ক্যামেলিয়া পর্ব ৩০
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৩০
পরের সুখ কেড়ে নিয়ে জীবনে হয়তো কম মানুষ সুখী হয়েছে কিংবা কাউকে ঠকিয়ে সুখী হওয়ার ঘটনাও এ সমাজে অনেক।কিন্তু দিন শেশেষে সবাইকে একলা সময় কাটাতে হয়। হোক সেটা শৌচাগারেই হোক না কেন।নিজের করা কৃতকর্মের জন্য মানুষ একটা সময় ভাবে, আমি কী ঠিক করেছি?
ভাতের চালে পানি দিতে দিতে এমনটাই ভাবছিল আশা।যে শাড়িটা জাফরিনের জন্য ছিল সেই শাড়িটাই বিয়েতে পড়েছিল আশা।অথচ একটা বারের জন্য চিন্তা করেনি এই শাড়িটা কেবল একটা শাড়ি নয়, এতে জমে রয়েছে জাফরিনের স্বপ্ন।একটা নতুন জীবনের স্বপ্ন।বাবার দেওয়া টাকার লোভের কারণে ঈশানের বাবা বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেও পরবর্তীতে এতো টাকা তাদের দিতে পারেনি।পারেনি তাদের চাহিদা পূর্ণ করতে।আশার বাবা ভেবেছিল জাফরিনের বাবার লাশের সাথে আসবে টাকা,তাছাড়া বাড়ি, জমিজমাও কম নেই। যেহেতু জাফরিনের ভাই নেই তাই সবটা চলে যাবে তাদের দখলে।সেখান থেকে মেয়ের জামাইকে অল্প কিছু দেওয়া কোনো ব্যাপার ছিল না।এমনটা আলোচনা করেই বিয়ের কথা বলেছিল আশার বাবা।অপর দিকে ঈশানের বাবা ভেবেছিল জাফরিনের বাবার থেকে ইতিমধ্যে মেয়ের সুখের জন্য পনেরো লাখ টাকা নিয়েছেই।তাছাড়াও ভদ্রলোক মেয়ের ঘর সাজিয়ে দেওয়ার জন্য এক দুই ট্রাক ফার্নিচারও দিয়েছে যেটা জাফরিনরা কেউ জানতো না।ভদ্রলোক মরে গেল আর এসব কথাও ধামাচাপা রইল।আশার বাবা কমপক্ষে বিশ লাখ দেওয়ার লোভ দেখাতেই সে রাজি হয়ে গেল।ফেরত নিলো বরপক্ষকে। কিন্তু দুদিন পর জানতে পারলো আশা নয়, বরঙ জাফরিনের সাথে বিয়ে হলেই তার ছেলে আজ অনেক টাকার মালিক হতো।
দুজনের মনের ইচ্ছেটা পূর্ণ না হলেও ঈশান চুপচাপ থাকে।সে আশার সাথে তেমন একটা কথা বলে না।খুব প্রয়োজন পড়লে যতোটা আর কি।বিয়ের পর দাম্পত্য জীবনটা ওই রাতের আধারে কামনা মেটানোর মতোই।ঈশানের প্রয়োজন পড়লে কাছে আসা এরপর?
বিছানার অপর পাশে মানুষটা কেমন আছে সেটা জানার প্রয়োজন বোধ করে না ঈশান। সে মেলাতে ব্যস্ত থাকে জাফরিনের সাথে।না জাফরিনকে তার কখনো এতোটা কাছে পাওয়া হয়নি।তবুও কল্পনায় জাফরিনের নেশায় মত্ত হয় সে আশার উপস্থিতিতে।সেই মুহুর্তে আশার ইচ্ছে হয় মরে যেতে। নিজেকে এতোটা ছোটো মনে হয় যে ঈশানের প্রেমময় স্পর্শ তখন জান্তব কোনো নরকের কীটের মতো লাগে।
শাশুড়ির ডাকে হুশ ফিরে তার। এই বাড়িতে এই একজন মানুষ তাকে আগলে রাখে।না হয় বাকী সবাই তো টিপ্পনী কাটে কিংবা তামাশা করে।
“বাড়ি যাবে না বৌ?তোমার বড় চাচা এসে দাওয়াত দিয়ে গেল।শুনলাম তোমার চাচার জন্য মানুষ খাওয়াবে।”
“আম্মা জানেন তো?জাফরিন আমার চাচার সব থেকে আদরের ছিল।তার হাসির জন্য চাচা কিন্তু আপনাদের এই বাড়িতে কম জিনিস দেয়নি।আব্বা বলেছিল গোসলখানা ঘরের সাথে নাই, আমার চাচা কিন্তু সেই গোসলখানা ঘরের সাথে দিয়ে দিয়েছে।তাহলে একটা বার ভাবুন তো?সেই মেয়ের জায়গা নিয়ে আমি বসে আছি আমি তার চোখে কতোটা খারাপ?”
“তোমার ভাগ্য ছিল।তাছাড়া কি জানো?তোমার চাচাতো বোনের ভাগ্য আরো ভালো কাউকে পাবে সে।যে অভিভাবক, বন্ধু, প্রেমিক কিংবা স্বামী সব কিছুই হবে। মেয়েটা ভালো, আর ভালো মেয়েরা শুরুতে ঠকে গেলেও শেষ অবধি কিন্তু জিতে যায়।জাফরিন জিতেছে।আমার মনে হয় ঈশানের সাথে বিয়ে হলে ও সুখী হতো না।এই যে এবাড়ির মানুষের খাই খাই স্বভাবটা যে আছে,এটা ও মেনেই নিতো পারতো না।যা আরো বেশি কষ্ট দিতো,তার থেকে সাময়িক কষ্ট পেলেও ওর জীবনটা সুখের হবে।
সুচিত্রা বসে থাকা অবস্থায় জাফরিন মাশহুদকে প্রশ্ন করতে চাইলো।কে আপনি? তখন তার মনে হলো এই সেই চোখ যে চোখ সে দেখেছিল তার বাবার লাশ দাফনের দিন।এই সেই স্পর্শ যেটা সে পেয়েছিল আগুন লাগার দিন কিংবা গত কয়েক দিন আগে।কে এই মানুষটা? ফাঁকা ঢোক গিলে সে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে স্মীত হাসি দিতেই ঘাবড়ে গেল মেয়েটা।সুচিত্রার কথাতে ধ্যান ভঙ্গ হলো তার।
” আপনি জাফরিনকে কীভাবে চিনেন?”
“যেভাবে চেনা যায়।মিস্টার শিকদার আমাদের কোম্পানির একজন কর্মকর্তা ছিলেন।”
“অহ আচ্ছা।কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
“করুন।”
“তবে ও এখানে কেন?”
“কিছু প্রশ্নের উত্তর সময় এবং পরিস্থিতি নিজে দেয়। এটাও সময় এবং পরিস্থিতি নিজেই দিবে।”
সুচিত্রা কথা বাড়ালো না।যথেষ্ট বুদ্ধিমতি সে। তার বুঝতে বাদ রইল না যে জাফরিন নামের মেয়েটার প্রতি মাশহুদের কোনো একটা দুর্বলতা রয়েছে। তাছাড়া জাফরিনের প্রতি তার অঙ্গরতা খুব একটা ভালো ঈঙ্গিত দিলো না তার মনে।
তার কেবল মনে হতে থাকলো জাফরিন মেয়েটা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।সে কেবল মাশহুদের একটা সুগ্যার বেবি।অথচ মেয়েটাকে কতোটা নিষ্পাপ লাগছে।এই যে সে এলোচুলে তাকিয়ে আছে মাশহুদের দিকে।মনে হচ্ছে প্রথম বার বড় কোনো রহস্যের উদঘাটন করে ফেলেছে সে।
“মিস সুচিত্রা কোনো সমস্যা না হলে আপনি যদি ক্যামেলিয়ার চুলগুলো বেঁধে দিতেন?”
“অবশ্যই।”
কিন্তু সেই মুহুর্তে জাফরিনের মাথায় চলছে হাজার খানেক প্রশ্ন।বাবার সেই পেইন্টিং, মাশহুদের চোখের দৃষ্টি কিংনা এই লোকটার চোখের রঙ।কেমন নীলাভ চোখের দৃষ্টি।দেখে মনে হয় যেন সমুদ্রের পাড়ের বালিতে রাখা কোনো এক উজ্জ্বল বস্তু। কথাটা মনে হতেই তার দুই চোখ চকমক করে উঠলো।সে দুজনের থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে কেবিন থেকে।ইউভানের নাম্বার ডায়াল হতেই সে রিসিভ করলো,
“ভাইয়া।’
” কিছু হয়েছে? এতো উত্তেজিত কেন?”
“আকাশ মানেই কী নীল?আর পানিতে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন আছে।এমন কী উপাদান আছে এই প্রকৃতিতে তা যা বালি তৈরী হতে সাহায্য করে?”
“আগুন ছাড়া কিছুই হয় না।”
“না আগুনে কোনো ক্লু নেই।আগুনে আমার ভয়। বাবা আগুনে কিছুই রাখবে না।”
“তবে?”
” ওহ খোদা, আমি বুঝেছি। আমি পেয়েছি।শোনো ভাইয়া তুমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখো বাবা আমার বিয়ের সারপ্রাইজ হিসেবে কোনো হানিমুন প্যাকেজ দেখেছিল কি না কিংবা কোনো টুরিস্ট স্পট।”
“খবর নিচ্ছি কিন্তু মনে হচ্ছে তা নয়।তুই একটু সামলে থাকিস।বাকীদের নজর কিন্তু তোর উপরেই থাকবে।”
“হুম থাকবো।যত দ্রুত পারো আমাকে জানাবে।”
পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে মাশহুদ সবটা শুনতে পেল।হাসির রেখা ফুটে উঠেছে তার মুখে।সে কুঞ্জকে বলেছিল এসব থেকে দূরে থাকতে কিন্তু সে এটাও জানতো জাফরিন তাকে নিয়ে যাবে তার লক্ষ্যের দিকে।এই মেয়েটা এসেছেই বাবার মৃত্যুর রহস্য জানতে কিন্তু কখন হবে যখন সে জানতে পারবে মৃত্যুই শ্রেয়।
চলবে…….