# আরশিযুগল প্রেম
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব- ২১
গোধুলি সন্ধ্যা। চারদিকে শেষ বিকেলের হলদেটে আলো। পশ্চিম আকাশে মিশে আছে একগুচ্ছ থোকা রক্ত। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাফেরায় ভর করেছে অস্বস্তিকর এক ক্লান্তি। পথচারীদের দেখে মনে হচ্ছে, তাদের জীবনীশক্তি যেন শেষের দিকে। শরীর তাদের চলছে না। মনটাও যেন ঠিক ভরসা পাচ্ছে না। বাড়ির পাশের মোটা, বৃদ্ধ আম গাছটার
চিকন ডালে বসে ঝিমাচ্ছে একটি নীল-কালো পাখি। আচ্ছা? এই পাখিটার কি কোনো সঙ্গী নেই? এই পাখিটাও কি শুভ্রতার মতোই কষ্টের আগুনে জ্বলছে? শুভ্রতা কাতর চোখে, পাশের বহুতল দালানটির দিকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে তাকায়। বুকটা কেমন যেন ভারি লাগছে তার। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এমন খাপছাড়া মন খারাপ হয় তার। দিনের শেষ ভাগে, চারদিকের আলোয় পঁচা খড়ের নিগড়ে পড়া পানির মতো রঙটি দেখতে পেয়েই বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার। মনে হয়, জীবনটা তার বৃথা। এই দীর্ঘ জীবনের আরো একটি দিন বৃথায় বয়ে গেলো অথচ কিচ্ছু পাওয়া হলো না। কিচ্ছুটি না। শুভ্রতাকে এভাবে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছাঁদের রেলিং থেকে লাফিয়ে নামলো অর্পন। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে শুভ্রতার গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো,
—” শুভি বেবি? একদম মন খারাপ করিস না তো তুই। আমরা আছি না? আচ্ছা? ওই ব্যাটার বাড়ি বনানীর ঠিক কোন জায়গায় বল তো?”
শুভ্রতা ভোঁতা মুখে তাকালো। মৃদু গলায় বললো,
—” জানি না।”
ডানপাশের রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পুষ্পি। শুভ্রতার উত্তরটা শুনে মুহূর্তেই প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,
—” মোবাইল নাম্বার? মোবাইল নাম্বার আছে তো নাকি?”
শুভ্রতা মাথা নাড়লো। পুষ্পি ক্ষেপে ওঠে বললো,
—” প্রেমে পড়েছিস অথচ ফোন নাম্বার জানা নেই? তোর জানাটা আছে কি,হ্যাঁ?”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কপট রাগ নিয়ে বললো,
—” প্রেমে পড়ার সাথে ফোন নাম্বার জানার বাধ্যবাধকতা আছে নাকি? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, প্রেমে পড়ে আমি মহান কাজ করে ফেলেছি যার জন্য ও খুশিতে আত্মহারা হয়ে নাচতে নাচতে বলবে…. শুভি? শুভি? তুমি আমার প্রেমে পড়ে আমাকে ধন্য করেছো। দয়া করে, ফোন নাম্বার টা রেখে আমায় কৃতার্থ কর।”
অর্পন বিরক্তকর শিষ তুলে বললো,
—” উফ! তোরা ঝগড়া করছিস কেন বল তো? আরে, ফোন নাম্বারটা পাওয়া কোনো ব্যাপার নাকি? তোর ওই শেফা আপুর কাছেই তো পাওয়া যাবে ফোন নাম্বার। উনার কাছেই চেয়ে নে।”
তনয়া এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এবার বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,
—” এটা বেশ ভালো প্ল্যান। কিন্তু, ফোন নাম্বার দিয়ে কি করবি তোরা? বাসার ঠিকানা চাইবি?”
পুষ্পি এবার চরম বিরক্তি নিয়ে তাকালো। পুষ্পির ধারনা, তনয়া দিন দিন আহাম্মকের চূড়ান্ত হচ্ছে। আর তার এই বিশেষ অবনতির একমাত্র কারণ হলো ‘হাসি’। মা বলে, অতিরিক্ত হাসলে এবং অতিরিক্ত কথা বললে ব্রেনের ধার কমে। আর এই মেয়ের কমছে বুদ্ধির ধার। মাঝে মাঝে এমন সব বোকা বোকা কথা বলে যে তনয়ার দু’গালে কষে দুটো চড় লাগাতে ইচ্ছে করে। ডাফার একটা! পুষ্পি বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে হাত জোড় করে বললো,
—” দোহাই লাগে। তুই কিছুক্ষণ চুপ থাক, মেরি মা। এমনি মেজাজ খারাপ। তোর এইসব আহাম্মক মার্কা কথা বলে মেজাজটাকে আর ফোর্টি নাইনের পর্যায়ে নিয়ে যাস না। প্লিজ!”
তনয়া অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—” সে কি! পুষি? তুই যেমনটা ভাবছিস তেমনটা কিন্তু একদম নয়,বুঝলি? আমার আর আঙ্কেলের মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তো উনাকে বাবা বাবা নজরে দেখি। শুধু শুধু মা ডেকে আমাদের বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নষ্ট করার পায়তারা কেন করছিস, বল তো?”
পুষ্পি রাগী চোখে তাকালো। এই মেয়েটাকে যতটা বলদ ভেবেছিলো ততটা বলদ সে নয়। প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলতে এক্সপার্ট। অর্পন মধ্যস্থতার ভঙ্গি করে বললো,
—” চাপাচাপি থামা তো। আগে প্ল্যানটা এক্সিকিউট করা হোক। শুভি? শেফা আপুকে ফোন লাগা জলদি।”
শুভ্রতা অসহায় মুখে তাকালো। মুখ কালো করে বললো,
—” অসম্ভব! শেফা আপুর থেকে নাম্বার নেওয়া অসম্ভব। ওর কাছে আমি সাদাফের “স” উচ্চারণ করতেই দুনিয়ার ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করে দিবে ও। খুঁচাতে খুঁচাতে তিল থেকে তাল বানিয়ে দু’মিনিটের মধ্যে পুরো গোষ্ঠীর কানে পৌঁছে দেবে। আমি যতই ফ্রীডমভাবে চলাচল করি না কেন। তোরা তো জানিস, প্রেম-ভালোবাসা দাদুর চক্ষুশূল। বাবাও তো কম যান না। একবার উনাদের কানে পৌঁছালে আর নিস্তার নেই। মা আর বড় খালামনি তো আছেনই।”
অর্পন আর পুষ্পি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তনয়াও ঠোঁট কামড়ে দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর হঠাৎই বোকা বোকা গলায় বলে উঠলো তনয়া,
—” আচ্ছা? শেফা আপুর অগোচরে উনার ফোন থেকে নাম্বারটা কালেক্ট করা যায় না?”
তনয়ার কথায় তিনজনেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। ওদের ওভাবে তাকাতে দেখে দ্বিধান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো তনয়া,
—” হোয়াট হ্যাপেন্ড? ইজ ইট সাউন্ডস বেড?”
প্রথম দফায় জবাব দিলো না কেউ। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো তিনজন। তনয়াকে তিনজনেই শক্ত করে চেপে ধরে, তার শ্বাস আটকে ফেলার সম্পূর্ণ চেষ্টা চালিয়ে বললো,
—” লাভ ইউ তনু বেবি। ইট’স সাউন্ডস টু মাচ গুড ইয়ার।”
তনয়া শ্বাস নেওয়ার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বললো,
—” ছাড় বলছি। ছেঁচড়াদের মতো চিপকাস কেন? জিন্দেগীতে আর কোনো আইডিয়া দিবো না তোগোর। কসম! মইরা গেলাম, খোদা! ছাড়ড়ড়… ”
তনয়াকে শ্বাসকষ্টের রুগী বানিয়ে তবেই সরে দাঁড়ালো তিনজন। শুভ্রতা আগ্রহ নিয়ে বললো,
—” কিন্তু কি করে কি হবে? ওর অগোচরে নাম্বার কি করে নেবো?”
অর্পন বিজ্ঞের মতো হাত নেড়ে বললো,
—” নো চাপ। কাল আমরা ভার্সিটি শেষে ডিরেক্ট উত্তরা যাবো, তোর খালামনির বাসায়। সেখানে যাওয়ার পর কিছু একটা বন্দোবস্ত ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। আর ফোন নাম্বার না পেলেও খুব একটা সমস্যা নেই। দরকার পড়লে বনানীর অলিগলিতে পোস্টার লাগিয়ে খুঁজবো ব্যাটাকে। গোয়েন্দা লাগবো…… খুঁজে পাওয়ার পর, মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বাংলা ছবির মতো বলবো, ‘ ভালোবাসা দিবি কিনা বল।’ ”
অর্পনের কথায় তিনজনেই বাঁকা চোখে তাকালো। ওদের এভাবে তাকাতে দেখে বেশ খানিকটা অপ্রস্তুত হলো অর্পন। কুকরানো চুলগুলো কানের পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো,
—” এভাবে তাকাস কেন? আমি সিরিয়াস। তোদের কি ডায়লগটা পছন্দ হয় নি? শাকিব খানের কোনো ডায়লগ লাগবে?”
অর্পনের কথাটা শেষ হতেই চারজনেই ফিক করে হেসে ফেললো। পুষ্পি ডান কাঁধের ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে হাসিমুখেই বললো,
—” তোর মাথা লাগবে। শুভি? আজ যাই রে। এখনই মাগরিবের আজান পড়ে যাবে। সাতটার আগে বাসায় না পৌঁছোলে আম্মুর ঝাড়ুর বাড়ি থেকে আর রেহাই পাওয়া যাবে না। একদম টেনশন করিস না….তোর সাদাফ বেবিকে এবার ছিঁপে তুলবোই তুলবো। মন চুরি করে পালাবে অথচ শাস্তি পাবে না, তা কি হয়? শুধু শাস্তি নয়। ধরা পড়লে, শালিদের হাতে তার রিমান্ড নিশ্চিত!”
শুভ্রতা মুচকি হাসলো। চারদিকে একটু একটু করে নেমে আসছে অন্ধকার। দূর আকাশে দু’একটা পাখি উড়ে চলেছে বিরামহীন। ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততা মাখা কোলাহল ছাপিয়ে কাছের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের সুমধুর সুর…. “আল্লাহু আকবর!” ” আল্লাহু আকবর!” আজানের শব্দ কানে আসতেই যেন চমকে উঠলো চারজন। দ্রুত পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো তারা। রাদিবা আহমেদ নামাযের জন্য চেঁচাচ্ছেন। শুভ্রব মায়ের চেঁচামেচিতে একরকম বাধ্য হয়েই টুপি হাতে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে অবশ্য শুভ্রতাদের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। শুভ্রতার ধারনা তার বান্ধবীদের মধ্যে থেকেই কেউ একজনের সাথে শুভ্রবের প্রণয় চলছে। সোজা বাংলায় যাকে বলে, প্রেম! কিন্তু এই প্রেম নামক বিষয়টি ঠিক কার সাথে চলছে তা ঠিক ধরতে পারছে না শুভ্রতা।
__________________
মাথার উপর তেজস্বী সূর্যের উত্তাপ। চৈত্র মাসেও কি ভীষণ ভ্যাপ্সা গরম। এই গরম আর উত্তাপ ছাপিয়ে উত্তরায় এসে পৌঁছেছে পাঁচ বান্ধবী। শুভ্রতার ফর্সা মুখ সূর্যের চড়া মেজাজে গোলাপী রূপ নিয়েছে সেই অনেক আগে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই শুভ্রতার। উত্তেজনা আর দ্বিধায় বুকটা কেমন ধরফর করে কাঁপছে তার। পাঁচ বান্ধবী মিলে হাজারো পরিকল্পনার ছক এঁকে লিফ্টে গিয়ে উঠলো। লিফ্টের বাটন চেপে টানটান উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সবাই। এমন একটা ভাব যেন নাম্বার নয় আস্ত এক রাজ্য হাসিল করতে চলছে তারা। আবার কখনো কখনো নিজেদের ফেলুদার মতো দুর্ধষ গোয়েন্দা ভেবে অভিমান করছে। দু’মিনিটের মাথায় লিফ্ট গিয়ে পৌঁছালো গন্তব্যে। কলিংবেল চাপার পর চাপা গুঞ্জন শুরু হলো তাদের মধ্যে। দরজাটা খুলে যেতেই হুট করেই স্তব্ধ হয়ে গেলো সবাই। সায়িদা বেগম এতোগুলো মেয়েকে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। উনার চোখ-মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, মঙ্গল গ্রহ থেকে টুপ করে কিছু এলিয়েন এসে ধরা দিয়েছে তার দরজায়। ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যের এবং তাতে সে যথেষ্ঠই আশ্চর্যান্বিত। মেয়েদের মধ্যে থেকে একটি পরিচিত কন্ঠে ভেসে আসায় কুঁচকানো ভ্রু দুটো খানিকটা রেহাই পেলো। ডানদিকের কোণে শুভ্রতাকে দেখতে পেয়ে বেশ খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন বলেই মনে হলো। সবাইকে ভেতরে আসতে বলে কৌতূহল দমন না করতে পেরে চুপিচুপি শুভ্রতাকে জিগ্যেস করেই ফেললেন,
—” কি রে? এভাবে পাল নিয়ে এতোদূর এলি। কাহিনী কি?”
শুভ্রতা নির্বিকার মুখভঙ্গি নিয়ে একের পর এক মিথ্যা দিয়ে সুন্দর একটা গল্প বেঁধে ফেললো। সবার এখানে আসার কারণ শুধুমাত্র শেফার সাথে গল্প করা এবং স্টাডি ট্যুরে কি কি শিক্ষনীয় বিষয় দেখলাম তার বিস্তারিত জানা। এটুকুতেই খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন সায়িদা বেগম। উপরে উপরে একটু গাম্ভীর্য দেখালেও ভেতরে ভেতরে যে তিনি গলে মোম হয়ে আছেন তা বেশ ভালোই জানে শুভ্রতা। সায়িদা বেগম নিজে বিএ পাস করার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও ‘শিক্ষা’ শব্দটা শুনলেই আপ্লুত হয়ে পড়েন। তার ধারণা, নিউ জেনারেশনদের উচিত টয়লেটে বসেও জ্ঞানার্জন করা। সে যায় হোক, পাঁচ বান্ধবী প্ল্যান মোতাবেক শেফাকে ঘিরে বসলো। গল্পের রসে শেফাকে ভুলিয়ে রেখে পাশ থেকে সাবধানে ফোনটা সরিয়ে নিলো প্রমা। একটু আসছি বলে সেখান থেকে সরে এলো প্রমা আর তনয়া। ফোন হাতে পেয়েছে বলে খুশিতে নেচে উঠলেও মুহূর্তেও মিইয়ে গেলো সেই খুশি। ফোনে পাসওয়ার্ড ইন করতে হবে, এখন উপায়? তনয়া প্রেমা একে-অপরের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো। তনয়া ঠোঁট কামড়ে বললো,
—” এই? শেফা আপুর বরের নাম কি জানি? সাদাফ?”
—” ধুর! সাদাফ তো শুভ্রতার প্রেমিক পুরুষের নাম। শেফা আপুর হাজবেন্ডের নাম “আ” দিয়ে কিছু একটা হবে। ঠিক মনে পড়ছে না।”
—” আদিব?”
প্রেমা মাথা নেড়ে বললো,
—” উহুমম৷ মনে হচ্ছে না আদিব। অন্যকিছু!”
তনয়া কপাল কুঁচকালো। চোখ পিটপিট করে একটানা বললো,
—” আবির? আরিয়া? আয়ান? আরাফাত?”
প্রেমা চোখ বড় বড় করে বললো,
—” এগুলো কিছু নয়। তবে ‘আরা’ ‘আরা’ দিয়ে কি জানি? ধুর! এই লম্বু স্যারটা ঠিকই বলে রে তনু। আমি দিন দিন লাস্ট ব্রেঞ্চার স্টুডেন্ট হয়ে যাচ্ছি। কিচ্ছু মনে থাকে না। কাল থেকে হরলিক্স খেতে হবে, বুঝছিস?”
তনয়া হেসে ফেললো। হাসি নিয়েই কিছু একটা বলবে তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো প্রেমা। নিজের ফোন দিয়ে শুভ্রতার ফোনে ডায়াল করে দরজা থেকে হাত নাড়লো। শুভ্রতা ফোনের দিকে কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকেই প্রেমাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে মাথা তুলে তাকালো। দরজার আড়ালে প্রেমাকে দেখতে পেয়েই ঝটপট ওঠে ওদের কাছে চলে গেলো সে। তারপর শুরু হলো পাসওয়ার্ড গেইস করার চেষ্টা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। উল্টো ফোনে কারেক্ট পাসওয়ার্ড ইন করার জন্য টাইমার শুরু হয়ে গেলো। শুভ্রতা, প্রেমা, তনয়া তিনজনই ভঙ্গ হৃদয় নিয়ে একে একে আগের জায়গায় গিয়ে বসলো। পুষ্পিকে ইশারা ইঙ্গিতে বিষয়টা বুঝাতেই সেও বেশ চিন্তায় পড়লো। কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে গল্প করার পর হুট করেই নিজের ফোনটা উল্টে পাল্টে মুখ কালো করে বলে উঠলো পুষ্পি,
—“ইশ!”
শেফা ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” কোনো সমস্যা, পুষ্পি?”
পুষ্পি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো,
—” আসলে আপু… ভার্সিটি থেকে ওদের পাল্লায় পড়ে ডিরেক্ট এখানে চলে এসেছি। বাসায় একদমই জানানো হয় নি। আম্মু নিশ্চয় খুব টেনশন করছে। তারওপর আমার ফোনে ব্যালেন্সও নেই। ইমার্জেন্সি নেওয়ার পর আর রিচার্জ করতে মনে ছিলো না। এখন কি করি?”
অর্পন হুট করেই বলে উঠলো,
—” আরে আমারটা নে। আমার তো এবেল…”
এটুকু বলতেই অর্পনের উরুতে খুব জোরে চিমটি কাটলো পুষ্পি। অর্পন ‘আহ’ করে উঠে পুষ্পির দিকে তাকালো। পুষ্পির চোখ রাঙানো দেখে কিছুটা আঁচ করতে পেরে থতমত খেয়ে গেলো সে। অযথা হেসে বললো,
—” আহ্ মানে হলো…আমারটা নিতে পারতি বাট আমার ফোনটার ব্যাটারে ডেড হয়ে গেছে। চার্জজার…. হ্যাঁ! কাল থেকে চার্জজারটা খুঁজে পাচ্ছি না। কি এক্টা ঝামেলা।”
তনয়া জানালো তার ফোনে জীবনেও টাকা থাকে না। তার নাকি ফোনে ব্যালেন্সের প্রয়োজনই পড়ে না। প্রেমা জানালো সে ফোন নামক বস্তুটি নিজের সাথে রাখেই না। বেশিরভাগ সময়ই নাকি টেবিলের ড্রয়ারে পড়ে থাকে তার ফোন। শেষমেষ পুষ্পির প্ল্যান মোতাবেকই নিজের ফোনের লক ছাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলো শেফা। পুষ্পি তাড়াহুড়ো করে ফোনটা হাতে নিয়েও হতাশ হলো। সাদাফ, সাদাফ ভাই সবরকমভাবে সার্চ দিয়েও সাদাফ নামের কোনো নাম্বার খুঁজে পাওয়া গেলো না। ব্যর্থ মনে শেফাকে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো সে। সবার মনেই বিষন্নতার ছোঁয়া। এতো এতো প্ল্যানগুলো যে এভাবে মাঠে মারা যাবে, কে জানতো? সায়িদা বেগমের জোড়াজোড়িতে সবাই মুখ কালো করে দুপুরের খাবার গিললো। শুভ্রতার মুখের দিকে যেন তাকানোই যাচ্ছে না। চোখদুটো এমনভাবে টলমল করছে যেন এই বুঝি ফোঁটা ফোঁটা পানিতে ভেসে যাবে সব। শুভ্রতার শুকনো মুখ দেখে কিছু একটা ভাবলো অর্পন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুট করেই প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—” শেফা আপু? তোমার দেবর নেই গো?”
শেফা তখন মাংস চিবুচ্ছিলে। অর্পনের প্রশ্ন শুনে চোখ তোলে তাকিয়ে মৃদু হাসলো,
—” না। ভাইদের মধ্যে ও একা।”
অর্পন হতাশ ভঙ্গিতে বললো,
—” ইশ! এটা কি ঠিক কাজ করেছো আপু? আমাদের কথা একবার ভাবলে না? আমাদেরও তো একটা হক আছে নাকি?”
শেফা হাসলো। অর্পন আবারও বললো,
—” আচ্ছা, শেফাপু? শুনলাম তোমার বরের নাকি একটা বন্ধু আছে। হেব্বি দেখতে…। ”
–” হ্যাঁ আছে। কিন্তু তুমি কি করে জানলে?”
—” তোমার বিয়ের আগে দেখা করতে গিয়েছিলে না রেস্টুরেন্টে সেদিনই বলেছিলো শুভ্রতা। তা সিংগ্যাল নাকি আপু?”
শেফা হেসে ফেললো। মুখের খাবারটুকু গিলে নিয়ে বললো,
—” আমার জানা মতে সিংগ্যাল কিন্তু ট্রাই মেরে লাভ বিশেষ হবে না। মজাও পাবে না। একদম নিরামিষ। এতো গম্ভীর। আমার সাথেই তো মনে হয় এই পর্যন্ত গুনে গুনে কথা বলেছে এই বান্দা।”
অর্পন উৎসাহ নিয়ে বললো,
—” দেখতে ভালো হলেই হলো। আর বাকি সব নাহয় ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। তার আগে উনার নাম্বারটা দাও না আপু। প্লিজ!”
অর্পনের এমন অকপটে নাম্বার চাওয়ায় বেশ অবাক হলো শেফা। মেয়েটা কি সত্যি সত্যিই নাম্বার চাচ্ছে নাকি? শেফা দ্বিধা নিয়ে বললো,
—” তুমি সিরিয়াসলি নাম্বার চাইছো?”
—” অবশ্যই আপু। বিয়ে করা তো বাধ্যতামূলক নয়। এমন একজন গম্ভীর মানুষকে একটু বাজিয়ে দেখায় যায়। দাও না আপু প্লিজ….প্লিজ…. তুমি কিন্তু বিয়ের ট্রিটটাও দাও নি। নাম্বারটা দাও। এটাই ট্রিট হিসেবে চালিয়ে নিবো।”
শেফা হালকা হাসলেও অর্পনকে বড্ড নির্লজ্জ মনে হলো তার। বিতৃষ্ণ গলায় বললো,
—” উনার নাম্বার আমার ফোনে সেইভ করা নেই। শুভ্রতার ফোনে সেইভ করা আছে। ওর থেকে নিয়ে নিও। ”
শেফার কথাটা খাবার টেবিলে যেন বজ্রপাতের মতো শোনালো। একসাথেই পাঁচটি কন্ঠস্বর চেঁচিয়ে উঠলো,
—“কিহহহহহহ!”
ওদের চিৎকারে শেফা চমকে উঠলো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
—” কি হলো?”
সবাই রক্তচোখে একবার শুভ্রতার দিকে তা্কালো। শুভ্রতা বোকার মতো বসে থেকে চোখে-মুখে নিদারুণ অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চালালো। অর্পন ঢকঢক করে পুরো
গ্লাসের পানি শেষ করে নিয়ে বললো,
—” শুভ্রতার ফোনে?”
শেফা মাথা নাড়লো। শুভ্রতা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললো,
—” আমার ফোনে উনার নাম্বার কিভাবে? আমি তো সেইভ করি নি।”
শেফা মাথা দুলালো। খুব আয়েশি ভঙ্গিতে হারে কামড় বসিয়ে নিয়ে বললো,
—” তোর ফোন আর আমার ফোনের মডেল সেইম। সেদিন আমি ভুলে তোর ফোনে সেইভ করে ফেলেছিলাম নাম্বারটা। সেইভ করার পর যখন বুঝি এটা তোর ফোন তখন আর ডিলিট দেওয়া হয় নি। আর তেমন প্রয়োজন নেই বলে আমার ফোনেও আর সেইভ করা হয় নি।”
শুভ্রতা বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। নিজের ফোনে নাম্বার রেখে এই গরমে সারা দুনিয়া ঘুরে ফেলেছে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে তার। শেফা যদি আগে বলতো তাহলে তো এতোটা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো না তাদের। যত্তসব অসহ্য!
#চলবে….
(রি-চেইক করা হয় নি। ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর
দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করা হলো)