ইলমা বেহেরোজ
অনেকগুলো পা ওর দিকে এগিয়ে আসছে! হাতে
কোনো অস্ত্র নেই, ও হাত মুষ্টিবদ্ধ করে স্যাঁতসেঁতে
মাটি মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। কয়েক কদম
এগোতেই ছয়টি অল্প বয়সী কিশোর-যুবক পথরোধ
করে দাঁড়ায়। ওদের হাতে লাঠি, ছুরি। এখানকার বখে
যাওয়া ছেলে এরা! বয়সে সবচেয়ে বড় ছেলেটার
মাথায় কোঁকড়া চুল। ছেলেটা আমিরের দিকে ছুরি
ধরে বলল, ‘এই এলাকায় থাকতে হইলে আগে
আমগোরে চাঁদা দিতে হয়। মানিব্যাগ বের কর।’
গলির শেষ প্রান্ত থেকে দলের দুজন লোেক সাহায্য
করার জন্য এগোতে চাইলে আমির বলে উঠল,
‘খামো।’
এই কথা শুনে কোঁকড়াচুলো রেগে গেল। আমিরের গলায় ছুরি ধরল, ‘কী কইলি? আমারে থামতে কস? এতো সাহস! মরতে চাস?”
আমির মজা পাচ্ছে। ও আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত
নেয়। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ছেলেটির
হাতে দেয়। সেখানে দুটো পাঁচশো টাকার নোট ছিল।
ছেলেগুলো খুশি না হয়ে বিস্মিত হলো। আমির যে
ভয় পাচ্ছে না তা স্পষ্ট, অথচ চিৎকার চেচামেচিও
করছে না, বাঁধাও দিচ্ছে না, সোজা মানিব্যাগ দিয়ে দিল! ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না কোঁকড়াচুলোর। বলিষ্ঠ আমিরকে প্রথম দেখে ভেবেছিল এই লোককে চাঁদার জন্য ধরলে নিশ্চয়ই প্রতিহত করবে। তাই সে এতজনকে নিয়ে এসেছে। আমির চলে যাবার সময় কোঁকড়াচুলোর কাঁধ চাপড়ে চোখ টিপে উৎসাহ দিল, ‘চালিয়ে যাও। ভালো করেছ।’
ছেলেগুলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল আমিরের যাওয়ার পানে। কিছুই বুঝল না। লোকটা পাগল নাকি?
গুকতারা আমিরের দলের একজন বয়স্ক লোকের ছিল। লোকটি সারাজীবন পাপ করেছে, রাস্তা থেকে বাচ্চাদের তুলে নিয়ে ছিনতাইকারী, ভিক্ষুক, মাদক ব্যবসায়ী বানিয়েছে। শত শত নারীর সঙ্গে স্ফূর্তি করেছে, ধর্ষণ করেছে কিন্তু শেষ বয়সে এসে তার মনে হয়, সে এতকাল ভুল করেছে! মৃত্যুর ভয় পেতে থাকে। অনুতপ্ত হয়ে বাঁচতে চায় সবকিছু থেকে। লোকটা খ্রিস্টান ছিল। দুনিয়াতে আপন বলতে কেউ ছিল না। পাদ্রীর কাছে সব স্বীকার করে পবিত্র হবার অভিলাষে যখন উপনীত হয় আমিরের কথায় তার লোকবল এই বাড়িতেই লোকটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারপর থেকে বাড়িটি পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে আলমগীর এখানে আসে। স্থানীয়দের
বলেছে, লোকটি তার আত্মীয়। এই বাড়ির উত্তরাধিকার বলতে কেউ নেই। তাদের যেকোনো প্রয়োজনে অবাধে প্রবেশ করতে পারে এখানে। আমির শুকতারার গেইট পার হয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে। পদ্মজার কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে ভয় পেয়ে যায়। দ্রুত রুমে প্রবেশ করে। পদ্মজা ঘুমাচ্ছে। সারাদিন কাজ করেছে, বাড়িঘর নিজের মতো গুছিয়েছে তাই সন্ধ্যা হতেই নামায আদায় করে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর মাথার কাছে হারিকেন জ্বলছে, নিবু নিবু আলো। পিছনে বিশাল জানালা। জানালা দিয়ে হুরহুর করে বাতাস ঢুকছে। ঠান্ডায় গুটিসুটি মেরে আছে পদ্মজা। আমির পাতলা কাঁথা টেনে দেয় ওর গায়ে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশের বৃত্তাকার চাঁদ। চাঁদের গায়ে কালো কালো দাগ। হারিকেনের আলোয় আবেশী এক অনুভবে মগ্ন হয়ে আমির পদ্মজাকে জানায়, ‘দেখো, চাঁদের গায়েও দাগ আছে। তোমার গায়ে নেই।’
কোথা থেকে যেন চাপা চেঁচামেচি ভেসে আসছে। আগ্রহবোধ থেকে আমির বারান্দা থেকে উকি দেয়।
দূরের এক বস্তিতে দুজন লোক মারামারি করছে। ও রান্নাঘরে গিয়ে কালোজিরের বক্স খুঁজে বের করে। পদ্মজা নিয়মিত কালোজিরা চিবোয়া হেমলতা এই অভ্যাস তৈরি করে দিয়ে গেছেন।যেখানে যায় সঙ্গে করে কালোজিরে নিয়ে যায়। আমির হাতে কিছুটা নিয়ে মুখে পুরে নেয়া কী বিস্বাদ!
তবুও সহ্য করে চিবোতে থাকে সিগারেটের গন্ধ দূর করার জন্য। পদ্মজা টের পেলে তুলকালাম ঘটবে।
রুমে এসে কিছুক্ষণ পদ্মজার পাশে বসে থাকে। হলুদ আলোয় ওর মুখটা দুই চোখ ভরে দেখে। ঘুম পাচ্ছে না, করার মতোও কিছু নেই। এই মুহূর্তে বের হবারও সুযোগ নেই। পদ্মজাকে দেখা ছাড়া আর কী করার আছে? অবসরে পদ্মজাকে দর্শন করাও একটা আবেগঘন ভালবাসার অনুভূতি সৃষ্টি করে বুকে।
আমির আলতো করে এক আঙুলে পদ্মজার নাক স্পর্শ করল, গাল, ঠোঁট, চিবুক স্পর্শ করল তারপর হেসেজাদু নিয়ে এসেছে এই নারী!
সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর কান্নার স্বর শোনা যাচ্ছে। আমির আবার বারান্দায় যায়। বস্তিতে এখন আর কেউ মারামারি করছে না। একটা টিনের ঘরের সামনে অনেক মানুষ ভীড় করেছে। তার হঠাৎ করে পারিজার কথা মনে পড়ে। আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে। সেখানে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্ররাজি।
আকাশের তারাদের দেখতে দেখতে চোখের তারায় ভেসে উঠে পারিজার জন্ম। সেদিন সকালে পদ্মজার খিচুনিযুক্ত ব্যথা শুরু হয়। ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে এবং সময়ের সাথে সাথে তা ঘন হতে থাকে। ওর যন্ত্রণা দেখে আমির উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করে। দিকদিশা হারিয়ে ফেলে। প্রসব বেদনা সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় ওর মনের কোণে বাজতে থাকে, পদ্মজা হয়তো মারা যাচ্ছে।
হাসপাতালে পৌঁছাতেই ডাক্তাররা পদ্মজাকে কেবিনে নিয়ে যায়। সে তখন বিশটি হাড়ভাঙা ব্যথার সমান যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। আমির ভেতরে যেতে চাইলে তাকে আটকে দেয়া হয়। বাহির থেকে পদ্মজার আর্তনাদ শুনে আমির চিৎকার করতে শুরু করে, ‘ওর ব্যথা কমছে না কেন? ওর ব্যথা কমান, ঔষধ দিন… এখানে কী ভালো ডাক্তার নেই? যত টাকা লাগে আমি
দেব, ওর ব্যথা কমান।’
ফরিনা, আলমগীর, লতিফা, মজিদ এরা উপস্থিত ছিল। কেউ আমিরকে শান্ত করতে পারছে না। তার চিৎকারে কেবিনের সামনে ভীড় জমে যায়। পুরো হাসপাতালে একটা মাত্র চিৎকার বাজছে, ‘ব্যথা কমাও, ওর ব্যথা কমাও। এখনো কেন কাঁদছে? ডাক্তাররা এতক্ষণ ধরে কী করছে? আমার বউয়ের কিছু হলে আমি সবকটাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।’
ওর চিৎকার চেচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ মামলার হুমকি দেয়। একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে যায়। আলমগীর আমিরকে বলে, ‘আমির কী করছিস? মা হতে চাইলে এরকম ব্যথা তো হবেই। এটা স্বাভাবিক।’
ফরিনা তসবিহ পড়ছেন। তিনি চেয়েছিলেন ধাত্রী দিয়ে এই মুহূর্তটা পার করবেন কিন্তু আমির বড নিয়ে হাসপাতালে
দৌড়ে চলে এসেছে। কে জানে কী হয়। এসব
ডাক্তারকে তিনি বিশ্বাস করেন না।
একসময় পদ্মজার কান্না থেমে গেল, শিশুর কান্নায়
মখরিত হলো চারপাশ। আলমগীর সঙ্গে সঙ্গে আমিরকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ‘বাবা হয়ে গেছিস।’
অজানা এক শিহরণে আমিরের গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে। সএ দ্রুতপদে প্রথমে পদ্মজার সঙ্গে দেখা করল, পদ্মজা হাসছে।
তার হাত ধরে চুমু খেয়ে আমির বলল, ঠিক আছো?’
পদ্মজা মাথা নাড়াল। দূর্বল গলায় কোনোমতে বলল, ‘ও এসেছে, আমাদের কাছে চলে এসেছে।’
আমির যখন পারিজাকে দেখল একটা সংকোচ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল তাকে। মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকল এক আতঙ্ক, এই হাত দিয়ে নিষ্পাপ শিশুটিকে স্পর্শ করলে যদি অপবিত্র হয়ে যায়?
পিতা সন্তানকে কোলে নিচ্ছে না ব্যাপারটা দেখে যখন সবাই বলাবলি করছিল তখন আমির সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে। সেদিন কি সে বুঝেছিল, তার ছোঁয়ায় ফুটফুটে শিশুটিকে সত্যিই কালো অন্ধকার ঘিরে ফেলেছিল চারিদিক থেকে!
স্মৃতি রোমন্থন করে আমিরের গলা জ্বলছে! বুকের
ভেতরটা হাহাকার করছে। জীবনের এ কোন স্তরে দাঁড়িয়ে আছে সে? সর্বক্ষণ চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক, আফসোস, চাপ, আক্ষেপ, ঘৃণা ঘিরে রাখে। পদ্মজা ছাড়া সুখ বলতে কি আছে তার? সেই সুখকে ধরে রাখতেও ছুটতে হচ্ছে। ছোটার শেষ নেই।
দুটো হাত পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই আমির শান্ত হয়ে যায়। পদ্মজা ঘুমঘুম চোখে বলে, ‘কী করছেন?’
আমির না ফিরেই বলল, ‘তারা গুনছি।’ কয়টা গুনলেন?’ আমিরের পিঠে মাথা রেখে চোখ বুজল ও। আমির বলল, ‘সত্তরটা।’
‘কখন ফিরেছেন?’
‘অনেকক্ষণ আগে।’
আমিরের গায়ের ওম গভীরভাবে অনুভব করার জন্য পদ্মজা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে।
আমির আকাশের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘মাঝেমধ্যে কি ইচ্ছে করে জানো?’
‘কী?”
‘তোমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হই। সারাজীবন পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। কখনো যেন প্রবীণ না হই,তৃষ্ণা না লাগে। হাতে হাত রেখে অনন্তকাল হেঁটে যাই।’
পদ্মজা হাসল। বলল, ‘অমরত্ব চাচ্ছেন?’
‘জনম জনম তোমার সঙ্গে থাকার জন্য অমরত্বই চাই। নশ্বর এই দুনিয়াতে অবিনশ্বর জীবন চাই।’
‘আমরা জান্নাতে অনন্তকাল একসঙ্গে থাকব, ইনশাআল্লাহ।’
এ কথায় আমির থমকে যায়, বুকে কিছু একটা বিঁধে।
পদ্মজা তাড়া দেয়, ‘বলুন, ইনশাআল্লাহ।’
আমির বিড়বিড় করে, ‘ইনশাআল্লাহ।’
পদ্মজা সামনে এসে ওর বুকে মাথা রাখে। আমিরের হাত দুটো রাতের ঠান্ডা বাতাসে বরফের মতো হয়ে গেছে। বর্ষাকালের সুবিধা হচ্ছে সবসময় বাতাস আর বৃষ্টি হয়। তাই এই সময়টা ভালো লাগে পদ্মজার। সে বলল, ‘আজ শেষরাতে বৃষ্টি হবে তাই না?’
‘প্রতিদিনই হচ্ছে। ‘হঠাৎ চোখমুখ কুঁচকে ফেলল পদ্মজা, আমিরের মুখের কাছে নাক নিয়ে শুঁকতে শুঁকতে বলল, ‘কালোজিরে খেয়েছেন?’
আমির থতমত খেয়ে বলল, ‘হা, খেয়েছি।’
‘কেন?’
‘এটা কেমন প্রশ্ন! তুমিতো সবসময়ই খেতে বলো, তাই খেলাম।’
পদ্মজা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘কিন্তু আপনি তো খান না! কী লুকোচ্ছেন?’
আমির কিছু বলার পূর্বে পদ্মজা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, ‘বাজারে গিয়ে সিগারেট খেয়েছেন!’
আমির ধরা পড়া চোরের মতো অপ্রস্তুত হাসল। গল্প বানানোর চেষ্টা করল না।
চলবে,,,,
সম্পূর্ণ গল্প