#পিশাচ দেবী
৩য় পর্ব
.
এরপর প্রায় মাস পেরিয়ে গেল। আকলার জীবন আবার আগের মতো চলতে লাগলো। সেদিন স্বপ্নে দেবী হারমাকে দেখার পর থেকে এই পর্যন্ত আর তার কোনো অস্তিত্ব তিনি জানান দেননি আকলাকে। গোষ্ঠীর লোকেদের মাঝে যে ফিসফিসানি ছিল পিশাচ দেবী হারমাকে নিয়ে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
আকলার মন থেকে অবশ্য তিনি গেলেন না। সে দিনের অনেক সময়ই দেবীর কথা ভাবে। এমনকি ঘুমানোর আগেও। এই দেবীর কারণে কী এমন ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছিল এই গোষ্ঠীতে, যে দেবীকে তারা বিতাড়িত করল! এমন কী তার নাম নেয়াও নিষিদ্ধ! কিছুই জানে না আকলা। এই সম্পর্কে ভালো বলতে পারবে গোষ্ঠীর বৃদ্ধরা। কিন্তু তারা বেশির ভাগই মানজা বু এর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এই বিষয়ে কথা বলবেন না।
দেবীকে সেদিন স্বপ্নে নিজের রূপে পুকুরে দেখার পর থেকে কেমন যেন ভয় করতে লাগলো আকলার দেবীকে। এক অজানা অনুভূতি শরীরটাকে কাঁপিয়ে তোলে দেবীর কথা মনে এতেই। দেবীকে সে ভুলে থাকতে চাইছিল। কিন্তু পারছিল না কিছুতেই।
অনেকদিন পর আজ রাতে সে ঘুমানোর আগে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো , ” হারমা , হারমা , হারমা , হারমা…..”
স্বপ্নে আবার সেই মাটির ঘরের সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। সামনে ঝোপের কারণে কিছু না দেখা গেলেও আকলা জানে সেখানে একটা পুকুর আছে। তবে আজ সেদিনের মতো জোৎস্না নেই। ঘরের সামনে ঝুলে থাকা হারিকেনের আলোতে চারপাশে তাকালো একবার। নিস্তব্ধ অন্ধকার। এরপর ঘরের ভেতর থেকে অসুস্থ কণ্ঠের একটা গোঙানির শব্দ শুনলো সে। কিছুটা চমকে হারিকেন হাতে নিয়ে ধীরও পায়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আলোতে , চকিতে শুয়ে থাকা অপরূপ সুন্দর মেয়েটাকে দেখতে পেল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না আকলা। হারিকেনের আলো ফেলে অপলক ভাবে মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। এত সুন্দর মুখ!
ধীরে ধীরে মুখায়বটা পরিচিত লাগতে লাগলো। তার মায়ের মুখ! শুধু মুখের রংটা আরো ফর্সা, চোখগুলো আরো বেশি সুন্দর , মুখ নিখুঁত। আর সবচেয়ে অপরিচিত , বেমানান লাগলো মুখে লেগে থাকা মিষ্টি হাসিটা। সে তার মাকে এত মিষ্টি করে হাসতে কখনই দেখেনি।
মা!
চিনতে পারিস?
আপনি দেবী ? বহুরূপী দেবী ! আমার মায়ের মতো দেখতে।
রূপতো আমার শরীরের অংশ বিশেষ রে। আমার রূপ ইতো তোদের সবার ভেতর রয়েছে। তোদের সবার রূপ আমার ভেতর।
আপনি বাস্তবে আমার সামনে আসেন না , কেন ?
তোরা ডাকলেই আমি আসবো। আমিতো তোদের জন্যই।
কিন্তু ওরা যে বাধা দেয় আপনার নাম মুখে নিতে। বু আর লোকেরা।
ওরা সঠিক পথ রেখে ভুল পথ বেছে নিয়েছে। সহজ পথ ছেড়ে জটিল পথ। সবাই আবার সঠিক পথে চলে আসবে। শুধু শুরু করতে হবে তোকে। তুইই আমাকে আবার তোদের গোষ্ঠীতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবি। ফিরিয়ে আনতে পারবি হারানো গৌরব।
কিভাবে?
বিনিময়! এর মাধ্যমেই সব মঙ্গল হবে। উপকারের বিনিময়ে উপকার। আমার ক্ষুধা মেটাতে হবে তোদের। আমার যে খুব ক্ষুধা! তোদের গোরস্থানে আমার প্রবেশ নিষেধ। ওখানে আমি যেতে পারি না । গেলেই দুর্বল হয়ে যাই। তোরাই পারবি আমার ক্ষুধা মেটাতে।
এবার চোখ-মুখ শুকিয়ে আসে আকলার। এখানে গোরস্থানের কথা আসছে কেন ! তার মনে পড়ে দেবীর বলা সেই কথা , ” যা তোরা মাটিকে খাওয়াস। অথচ মাটির তার প্রয়োজন নেই । প্রয়োজন আমার!”
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপ নারী মূর্তিকে এই প্রথম ভয়ঙ্কর লাগলো তার কাছে। বুঝতে পারলো কেন এই দেবীকে সবাই পিশাচ বলে। স্বপ্নেও আকলা প্রচুর পানি পিপাসা অনুভব করতে পারল। ইচ্ছা করলো ছুটে পালায়। সে আৎকে দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচিয়ে বলে ওঠে :
এ আমি কিছুতেই পারবো না। কেউই পারবে না। কেউই করবে না! এ অন্যায়, অনাচার!
কেন করবে না? এর বিনিময়ে কী এমন জিনিস , ইচ্ছা , চাহিদা আছে তোদের যা আমি মেটাবো না ? তোকে রক্ষা করেছি। তার বিনিময় নাই দিলি। কিন্তু তোকে যদি তোর পিতৃপরিচয় জানিয়ে দেই আমি। তবে ?
আকলা দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার আবার বিছানায় শুয়ে থাকা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল :
আপনি অন্তর্যামী! আপনি জানেন আমি আমার পিতার নাম জানি!
তুই মনে করে দেখতো তোর মা একবারও বলেছিল কিনা যে তোর বাপ মানজা বু ? সে শুধু তোর বাবার ব্যাপারে বলতে গিয়ে এই নামটা নিয়েছিল। মানজা বু যে তোর বাবা তা বলেনি। পুরো কথা শেষ করার আগেই মারা যায়। মনে করে দেখ!
ভাবনায় ফেলে দেয় কথাটা আকলাকে। সে জেদের সঙ্গে বলে :
আমি ঠিক জানি ! তিনিই আমার বাবা। আপনি আমাকে বোকা বানাচ্ছেন।
তোর মা এমন একটা পাথর ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে তোর বাবার নাম কখনো প্রকাশ করবে না সে। এটাতো তোকে তোর মা অনেক বার বলেছে ? তুই জানিস তোদের গোষ্ঠীর সেই পবিত্র পাথরের প্রতিজ্ঞা কেউই ভাঙে না শত বিপদেও। তোর মাও ভাঙেনি। সে মানজা বু এর নাম এই কারণে নিয়েছিল কারণ তোর পিতার কথা সে ছাড়া আর কেউ জানে না। এটাই সে বলতে চাইছিল।
আর কেউ জানে না!
আর জানে তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অন্তর্যামী। একবার ভেবে দেখ আমি চাইলেই গোষ্ঠীতে তোর বাবার নাম প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। কেউ আর তোকে পিতার পরিচয়হীন বলবে না। তোকে ছোট করে দেখবে না। শরীরের দিকে তাকা। এই উৎলে ওঠা যৌবন আটকে রাখবি কী করে ? তুই জানিস পিতৃপরিচয়হীন কন্যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একা থাকবে। না স্বামী , না সন্তান। একা ঘরে কুমারীত্ব নিয়ে ধুকে ধুকে বৃদ্ধ অবস্থায় মরবি। যেমনটা তোদের গোষ্ঠীর অনেক মেয়ের পরিণতি হয়েছে। তুই কী এমনটাই চাস?
আকলার কাছে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। দেবীর কথাগুলো এলোমেলো হলেও সত্যি। পরিচয়হীনতার কারণে তাকে কেউ বিয়ে করবে না , সম্মান পাবে না সে , তার বৈধ সন্তান হবে না , চাইলেই একটা সময় জোরপূর্বক তাকে ভোগ করলেও কাউকে বু শাস্তির আওতায় আনবে না। এই নিয়ম! এটাই তার মতো পিতৃপরিচয়হীন মেয়ের জীবনের পরিণতি। এটাকেই মেনে নিতে হয়! ভাবনার মাঝেই সে বুঝতে পারলো তার নিয়ন্ত্রণ নিজের মধ্যে নেই। সে ঝুঁকে দেবীর পা স্পর্শ করল। তার মাথায় তার হাতের স্পর্শ পেতেই ঘুম ভেঙে যায়।
তিন দিন পর , মাঝরাত ।
পিশাচদের বসবাস এই অঞ্চলে প্রায় হাজার বছর ধরে। গোরস্থানটাও শত বছরের পুরনো। এই গোষ্ঠীর পূর্ব-পুরুষেরা বুঝতে পারে পিশাচদের কারণে মৃত্যুর পরেও তারা নিরাপদ না । অনেক সময় দেখা যায় কবর দেওয়ার রাতেই গোরস্থানে পিশাচের আগমন ঘটেছে। ছিন্ন-ভিন্ন করে ছিড়ে লাশটা খেয়ে শুধু হাড্ডিগুলো ফেলে যেত। আবার মাঝেমধ্যে পুরো লাশটা নিয়েই অদৃশ্য হয়ে যেত , কোনো নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিয়ে ক্ষুধা মেটানোর জন্য। কিছু কিছু পিশাচ মায়াবলে লাশ নিয়ে যাওয়ার পর কবরটা আবার আগের মতো করে রাখতো যাতে লাশ চুরির ব্যাপারটা কেউ টের না পায়।
এইসব বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পূর্বপুরুষেরা গোরস্থানটাকে নানান রীতিনীতি করে এমন ভাবে রূপ দিয়েছে , মন্ত্রবলে দীর্ঘদিন সাধনা করে এমন মায়ার বাধা সৃষ্টি করেছে যে পরবর্তীতে আর কোনো পিশাচ এই গোরস্থানে প্রবেশ করতে পারবে না । হয়েছেও তাই। কয় যুগ হবে এই গোরস্থানে কোনো পিশাচের প্রবেশ ঘটেনি। কিন্তু মানুষের প্রবেশ করতে তো দোষ নেই। গোরস্থানটাই তো মানুষেরই!
সেই মায়া শক্তিই গোরস্থানকে পিশাচদের থেকে রক্ষা করেছে এতদিন। অনেক পিশাচ অন্যত্র চলে গেছে , মারা গেছে ক্ষুধার্ত হয়ে। আবার তাদের অলৌকিক শক্তির উদারতা অনেক পিশাচকে পূজনীয় করে তুলেছে মানুষের কাছে। তাদের মায়া শক্তি , মানুষের সব চাহিদা পূরণের অলৌকিক শক্তির ব্যবহার অনেক মানুষকেই প্রলুব্ধ করেছে তাদের অনুসারী হয়ে খাবার যোগানের। বিনিময় , বিনিময়, উপকার , উপকার খেলা!
আজ সকালেই মারা গিয়েছিল গোষ্ঠীর ফিরো , আর আনারা এর ৮ বছরের বাচ্চা মেয়েটা সাপের কামড়ে। দুপুরেই সব আয়োজন শেষ করে মানজা বু এর অনুমতি নিয়ে এই গোরস্থানে কবর দেওয়া হয় তার। সেই কবরটাই এখন খুঁড়ছে আকলা হারিকেনের মৃদু আলোতে।
অনেক দিন ধরে এই গোরস্থানে লাশ চুরি হয়না বলে কেউ পাহারায় থাকে না। তবুও কাঁপছে-ঘামছে আকলা , সতর্ক দৃষ্টিতে চার-পাশে তাকাচ্ছে বারবার ।
সেই রাতের পরে আরো একবার স্বপ্নে দেবীর সঙ্গে কথা হয়েছে তার। দীর্ঘ আলাপন শেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় যাতে তার পিতার পরিচয় গোষ্ঠীতে প্রতিষ্ঠিত হয় আর তার জীবনটা সহজ হয় সেই পথেই যাবে সে। দেবী হারমা তার উপকার করবেন। কিন্তু বিনিময় লাগবে! সেই বিনিময়ই জোগাড় করছে সে। লাশের কাছে পৌঁছে গেছে সে। ওপরের মাটি সরাতেই কলা পাতা দিয়ে মোড়া লাশটা দেখতে পেল সে।
ভয়ে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এখনো চিন্তা করছে কাজটা কী তার উচিত হচ্ছে কিনা। না, সময় নষ্ট করা যাবে না! মেয়েটার ওজন বেশি না। সহজেই কবরের ওপর তুলে কবরটা আবার মাটি দিয়ে ভরে দিল সে। অনেকটা সময় লাগলো।
এক হাতে হারিকেন নিয়ে পাঁজাকোলা করে লাশটা নেওয়া যাবে না। বাহুর সঙ্গে লম্বালম্বি করে জড়িয়ে লাশটা নেয়ার সাহস হচ্ছে না আকলার। সেক্ষেত্রে লাশটার মাথা থাকবে তার কাঁধে। তার মনে হবে যেকোনো মুহূর্তে লাশটা চোখ খুলে তার ঘাড়ে কামড়ে দেবে বা শক্ত করে তার পিঠটা চেপে ধরবে। যদিও এছাড়া আর উপায় নেই। জঙ্গলের ভেতর ভয়ানক অন্ধকার।
সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কলা পাতা মোরা লাশটা লম্বালম্বি করে বুকের সাথে লেপ্টে নিল। এমন সময়েই লাশটার মুখের ওপর থেকে কলা পাতা সরে যেতেই অস্ফুট একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো আকলার গলা থেকে। ইচ্ছা করছে লাশটা এখানে ফেলে পালায়। কিন্তু এটা সম্ভব না। হারিকেনটা তুলে কাঁপতে কাঁপতে, দেবী হারমার নাম নিতে নিতে গোরস্থানের পথ পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে এগোলো আকলা।
আরুল, মানজা বু এর লাঠিয়াল বাহিনীর লোক। রাতে গোষ্ঠীর লোকদের গুদামগুলো পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে রয়েছে সে। এক নতুন ধরনের নেশার জিনিস পেয়েছে কয়দিন আগে। বুড়োর বয়স হলেও এইসব গন্ধ টের পেয়ে যায়। তাই সেটাই কলকেতে নিয়ে আগুন ধরাতে জঙ্গলের এইদিকে চুপিচুপি এসেছে সে। এখনো একটাও টান দেয়নি। এমন সময় মনে হলো একটা মেয়ে লোককে , কোলে একটা বাচ্চাকে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে দেখলো সে। হাতে হারিকেন! এত রাতে কে যাবে জঙ্গলে ! সে কী ভুল কিছু দেখেছে ! নেশাতো এখনো শুরু করেনি! ঝাপসা আলো!
কলকেটা এক জায়গায় লুকিয়ে রেখে হারিকেন আর লাঠি হাতে নিয়ে সেও ধীরে ধীরে জঙ্গলে ঢুকে গেল অনুসন্ধানের জন্য। ……………………………..
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana
.