#অবন্তিকা_তৃপ্তি
আজ রবিবার! রবিবারে; মাথার উপর শনির ন্যায় নেচে যাচ্ছে সূর্য। দুপুরটা বড্ড খরখরে! তীব্র রোদ আর অসহ্য গরমে অদিতির অবস্থা করুন-বেহাল। কোনোরকমে টিউশন করিয়ে বেরিয়েছে সে। রিকশা খুঁজছে, মহাখালীর এদিকটায় আজকাল রিকশা মেলে না। অদিতি কপালের ঘাম ওড়নায় আগায় মুছে; চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে।
হঠাৎ এক রিকশা ওর সামনে এসে দাঁড়াল। রিকশাওয়ালা মামা রিকশার প্যাডেল থামিয়ে; মুখে হাসি টেনে বললেন—-‘ ভাবি; ছলেন , আপনারে হোস্টেলে নামায় দেই।’
অদিতি ভ্রু কুঁচকাল। ‘ভাবি’— শব্দটা ইদানীং ঘুমের মধ্যেও ওর কানে বাজে। সারাক্ষণ ভার্সিটি, রোডে এ, নাহলে ও ভাবি ডেকেই চলেছে। কোন ভাইয়ের বউ হয়ে আছে ও; খোদা জানে। অদিতি কাঁধের ব্যাগটা এক হাতে চেপে ধরে; চাপা স্বরে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো——-‘আপনাকে কে পাঠিয়েছে, মামা?”
‘ধ্রুব ভাইয়ে।’ ——বলে রিকশাওয়ালা ইশারা করল পেছনে; কাউকে খুঁজতে লাগলো যেমন। অদিতিও অবাক হয়ে পেছনে তাকাল; কেউ নেই সেখানে। ওর মুখ থমথমে হয়ে এলো; যা বোঝার সে বুঝে গেল। সে সামনে আসবে না; অথচ ঠিকই অদিতির আশেপাশে না থেকেও কেমন করে সে থেকে যায়। অদিতির ঠোঁটে না চাইতেই হাসি চলে এল! পরপর ও নিজেকে শাসিয়ে; হাসি লুকিয়ে ভ্রু–ট্রু কুঁচকে তাকালো।
ওপাশ থেকে রিকশাওয়ালা মামা অদিতিকে এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে; অবাক হয়ে বললেন—-‘ভাবি আপনে যাইবেন না? ধ্রুব ভাইয়ে বকবো আমারে।’
আবারও এই অসহ্য ‘ভাবি’ -ডাক। অদিতি এবার কিছুটা কঠোর গলায় বললো—-‘মামা; আমি বিয়ে করিনি আপনার কোনো ধ্রুব ভাইকে। আমাকে ভাবি আল্লাহর ওয়াস্তে ডাকবেন না।’
রিকশাওয়ালা মামা যেন ভারি অবাক হলেন! অদিতির গরম-গরম রাগ দেখে উনি মিইয়ে গিয়ে বললেন—-‘ভাবি, আপনাগো কি ঝগড়া হইসে? ঝগড়া করিয়েন না; ধ্রুব ভাইয়ে ভালা মানুষ; একদম মাটির মানুষ। রিকশায় উঠে আহেন; রোদে দাঁড়ায় আবার কিসের রাগ?’
অদিতির এবার ইচ্ছে হচ্ছে— মাথার সবগুলো চুল টেনে ছিড়ে ফেলতে। ভাইর নাই প্রেমের খবর; তার সঙ্গে আবার নাকি রাগ করাও হয়। অসহ্য এবং বিশ্রী রাগে মাথার ভেতরটা অব্দি ধবধবিয়ে উঠল। অদিতি আর দাঁড়ালো না; দ্রুত উঠে বসলো রিকশায়; ব্যাগ কোলের উপর রেখে বললো—-‘মামা; যান তো যান।’
মামার খুশি কে দেখে! আজ অদিতিকে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে পারলেই; করকরে এক হাজার টাকার নোট মিলবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। রিকশাওয়ালা মামা ধ্রুবর নির্দেশ মতো; শেষবারের রিকশা চালানোর আগে একবার অদিতির জামা, ওরনা দেখে নিল, কোনোভাবে ওরনা ওর চাকায় আটকে গেলে মহা বিপদ হয়ে যাবে। ধ্রুব ভালোর ভালো; খারাপের খারাপ! মাইর লাগাবে ধরে! উনি সাবধানে সব দেখে নিয়ে; স্বস্থির শ্বাস ফেলে রিকশা চালানো শুরু করলেন।
অদিতি অস্বস্তি নিয়ে রিকশায় বসে আছে। ওর মনে চলছে অন্য ভাবনা! ধ্রুব এসব করে কী বোঝাতে চাইছে? সে কি সত্যি অদিতির প্রেমিক হয়েছে?অদিতি তাকে ফিরিয়ে দেবার পরেও; ওর আশেপাশে থেকে ওকে এভাবে দুর্বল করে দিয়ে কি শান্তি পাচ্ছে ওই ছেলে? অদিতির বুকের মধ্যে ভোঁতা এক যন্ত্রণা হচ্ছে। ওর বেহায়া মন বারবার বেহায়া কিছু করে বসতে চাইছে; অথচ মস্তিষ্ক আটকাচ্ছে ওকে।
মাঝরাস্তায় অদিতির ফোনে কল এলো। রিকশায় বসে থেকেই ফোন রিসিভ করলো সে। অদিতি সালাম দিল; ফাহিমা ওপাশ থেকে বললেন—-—‘কি রে মা, কবে আসবি বাড়ি? তোর কলেজ বন্ধ দিবে কখন রে?’
অদিতি হালকা গলায় উত্তর দিল—-‘পরশু থেকে ছুটি আছে, সাতদিনের। দেখি আসতে পারি কিনা।’
ফাহিমা এবার একটু দোনামনা করতে লাগলেন; উশখুশ করছেন কিছু বলার জন্যে। অদিতি যেন বুঝে ফেললো; ও লাই দিয়ে বললো—-কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো, মা। আমার সামনে এত কি ভাবছো?’
ফাহিমা কিভাবে কথাটা উঠবেন বুঝতে পারছেন না। এই ব্যাপারে উনার নিজেরও তেমন মত নেই। শুধু স্বামীর চাপে পরে মেয়ের চলার পথে বাধা হতে মন চাইছে না। তবুও উনি বললেন; অপ্রস্তুত গলায়——‘আসলে…তোর জন্য একটা বিয়ের আলাপ এসেছে। ছেলে পাশের গ্রামের, ঢাকাতেই চাকরি করে। তোর আব্বা রাজি। বলছিলেন, যদি আকদ করিয়ে রাখি…’
অদিতির বুকটা ধ্বক করে উঠলো সঙ্গেসঙ্গে। চোখের সামনে ধ্রুবর পাগলাটে মুখটা ভেসে উঠল; ভেসে উঠল সেদিন রাতের ধ্রুবর শিহরণ জাগানো একেকটা ছোঁয়া! অদিতির শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে; ও চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। তারপর থেমে থেমে বলল,—-‘ মা; এ..এখনই এসব কেন? আমি তো এখনো প..পড়াশোনা করছি।”
ফাহিমা মেয়ের কথার উত্তরে কি বলবেন; খুঁজে পেলেন না। একই কথা উনি নিজেই স্বামীকে বলেছেন; তোফাজ্জল এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। ফাহিমা গলাটা নরম করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেন——-‘উঠিয়ে তো নেবে না রে। এবার বাড়ি এলে ওরা যদি দেখে পছন্দ করে, তবে পরে কথা এগোবে।”
এ কথা শুনে অদিতির বাড়ি যাওয়ার যেটুকু ইচ্ছা ছিল, তাও মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। ওর এতদিন শুধু ধ্রুবর থেকে পালানোর জন্যে বাড়ি যাওয়ার জন্যে ছটফট করছিলো। আর এখন? সেখানেও আরেক বিপদ ছুটে আসছে। এখন কোথায় যাবে অদিতি?
অদিতি যেটুকু বলার ছিলো; সেই কথাটাও মুখ থেকে বের করতে পারলো না। বাড়ি না যাওয়ারও আর কোনো অজুহাত দেখাতে পারবে না। তবুও ও চেষ্টা করলো, বলল——‘আমি রিকশায় আছি, মা। আর এই মাসে ছুটি পাবো কি না এখনো তো নিশ্চিত হয়নি। রুমে গিয়ে তোমার সাথে কথা বলি?’
ফাহিমা উত্তরে কচু বলার আগেই; উনার কথার মাঝপথেই ফোনটা কেড়ে নিলেন অদিতির বাবা তোফাজ্জল। বাবার গমগমে গলা শোনার সাথেসাথে অদিতির শ্বাস আটকে এলো; গা কাঁপতে লাগলো।
তোফাজ্জল ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করার ধার ধারলেন না; শুরুতেই বলে ফেললেন——‘অদিতি, তুমি পরশুর ট্রেন ধরে বাড়ি আসছো!আমি ছেলেদের কথা দিয়ে ফেলেছি, এখন তোমার বাবার মুখ রাখা উচিত তোমারই, আমি কি ঠিক বলছি?”
অদিতি কিছু বলার সাহস পেল না; হাত কাঁপছে তার। ও ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো—-‘আ…আমি আসব, আব্বা।”
তোফাজ্জলকে শান্ত হতে দেখা গেল; উনি গমগমে গলায় বললেন——‘তোমার ট্রেনের টিকিট আমি কেটে রেখেছি সামনের সপ্তাহে। সময়মতো চলে আসবে, আর রিকশায় বসে এত কথা বলার দরকার নেই। রুমে গিয়ে কল করো।”
অদিতি মাথা নাড়লো; তারপর সালাম দিয়ে কল কেটে দিল। ফোন কেটে ও ফোনটা দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরলো! ধ্রুব; ধ্রুব পাগল হয়ে যাবে এসব শুনলে! অদিতি; অদিতিও তো ঠিক নেই। ধ্রুবকে যতই ফিরিয়ে দিক; দিনশেষে যেটুকু ফেঁসে যাওয়ার ও তো ফেঁসেই গেছে। অদিতির চোখ টলমলে হয়ে যাচ্ছে, ও অনেক কষ্টে কান্না আটকে রাখল পুরোটা রাস্তায়।এদিকে ওদের পুরো কথোপকথন রিকশাওয়ালা মামা কান খাড়া করে শুনছিলো।
____________
ধ্রুব সারাদিনের ছোটাছুটি শেষে সবে রুমে ফিরেছে। রুমটা ওর বড্ড অগোছালো! ড্রয়ারের ওপর জিন্স-শার্ট ছড়ানো, বিশাল আয়নার কোণে ঝুলিয়ে রাখা টাওয়াল, বিছানার একপাশে স্তূপ করে ফেলে রাখা কাপড়-চোপড়। রুমে ঢুকেই এসব দেখে ধ্রুবর মেজাজ বিগড়ে গেল।ও ভ্রু-ট্রু কুঁচকে মহা বিরক্ত হয়ে কাপড়ের স্তূপ একপাশে সরিয়ে বিছানায় বসলো। বসে পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে দেখল; এলোমেলো রুমের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে ওর মনে হলো——বিয়ে করার পর তার রুম তো আর কখনোই এমন থাকবে না। অদিতি তার গোলগাল-নরম হাত দিয়ে ধ্রুব; ধ্রুবর রুমকে ঠিক গুছিয়ে নেবে। ধ্রুবকে অন্ধকার থেকে টেনে আনবে আলোর দিকে।
অদিতির কথা ভাবতেই ধ্রুবর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। ধ্রুবর এখন ইচ্ছে করছে, অদিতির কাছে একবারে ছুটে যেতে। নতুন প্রেমে পরলে কি মানুষ এমন পাগল হয়ে যায়? নিজের ভাবনাতেই নিজেই হেসে ধ্রুব মাথার চুল একহাতে এলোমেলো করে ফেললো। তারপর হেসে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে নিজেকে আগাগোড়া দেখলো। আজ রাজন বলছিল—ধ্রুব নাকি বদলে যাচ্ছে,প্রেমের সব সিমটম নাকি ওর মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে? ধ্রুব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই সিমটম-গুলোই খুঁজে চলেছে। তার মধ্যে কি সত্যিই অনেক পরিবর্তন এসেছে?প্রেমে পড়ে কি মানুষ এতটা পরিবর্তন হয়?
এমন সময় ফোন এলো। ধ্রুব মুখ স্বাভাবিক করে পুরনো গম্ভীর রূপে ফিরে এসে; এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপর থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কেউ তাকে কিছু বলল। সব শুনে হঠাৎ ধ্রুবর মুখটা থমথমে হয়ে গেল। ও ঠান্ডা গলায় শুধু বললো—–‘করাচ্ছি বিয়ে উনাকে।’
ধ্রুব ফোন কেটে পকেটে পুড়লো। দ্রুত হেটে গিয়ে বিছানার উপর থেকে শার্ট নিয়ে গায়ে দিল; তারপর বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল রুমের বাইরে। ড্রয়িং রুমে আসতেই পেছন থেকে সৌরভ এতরাতে ছেলেকে বাইরে যেতে দেখে ডাক দিলেন——-‘এত রাতে কোথায় যাচ্ছো?
ধ্রুব ফিরেও তাকাল না। ওর এখন বড্ড তাড়া, মাথায় চড়ে আছে আশি কেজি ওজনের জেলাসি। ও কোনো জবাব না দিয়েই দ্রুত পা চালিয়ে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল।
অদিতি সেই কখন থেকে সামনে বই নিয়ে বসে আছে। কিন্তু তার আজ পড়াশোনায় একদমই মন বসছে না। পুরো মন জুড়ে ধ্রুবর চিন্তা; ওর ভাবনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে অদিতির মনে হয়; ওর মস্তিষ্ক আর ওর নেই; পুরোটাই ধ্রুবর দখলে চলে গেছে। শান্তি দিচ্ছে না এই ভাবনা-গুলো ওকে।
অদিতি ভাবছে; এবার বাড়ি গেলে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে, এটা জানলে ধ্রুব কী করবে? কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ফেলবে হয়তো। শুধু ধ্রুবই নয়, অদিতি নিজেও চাইছে না ছেলেপক্ষের সামনে যেতে। গ্রামের ছাপোষা মেয়ে অদিতি কীভাবে এমন একটা বখাটে প্রেমিকের প্রেমে পরে গেল, কে জানে? প্রেমে পরলো তো; তার উপর তার প্রেমে পরে এই করুণ হাল; মানুষ কি বলবে? অদিতির ভালো লাগছে না কিছুই। কি করবে? কাকে বোঝাবে মনের এই ব্যথা-গুলো, অসহ্যকর এই দ্বিধা-গুলো?
অদিতি মনের এক টানাপরনে হঠাৎ টেবিলের উপর রাখা ওই ফোন বেজে উঠলো। অদিতি ভাবনার মধ্যেই চমকে উঠলো। নম্বর সেভ করা নেই;ও ভ্রু কুঁচকে বইটা বন্ধ করে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে একটা থমথমে গলার স্বর ভেসে আসলো——-‘ধ্রুব বলছি। নিচে আসো; আ’ম ওয়েটিং।’
অদিতি চমকে উঠে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে চোখের সামনে ধরল। ভালোভাবে নম্বরটা দেখল; এটা কি নতুন কোনো নম্বর তার? ধ্রুব কীভাবে এতবার নম্বর পাল্টায়; ভেবে পাচ্ছে না ও।
অদিতি ফোনটা কানে লাগালো ধীর হাতে; ঢোক গিলে সরাসরি বলার চেষ্টা করলো—-‘আ..আমি আসতে পারবো না। রাত অনেক হয়েছে; বাড়ি চলে যান প্লিজ।’
ওপাশ থেকে ধ্রুব যেন ব্যঙ্গ করে হাসল; কপাল আঙুলে চুলকে নিতে নিতে উপরের দিকে অদিতির জানালার দিকে তাকিয়ে বলল —-‘ফিফথ ফ্লোর; রুম নম্বর ৫০২; রাইট অদিতি?’
অদিতি চমকে উঠল; দ্রুত গিয়ে জানালার পাশে দাড়িয়ে নিচে তাকালো; ধ্রুব ওর দিকেই চেয়ে আছে। অদিতি আঁতকে উঠে বুকে ফুঁ দিয়ে সরে গেল আড়ালে; ভীতু গলায় বলল—-‘আ..আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?’
ধ্রুব এবার কঠোর গলায় স্পষ্ট করে বলে ফেলল—-‘আমি উপরে উঠব নাকি তুমি নিচে আসবে? আমাকে দয়া করে আর জ্বালিও না, অদিতি। আমি জ্বললে ঝাঁঝরা করে ফেলবো তোমাকে; জানো তো?’
অদিতি ঢোক গিললো! একবার বলে দিয়েছে; উপরে আসবে মানে চলে আসবেই। যা ঘাড়ত্যাড়া ছেলে! অদিতি অজুহাত দেখানো শুরু করলো এবার—-‘নিচে দারোয়ান আছে।’
ওপাশ থেকে ধ্রুব হাসে;কৌতুক শুনেছে যেমন তেমন করে বললো—-‘আমার মতো দারোয়ানও তোমার জন্যে ওয়েট করছে,বেচারা ঘুমে ঢুলছে। নিচে নামো তুমি।’
দারোয়ান ওর নিচে নামার অপেক্ষা করছে? এটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না অদিতির। এই দারোয়ান অনেক রাগী; রাত দশটা বাজলেই গেট বন্ধ করে ফেলে। রাত এগারোটায় কীভাবে তার জন্য গেট খুলে রেখেছে?
ধ্রুব ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে; ফোন কাটার আগেও অবশ্য কয়েকবার শাসিয়েছে। ওদিকে অদিতির মন মানছে না। ভেতরের মন বলল, যা; প্রেমিক ধ্রুবের জন্যই তো মন খারাপ করে বসে ছিলি এতক্ষণ।
কিন্তু মস্তিষ্ক বলল, নিজেকে আটকে রাখ; অদিতি। নিজের বিপদ তুই নিজেই ডেকে আনছিস।
অতঃপর শেষ পর্যন্ত মনের কথাই জিতলো। অদিতি চাদর দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে, মুখ লুকিয়ে বেরিয়ে এলো। গেইটের সামনে আসতেই দারোয়ান মুখ ভরে হেসে দরজা খুলে দিল। অদিতি শুধু অবাক হয়ে দেখছিল দারোয়ানের আচরণ-গুলো।
গেইট পেরিয়ে আসতেই দূর থেকে ধ্রুবকে দেখতে পেল। ব্যাস; ওর মন বেপরোয়া গতিতে লাফানো শুরু করে দিলো। অদিতি বুকের বা-পাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখ বুজে জোরে-জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করল। তারপর চোখ খুলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ধ্রুবর সামনে। ধ্রুব ওর দিকে পিঠ করে আছে; অদিতি আস্তে করে ডাকল——‘শুনছেন?”
ধ্রুব ঘুরে তাকাল। ধ্রুবর চোখ-দুটো অদিতির চোখ আটকে গেল। দুজনেই ভেসে গেল এক অন্য দুনিয়ায়! অদিতির মাথা ঢেকে রাখা চাদরে; ধ্রুবর মাথায় ক্যাপ! অন্ধকারে দুজন দুজনের চোখে কি এমন দেখলো কে জানে! দুজনের মধ্যে একে অন্যের জন্যে যেটুকু রাগ; ঈর্ষা ছিলো সব দূর-দূর করে পালিয়ে গেল। বাকি যেটুকু থাকল; সেটুকু শুধুই ভালোবাসা। একজনের প্রকাশিত প্রেম; অন্যজনের অপ্রকাশিত।
অদিতি নিজের চোখ বড্ড কষ্টে সরালো; অন্যপাশে চেয়ে হৃদয়ের যন্ত্রণা চেপে; ধীমে গলায় জিজ্ঞেস করলো——‘ক…কেন ডেকেছেন?’
ধ্রুবর ধ্যান ফিরলো; ও চোখ সরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালালো। তারপর আবার তাকাল অদিতির দিকে। ধীরে ধীরে ওর চোখে সেই ‘আশি কেজি ওজনের’ জেলাসি ফুটে উঠল; ধ্রুব ঠান্ডা গলায় বললো——‘ছেলেটা কি করে?ওই শা* কি আমার চেয়েও অনেক বেশি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছে?’
অদিতি শুরুতে বুঝতে পারল না ধ্রুব কি বোঝাতে চাইছে? ও অবাক চোখে ধ্রুবর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল; জিজ্ঞেস করলো——-‘কোন ছেলের কথা বলছেন?’
ধ্রুব এবার নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না; অদিতির হাত টেনে ধীরে নিজের সঙ্গে ওকে মিশিয়ে নিলো! অদিতির বাহু দুহাতে দুদিকে চেপে ধরে চোখে চোখ মিলিয়ে; চেঁচিয়ে বলে গেল শুধু নিজের ঈর্ষার কথা——‘কোনো ছেলেপক্ষের সামনে তুমি একদম বসবে না অদিতি; কসম তোমার। যদি বসো; তুমি জানবেও না আমি ওই ছেলেকে কি করে ফেলব। আমি ধীরে ধীরে নিজের রাগ কন্ট্রোল করছি; জাস্ট বিকজ অফ ই্যয়ু! আমাকে আমার পুরনো রাগ ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করিও না অদিতি; প্লিজ।’
ধ্রুবর রাগের পারদ লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছিল। ও অদিতির সামনে নিজের রাগী সত্ত্বা প্রকাশ করতে চায়নি; কিন্তু ও নিজেকে আটকেও রাখতে পারেনি। অদিতি বড়বড় চোখে ধ্রুবর রাগ আর ঈর্ষা দেখছিল। ধ্রুবর এই অস্থিরতা দেখে অদিতির ভেতর নড়ে উঠল যেমন।ও ভয়ার্ত মুখে ধ্রুবকে দেখছিল। অদিতির ভয়ার্ত মুখ দেখে আচমকা ধ্রুবর ওর হুশ ফিরলো; কি করছিল ও এতক্ষণ?
ধ্রুব ওর চোখের দিকে চেয়ে; আচমকা ওকে ছেড়ে দিলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে; নার্ভাস গলায় নিচু স্বরে বলল——‘ স..সরি!’
তারপর; ও পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে গেলো; কোমরে হাত রেখে জোরেজোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। ধ্রুব চোখ বুজে নিজের রাগটুকু সামলাচ্ছিল;আর অদিতি শুধু অবাক চোখে ওকে দেখে যাচ্ছিলো। ধ্রুব এই প্রথমবার ওর উপর এমন রাগ দেখাল; এসব কি শুধুমাত্রই অদিতি ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে সেজন্যেই?
অদিতির হঠাৎ কি যে হলো। ও নিজের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে ধ্রুবর বাহু স্পর্শ করলো। ধ্রুব অবাক হয়ে ফিরে তাকাল! ওর হাতের দিকে একবার তাকিয়ে; অদিতির চোখের দিকে তাকাল। অদিতি ধ্রুবকে শান্ত করার ভঙ্গিতে বলল—-‘একটু শান্ত হোন; প্লিজ! আমি রাজি নই এই বিয়েতে। আমি পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি।’
ধ্রুব স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল; ওর চোখ-দুটো অদিতির চোখে আটকে আছে। অদিতির হাতটা তখনও ধ্রুবর শক্ত বাহু ছুয়ে আছে। দুজনেই দুজনের চোখের দিকে চেয়ে!
তারপর; হঠাৎ ধ্রুবর পুরুষালি মনে মনে খুশি দৌড়ঝাপ করে উঠলো; তার অদিতি কি আজ তাকে কৈফিয়ত দিচ্ছে? এই অধিকার কি সে ফাইনালি পেয়েই গেছে?
#চলবে
এই পর্ব শেষ হয়নি; ওদের কথা শেষ হয়নি। এখানে আরো অ্যাড হবে আগামী পর্বে। বিশালেষ্ট পর্ব!গল্পের মোড় আর আগামী পর্বেই ঘুরে যাবে; ওয়েট!
মনখুলে সবাই রিয়েক্ট-কমেন্ট করবেন প্লিজ!
পর্ব ভালো লাগলে বা না লাগলে, আপনারা গ্রুপে এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
অবন্তিকা তৃপ্তির পার্সোনাল গ্রুপ লিংক- https://www.facebook.com/share/g/5XQheuegTGqc2anJ/?mibextid=K35XfP