# আরশিযুগল প্রেম পর্ব ২৩
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব- ২৩
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝামাঝি পলাশী মোড়ে বসেছে বন্ধুদের আড্ডা। রাত নয়টা/সাড়ে নয়টা পর্যন্ত অফিস করে এগারোটার দিকে আবারও পুরোনো আড্ডামহলে জুটেছে সব। তিন-চার বছর আগে মাস্টার্স শেষ করে সবাই এখন কর্মব্যস্ত মানুষ। কেউ উদ্যোক্তা, কেউ সরকারি চাকরিজীবি তো কেউ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত। এতো এতো ব্যস্ততার চাপে কারোরই তেমন একটা সময় হয়ে ওঠে না। প্রথম যৌবনের উছ্বাসটাকে আবারও ফিরিয়ে আনার অবসরও জুটে না কারো।
বসন্ত উৎসবের পর, দীর্ঘ দেড় মাসে আজই আড্ডায় বসেছে তারা। তবে, এর পেছনে বিশেষ একটা কারণও আছে বটে। বন্ধুমহলের দূরন্ত মাহিনের প্রথম বারের মতো বাবা হওয়ার আনন্দটাই এই আড্ডার মূল আকর্ষণ। পলাশী মোড়ের পরিচিত চা স্টলের সামনে বসে আছে সাদাফ ও তার বন্ধুরা। চারদিকের জ্যোস্নাটা যেন আজ বাড়াবাড়ি রকমের সাদা। সবার হাতেই ধোঁয়া ওঠা গরম চা। পাশে রাখা সমুচার প্লেটটা অনেকটাই ফাঁকা।
—” সাড়ে বারোটা বেজে গেছে প্রায়। এখনও বাসায় না ফিরলে বউ আর বাসায় ঢুকতে দিবে না দোস্ত। বিয়েটা করে বিরাট বোকামো করে ফেলছি। শালার সিগারেট টাইনাও শান্তি নাই।”
জিহাদের আক্ষেপ মাখা কন্ঠে আমোদিত চোখে তাকালো সবাই। জিহাদের মাথায় চাটি দিয়ে পাশ থেকে বলে উঠলো রিফাত,
—” ধুর মিয়া! মাহিন তিন দিনের পোলা রাইখা আড্ডা দিতাছে আর তোমার খালি যাওনের কথা। বউ দেখলে তো তোর হুশ থাকে না।”
জিহাদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। বাধ্য শিষ্যের মতো মুখভঙ্গি করে বললো,
—” মাহিন? গুরু? একটু টিপস দে তো। বউকে কি খাওয়াস তুই? তেজ-টেজ কিছু নাই? তিনদিনের বাচ্চা আর অসুস্থ বউকে রেখে নিশ্চিন্তে বসে আছিস। কোনো চাপ নাই। কেমনে সম্ভব?”
মাহিন মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বললো,
—” বাচ্চা আর বউ দেখার জন্য অনেক মানুষ আছে বাসায়। বাচ্চা হওয়ার সুবাদে শশুড়বাড়ির পুরো পল্টন এসে উঠেছে ফ্ল্যাটে। বউয়ের একটা বড় বোন আছে। বোন তো নয় ডাইনী। যতক্ষণ বাসায় থাকি প্যাকপ্যাক করতেই থাকে। মাহিন তুমি বাবুর জন্য এটা করলা না, ওটা করলা না ব্লা ব্লা। আমার প্রতি বউয়ের থেকে বউয়ের বড় বোনের অভিযোগই বেশি। এই মহিলাকে তার জামাই সামলায় কেমনে আল্লাহ জানে। আর যায় করিস, বড় বোন আছে এমন মেয়ে বিয়ে করে মরিস না। ভাইজা খাইয়া ফেলবো একদম। না পারবি গিলতে আর না পারবি উটকাইতে। এগ্লা সব নাম্বার ওয়ান ফাজিল মহিলা। এই মহিলার ভয়ে বাসায় ফিরতেই ভয় লাগে এখন।”
মাহিনের মুখভঙ্গি দেখে হাসলো সাদাফ। মাহিন ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
—” হাইসো না বন্ধু। সময় তোমারও আসবো। এনিওয়ে, বিয়ে টিয়ে করবি না? আমরা সব বাচ্চার বাপ হয়ে যাচ্ছি অথচ তুই,রাকিব আর রতন বিয়ের পিঁড়িতেই বসছিস না। রাকিব তবু মেয়েদের দেখে লাফালাফি করে তোর তো সেই লক্ষ্মণও নেই। কাহিনী কি? সব সিস্টেম ঠিক আছে তো?”
কথাটা বলে ফিচলে হাসি হাসলো মাহিন। সাদাফ ডান পায়ের জুতোটো খুলে মাহিনের পেট বরাবর ছুঁড়ে মেরে বললো,
—” বুলশিট।”
মাহিন পেট চেপে ধরে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো। জুতোটা সাদাফের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
—” কথায় কথায় জুতা মারিস কেন শালা। বিয়েটা খালি করে নে, তোর বউ ভাগিয়ে এই জুতোর প্রতিশোধ নিবো।”
মাহিনের কথায় হেসে ফেললো সবাই। চায়ের কাপটা ব্রেঞ্চে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো জিহাদ। বাঁকা হেসে বললো,
—” অল দ্যা বেস্ট বন্ধু। সাদাফের বউ ভাগানোর আগেই বউয়ের হাতে শহীদ না হয়ে যাস এই দোয়ায় করি।”
কথাটা বলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে একবার ঘড়ি দেখলো জিহাদ —-১২ঃ৩৫। মুখ কালো করে বললো,
—” এবার যেতে হবে রে। আসছি।”
জিহাদের বিদায়সম্ভাষণে আড্ডার সুর কাটলো। একে একে উঠে পড়লো সবাই। সাদাফ-আরাফের বাসা কাছাকাছি হওয়ায় নীরবে হাঁটতে লাগলো দু’জনে। আরেকটু সামনে থেকে রিকশা বা সিএনজি পেয়ে যাওয়ার প্রত্যাশাটাই দু’জনের মনে। এই নীরবতা কাটিয়ে কথা বললো সাদাফ,
—” ওহ্ তোকে একটা কথা জিগ্যেস করবো ভাবছিলাম।”
আরাফ সামনের দিকে তাকিয়েই ক্লান্ত গলায় বললো,
—” হু।”
সাদাফ আবারও নীরব হয়ে গেলো। বেশ কিছুদিন ধরেই আরাফের কাছে শুভ্রতার নাম্বারটা চাইবে বলে ভাবছিলো সাদাফ। কিন্তু সময়, সুযোগ কোনোটিই হয়ে ওঠে না। হয়তো অস্বস্তিটাই কাটিয়ে উঠতে পারে নি সে। সাদাফকে চুপ থাকতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আরাফ।
—” কি রে? কি জানি বলতে চাইলি, বললি না?”
সাদাফ মৃদু মাথা নাড়লো। জোড়ে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বললো,
—” হ্যাঁ বলছি। তোর কাছে শুভ্রতার নাম্বার হবে?”
আরাফ অবাক চোখে তাকালো। আরাফের এই দৃষ্টিতে দ্বিগুণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো সাদাফ। মুখ কাচুমাচু করে বললো,
—” কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
—” তোর কাছে শুভ্রতার নাম্বার নেই?”
আরাফের কন্ঠে বিস্ময়। সাদাফ বিরক্ত হয়ে বললো,
—” থাকলে কি আর তোকে বলতাম নাকি?”
সাদাফ থামলো। আরাফের মুখে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে চট করেই একটা ছোট্ট মিথ্যে বলে ফেললো সে,
—” আসলে…ট্যুরের সময় ভুল করে শুভ্রতার একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে। ওটাই ব্যাক করবো। কিন্তু আমার কাছে উনার নাম্বারটাই নেই। তোর কাছে থাকলে দে তো।”
আরাফ বিস্মিয় ভাবটা কাটিয়ে নিয়ে বললো,
—” তুই একটা মানুষ! এত্তোগুলো দিন একটা মেয়ের সাথে কাটানোর পরও তার নাম্বার তোর কাছে নাই? অদ্ভুত!”
সাদাফ শক্ত গলায় বললো,
—” তুই দিবি নাম্বার?”
—” আমি কি মানা করছি নাকি? ফোন বের কর,
বলছি।”
সাদাফ পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই খেয়াল হলো, চার্জ না থাকার দরুন সন্ধ্যা থেকেই বন্ধ পড়ে আছে তার ফোন। রাতে ফোনটা চার্জে না দেওয়ায় আর পাওয়ার ব্যাঙ্কটা সাথে না রাখার ফলেই তার এই দুর্ভোগ। ফোনটা আবারও পকেটে পুড়ে নিয়ে মুখ ফুলিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ছাড়লো সাদাফ। আরাফের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” চার্জ নেই। ফোন অফ। তুই বরং ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে দে।”
আরাফ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ফোনের দিকে নজর দিলো। সাদাফ সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। পিচ ঢালা রাস্তাটা চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে, রাস্তার গা পিছলে পড়ছে জ্যোস্না। শুভ্রতা মাখা জ্যোস্না। মাঝে মাঝেই পাশ কাটিয়ে ছুটে যাচ্ছে মোটর বসানো দু-একটা রিকশা। সাদাফ তার ঘন চুলে হাত চালিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশেও আজ মস্ত এক শুভ্রতা রাঙা চাঁদ। কথাটা ভাবতেই নিজের মনে হেসে উঠলো সাদাফ। শুভ্রতা! প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে তার মনেও ঘুরে বেড়াচ্ছে একঝাঁক শুভ্রতা। আচ্ছা? এমন তো নয় যে, তার মনের সাথে পাল্লা দিয়েই প্রকৃতি সেজেছে এই শুভ্রতাময় সাজে? হবে হয়তো, নয়তো নয়। নয়তো, সবই তার উদাসীন কল্পনা।
____________________
ঘড়িতে একটার ঘন্টা বাজতেই চমকে উঠলো শুভ্রতা। অস্থির চোখে একবার জানালার বাইরে তাকালো। বাইরে দিনের আলোর মতো ঝকঝকে জ্যোস্না। শুভ্রতা দুইহাতে চোখ মুছে আবারও ফোনের দিকে তাকালো। সেই সন্ধ্যা থেকে এই মধ্যরাত পর্যন্ত ক্রমাগত সাদাফের নাম্বারে ডায়াল করে চলেছে সে। প্রতিবার ফোন কাটার পর ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। সময়ের সাথে সাথে অযথায় অস্থির হয়ে উঠেছে। ছোট্ট বাচ্চার হাত থেকে তার প্রিয় খেলনাটা হারিয়ে গেলে যেমন দিশেহারা, চঞ্চল হয়ে উঠে। ঠিক তেমনভাবেই দিশেহারা আর চঞ্চল হয়ে উঠেছে ক্ষণে ক্ষণে। দীর্ঘ সময় কান্নার ফলে চোখদুটো ফুলে লাল রূপ ধারণ করেছে। ফর্সা নাকের ডগাটা যেন লাল আবিরে ছেয়ে আছে। মাথাটাও বেশ ভারী লাগছে। মাথার দু’পাশের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় মাঝে মাঝেই চোখ-মুখ কুঁচকে আসছে। শুভ্রতা উত্তরের দেয়ালটিতে ঠেস দিয়ে বসে ছিলো। তার মুখ বরাবর দক্ষিণা খোলা জানালা। ঘরের আলো নেভানো থাকায় রুমের সর্বত্রই চাঁদের আলোর নরম স্পর্শ। শুভ্রতা কিছুক্ষণ নিথর বসে রইলো। একটা তীক্ষ্ণ শ্বাস টেনে নিয়ে সাদাফের নাম্বারটা আবারও ডায়াল করে কোলের ওপর রাখলো। একটানা এতোক্ষণ বসে থেকে হাতে-পা একদমই বল পাচ্ছে না শুভ্রতা। উদাসী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে কি ভেবে তাড়াতাড়ি ওঠে দাঁড়ালো। জামাটা এদিক-ওদিক টেনে, মাথায় ওড়না চাপিয়ে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ফোনটা পড়ে রইলো ফ্লোরের এক কোণায়।
আনিমুল হক ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে আছেন।
চোখদুটো বোজা। ডানহাতের দু আঙ্গুলের মাথায় ঝুলে থাকা তছবীটা ক্রমাগত দুলছে। তছবীর এই দোলনটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে আনিমুল হক জেগে আছেন। লম্বা ট্রেন জার্নির পর শরীরটা ক্লান্ত হলেও চোখদুটোতে ঘুমের লেশমাত্র নেই। শেষ কবে রাতে শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিলেন, এখন আর তা মনে করতে পারেন না আনিমুল হক। সারারাত তছবী পাঠ, তাহাজ্জুদ নামায আর মৃতা স্ত্রীকে ভাবতে ভাবতেই কেটে যায় তার। ঘুম নামক বস্তুটা বহু বছর যাবৎ তাকে দেখা দেয় না। কেন দেয় না, কে জানে? আনিমুল হকের ধারণা এসব তার বয়সের দোষ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের হারানোর পাল্লা ভারী হতে থাকে। তারও হচ্ছে। একে একে হারিয়ে যাচ্ছে সব। সুখ, আনন্দ, হাসি, কান্না,শক্তি, ঘুম তারপর…. তারপর এই বিস্ময়কর জীবন! দরজার কাছে কারো পায়ের শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকালেন আনিমুল হক। ঘরে ডীম লাইটের হালকা আলো। এই হালকা আলোতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রমনীটিকে ঠিক চিনতে পারলেন না আনিমুল হক। গমগমে গলায় বললেন,
—” কে? বড় বউমা?”
শুভ্রতা দু’পা এগিয়ে এসে বললো,
—” আমি দাদু, শুভ্রতা।”
আনিমুল হক গম্ভীর গলাটাকে খানিকটা মোলায়েম করে বললেন,
—” দিদিভাই? এসো। ভেতরে এসো।”
শুভ্রতা এক পা দু’পা করে এগিয়ে গিয়ে দাদুর পা ছুঁয়ে সালাম করলো। দাদুর পায়ের কাছে বসে দাদুর কোলে মাথা রাখলো। আনিমুল হক বামহাতটা আলতো করে শুভ্রতার মাথায় রাখলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিন্তিত গলায় বললেন,
—” এখনও ঘুমোওনি দিদিভাই? তোমার মা বলছিলো অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছো, তাই আর ডাকি নি।”
শুভ্রতা উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মৃদু গলায় বললো,
—” আমি কি তোমাদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে গিয়েছি দাদু?”
আনিমুল হক আৎকে উঠলেন। শুভ্রতার কন্ঠের আকুলতাটা যেন তার বুকে গিয়ে লাগলো। কয়েক যুগ আগে এমনই একজন যুবতী এভাবেই কতো শতো অভিমানমাখা অভিযোগ করতো তাকে। তখন তিনি হাসতেন। কিন্তু আজ হাসি নয়, বুকটা ভারী লাগছে খুব। আনিমুল হক শুভ্রতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
—” সে কি দিদিভাই? সবই তো তোমার। রাণীর রাজত্বে রাণী কি কখনো বোঝা হয় ?”
শুভ্রতা এবার মাথা তুলে তাকালো। মুখ কালো করে বললো,
—” রাণীর রাজত্ব থেকে রাণীকে তো কখনো তাড়ানো হয় না দাদু। তাহলে আমায় কেনো তাড়াতে চাইছো?”
—” কার এতো বড় দুঃসাহস যে তোমাকে তাড়িয়ে দেয় দিদিভাই?”
—” তোমরা সবাই। নয়তো কাল কেন আমাকে দেখতে আসছে ওরা? আমি জানি কালকেই এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছো আমায়। নয়তো তুমি আর চাচ্চু এভাবে ছুটে আসতে না। কিছুতেই না। এটাকে বুঝি তাড়ানো বলে না?”
আনিমুল হক মৃদু হাসলেন। শুভ্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন,
—” এটাই তো নিয়ম দিদিভাই। রাণীদেরকে যে এক জায়গায় আটকে রাখা অন্যায়। আল্লাহ আমাদের ঘরে তোমার মতো এক রাণী দিয়ে আমাদের ধন্য করেছেন। সেই রাণীকে আগলে রেখে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াটাই যে আমাদের কর্তব্য। রাণীদের একটা নয় অসংখ্য রাজত্ব সামলাতে হয়, গোছাতে হয়। বাবার রাজত্ব, স্বামীর রাজত্ব, ছেলের রাজত্ব এই এতোসব রাজত্ব ফেলে এক জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে থাকাটা কি রাণীদের মানায়? তাদের তো অনেক দায়িত্ব দিদিভাই। তাদের থেকেই সৃষ্টি এই জগৎ সংসার। এটাকে তাড়ানো বলে না। এটাকে বলে দায়িত্বের বিস্তৃতি।”
শুভ্রতার চোখ থেকে দু’ফোটা’ পানি গড়িয়ে পড়লো।
ভাঙা গলায় বললো,
—” আমি এখনই এতো রাজত্ব চাই না দাদু। আমি এখানেই… এই রাজত্বটাতেই রাণী হয়ে থাকতে চাই। এখনই এতোসব দায়িত্বে ছুঁড়ে ফেলো না আমায়। আর কিছুদিন সময় দাও না প্লিজ। তারপর তোমরা যা বলবে তাই হবে। ছোট থেকে কি কখনো তোমার কথার অবাধ্য হয়েছি দাদু? এটুকু বিশ্বাস কি তুমি আমায় করতে পারো না? শেফা আপুর রিসেপশনটাই যেখানে তোমাদের হজ্জ থেকে ফেরার পথ চেয়ে আছে। সেখানে আমার জন্য কেন এতো তাড়া দাদু? আমার কি তোমাদের ওপর কোনো অধিকার নেই? এই ছোট্ট চাওয়াটাও কি চাইতে নেই? তুমি কি আমায় অবিশ্বাস করো দাদু?”
কথাগুলো বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে উঠলো শুভ্রতা। শুভ্রতার হঠাৎ কান্নার শব্দে হকচকিয়ে উঠলেন আনিমুল হক। ব্যস্ত হয়ে বললেন,
—” আহা! কাঁদছো কেন দিদিভাই? কে বললো আমি তোমায় অবিশ্বাস করি? কেঁদো না। রাণীদের চোখের জলের অনেক দাম। এই অমূল্য চোখের জল এভাবে হেলায় ফেলতে নেই দিদিভাই।”
শুভ্রতা শ্বাস টেনে টেনে বললো,
—” তুমি ওদের মানা করে দাও না দাদু। তুমি হজ্জ থেকে ফিরে এলেই নাহয় ওই অথৈ দায়িত্বের আসনে বসিও আমায় । আমি তখন একটুও মানা করবো না, দেখো তুমি। সত্যি বলছি! প্লিজ দাদু। প্লিজ….”
শুভ্রতার কান্নায় অস্থির হয়ে উঠলেন আনিমুল হক। দম টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। খানিকবাদে গমগমে গলায় আওয়াজ করে ডেকে উঠলেন উনি,
—” শফিক? শফিক?এই শফিক?”
উঁচু গলায় তিনবার ডেকেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন আনিমুল হক। আবারও দম টেনে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। কিছুক্ষণবাদেই হন্তদন্ত করে দরজায় এসে দাঁড়ালো চল্লিশ/পয়তাল্লিশ বছরের এক ভদ্রলোক। চোখে-মুখে সদ্য ঘুম ভাঙা ছাপ। গায়ে হালকা সবুজ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। গায়ের রঙ শ্যামা। চুলগুলো অগোছালো। গায়ে ধারালো পৌরুষ্যের ছাপ। তাড়াহুড়ো করে দরজায় দাঁড়িয়েই মাথা নিচু করলেন ভদ্রলোক। নরম গলায় বললেন,
—” বাবা ডাকছিলেন?”
আনিমুল হক গম্ভীর স্বরে বললেন,
—” হু। তোমার বড় ভাই আর বড় বউমাকে আমার ঘরে আসতে বলো।”
শফিক এবার চোখ তুলে তাকালেন। তার চোখে বিস্ময়। শুভ্রতাকে বাবার পায়ের কাছে বসে থাকতে দেখে বিস্ময়টা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো তার। বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
—” এখন? এতো রাতে বাবা?”
আনিমুল হক শফিকের দিকে তাকাতেই আবারও মাথা নিচু করলেন শফিক। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,
—” জ্বি বাবা। ডাকছি।”
তারপর নিস্তব্ধতা। সারা ঘরময় শুধু ঘড়ির টিকটক শব্দ। প্রায় দশ-পনেরো মিনিটের মাথায় ঘুম ঘুম চোখে দরজায় এসে দাঁড়ালেন শাহিনুজ্জামান ও রাদিবা আহমেদ। দরজায় দাঁড়িয়েই আনিমুল হককে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—” আসসালামু আলাইকুম, বাবা।”
আনিমুল হক গমগমে গম্ভীর গলায় বললেন,
—” ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভেতরে এসো।”
দু’জনেই দ্বিধা নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। আনিমুল হক কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন,
—” শাহিন? কাল যেন দিদিভাইকে দেখতে এই বাসায় কেউ না আসে। একটা প্রাণীও না।”
রাদিবা আহমেদ বিস্ময়ে স্থবির থেকে হঠাৎই বলে উঠলেন,
—” কিন্তু বাবা…”
আনিমুল হক রাদিবার দিকে তাকালেন। সাথে সাথেই কথা থামিয়ে মাথা নিচু করলেন রাদিবা আহমেদ।
—” আমি যা বললাম তাই হবে। এই ব্যাপারে আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না আমি। কাল এই বিষয়ে আলোচনা হবে। এবার তোমরা যেতে পারো।”
শাহিনুজ্জামান মৃদু গলায় বললেন,
—” জ্বি বাবা। আসছি, আসসালামু আলাইকুম। ”
—” ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
সবাই বেরিয়ে যেতেই দাদুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে রইলো শুভ্রতা। মন থেকে দুশ্চিন্তার ছাপটা অনেকটাই হালকা হয়েছে তার। অন্তত কিছু সময় তো পাওয়া গেল হাতে। দাদুকে রেখে নিজের রুমে আসতে আসতে ঘড়ির কাটা দেড়টা ছুলো। নিজের রুমে পা রাখতেই নিজের ফোনের রিংটোনটা ভেসে এলো কানে। শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকালো। এতো রাতে কে ফোন দিতে পারে তাকে? ফ্লোরে পড়ে থাকা ফোনটা তুলে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক গম্ভীর কন্ঠস্বর,
—” আসসালামু আলাইকুম, হ্যালো?”
কন্ঠটা কানে যেতেই কেঁপে উঠলো শুভ্রতা। তাড়াহুড়ো করে ফোনটা সামনে এনে নাম্বারে চোখ বুলালো। সন্ধ্যা থেকে সাদাফকে কল করতে করতে সাদাফের নাম্বারটাই মুখস্থ হয়ে গেছে তার। ফোনের স্ক্রিনে সেই চিরচেনা নাম্বার দেখেই উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপতে লাগলো তার। কন্ঠনালি যেন শুকিয়ে গেলো। কোনো আওয়াজ না করে চুপচাপ ফোন কানে বসে রইলো সে। ওপাশ থেকে আবারও ভেসে এলো সেই কন্ঠস্বর,
—” হ্যালো? শুনতে পাচ্ছেন? এই নাম্বার থেকে আধা ঘন্টা আগে আমার ফোনে কল এসেছিলো। হ্যালো? হ্যালো?”
এবার নিয়ন্ত্রণহারা হলো শুভ্রতা। হঠাৎই ফুঁপিয়ে উঠলো সে। মেয়েলি কান্নার শব্দে ওপাশের মানুষটি খানিকটা ভরকে গেলো। উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
—” হ্যালো? কে আপনি? শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো?কাঁদছেন কেন? হ্যালো?”
শুভ্রতা হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো,
—” আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। কিছুতেই না।”
শুভ্রতার কথায় ওপাশের মানুষটি যেন থমকে গেলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে মনোযোগী শ্রোতার মতো শুভ্রতার কান্নার আওয়াজ শুনলো সে। তারপর নরম গলায় বললো,
—” শুভ্রা?”
সাদাফের এই ছোট্ট কথাতেই কান্নার বাঁধ ভাঙলো শুভ্রতার। কাঁদতে কাঁদতেই জড়ানো গলায় বললো,
—” আমি অনেকবার ফোন দিয়েছি আপনাকে। কেন তুলেন নি আপনি? আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। কিছুতেই না।”
শুভ্রতার কথায় হেসে ফেললো সাদাফ। বুকের মধ্যে অজানা এক আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো তার। নরম গলায় বললো,
—” শান্ত হও শুভ্রা। আমি আসবো। বাবা-মাকে সাথে নিয়ে আমার ছোট্ট ঘরটা শুভ্রতায় সাজাবো । প্রমিস।”
শুভ্রতা এবার লজ্জায় রাঙা হলো। সাদাফ হয়তো শুভ্রতার লজ্জাটা বুঝে গেলো। এই বুঝাটাই যেন তার কাল হলো। দমটা যেন আটকে আসতে লাগলো। ক্রমেই কান্নারত লাজুক শুভ্রতাকে দেখার এক অপ্রতিরোধ্য তৃষ্ণা জেগে উঠতে লাগলো মনের প্রতিটি কোণে।
#চলবে…