#তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর
পর্ব ৬
নবনী বাবার বাড়িতে যেতে যেতে রাত ১টা বেজে গেলো।নবনীর বাবার বাড়ি ঢাকার বাহিরে। হামিদুর রহমান নবনীকে তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,”আমি পারলাম না ভাই,আপনার হিরের টুকরো মেয়েকে আমার বাড়ির বউ করে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে রাখতে পারলাম না।নিজের কাছে আমি আজ সবচেয়ে বড় অপরাধী। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন।আমার মা’কে আমি নিজ হাতে আপনার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম আজ আবার। আমি জানি পরের জন্ম বলে কিছু নেই,নয়তো পরের জন্মে নবনীর বাবা হতে চাইতাম আমি।তবে আল্লাহর কাছে চাইবো,সব বাবাকে আমার ছেলের মতো ছেলে না দিয়ে আল্লাহ যেনো এরকম মেয়ে দেয়।তাহলে সে বেঁচে থাকতেই বেহেশতের শান্তি পাবে।”
হাশেম আলী কিছুই বুঝতে পারলো না। রাবেয়া ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল চেপে কাঁদছেন।কিছু না বুঝলেও বেয়াই সাহেবের কথা শুনে এটুকু বুঝেছেন রাবেয়া তার মেয়ে একেবারে শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছে।
হামিদুর রহমান হাশেম আলীকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন।
নবনী কারো সাথে কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে গেলো বড় একটা ব্যাগ নিয়ে।নবনীকে কাউন্টারে বসিয়ে রেখে হামিদুর রহমান সাহেব কিছুক্ষণের জন্য বের হলেন।ফিরলেন এই ব্যাগ হাতে নিয়ে। নবনীকে দিয়ে বললো,আগামীকাল সকালে সবাইকে নিয়ে খুলে দেখিও।
হাশেম আলী বারান্দায় রাখা পাটিতে বসে পড়লেন।রাবেয়া তার পাশে বসে আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,”কি এমন হইছে কন তো?বেয়াই সাব এগুলা কি সব কইয়া গেলো?আমার নবনীর লগে ওরা কোনো খারাপ কিছু করছে নি?রাইতের ১ টা বাজে মাইয়াডারে দিয়া গেলো।আমার কেমন জানি লাগতাছে। “
হাশেম আলী নিজের স্ত্রীর হাত চেপে ধরে বললো,”এতো চিন্তার কিছু নাই নবনীর মা।আমার মাইয়ারে আল্লাহপাক কি পরিমাণ ধৈর্য,জ্ঞান,বিনয় দিছে তা কেউ না জানলে ও আমরা দুইজন ভালো কইরা জানি।আমার চাইরটা পোলা মাইয়া, আইজ পর্যন্ত কেউ একটা কথআ কইতে পারছে তাদের নিয়া?আমি মানুষ গরীব হইতে পারি কিন্তু গেরামে আমার একটা আলাদা সম্মান আছে আমার পোলা মাইয়াগোরে দিয়া।সবাই কয়,হাশেম আলী গরীব অইলেও পোলা মাইয়া দিয়া সুখী।আমাগো ট্যাকা পয়সা থাইকাও পোলাপাইন মানুষ করতে পারলাম না।তুমি নবনীরে একটা কথাও জিগাইবা না।আমার মাইয়া নিজ থাইকা যখন মনে করবো কিছু কওন দরকার আমাগোরে,কইবো।আর যদি না কয় তো নাই।নিজে থাইকা একটা কথাও আমার মাইয়ারে তুমি জিগাইতে যাইবা না।আমার মাইয়াডা মনে কষ্ট পাইবো,হয়তো মনে করবো বাপের বাড়ি একেবারে চইলা আসায় বাপ মা’য় হের উপর বিরক্ত।”
রাবেয়া স্বামীর মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো,”এগুলা আপনে কি কন?মাইয়া কি শুধু আপনার? আমার না?আমার মা’রে হেরা ৩ বছরে দুই বার আমার বাড়ি আসবার দিছে।তাও দুই দিন কইরা চাইর দিন থাকছে।আমার কি অন্তর পোড়ে নাই মাইয়ারে দেখবার লাগি?আমার মাইয়া যে আমার বুকে ফিরা আইছে এইডাই তো আমার জন্য অনেক বেশি। আমি ক্যান মাইয়ারে এসব কথা জিগামু?আমি জানি নবনীর বাপ,এই সময় মাইয়াগো মনে কি পরিমাণ যন্ত্রণা থাকে।উত্তর পাড়ার রুবি আছে না।মাইয়াডারে দেখি প্রায় সময় খালপারে বইসা বইসা কান্দে।জামাইয়ের বাড়ি থাইকা হেরা পাঠাইয়া দিছে রুবির পোলা মাইয়া অয় না দেইখা।এখন বাপ মায়ের বাড়িতে আইজ ২ মাস হইলো আইছে। বাপ মা মনে করতাছে মাথার বোঝা।দিনরাত মায়ে গালাগালি করে মাইয়াডারে। বাপে তো মুখ ও দেখবার চায় না।সামনে দেখলেই হাতের কাছে যা পায় তা দিয়াই মারতে চায় মাইয়ারে।এইসব সময় মাইয়াগোরে আরো বেশি আদর যতন করন লাগে যাতে কইরা মাইয়া আগের শোক সামলাই উঠতো পারে।আমি অশিক্ষিত,মূর্খ মাইয়া মানুষ অইলেও কইলাম আল্লাহ এইটুকু জ্ঞান দিছে মাথায়।”
নবনী টিনের বেড়ার সাথে দাঁড়িয়ে বাবা মায়ের সব কথা শুনলো।কৃতজ্ঞতায় নবনীর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।সব বাবা মায়েরা কেনো এরকম হয় না?
বেশিরভাগ ডিভোর্সের পর দেখা যায় মেয়েরা বাবার বাড়িতে যেনো সবার কাছে বোঝা হয়ে যায়। বাবা মা ও মেয়েরে সহ্য করতে পারে না। উঠতে বসতে কথা শুনায়।অথচ মেয়েটার মনের খবর কেউ জানতে চায় না।বুকের ভেতর কি একটা কষ্টের পাহাড় জমিয়ে রেখেছে তা কেউ দেখতে চায় না।
সবাই এসে উপদেশ দিয়ে যায়,মাইয়া মানুষের একটু সহ্য করে চলা উচিত শ্বশুর বাড়িতে। সব ডিভোর্সের জন্য সবসময় মেয়েদের দিকেই আঙুল তোলা হয়।
হাশেম আলী রাবেয়া বললো,”নবনীর জন্য খাবার লও,এতোটা পথ আইলো মাইয়াডা,কে জানে খাইয়া বাইর অইছে কি-না। আর খাইলেও এতো পথ আইছে,এতোক্ষণে পেটে কিছু নাই।”
রাবেয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন মেয়ের জন্য খাবার নিতে।নবনীদের ঘরে ৩ রুম।এক রুমে বাবা মা থাকে।আরেক রুমে নবনীর ভাই সাব্বির থাকে।আর এক রুমে ফাল্গুনী আর চৈতালী থাকে।নবনী বোনদের রুমে গিয়ে দেখে দুজনেই জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। মুগ্ধ হয়ে নবনী তাকিয়ে রইলো বোনদের দিকে।আল্লাহর কি অপরূপ সৃষ্টি!
কি অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে আল্লাহ চৈতালী আর ফাল্গুনীকে বানিয়েছেন দেখলেই নবনীর বুকের ভেতর আনন্দ অনুভব হয়।ফাল্গুনী আর চৈতালী দুজনেই জমজ।নবনীর মনে আছে যেদিন তার দুই বোন জন্ম নিলো নবনীর সে কি আনন্দ। সর্বপ্রথম নবনী বোনদের কোলে নিলো।হাশেম আলী একসাথে দুই কন্যা সন্তান দেখে আনন্দে কেঁদে দিলেন।আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন,নবনী দুই বোনের নাম রাখলো ফাল্গুনী আর চৈতালী। কেননা তখন বসন্ত কাল ছিলো।নবনী তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। সাব্বির তখন ক্লাস ওয়ানে।
রাবেয়া ঘরে এসে বললো,”নবনী মা,আয় খেতে আয়।তোর বাপ বইসা রইছে আইজ তোর লগে আবারও ভাত খাওনের লাইগা।মেয়ে আসছে দেইখা খুশিতে তোর বাপে আর দুনিয়ায় নাই।”
নবনী হাসলো।মা না বললেও নবনী জানে বাবা কেনো খেতে বসেছে।কারণ,নবনীকে খেতে বললে নবনী নিশ্চয় বলবে সে এখন খাবে না।কিন্তু যদি বলে বাবা বসে আছে একসাথে খাবার জন্য তাহলে নবনী আর নিষেধ করতে পারবে না।অথচ বাবা খাবে দুই লোকমা,এর বেশি আর খাবে না।
মা’কে বুঝতে না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো নবনী।হেসে বললো,”আমার ও ভীষণ ক্ষিধে লেগেছে মা,চলো।”
রাবেয়া মেয়ের হাত ধরে নিয়ে গিলেন খাবার ঘরে।রান্না ঘরের এক পাশে খাবার রাখার একটা কাঠের আলমারি আছে। সবাই মাটিতে পাটি বিছিয়ে বসে এখানে রাতে খায়।আর দিনের বেলায় সবাই ঘরের সামনের বারান্দায় বসে খায় ওখানে একপাশে একটা পাটি বিছিয়ে রাখা থাকে সবসময়। অন্যপাশে একটা চৌকি ও আছে।নবনী যেই দুই বার বাবার বাড়ি এসেছিলো তামিম সহ তখন সে আর তামিম এক রুমে ঘুমাতো।সাব্বির তার নিজের রুমে।ফাল্গুনী চৈতালী বাবা মায়ের রুমে।আর বাবা মা বারান্দার এই চৌকিতে ঘুমাতো।
খেতে বসে নবনী দেখলো বুটের ডাল রান্না,পেয়াজ দিয়ে ডিম ভাজা আর আলু ভাজি।নবনীর পাতে পুরো ডিম দেওয়া। নবনী আস্তে করে ডিমটা তুলে রাখলো।নবনী জানে তার ভাই বোনেরা সবাই আজকে ডাল আর আলুভাজি দিয়েই ভাত খেয়েছে।অথচ সে একা একটা ডিম খেয়ে নিবে এখন!এটা তার গলা দিয়ে নামবে না।
রাবেয়া আবারও ডিম তুলে দিতে গেলে নবনী বললো,”মা এখন ডিম দিও না। আমি তোমার হাতের আলুভাজি দিয়েই দুই প্লেট ভাত খেতে পারবো।ডিম মাছ মাংস তো কতোই খেয়েছি। এখন আর এসব ভালো লাগে না। “
রাবেয়া আর কিছু বললো না।মেয়ে আসলে কেনো খাচ্ছে না তা মা হয়ে তিনি না বুঝলে কে বুঝবেন!
মেয়ের অলক্ষ্যে চোখের জল মুছলেন তিনি।হাশেম আলী ভাত খেলেন দুই তিন লোকমা। খাবার পর হাশেম আলী মেয়েকে বললো,”এতো দূর থেকে এলি,একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর মা।নাহলে শরীর খারাপ লাগবে তোর।”
নবনী রুমের দিকে যেতে নিলে হাশেম আলী বললেন,”ওখানে ঘুমাতে পারবি না তুই। এতো গাদাগাদি করে ঘুমাতে হবে না।আমাদের খাটে ঘুমা তুই। আমরা বারান্দায় ঘুমাবো।”
নবনী হেসে বললো,”এক বিছানায় ভাইবোন চারজন মিলে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে বাবা।আমার কোনো কষ্ট হবে না।বোনদের কাছে ঘুমাতে আমার আরো বেশি ভালো লাগবে।”
নবনী বোনদের একপাশে শুয়ে পড়লো তাদের জড়িয়ে ধরে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে।নবনী ভেবেছিলো আজকে তার ঘুম হবে না।কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে শোয়া মাত্রই ঘুম চলে এলো চোখে।ভোররাতের দিকে ঝুম বৃষ্টি নামলো।হালকা ঠান্ডা লাগতে লাগলো।রাবেয়া বক্স থেকে একটা নকশিকাঁথা এনে মেয়েদের গায়ের উপর দিয়ে গেলেন।
বহুদিন পর নবনী বেশ আরাম করে ঘুমালো।
হামিদুর রহমান ফজরের নামাজের পর মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাসায় ফিরলেন।অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজানোর পর সামিম এসে দরজা খুলে দিলো। বাসার সবাই ঘুমে।সামিম উঠেছে নামাজ পড়তে।বাবার সাথে তার অদৃশ্য একটা দূরত্ব রয়েছে। তামিমের আগে বিয়ে করে নেয়ায় বাবা তাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না।তার উপর দিশার উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে হামিদূর রহমানের আরো বেশি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে।
আজ বহুদিন পর সামিম বাবার দিকে ভালো করে তাকালো।বাবার দুই চোখে হতাশার চাপ।এক রাতেই যেনো বয়স বেড়ে গেছে ১০ বছর। সামিমের ভীষণ কান্না এলো।ইচ্ছে করলো বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে,”আমাকে ক্ষমা করে দিন বাবা।কতো বছর ধরে আপনি আমার নাম ধরে ডাকেন না।আমার মাথায় স্নেহের হাত রাখেন না।খুব বড় হয়ে গেছি মনে হয় যেনো।আমাকে আবার ছোট করে দেন বাবা।আমি আবার ছোট হতে চাই।ততটা ছোট, যতটা থাকতে আপনি সবসময় হাত ধরে রাখতেন।আপনার মনে কষ্ট দিয়ে আমি ভালো নেই বাবা।”
সাহসের অভাবে পারলো না।হামিদুর রহমান সোফায় বসে পড়লেন।সামিম নামাজ পড়ে বাবার জন্য চা বানালো। তারপর নিজের হাতে বাবার সামনে রেখে বললো,”চা নিন বাবা।”
হামিদুর রহমানের চোখ লেগে আসছিলো। হঠাৎ করেই “চা নিন বাবা” কথাটা শুনিতেই চমকে উঠে বলে ফেললেন নবনী! তারপর দেখলেন,নবনী নয় সামনে সামিম দাঁড়িয়ে আছে। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বললেন,”নিয়ে যাও চা।আমি খাবো না।”
সামিম বাবার পাশে বসলো। তারপর বললো,”ভাবী কোথায় বাবা?”
হামিদুর রহমান রাগী গলায় বললেন,”যেখানে থাকলে তোমাদের সবার শান্তি সেখানে।চলে গেছে বাবার বাড়ি। শীঘ্রই তোমার ভাইকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে।তারপর সবাই মিলে উৎসব করো তোমরা। “
সামিম বাবার মন খারাপ বুঝতে পেরে আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলো। হামিদুর রহমান চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন।বুকের ভেতর খুব ব্যথা করছে তার।সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলেন,আজকেই ট্রাভেল এজেন্সিতে গিয়ে টিকিট কেটে আসবেন,আজকে রাতের মধ্যে দেশ থেকে চলে যাবেন।মরে গেলে বিদেশের মাটিতে মরবেন।আর ফিরবেন না দেশে।এই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হবে।
চলবে….
রাজিয়া রহমান
[গল্পটি ভালো লাগলে অবশ্যই আমার এই পেইজটিতে লাইক করবেন, তাহলে পরের পর্বগুলো সবার আগে পাবেন।]