ক্যামেলিয়া পর্ব ২৭
# সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ২৭
একজন নারীর জীবনে সবচেয়ে অসহায় শোক হলো পিতৃশোক। যে শোক কাটানোর কোনো পন্থা থাকে না।একজন মেয়ের জীবনে প্রথম পুরুষ, প্রথম ভরসা থাকে তার বাবা।পুরো পৃথিবী তার বিপরীতে চলে গেলেও মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলতে জানে ‘ভয় কীসের আমি আছি।তুমি এগিয়ে যাও। বাকীটা আমি দেখবো।’
কিন্তু পৃথিবীর সব বাবা এমন নয়।ভালো মন্দের মিশ্রণেই এই পৃথিবী।জাফরিন তার বাবার কাছাকাছি ছিল।মেয়েটা সব সময় ভাবতো এই তো বাবা কত কাছে।ফোন হাতে নিলেই তাকে দেখা যায়। কথা বলা যায়, অথচ যেদিন বাবা মারা গেল সেদিন সে হাড়েমজ্জায় টের পেয়ে বাবা কতোটা দূরে।ঘুমের ঘোরে অবচেতন অবস্থায় সে বার বার বাবাকেই ডেকে যাচ্ছে।তার শিয়রে বসে ছিল মাশহুদ। ব্যথার যন্ত্রণায় আবোলতাবোল বকছিল জাফরিন।তার কথাগুলো অস্পষ্ট তবে সে দিকে খেয়াল করলে বুঝা যায় সে তার মাকে ডেকে চলেছে।ডাক্তার এসে রুটিন চেকাপ করে গেল।জাফরিনের গায়ে তীব্র জ্বর।একে তো হাতের ক্ষতটা সাথে তার মাথাতেও সেলাই পড়েছে চারটে।লোকগুলোর কাছে যদি খুন করার পারমিশন থাকতো তবে হয়তো তারা তাই করতো।বহুতল ভবনের এই হাসপাতালের ভি আই পি জোনে আছে জাফরিন এবং মাশহুদ। কুঞ্জ সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছে বাইরে। তার ধারণা মতে পুনরায় হামলা হবে জাফরিনের উপর।এরপর যে হামলা হবে সেটা হবে প্রাণঘাতী। তাকে মেরে ফেলাই থাকবে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।দরজায় মৃদু কড়া নেড়ে ভিতরে প্রবেশ করলো কুঞ্জ।কফি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন কেমন আছে?”
“ভালোই তো বলল।কিছু সময় আগেও কিছু বিড়বিড় করে বলছিল।”
“রেকর্ড করেছিস?”
“কেন?”
“হতে পারে এটা সেই ইনফরমেশন যেটা আমাদের চাই।”
মাশহুদ হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো তার বন্ধুর দিকে।কুঞ্জ মরিয়া হয়ে উঠেছে সেই ইনফরমেশন এর জন্য অথচ একটা বার তার বন্ধুর মনের মাঝে বইতে থাকা দাবানলের স্রোতটার আভাস পাচ্ছে না?এই সামান্য, ছোটো মেয়েটাকে হারানোর যে তীব্র ভয় তাকে কাবু করে রেখেছে এই ভয়ের ছাপ কি সে দেখতে পাচ্ছে না?এই মুহুর্তে জাফরিনের সুস্থতাই যে অধিক কাম্য এইটুক কি সে জানে না?না কি জেনেও না বুঝার ভান করে রয়েছে?
“এই মুহূর্তে? “
“তুই কী ভুলে যাচ্ছিস?এটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে?”
“ভুলিনি আমি তবে এই মুহুর্তে ওসবের থেকেও অধিক প্রয়োজন মিস শিকদারের নিরাপত্তা।”
“ভালোবেসে ফেলেছিস?শোন নিজের ভিতরের এই উষ্ণতাকে সামাল দে।না হলে এই মেয়েটাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতে পারবি না।”
“আমি জানি প্রতিপক্ষটা আমার আপন জনের মাঝেই কেউ।কিন্তু সে এই মেয়েটার কথাটা জানতে পারলো কীভাবে?”
কথাটা বলতে না বলতেই তার কপালের শিরা গুলো ফুলে উঠলো।সে বেশ ভালো করেই জানে আজকের ঘটনার সাথে সুচিত্রার কোনো যোগসূত্র নেই।তাকে কেবল মাত্র একটা গুটি হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে।কিন্তু এই মুহুর্তে সব থেকে চিন্তার বিষয় হচ্ছে যে জানে জাফরিনের কথা, যে জানে সুচিত্রার কথা সে এটাও নিশ্চয়ই জানে তার দাদার প্রথম পক্ষ এখানে রয়েছে।তার থেকে সেই মানুষগুলোও নিরাপদ নয়।কুঞ্জকে বলল একবার সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে। আর এটা অবশ্যই জেনে আসতে যে তাদের সাথে কেউ দেখা করতে এসেছিল কি না আর সুচিত্রা কেন বাইরে গিয়েছিল।
টেবিলের উপরে থাকা জাফরিনের ফোনটা বার বার বেজে চলেছে।টাইয়ের নট ঢিলে করে এগিয়ে এলো মাশহুদ জাফরিনের ফোনের কাছে।মা নামে সেভ করা নাম্বার থেকে বার বার কল আসছে।মা ডাকটা পড়তেই মাশহুদের মনের সেই গহীনে এক চিলতে আলো দেখা গেল।তার নিজের মায়ের সাথেও তো কথা হয় না আজ দীর্ঘ কয়েক মাস।দীর্ঘ কয়েক বছর একা থাকার পর তার মা বিয়ে করেছেন।তখন মাশহুদের বয়স পঁচিশ চলছে।মায়ের বিয়েতে সে উপস্থিত ছিল।নিয়ে গিয়েছিল উপহার। তার মা পরিচয় করিয়ে দিলো নতুন স্বামীর সাথে।হ্যাঁ তার মায়ের নতুন স্বামী কিন্তু মাশহুদের বাবা নয়। কী অদ্ভুত নিয়ম এই সমাজের।মায়ের বিয়ের পর তার বর্তমান স্বামীর সন্তানেরা তাকে মা বলে ডাকছে অথচ এই ডাকটা কেবল মাশহুদের থাকতে পারতো।তার বাবা নিঃসন্দেহে তার মাকে ভালোবাসতো কিন্তু মা ছিলেন ক্যারিয়ার নিয়ে বেশ পসেসিভ।বাবা পছন্দ করতেন না তার দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানো।একদিন, দুদিন, তিন দিন বাড়তে লাগলো ঠোকাঠুকি। কখনো মাশহুদের স্কুলে প্যারেন্টস ডে মিটিং নিয়ে আবার কখনো মায়ের ফ্লাইট নিয়ে। পেশায় তার মা একজন বিমানবালা ছিলেন।মাশহুদ ছোটো বেলায় দেখতো ফ্লাইট শেষে মা এসেছে গভীর রাতে। বাড়ি ফিরেই তার কপালে চুমু দিচ্ছে। সেই সময় তার ইচ্ছে হতো মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরতে কিন্তু তার পূর্বেই মা চলে যেতেন অন্য রুমে। পাশের রুম থেকে রাত ভর ভেসে আসতো নিচু স্বরে তর্ক বিতর্ক।আবার কোনো ভোরে মাশহুদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতো উঁচু উঁচু হিল পড়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার মা। হয়তো কিছু সময় পরেই তার ফ্লাইট।এমন নয় তার মা তাকে কম ভালোবাসতো।বিভিন্ন সময় বাহারি উপহার নিয়ে হাজির হতো কিন্তু তার মা আর ভালোবাসতে পারেনি তার বাবাকে যতোটা ভালোবেসেছিল নিজের ক্যারিয়ারকে।মায়ের চলে যাওয়ার পর সবাই বাবাকে বলেছিল পুনরায় বিয়েটা করে নিতে কিন্তু বাবার আর মন টানেনি।হয়তো তার জীবনে ভালোবাসার সাতরঙা রংধনু আর কাউকে দেখে জাগেনি।বাবা পুরো জীবন পার করে দিলো ফাইল এবং নতুন প্রজেক্টে আর মা চাকরির পর পাতিয়ে নিলো নতুন সংসার।এখন আর সে চাকরি করে না। কারণ মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের শর্ত ছিল তাকে হাউজ ওয়াইফ হতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে অচেনা মানুষের সন্তানের।মা খুশি খুশি মেনে নিয়েছে।কথাটা শোনার পর মাশহুদ তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
“মা?তবে কেন আমরা তোমার পছন্দ নই?কেন তুমি আমাদের কে বেছে নিলে না?”
তার মা আলতো স্পর্শ করে ছেলের গায়ে হাত রেখে বলেছিল,”আমি তোমার বাবাকে ঠকানোর যন্ত্রণাটা টের পেতে চাই মাই লাভ।”
পুনরায় ফোন বেজে উঠায় ধ্যান ভঙ্গ হলো মাশহুদের।স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম দেখে তার মনে পড়লো জাফরিনের মায়ের বয়স তার মায়ের থেকে কম হবে অথচ ভদ্রমহিলা স্বামী শোকে নিজেকে যতোটা কাতর করেছেন পরবর্তী জীবনে হয়তো বিয়ের কথাটা চিন্তাও করবেন না।কিংবা তার বড় দাদী?সে নিজেও দাদার নামে বৈধব্য পালন করে চলেছে পুরো জীবন।বঙ্গ দেশের নারী গুলো এমন কেন?তারা কীভাবে পারে নিজের মাঝে এতো মায়া লুকিয়ে রাখতে? মাশহুদ নিজের প্রশ্নের জবাব পায় না।তবে সে চিন্তা করে একদিন জিজ্ঞেস করবে তার বড় দাদীকে।কীভাবে এতোটা ভালোবাসা যায়?কতোটা ভালোবাসলে নিজেকে নিঃস্ব করে অন্যের জন্য অপেক্ষা করা যায়?
ফোন রিসিভ করে মাশহুদ জাফরিনের মা কে কিছুটা মিথ্যে কথা বলল।সে জানালো জাফরিনের হাতের সার্জারীর জন্য ভর্তি করা হয়েছে। তাই সে আপাতত কয়েক দিন ফোন ব্যবহার করবে না।সে এসেছিল রুটিন চেকাপের জন্য কিন্তু ডাক্তার আজকেই তাকে ভর্তি হতে বলেছে।চিন্তার কিছু নেই, সে ঠিক আছে। ফোন কেটে দিতেই বেজে উঠলো মাশহুদের ফোন।কুঞ্জ কল দিয়েছে, যার কথার সারাংশ এটুক দাঁড়ায়
“মাশহুদের মায়ের বর্তমান স্বামী এসেছিল ওদের সাথে দেখা করতে এবং সে একজন বাংলাদেশী।যার সাথেই সুচিত্রা বেরিয়েছিল।এমনটা সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেই জানা গেছে।তার ধারণা হচ্ছে জাফরিনের বাবার মৃত্যুর সাথে মাশহুদের মায়ের কোনো না কোনো যোগাযোগ রয়েছে।”
চলবে …….