#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
” আমার স্ত্রীর কোন ব্যাপারে কখনো না করিনি, কিন্তু কোনদিনই সে আমার কষ্টটা বোঝে নাই । এমনকি বাচ্চাগুলোকে পর্যন্ত নিজের দলে ভিড়িয়েছে। আমি কেন এই সম্পর্কে থাকবো? বহুৎ সহ্য করেছি, আর না। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। আপনার সাথে আসলে কথা বলারও আমার কোন ইচ্ছা নেই। নিতান্তই বাধ্য করেছে পারিবারিকভাবে তাই এসেছি, কোন উপদেশ শুনতে আসিনি। আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে লাভ হবে না। ১০ মিনিট পরে উঠে যাবো, আশা করি কিছু মনে করবেন না।”
আমি হেসে ফেললাম। বললাম,
” আমি শুধু আপনাকে দুটো কথা বলবো;
প্রথমত,কাউন্সেলিং মানে উপদেশ দেয়া না। এটা একটা ভুল ধারণা যে কাউন্সিলর বলে দেয় কি করবেন।
দ্বিতীয়ত, আপনাকে কনভিন্স বা ম্যানিপুলেট করা আমার পেশাগত নীতিবিরুদ্ধ। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
আপনি কথা বলতে রাজি না থাকলে, সেশন কন্টিনিউ করার প্রয়োজন দেখিনা। “
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন,”তারমানে আপনি আমাকে উপদেশ দেবেন না?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “উপদেশ কি আপনি নিজে কম জানেন, যে ঠেকায় পড়ে আমার কাছ থেকে টাইম, এনার্জি, মানি নষ্ট করে সেটা পয়সা গুনে শুনতে হবে?”
ভদ্রলোক অবাক হয়ে, ” তাহলে আপনি কি করেন?”
আমি, ” It’s a very good question. যদি কোনো কারণে কারো খুব দুঃখ হয় বা কেউ রাগ করে বা মানুষটি ভয় পায় তবে সে আমার কাছে আসে, পেশাগত দক্ষতায় সিড়ি ভাঙ্গা অঙ্কের মত আমি ধাপে ধাপে তার সচেতন আর অবচেতন মনকে ডিসেকট করে দেখি মনের কোন ঘরে কি কি অনুভূতি আর চিন্তা ঘাপটি মেরে আছে। যা সেই মানুষটির আচরণকে প্রভাবিত করে। তারপর কি করতে হবে, কি না করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত সেই মানুষটিই নেয়। আমার সেখানে কোনো রোল নেই।”
ভদ্রলোক একটু ঠোঁট বাঁকা করে,” আপনি মনের ঘরে ঢুকতে পারেন?”
আমি স্থির চোখে,” হ্যাঁ।”
ভদ্রলোক, তাচ্ছিল্যের গলায়, “আমার মনের ঘরে চাইলেই ঢুকতে পারবেন?”
আমি, ” সেটা নির্ভর করছে যদি আপনি আমার পেশাগত দক্ষতাকে সম্মান জানিয়ে সত্যি নিজের মনের ঘরটাকে খুঁজে দেখতে রাজি থাকেন। তাচ্ছিল্য থাকলে অবশ্যই না, আর মানুষ হিসেবে আমার দক্ষতারও একটা সীমাবদ্ধতা থাকে, সেরকম হলে কি সমস্যা সেটা বুঝে আমি প্রয়োজনে রেফার করে দেই। আর আপনার যেমন, আমাকে চুজ করবার রাইট আছে, আপনাকে নিয়ে কাজ করবো কিনা আমারও সেটা ভাবার রাইট আছে। ভালো কথা দশ মিনিট কিন্তু হয়ে গেছে।”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আবার একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
চোখাচোখির এই খেলাটা আমি ভালোই পারি। কারণ ছোটবেলায় একজন একজনের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি সে খেলাটা খেলতাম। বড়বেলায় শিখেছি, মানুষের মস্তিষ্কের সাথে ডাইরেক্ট কমিউনিকেট করার ক্ষমতা শুধুমাত্র চোখের দিকে তাকিয়ে সম্ভব। কারণ মস্তিষ্ক সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের অংশ। সেখান থেকে কানেক্টেড থাকে চোখের রেটিনায় অপটিক নার্ভ। তাই একটা গান যে আমরা শুনি, ‘ কথা কিছু কিছু বুঝে নিতে হয় সে যে মুখে বলা যায় না, চোখের কথা মনের কথা, চোখ যে মনের আয়না।’ কথাটা এনাটোমিকালী সত্য।
ভদ্রলোক খুব শান্ত গলায় বললেন, “আমার স্ত্রী আমার কাছ থেকে পারমিশন নেবার প্রয়োজন বোধ করে না। ও পারমিশন চাইলে আমি না করব না, কিন্তু ওকে তো চাইতে হবে। এটা নিয়ে আপনার কিছু করার আছে?”
আমি, ” কাউন্সেলিং এর মূলমন্ত্র হলো, you can’t change others, you only can change yourself. আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আমার কাজ করার কিছু নেই, আমার সামনে এখানে তিনি নেই, আমার সামনে আছেন আপনি। আপনি যদি চান আমরা এটা নিয়ে কাজ করতে পারি।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ভদ্রলোক একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় প্রধান। পরিবারের বড় ছেলে। বাবাও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। কথা প্রসঙ্গে বের হয়ে আসলো, তার বাবা-মার বয়সের পার্থক্য ছিল ১৬ বছর। মা ছিলেন বাবার ছাত্রী। মায়ের ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়; আর বছর ঘুরতেই ভদ্রলোক জন্মান। বয়সের পার্থক্যের জন্য, বাবা-মার মধ্যে স্বাভাবিক খুনসুটি সম্পন্ন দাম্পত্য আচরণের বদলে আজীবন তিনি দেখে এসেছেন ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক।
ভদ্রলোকের বাবা, ভদ্রলোকের মাকে আর ভদ্রলোককে একই টেবিলে পড়াতে বসাতেন। পরবর্তীতে মায়ের পিএইচডি করা পর্যন্ত ভদ্রলোক দেখেছেন বাবাকে একইভাবে গাইড করতে। ফলে, ভদ্রলোক দেখেছেন আশৈশব মা বাবার কাছ থেকে পারমিশন চেয়েছেন, ঠিক যেমনটি ভদ্রলোকও চেয়েছেন। সব সময় স্বামীর কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে এই মেসেজটাই ভদ্রলোক পেয়েছেন অবচেতন ভাবে।
ভদ্রলোক বাবার শাসনের বাইরে মুক্তির স্বাদ পান বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। প্রথম বছরেই ক্লাসের বাবুই পাখির মতন ছোটফটে মেয়েটির প্রেমে পড়েন। ভদ্রলোক যেহেতু জীবনে নিজের ইচ্ছাগুলো মুখ ফুটে বলতে পারমিশন পাননি বাবার কড়া শাসনে, তাই মেয়েটি যখন অবলীলায় নিজের ইচ্ছাগুলো বলতো অবাক হয়ে যেতেন। তবে প্রেমে পড়েছেন এটা বলতেও সময় লেগেছিল ৭ বছর। তখন দুজনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত বিদেশে। এরপর যা হয় বিয়ে, সংসার জীবনের চাকা ঘুরে চলে।
কিন্তু ধীরে ধীরে তিক্ততা জমতে থাকে। কারণ ভদ্রলোকের ‘বিলিভ সিস্টেম’ বিশ্বাস করে স্ত্রীকে সবকিছুতে পারমিশন চেয়ে নিতে হয়। অধ্যাপনা পেশা ভদ্রলোকের পারমিশন দেবার ধারণাকে রিইনফোর্স করতে থাকে। ভদ্রলোক অবচেতন ভাবেই তার বাবার ভূমিকায় ঢুকে যান যা ছোটবেলায় দেখে এসেছেন। ক্রমান্বয়ে তিক্ততা তৈরি করে রাগ। এই রাগ এখন এমন পর্যায়ে যে ভদ্রলোক ডিভোর্সের জন্য তৈরি।
আমি ভদ্রলোককে বললাম, “আপনার ১৬ বছরের ছোট কেউ আর সমবয়সীর সাথে আচরণ কি একি হবে?”
আবার সেই ঠায় তাকিয়ে থাকা।
পুনশ্চ : অনেকদিন আগে ডাক্তারদের ক্ষেতের কলাটা মুলাটা ভেট দেওয়া প্রচলন ছিল। দিন পাল্টেছে। ইদানিং সেই ভেট রূপান্তরিত হয়েছে ট্রিট নামে ফুডপান্ডার সাহায্যে করোনাকালে। সেই ধারাবাহিকতায় ভদ্রলোক চাইনিজ খাবার পাঠিয়েছেন। কারণ সেকেনড ওয়েভ শুরু হয়েছে। আর কে না জানে কেউ কেউ আজও ট্রিট পেতে ভালোবাসে।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রাক্টিশনার।