্যায় নয়। রেখে দাও ওটা।”
জুলফা নীরবে পাখাটা জায়গায় রেখে অন্যদিকে ফিরে তাকাল। তার চোখে অভিমানের জল। শব্দর তাকিয়ে থাকলেও কিছু বলার সাহস করল না।
পরদিন সবাই যখন কাজ নিয়ে ব্যস্ত, নাভেদ সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল সেই হাতপাখাটা হাতে নিয়ে। জুলফার সামনে ধরে মৃদু গলায় বলল,
“দয়া করে মন খারাপ করে থাকবেন না। আপনাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না।”
জুলফা চুপ করে রইল। কিছু বলতে পারল না। শুধু অনুভব করল ভেতরে কোথাও একটা ভাঙন ধরেছে—নিজেকে ধরে রাখার ভাঙন।
সেদিন বৈশাখের সকালটা ছিল মেঘলা। কোহিনূর জুলফা আর এক দাসীকে নিয়ে মাঠে কৃষকদের কাজ দেখতে গেলেন। নাভেদও সেখানে উপস্থিত ছিল। জমিদারবাড়ির লোকজন মাঠে গেলে সেটা গ্রামবাসীর জন্য বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সবাই উদ্যমী হয়ে কাজে করছে।
কিছুক্ষণ পর মেঘ কেটে গেল। রোদের তীব্রতায় মাঠ যেন ঝলসে উঠল। জুলফা ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একসময় পথে পথে জীবন কাটালেও, জমিদারবাড়ির আরাম তাকে ননির পুতুল বানিয়েছে। প্রখর রোদে তার মুখ লাল হয়ে উঠল, ঘামে ভিজে গেল শাড়ি।
নাভেদের নজর এড়াল না কিছুই। কোথা থেকে যেন সে দুটো ছাতা নিয়ে এল।
একটা ছাতা দাসীর হাতে দিয়ে বলল,
“ফুফুজানের মাথায় ধরুন।”
দ্বিতীয় ছাতাটা জুলফার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা আপনার জন্য।”
জুলফা এবারও কিছু বলল না।
নাভেদ পাশ ঘেঁষে যাবার সময় ধীর গলায় বলল, “আমি থাকতে আপনাকে কোনো কষ্টই ছুঁতে পারবে না।”
নাভেদের সাদামাটা কথাটি তীব্র শিহরণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে জুলফার ভেতর। কী যেন ছিল ওই কথার ভাঁজে! জুলফার বুকের রক্ত আবেগে ছলকে ওঠে।
তার দুইদিন পর জুলফার জ্বর পুরো জমিদারবাড়ির অশান্তির কারণ হয়ে ওঠল। ভীষণ জ্বর, মাথা তোলার ক্ষমতাও নেই। মুখে রুচি নেই। বাড়ির সবাই উদ্বিগ্ন। না খেলে সুস্থ হবে কী করে?
শঙ্খিনী তিন-চারদিন একটি বিশেষ স্যুপ খাওয়াল। যার প্রভাবে ধীরে ধীরে জুলফার শরীরে শক্তি ফিরতে লাগল।
কিছুদিন পর জ্বরে শুকিয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে জুলফা ছাদে ওঠে। কথায় কথায় শঙ্খিনীর মুখে শোনে, সেই স্যুপের উপকরণগুলো নাভেদ নিজে হাতে সংগ্রহ করে শব্দরকে দিয়েছিল। তার কথাতেই শঙ্খিনী সেটি বানিয়ে খাইয়েছে। কথাটা শোনার পর জুলফা আর স্থির থাকতে পারল না।
শঙ্খিনীকে বলল, “নাভেদ পাটোয়ারীকে বল, আজ সন্ধ্যায় দক্ষিণের বারান্দায় আসতে।”
সন্ধ্যার আলো ম্লান হতে শুরু করেছে। দক্ষিণের বারান্দায় নাভেদ নির্জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পায়ের শব্দে সে পেছনে ফিরে তাকাল।
জুলফা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। সোজাসুজি তাকিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“কী চান আপনি? কেন করছেন এত কিছু? আমি কি কখনো আপনাকে কিছু করতে বলেছি?”
নাভেদ নরম স্বরে বলল, “আমি শুধু আপনার মঙ্গল চাই। আপনাকে সুখী দেখতে চাই। আর যদি সাহস করে বলতেই হয়, তবে বলি—আমি আপনার বন্ধুত্ব চাই। শুধু একটু বন্ধুত্ব।”
মানুষের মন গভীর সমুদ্রের মতো, কখন কোন ঢেউ কোথা থেকে উঠে আসে, কখন কোন অনুভূতি কীভাবে জেগে ওঠে, তার কোনো নিয়ম নেই। ঠিক যেমন ভোরের কুয়াশা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলে, চোখের সামনে থেকে সব পথ মুছে দেয়, তেমনি করেই মনের মধ্যে জমে ওঠা অনুভূতিগুলো সমস্ত চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
জাওয়াদের মনেও যেন সেই গভীর সমুদ্রের ঢেউ ওঠা-নামা করছে। ভেতরে জমে থাকা অভিমানের কুয়াশা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তার সমস্ত চিন্তাকে।
প্রতিদিনকার অভ্যস্ত জীবনের চেনা ছন্দে আচমকা বিরতি এসেছিল, যেদিন রাইহার জন্য তাকে চন্দ্রেশ্বরীর জমিদার বাড়িতে ফিরতে হয়েছিল। কিন্তু সেই বিরতি ভিন্ন রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল তার জীবনকে।
গুলনূরের উপস্থিতি—তার নীরবতা, শব্দহীন পায়ে চলা, মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি কাজ শেষ করা, নিরবে সব কথা শোনা— এই ছোট ছোট দৃশ্যগুলো জাওয়াদের অন্তরে কোমল, ভালোলাগার স্পর্শ এনে দিয়েছিল।
এখন সেই জীবনের ছন্দ আবার ভাঙতে বসেছে। গুলনূর চলে যেতে চায়। তার এই সিদ্ধান্ত জাওয়াদের হৃদয়কে অস্থির করে তুলেছে। কেন গুলনূর তার সঙ্গে ভালো বোধ করে না? কী এমন ভুল করেছে সে যার জন্য গুলনূর অন্য কোথাও যেতে চায়?
পরক্ষণে নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে ভাবে—গুলনূরের তো তার সঙ্গে থাকার কথা নয়। চলে যাবারই কথা।
সেদিন থেকে গুলনূর কিছু করার আগেই সে নিজেই সব কিছু করে রাখছে। সকালে ঘুম ভাঙতেই প্রথমে নিজে থেকে বিছানা গুছিয়ে রাখে। হাত ধোয়ার পর নিজেই গামছা তুলে নিয়ে হাত মুছে। এমনকি গুলনূর খাবার নিয়ে আসার আগেই নিজের হাতেই খাবার তুলে নিয়ে খেতে বসে যায়।
গত রাতে গুলনূর দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, হাতে পুরনো খাতা আর কলম। চোখেমুখে সংশয়, মাথা নত। দরজার ওপাশ থেকে মৃদু বাতাসে নাম না জানা এক ফুলের গন্ধ এসে ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কিছু হয়েছে?”
গুলনূর কোনো শব্দ না করে খাতায় লিখল, “আমি কি কোনো ভুল করেছি? আপনার মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে দয়া করে ক্ষমা করুন।”
জাওয়াদ কিছুক্ষণ খাতার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল, তারপর শান্ত গলায় বলল, “না। তুমি ভুল করবে কেন?”
গুলনূরের আঙুলের সূক্ষ্ম কাঁপুনি তখনও থামেনি। সে আবার খাতায় লিখল, “ভুল করে থাকলে শাস্তি দিন।”
জাওয়াদ মৃদু স্বরে বলল, “তুমি কিছু করোনি, গুলনূর। চলেই তো যাবে। তাই নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস করছি।”
কথা শেষ করেই হনহনিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল জাওয়াদ। গুলনূর খাতাটা বুকের কাছে চেপে ধরে দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল অনেকক্ষণ।
সেই থেকে জাওয়াদ নিজের মনে যুদ্ধ করছে। কেন তার অন্তরে এত অস্থিরতা? গুলনূর শুধুমাত্র একজন বোবা, অসহায় দাসী। যার প্রতি তার করুণা, সহানুভূতি থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এই মনের টানাপোড়েন? সেটা কেন থাকবে? কেন ওর মায়াভরা চোখের চাহনি বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে? কেন এই অভিমান? কেন এই অন্তর্জ্বালা?
বুকের গভীরে জমে থাকা উৎকণ্ঠা সহ্য করতে না পেরে জাওয়াদ একসময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
অনেক রাতে ভেজা অবস্থায় কাঁপতে কাঁপতে যখন বাড়ি ফিরে আসে, গুলনূর দরজা খুলে দাঁড়ায়। তার দুটি সজল চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া। জাওয়াদ হাঁচি দিতে দিতে ভেজা কাপড়ে ঘরে ঢোকে।
বাইরে তখন বৃষ্টি ঝরছে একটানা। ঝমঝম শব্দে ভিজে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী।
চলবে…
[একটা ভুল, একজনের মোহ কী করে অনেকগুলো জীবনকে নষ্ট করে দেয়, অনেক পাপের সৃষ্টি করে তা নিয়ে এই উপন্যাস। নবোঢ়া অর্থ নতুন বউ। এই নাম শুধু একটা নির্দিষ্ট চরিত্র নিয়ে মানায়। অথচ এই উপন্যাস অনেকগুলো চরিত্রের জীবনগাঁথা। উপন্যাসটা দিনকে দিন আমার মস্তিষ্কের ভেতর মহাকাব্যের রূপ নিচ্ছে। তাই এর নাম আজ থেকে, কৃষ্ণচূড়ার কাব্য।]