# আরশিযুগল প্রেম পর্ব ২৭
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব- ২৭
________________
চৈত্রের শেষ রাত। অন্ধকার আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। চারদিকে হালকা মৃদু বাতাস। ছাঁদের দক্ষিণ রেলিং ঘেঁষে ওঠে গেছে মস্ত এক আম গাছ। আমের মকুলের সুবাসে চারদিক মউ মউ করছে। সেই আম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, মৃদু গলায় ফোনালাপে ব্যস্ত শুভ্রতা। আজকে শুক্রবার হওয়ায় সাদাফের কাজের চাপ নেই। সেই সাথে শুভ্রতার ঘুমের চাপটাও অনেকটা মিঁইয়ে গিয়েছে আজকাল। গম্ভীর কন্ঠে সাদাফের বলা হাজারো লজ্জা আর অনুভূতিমাখা কথাগুলোতে নতুন করে প্রেমানুভূতি জাগছে শুভ্রতার। সাদাফের প্রতি গাঢ় আচ্ছন্নতায় মত্ত হতে হতে অনেকটাই পাগলপ্রায় অবস্থা তার।
—” মাকে তোমার কথা বলেছি, শুভ্রা।”
সাদাফের কথায় চমকে উঠলো শুভ্রতা। ঢোক গিলে নিয়ে শান্ত গলায় বললো,
—” কি বললেন উনি?”
সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—” কি আর বলবে? যা সব মায়েরা বলেন তাই বললেন।”
সাদাফের এমন কথায় ভয় পেয়ে গেলো শুভ্রতা। রুদ্ধশ্বাসে বললো,
—” মানে? সব মায়েরা যা বলেন মানে? শুধু শুধু বণিতা কেন করছো বলো তো? আমার খুব টেনশন হচ্ছে।”
—” ভণিতা কোথায় করলাম? তাছাড়া, টেনশনের বিষয়ে টেনশন হবে, এটাই স্বাভাবিক। “
শুভ্রতার কপাল কুঁচকে এলো। টেনশনে ঠোঁটদুটি শুকিয়ে আসছে তার। অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তায় শরীরটা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে,
—” মা আমায় পছন্দ না করলে কি তুমি আমায় ছেড়ে দিবে? সত্যি করে বলো, প্লিজ!”
কথাটা বলতেই চোখের কোণে অশ্রুফোঁটা টলমল করে উঠলো শুভ্রতার। সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
—” এটাই তোমার দোষ শুভ্রা। আমি তোমাকে আগেও বলেছি কথায় কথায় কাঁদবে না। কান্না কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। আর তাছাড়া, তোমাকে ছেড়ে দিবো মানে কি? এটা কেমন কথা? তুমি কি কোনো বস্তু যে ইচ্ছে হলো আর ফেলে দিলাম? তুমি আমার সত্তার অংশ, শুভ্রা।”
এটুকু বলে থামলো সাদাফ। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,
—” তুমি আমার ভালোবাসা শুভ্রা।”
সাদাফের এই একটা কথাতেই বুকের গভীরে শীতল স্রোত বয়ে গেলো শুভ্রতার। কোথায় একটা চিনচিনে ব্যাথা খেলে গেলো। তীব্র অনুভূতিতে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো বড় বড় দুই ফোঁটা জল। দু-একবার ফুঁপিয়ে ওঠে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। শুভ্রতার এই কান্নায় এবার আর বিরক্ত হলো না সাদাফ। বরং, তার কান্নামাখা মুখটা কতটা মায়াময় হতে পারে তা ভেবে মৃদু হাসলো। প্রেমিকের প্রেম নিবেদনে প্রেমিকার আচ্ছন্নের মতো কান্না কি সবার ভাগ্যে জুটে? ভালোবাসার কথা শুনে সব মেয়েই কি কাঁদতে পারে? আর যে কাঁদতে পারে তার মতো বিশুদ্ধ ভালোবাসাও কি অন্য কোনো নারীর মনে সৃষ্টি হতে পারে? সাদাফ বড্ড ভাগ্যবান বলেই হয়তো শুভ্রতার মতো জীবন সাথী পেয়েছে সে। যে মেয়েটা তাকে হারানোর ভয়ে কাঁদে, রাগের ভয়ে কাঁদে, তার মনোক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে মুহূর্তেই অস্থির হয়ে পড়ে! অল্প একটু ভালোবাসা পেলেই আদুরে বিড়াল ছানার মতো বুকের কাছে এসে দাঁড়ায়। এই কান্নাভেজা মেয়েটাকেই সাদাফের চায়। বুকের মাঝে আগলে রাখার জন্য হলেও চায়। দু’জনের এই নীরব কথোপকথন ভেদ করে সাদাফই কথা বললো প্রথম,
—” মিসেস সাদাফের কান্না থেমেছে?”
শুভ্রতা লাজুক হাসি দিয়ে বললো,
—” আমি মোটেও কান্না করছিলাম না।”
সাদাফ হেসে বললো,
—” তাই বুঝি? কাঁদছিলেন না আপনি?”
—” উফ! বাদ দাও তো। আচ্ছা? মা আমায় পছন্দ করে নি না?”
—” না পছন্দ করে নি কারণ…..”
শুভ্রতা আৎকে উঠে বললো,
—“কারণ?”
—” কারণ অনেক বেশি পছন্দ করেছে। “
এটুকু বলেই হেসে ফেললো সাদাফ। শুভ্রতা নাক ফুলিয়ে বললো,
—” তুমি না আসলেই ফাজিল। আমি টেনশনে মরে যাচ্ছিলাম আর তুমি মজা করছিলে?”
সাদাফ হাসতে হাসতেই বললো,
—” আচ্ছা সরি। মা আর পৃথা তোমার সাথে দেখা করার জন্য খুব এক্সাইটেড, বুঝলে?”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” পৃথা? পৃথা কে?”
—” আমার ছোটবোন এবং তোমার একমাত্র ননদ। এইবার এইচএসসি দিচ্ছে।”
—” এইচএসসি? তাহলে তো এখন এক্সাম চলছে।”
—” হ্যাঁ।”
—” তোমার বড় ভাইয়া-ভাবিরা পছন্দ করেছে? ওদের আমার ছবি দেখিয়েছিলে?”
—” বড় ভাইয়া ভাবি কেউই চট্টগ্রাম থাকে না। বড় ভাইয়া বউ নিয়ে কুমিল্লায় থাকে আর ছোট ভাইয়া সিলেট। চট্টগ্রাম শুধু বাবা-মা আর পৃথায় থাকে। তোমার ছবি মা আর পৃথাকে দেখিয়েছি।”
—” বাবা-মা একা থাকে? ওদেরকে ঢাকায় আনা যায় না? তোমার অতোবড় ফ্ল্যাটটাও তো ফাঁকাই পড়ে আছে। সাথে রাখলেই পারো।”
সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—” রাজি হলে তো আনবো? তিন ভাই কি কম চেষ্টা করেছি? কিন্তু বাবার এককথা… বাপের ভিটে ছেড়ে অন্যকোথাও মরতে চায় না সে। কিছুতেই না। মা আর পৃথা তোমায় দেখতে আসতে চেয়েছিলো ঢাকায় কিন্তু পৃথার পরীক্ষার জন্য হলো না।”
—” আমার মাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে…. ”
শুভ্রতা এটুকু বলেই থেমে গেলো। তার থেকে দু-তিন হাত দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা কারো কথায় আটকে গিয়েছে সে। অপরপক্ষও শুভ্রতার মতোই চমকে ওঠে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এই অযাচিত পরিস্থিতিতে দু’জনেই চরম অস্বস্তির শিকার। এই অস্বস্তিময় নীরবতা কাটিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো শুভ্রতা,
—” ভাইয়া তুই? কার সাথে কথা বলছিলি? কাহিনী কি?”
শুভ্রব অপ্রতিভভাবে বললো,
—” ক ক কার সাথে কথা বলছিলাম মানে? ওই? তোকে বলতে হবে কার সাথে কথা বলছিলাম আমি? আমার কতো ফ্রেন্ড আছে…”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ফোনটা কেটে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। সন্দেহী গলায় বললো,
—” বন্ধু না? তুই যে ‘জানপাখি’ বললি তা আমি স্পষ্ট শুনেছি। কাহিনি কি বল? নয়তো এক্ষুনি আম্মুকে বলবো গিয়ে। “
শুভ্রব কেঁশে উঠলো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললো,
—” বল গিয়ে যা। আমিও আম্মুকে বলবো।”
শুভ্রতা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
—” তুই কি বলবি?”
শুভ্রব বাঁকা হেসে বললো,
—” তোর কি মনে হয়? আমি কানে কালা? তুই ফোনে কার লগে কথা বলছিলি আমি কি শুনিনি ভেবেছিস?”
শুভ্রতা বিস্ফারিত চোখে তাকালো। জোর দিয়ে বললো,
—” একদম বাজে বকবি না। আমি…. আমি….আমি অর্পনের সাথে কথা বলছিলাম।”
শুভ্রব ভাবলেশহীন গলায় বললো,
—” আমিও নাদিমের সাথে কথা বলছিলাম।”
শুভ্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—” নাদিম ভাইকে তুই ‘জানপাখি’ ডাকিস কবে থেকে? আমার বান্ধবীর সাথে প্রেম করে আমাকেই ফুটানি দেখাস? কালই তোর ব্রেকআপ করাবো দেখে নিস।”
শুভ্রব খানিকটা চমকালো। অন্ধকারে তার মুখের ভাবটা ঠিক বুঝা গেলো না। থতমত খেয়ে বললো,
—” ওই? নিজেকে কি মনে করিস? তোর বান্ধবী ছাড়া এই গোটা ঢাকায় আর কোনো মেয়ে নাই ? সব বান্দরের মতো বান্ধবী তোর।”
শুভ্রতা ঢং করে বললো,
—” তাই নাকি? তাহলে বান্দরের সাথে প্রেম করতে যাস কেন তুই? বান্দর বলিস আর হনুমান বলিস কাল তোর ব্রেকআপ কনফার্ম।”
এটুকু বলেই দ্রুত নিচে নেমে এলো শুভ্রতা। সিঁড়ির দু’ধাপ পেরিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। শুভ্রবকে উলোট পালোট কথায় বেঁধে রেখে নিজে বেঁচে গেছে তাতেই রক্ষে। কিন্তু, শুভ্রবের হৃদয়ঘটিত ব্যাপারটা কার সাথে চলছে? সত্যিই শুভ্রতার কোনো বান্ধবীর সাথে? নাকি অন্যকোনো মেয়ে? এই প্রেমাখ্যানের লেজটা যে খুঁজে বের করতেই হবে!
___________________
চারদিকে কাঁচা হলুদের মতো হলদেটে
আলো থাকতেই ঘুম ভেঙেছে শুভ্রতার। ঘড়িতে পাঁচটাও বাজে নি ঠিকঠাক। মনটা ভীষণ উত্তেজিত তার। আজ সাদাফকে শাড়ি পরে চমকে দেওয়ার মারাত্মক একটা প্ল্যান ঘুরঘুর করছে তার মাথায়।
আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের শুরুর সাথে সাথে শুভ্রতা আর সাদাফের ভালোবাসারও এক নতুন অধ্যায়। সাদাফকে কিভাবে চমকে দেওয়া যায় তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই নির্ঘুম রাত্রি কেটেছে শুভ্রতার। কিভাবে সাজবে এসব ভাবতে ভাবতেই কেটে যাচ্ছে এই আনন্দময় সকাল। আচ্ছা? শুভ্রতাকে নববধূর সাজে দেখে সত্যিই কি চমকাবে সাদাফ? বোকার মতো তাকিয়ে থাকবে তার দিকে? না, বোকার মতো তাকাবে না। তাহলে কিভাবে তাকাবে? শুভ্রতা আর ভাবতে পারে না। লজ্জা আর খুশিতে মুখ-চোখ লাল হয়ে আসে তার।
#চলবে….
[ অসুস্থ থাকার কারণে ভালোভাবে লিখতে পারছি না। কেমন একটা দায়সারা ভাবে লিখে চলেছি। এই সমস্যাটা জলদি কাটিয়ে উঠবো ইনশাআল্লাহ। কিছুদিনের অনিয়মিতাটাও গুছিয়ে নিবো ইনশাআল্লাহ। রি-চেইক করা হয় নি। তাই ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।]