# আরশিযুগল প্রেম পর্ব ২৪
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব- ২৪
আধা ঘন্টা যাবৎ শুভ্রতা কাঁদছে। শুভ্রতার এই বাচ্চামোতে ফোনের ওপাশে হেসে চলেছে সাদাফ।
—” আচ্ছা, তুমি কাঁদছো কেন? আমি কিন্তু কাঁদার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।”
শুভ্রতা উত্তর দিলো না। ফোনের ওপাশ থেকে বার কয়েক ফুঁপানোর আওয়াজ এলো মাত্র। সাদাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—” এতো আবেগী হতে নেই শুভ্রা। জীবনটা খুবই কঠিন। এই কঠিন জীবনে অল্পতে ভেঙ্গে পড়তে নেই। একটু শক্ত হতে শেখো। ”
সাদাফের কথায় কান্নাটা কমে এলো শুভ্রতার। রাগ নিয়ে বললো,
—” অল্প? এটা অল্প? আপনার কোনো ধারনা আছে? অলমোস্ট অন্যকারো বউ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। দাদু যদি রাজি না হতো, তখন?”
ফোনের ওপাশে নিঃশব্দে হাসলো সাদাফ,
—” এতো সোজা? আমার বউকে বুঝি অন্যকারো হতে দিতাম আমি?”
সাদাফের কথায় আবারও লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো শুভ্রতা। বামহাতে চোখ ঢেকে চোখ বোজলো সে। সাদাফের কথার জবাবে একগুচ্ছ ভারী নিঃশ্বাস উপহার দিয়ে নীরব প্রতিমার মতো ঠাঁই বসে রইলো। শুভ্রতার লজ্জাটা এবারও ঠিক ঠিক বুঝতে পারলো সাদাফ। শুভ্রতার মান-অভিমান আর কান্না থামাতে ইচ্ছে করেই লজ্জার বাণ ছুঁড়েছে সে। সেই বাণের সফলতায় ঠোঁট কামড়ে হাসলো সাদাফ। শুভ্রতাকে আরো একটু লজ্জায় ফেলতেই আবেগী গলায় বলে উঠলো,
—” ইশ! আমার বউ যে এতো লজ্জা পায় জানা ছিলো না তো।”
সাদাফের কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই ফোনটা কেটে বালিশে মুখ চেপে শুয়ে পড়লো শুভ্রতা। বালিশের নরম তুলোই মুখটুকুকে আবদ্ধ করার চেষ্টা করে চুপচাপ পড়ে রইলো সে। আচ্ছা? বালিশটা কি একটু সদয় হতে পারে না? তার বুকের নরম তুলো গুলো দু’ভাগ করে শুভ্রতার লজ্জামাখা মুখটাকে কি একটুকুও আশ্রয় দিতে পারে না? শুভ্রতার এই লাজুকতা মাখা শিহরণের মাঝেই নির্লজ্জ হয়ে উঠলো হাতের মুঠোফোনটা। তীব্র চিৎকার আর কাঁপুনিতে নিজের নির্লজ্জতার বার্তা প্রকাশ করতে লাগলো সমান তালে। শুভ্রতা মুখ উঠিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়েই লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। বার দুয়েক জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে কম্পিত হাতে ফোনটা কানের কাছে ধরলো সে। সাথে সাথেই উছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠলো সাদাফ,
—” ফোন কাটলে কেন? এট এনি চান্স, তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো শুভ্রা?”
শুভ্রতা উত্তর না দিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে চুপ করে রইলো। সাদাফের মতো গম্ভীর মানুষ যে কাউকে এভাবে লজ্জায় ফেলতে পারে ধারণায় ছিলো না তার। প্রথমবার আবেগে আপ্লুত হয়ে মুখে কথার ফুলঝুরি ফুঁটলেও সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক লজ্জাটা যেন ঝাপটে ধরতে লাগলো তাকে। শুভ্রতার নিশ্চুপতায় সাদাফের দুষ্টুমিটা যেন আরো গাঢ় হলো।
—” কি হলো ব…”
সাদাফকে শব্দটা শেষ করতে না দিয়েই চাপা গলায় ধমকে উঠলো শুভ্রতা,
—” চুপ! আপনাকে দেখে বুঝা না গেলে কি হবে? আপনি আস্ত একটা ফাজিল। ইচ্ছে ইচ্ছে করে লজ্জায় ফেলছেন আমায়।”
শুভ্রতার কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো সাদাফ। সাদাফের থেমে থেমে ঝংকার তোলা হাসিতে মনের অজান্তেই মুগ্ধতায় স্তব্ধ হয়ে গেলো শুভ্রতা। সাদাফ হাসি চেপে বললো,
—” আমি কিন্তু তোমায় ‘তুমি’ বলছি শুভ্রা। এবার তো তাহলে তোমার পালা। নারী-পুরুষ সমান অধিকার জানো না? আমি কিন্তু এই অসম অধিকার মানবো না।”
শুভ্রতা লাজুক হেসে বললো,
—“আমি চেষ্টা করবো। হুট করে তো হয়ে উঠবে না….”
—” আচ্ছা বেশ! চেষ্টা করো। তোমাকে পুরো দু’মিনিট সময় দেওয়া হলো। সময়টা একটু বেশি হয়ে গেছে, তাই না? কি করবো, বলো? আমি খুবই বিগ হার্টেড পার্সোন।”
সাদাফের কথায় হেসে ফেললো শুভ্রতা। মন জুড়ে বয়ে গেলো এক স্বস্তিময় ঠান্ডা বাতাস। অবশেষে সাদাফকে পেলো সে। সত্যিই পেলো!
__________________
হালকা মৃদু অস্বস্তিতে হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেলো শুভ্রতার। ভ্রু দুটো কুঁচকানো। ডানহাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট ও নাকের ঘামটুকু মুছে নিয়ে জানালার দিকে তাকালো। কাল রাতে সাদাফের সাথে কথা বলার পর প্রায় তিনটার দিকে ঘুমিয়েছিলো সে। আনন্দ আর ক্লান্তি দুইয়ে মিলে চোখের পলকেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো । দক্ষিণের জানালাটা খোলা পড়ে আছে খেয়ালই ছিলো না তার। সেই জানালা ভেদ করেই সকালের কড়া রোদ এসে পড়ছে শুভ্রতার চোখে-মুখে। শুভ্রতা অলসতা ভরা শরীরটা টেনে উঠে বসলো। মাথার ওপর থাকা ফ্যানটা ঘুরছে না। তবে কি রাতে ফ্যান অন করে ঘুমোই নি সে? শুভ্রতা মুখ কুঁচকে গলা হয়ে ঘাড় পর্যন্ত হাত বুলালো। ঘেমে নেয়ে চুলগুলো কি বিশ্রীভাবেই না আটকে আছে তার ঘাড়ে। শুভ্রতা বিরক্তি নিয়ে চুলগুলোকে হাত খোপা করে নিয়ে ফোনের দিকে তাকালো। ফোনটা হাতে নিয়েই বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো খানিকক্ষন। ফোনের লক স্ক্রিনে ‘ 87 missed calls’ লেখাটা দেখেই হতবিহ্বল চোখে হাজারও ভাবনা ভাবলো সে। আচ্ছা? সাদাফ কি এতোবার কল করেছে তাকে? কথাটা ভেবে, আনন্দ আর মন খারাপ এই দুইয়ে মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো তার মনে। কিন্তু এই অনুভূতিটা বেশিক্ষণ টিকলো না। তাড়াহুড়ো করে কল লিস্টে ঢুকেই অনুভূতিটা শূন্যে ভেসে গেলো তার। সাতাশিটি মিসকলের মাঝে চুরাশিটি মিসকলই তার বান্ধবীদের দেওয়া। বাকি তিনটির একটি সিম কোম্পানির আর দুটো সাদাফের । কল হিস্টোরি দেখে হঠাৎই ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো শুভ্রতার। বারবার মনে হতে লাগলো, তার খচ্চর বান্ধবীরা তাকে চুরাশিবার কল করে ফেললো আর সাদাফ মাত্র দু’বার? মাত্র দু’বার! কথাগুলো ভেবে বেশ অভিমানও হলো তার। মুহূর্তেই সাদাফের চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই অভিমান ফেলে সাদাফের নাম্বারে কল লাগালো সে। ফোন রিসিভ না করার জন্য সাদাফ রাগ করেছে কিনা, কে জানে? ফোনটা ঢুকে কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর পরই ফোনটা কেটে দিলো সাদাফ। প্রায় সাথে সাথেই কল ব্যাক করলো। শুভ্রতা খুশি মনে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় বলে উঠলো সাদাফ,
—” একটু ব্যস্ত আছি শুভ্রতা। আধা ঘন্টা পর কল করছি।”
এটুকু বলে, শুভ্রতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিলো সাদাফ। শুভ্রতা ব্যাপারটাই বিস্মিত হলো। সেইসাথে চিনচিনে এক রাগে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠলো তার। আশ্চর্য! ব্যস্ত আছি মানে কি? মানুষ তার প্রিয় মানুষের জন্য কতো সেক্রিফাইজ করে আর সাদাফ? তারমানে কি সাদাফ তাকে ভালোবাসে না? সবকিছু মিথ্যে? সবকিছু? রাগে-অভিমানে শুভ্রতার চোখ ভরে এলো। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, সাদাফের সাথে কথা বলবে না সে। কিছুতেই না। সাদাফ ইচ্ছে করে তাকে অপমান করলো। এতে তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগা উচিত। এসব অদ্ভুত সব চিন্তা-ভাবনার বেড়াজালে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো সে। ঘড়িতে বারোটার ঘন্টা বাজতেই চমকে উঠলো শুভ্রতা। তাড়াহুড়ো করে ফোনের ঘড়িতে চোখ বুলিয়েই অবাক হলো সে। ঠিক তখনই ফোন করলো সাদাফ। সাদাফের নাম্বারটা স্ক্রিনে ভাসতেই এতোক্ষণ যাবৎ করা জল্পনা-কল্পনাগুলো যেন মুহূর্তেই ভুলে গেলো শুভ্রতা। পাহাড় সমান অভিমানগুলো ভাসিয়ে দিয়ে খুশি হয়ে ফোন রিসিভ করলো সে। ফোন রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো সাদাফ,
—” সকালে গুড মর্নিং উইশ করার জন্য ফোন করেছিলাম কিন্তু সে ভাগ্য কি আমার আছে?”
শুভ্রতা লজ্জামাখা গলায় বললো,
—” রাতে দেরীতে ঘুমিয়েছিলাম তো তাই বুঝতে পারি নি। সরি!”
—” সরি বলার দরকার নেই। এই? তোমার আজ ক্লাস ছিলো না?”
শুভ্রতা ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব নিয়ে বললো,
—” থাকলেই কি? দু-একটা ক্লাস মিস হলে কিছুই হয় না।”
সাদাফ চিন্তিত গলায় বললো,
—” পড়াশোনায় ফাঁকি চলে? তাহলে আমার বাচ্চাদেরও ফাঁকিবাজ হওয়ার চান্স আছে। ভাবনার বিষয়!”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকালো। মুখ ফুলিয়ে বললো,
—” এই আপনি সবসময় এমন টাইপ কথা বলেন কেন বলুন তো? বউ, বাচ্চা ছাড়া কথা নেই মুখে?”
সাদাফ হেসে ফেললো। হাসিমুখে বললো,
—” তো কি বলবো? আমি কি টিনেজারদের মতো প্রেম করছি যে সামলে কথা বলবো? আমি অলরেডি ম্যারিড। সো আমার কথাবার্তা এই টাইপ হওয়াটাই বাঞ্চনীয়।”
সাদাফের কথার পিঠে কিছু বলার আগেই অসম্ভব তেজে রুমে ঢুকে এলো পুষ্পি, অর্পন আর তনয়া। হঠাৎ দরজায় এমন প্রচন্ড শব্দে চমকে উঠলো শুভ্রতা। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে পেছনে তাকাতেই ভ্রমরের মতো ছুটে এলো তিনজন। শুভ্রতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়তে লাগলো একের পর এক,
—“শুভি? সাদাফ ভাই ফোন ধরেছিলো?পাত্রপক্ষ কখন আসবে রে? আল্লাহ! তুই ফোন ধরছিলি না দেখে তো আমার আত্মা উড়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলাম সুইসাইড টুইসাইডই না করে বসেছিস! শোন শুভি? একদম চাপ নিস না….এই পোলায় ফোন না ধরলে ডিরেক্ট বনানী থেকে তুলে আনবো। আমি তো কোন গুন্ডাকে ভাড়া করবো সেইটাও ঠিক করে ফেলেছি। আরে, আমাদের ভার্সিটির কয়েকটা হ্যাংলা আছে না? ওগুলো দিয়েই কাজ হয়ে যাবে। নো চাপ….এমন প্যাচ খেলবো না? ব্যাটা বাপ বাপ করে তোর লগে প্রেম করবে দেখিস।”
পুষ্পি বিরক্ত হয়ে বললো,
—” উফ চুপ কর তো। শুভি? তুই না ডিপ্রেশড হোস না। দেখ, মানুষ লাইফে এক-দুইবার প্রেমে পড়েই। এটা আহামরি কিছু ব্যাপার না। আর এইজন্য সুইসাইড করারও কোনো কারণ নেই। তুই বরং এই সাদাফ মাদাফকে ভুলে যা। আন্টি যে ছেলেকে ঠিক করেছে তাকেই বিয়ে করে নে। ফ্যামিলিরও তো একটা ব্যাপার আছে বল। তাছাড়া, আমরা তো ওই ব্যাটাকে ছেড়ে দিবো না। এইযে তোকে এমন প্যারায় রাখলো তারজন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে। তোর বিয়ের পর ব্যাটাকে খুঁজে খুঁজে বের করে পেদাবো বুঝছিস? সারা বনানীর মধ্যে ব্যাটার নাম হয়ে যাবে পেদানী সাদাফ, হুহ।”
বান্ধবীদের কথায় বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়লো শুভ্রতা। আড়চোখে ফোনের দিকে তাকালো। সাদাফ ফোনটা কাটে নি। তারমানে পুষ্পি আর অর্পনের বলা প্রতিটি কথা শুনেছে সে! ছি, ছি….. শুভ্রতার মানসম্মানটা এবার বুঝি আর রইলো না। একটুও না। শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে ফোন কেটে বান্ধবীদের দিকে তাকালো। তার চোখে-মুখে অসহায়ত্ব। ভয়ানক অসহায়ত্ব!
#চলবে….
(রি-চেইক করা হয় নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)
কপি সম্পূর্ণ নিষেধ