ক্যামেলিয়া পর্ব ২৮
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ২৮
জাফরিনের হাতের অস্ত্রোপচার বেশ ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই মুহুর্তে মেডিসিনের প্রভাবে সে ঘুমিয়ে আছে।সেই গভীর ঘুমে এক অদ্ভুদ স্বপ্ন দেখলো সে।তার মৃত বাবা বসে আছে মাথার কাছটায়।পরণে সাদা রঙের শার্ট,জায়গাটা চিনতে খুব একটা সময় লাগলো না। এটা এই হাসপাতালের এই বেড রুমেই।স্বপ্নে জাফরিন উঠে বসেছে।বাবার আদরে আহ্লাদিত হয়ে হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“আব্বা, আমার এখানে ভালো লাগছে না।আপনি চলেন আমরা বাড়ি ফিরে যাই।”
“আম্মাজান,আমি তো বাড়ি ফিরেই গেছি।মাঝ থেকে আপনাকে এই বিদেশ বিভুইয়ের মাঝে ফালাইয়া উড়াল দিছি স্বার্থপরের মতোন।”
“না আব্বা, আমি নিজেই তো আসছি।”
“আম্মাজান?চোখের সামনে যা দেখা যায়,তা কিন্তু সব সত্যি না।মনে রাখবেন পানির স্বচ্ছতা প্রকাশে আকাশ,আলো আর মাটি তিনটার যথাযথ স্থান প্রয়োজন।”
“আকাশ,মাটি আর আলো?”
“আম্মাজান নিজের খেয়াল রেখো।তুমি আমার কলিজার টুকরা।মানুষ বেঁচে থাকতে তার কলিজা সন্তানকে দিতে পারে না।আমি তোমাকে দিয়েছি।চিন্তা করো সব বুঝতে পারবে।”
জাফরিনের ঘুম ছুটে গেল।মাথাত ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে।উঠে বসবে কিন্তু খেয়াল হলো তার হাতে শক্তি পাচ্ছে না।টেবিলের উপরেই অনবরত বেজে চলেছে ফোন।সেবিকার সাহায্যে ফোনটা তুলে হাতে নিলো সে।ইউভান কল দিচ্ছে, জমা হয়েছে আরো কয়েকটা ম্যাসেজ।ফোনের তারিখ দেখে বুঝতে পারলো পার হয়েছে ইতিমধ্যে তিনটা দিন।ফোনে কথা বলতে চাইলে সেবিকা জানালেন তার ফোনে কথা বলা বারণ রয়েছে।জাফরিন বলল,
“আমার বাড়ি থেকে কল দিচ্ছে, নিশ্চয়ই তারা চিন্তিত রয়েছে আমাকে নিয়ে।”
“ম্যাম, আপনার স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই বলা হচ্ছে।এই মুহূর্তে কথা বলাটা আপনাকে উত্তেজিত করে দিতে পারে।কয়েক মুহুর্ত হলো আপনি জেগেছেন।”
“এই মুহুর্তে আমাকে কথা না বলতে দিলে আমি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি।”
সেই মুহুর্তে দরজায় নক করে ভিতরে প্রবেশ করলো সুচিত্রা। দু মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে জাফরিন ডায়াল করলো ইউভানের নাম্বারে।
“কেমন আছিস? “
“ভালো ভাইয়া।তবে মাথাটা ঝিমাচ্ছে। দাঁত দিয়ে শক্ত কিছু চিবোতে ইচ্ছে করছে।”
“অপারেশন শেষ হয়েছে? আমাদের জানিয়েছিল উনারা।কথা ছিল শেষ হলে খবরটা জানাবে কিন্তু দেরি হচ্ছে দেখে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।”
ইউভানের কথাতে এতটুক স্পষ্ট যে তিন দিন তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে জাফরিনের খবর তো ঠিক দেওয়া হয়েছে তবে আততায়ী হামলা সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না।মায়ের খবর জানতে চেয়ে জাফরিন জিজ্ঞেস করল,
“মা কেমন আছে?কোথায় এখন?”
“গ্রামে আছেন।এসেছিল গতকাল, আজ ফিরেছে বৃদ্ধাশ্রমের কাজটা ধরতে চাইছেন।”
“আর বড় আপা?আপা কেমন আছে?আপা কী এখনো তার শাশুড়ির জন্য ছোটো হয়ে থাকে?”
“তুই যাওয়ার পর পর আপা এসেছিল। ফুপুর পা ধরে খুব কাঁদছিল সে।নিজের কৃতকর্মের জন্য মাপ চেয়েছে।এরপর আর ফিরেনি।দুলাভাই তাদের নিয়ে আলাদা উঠেছে।”
“তাহলে তো মাঈমা আমাকেই দোষ দিচ্ছে। আমার জন্য তার সংসার ভাগ হলো।ছোটো ছেলের বৌটা কোনো বিচার পেল?”
“আত্মহত্যার কোনো বিচার নেই।আজ কী হয়েছে যে সবার কথা জিজ্ঞেস করছিস?”
” তোমাদের মনে পড়ছে।জানো তো নিজের উপর নিজের ভীষণ রাগ হয় আমার।আমি মেয়ে বলেই কী দুর্বল?”
“কেন?”
“একজন পুরুষের দেহে যতোটা শক্তি আছে নারীর নেই।তাই পুরুষের খারাপ নিয়তের কাছে,খারাপ শক্তির কাছে নারী দৈহিক শক্তিতে হেরে যায়।”
“কিছু হয়েছে?”
“না।”
“মন খারাপ হলে আকাশের দিকে তাকাবি।ঝলমলে আলো মনের অন্ধকার কাটিয়ে স্বচ্ছতা আনবে।”
জাফরিনের হুট করেই মনে পড়লো তার বাবার সেই কথাগুলো।সে স্বপ্নে দেখেনি,তার অবচেতন মন বার বার নির্দেশ করছে একটা দিক।আলো, আকাশ আর স্বচ্ছতা। এমন কিছুর কথা কি বাবা বলতে চাইছে দেয়ালের সেই পেইন্টিংটার ভাষায়?জাফরিন বুঝতে পারলো তার জন্য পরবর্তী ক্লু লুকিয়ে আছে নিজ ঘরের বিছানার নিচে রাখা সেই পুরোনো ছবিটাতে।যেখানে পাওয়া যাবে তার বাবার মৃত্যুর একমাত্র কারণ।
সামনে সুচিত্রা থাকায় নিজের অস্থিরতা প্রকাশ করলো না জাফরিন।যতোটা সেদিন জানতে পেরেছে এই মেয়েটা কোম্পানি সি ই ও মাশহুদ এর কিছু একটা লাগে।তাই তাদের নিয়ে আসা হয়েছে দেশ থেকে।এখানে যুদ্ধটা এই কোম্পানির লোকের সাথেই করতে হবে।জাফরিন এটা জানে যে কেউ শত্রু হতে পারে।সেটা এমিলিই হোক কিংবা সুচিত্রা। এই মুহুর্তে নিজের ছায়াকেউ বিশ্বাস করে না সে।অন্তত গত দিনের আততায়ী হামলার পর।
(৫৮)
মায়ের সামনে মুখোমুখি বসে আছে মাশহুদ।তার মায়ের গোছানো সংসার। এই সংসারে ব্যস্ত দিন পার করছে ভদ্র মহিলা।চুলে পাক ধরেছে, চোখের নিচে জমেছে কালি।উন্মুক্ত পোরসগুলো চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সে নিজের যত্নের প্রতি সময় কতোটা দিতে পারে।কফির মগ এগিয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা। মাশহুদের দৃষ্টি সেই মুহুর্তে পোষা বিড়ালটার দিকে।বিড়ালটার নাম স্নুফি। স্নুফিকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল মাশহুদ নিজেই।নিজের প্রিয় বিড়ালের নাম সে রেখেছিল জিজেল।আগে মা তার সাথে দেখা করতে আসলে তাকে স্নুফি বলে ডাকতো এবং স্নুফিও আহ্লাদ করতো।সেই সূত্র ধরেই উপহার দেওয়া।মার্জার গোত্রের এই সুন্দরী এই মুহুর্তে ময়লায় আবৃত। শুভ্র সাদা লোমের বিভিন্ন স্থানে ময়লা লেগে আছে।দেখে বুঝে যায় তার যত্নের অভাব রয়েছে, চোখের দিকটাও ইনফেকশনের প্রভাবে ময়লা হয়ে আছে।একটা ফড়িং ধরার জন্য সে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে করতে হুট করেই থাবা বসালো মায়ের স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলের হাতে।সজোরে পা দিয়ে আঘাত করে দূরে ফেলে দিলো সে জিজেলকে।বিড়ালটা ব্যথায় কুঁকড়ে দৌড়ে চলে গেল।মাশহুদ নিজেকে সংবরণ করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার স্বামী কোথায়?”
“বাবা না বলতে পারো।আংকেল তো বলো?”
“সে কোথায়?”
“অফিসের কাজে বাইরে গেছে।তোমার তাকে দিয়ে কী দরকার?”
তার মায়ের দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে মাশহুদ বলল,
“আমি জানি না আমার বাবার ব্যবসা আপনাকে কতোটা ঘৃণা করতে বাধ্য করেছিল কিন্তু রইল আপনার স্বামীর বর্তমান কাজের নথিপত্র। আপাতত সে পুলিশ কাস্টাডিতে আছে। আমার প্রিয়তমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য।”
ভদ্রমহিলা বিষম খেলেন।তিনি চিন্তিত মুখে বললেন,
“কী বলছো তুমি?জেসিয়া কে আমার স্বামী কি করেছে?”
“জ্যাস আমার প্রিয়তমা এটা কে বলল?তাছাড়া ছবিতে যে মেয়েটার সাথে আপনার স্বামী কথা বলছেন তাকে আপনি চিনেন?”
“কেন চিনবো না?আমার স্বামীর ছোটো বোনের মেয়ে।”
“মানে?”
“হ্যাঁ, ওরা বাংলাদেশ থেকে কয়েকদিন আগেই তো এলো।”
মাশহুদের দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে সময় লাগলো না।সে বেশ বুঝতে পারলো মাত্র কয়েকটা টাকার লোভে তার পরিচিত কারোর কথাতেই সুচিত্রাকে ব্যবহার করেছে খালিদ ফেরদৌসী। সে যেই হোক তার পুরো গল্পটা জানা।যে জানে শিকদার সাহেবের মৃত্যু কিংবা জাফরিনের আসাটা।আর এসব কেবল এক জনেই জানে, সে হচ্ছে কুঞ্জ।
তবে কী এই পুরো গল্পটার পিছনে কুঞ্জই রয়েছে?
চলবে…………..