# আরশিযুগল প্রেম পর্ব ৫০
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব – ৫০
‘ আবার দেখা হলে,
পুরনো গান, পুরনো কবিতা,
ফিরিয়ে দেব।।
শুধু পুরোনো চিঠি চেয়ো না
ভিজে গেছে সব চোখের জলে।’
অক্টোবরের মাঝামাঝি। প্রতিবছর এই সময়টাতে হালকা ঠান্ডাভাব দেখা দিলেও এবছরটায় ভ্যপ্সা গরম। পৃথা ওড়নার কোণা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে রহস্যময় ঘরটির ভেতর উঁকি দেয়। কিছুক্ষণ আগেই শুভ্রতার বাড়িতে এসে পৌঁছেছে পৃথা। বাবা, মা, মেজো ভাবি আর সে। সাদাফ আসে নি। পাত্রী দেখা নামক গেঁয়ো প্রথা তার পছন্দ নয়। শুভ্রতার বাসায় পৌঁছে, হালকা কুশল বিনিময় করেই বড়দের মহল থেকে উঠে এসেছে পৃথা। উদ্দেশ্য শুভ্রতার শোবার ঘর খুঁজে বের করা। রাদিবা করিডোরের শেষ মাথায় ডানদিকের ঘরটির কথা বলে দিলেও সঠিক ঘরটা খুঁজে পাচ্ছে না পৃথা।
ডানদিকের তিনটি ঘরের কোনটি শুভ্রতার ঘর হতে পারে বুঝার উপায় নেই। প্রত্যেকটা ঘরের পর্দার রঙও একই। পৃথা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ‘ঘর সমস্যার’ সমাধান খুঁজার চেষ্টা করতেই তিনটা ঘরের সবচেয়ে কোণার ঘর থেকে গিটারের মৃদু শব্দ কানে এসেছে তার। সেই সাথে ভরাট গলায় গাওয়া সেই গান, ‘আবার দেখা হলে….’ কি বিষাদময় সুর! পৃথা এর আগে কখনও এমন বিষাদময়, ঘোর ধরানো কন্ঠ শুনে নি।
পৃথা আবারও ঘরের ভেতর উঁকি দিল। ভিতরটা অন্ধকার, হিম ধরা গুমোট পরিবেশ। চারপাশটাই কেমন রহস্য রহস্য ভাব। আচ্ছা? এই ঘরটাতে কি ভূতুরে টাইপ কোনো ব্যাপার আছে? হাওয়ায় গানের সুর বাজে এমন টাইপ কিছু? পৃথা যতটুকু জানে কিছুদিন আগেই শুভ্রতার দাদা মারা গিয়েছেন। চল্লিশ দিন হতে এখনও বিশ দিন বাকি। পৃথার বড় মা বলতেন, চল্লিশ দিন আগে মৃত ব্যক্তির রুহু ঘরে-বাইরে ঘুরে বেড়ায়। আত্মীয়-স্বজনের কাছাকাছি থাকে।
তাহলে এটা শুভ্রতার দাদার আত্মা টাত্মা নয় তো? না, তা কি করে হবে? ভূত কি কখনও গিটার বাজাতে জানে নাকি? তাছাড়া, শুভ্রতার দাদা ছিলেন হাজী মানুষ, সে মৃত্যুর পর হঠাৎ গিটার বাজিয়ে গান গাইতে যাবেন কেন? পৃথা গাল চুলকে আরেকটু হেলে পড়তেই পর্দা ঠেলে সামনে এসে দাঁড়াল একটি ছেলে। অন্ধকার ঘর থেকে আকস্মিক কারো আগমনে চমকে উঠল পৃথা। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে নিয়েও মুখ চেপে নিজেকে সামলে নিলো। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুকে থুতু ছিটালো। আয়াতুল কুরছী পড়ে বুকে ফু দিল। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা বেশ অবাক হল। কপাল কুঁচকে বলল,
—-” আপনি কে?”
পৃথা চোখ তুলে তাকাল। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা বেশ লম্বা। ছেলেটির মুখ দেখার জন্য পৃথাকে অনেকটা আকাশ দেখার মত করে মাথা তুলে তাকাতে হল। গম্ভীর গলায় বলল,
—-” আপনি কে?”
ছেলেটি এবার বেশ থতমত খেয়ে গেল। খানিক চুপ থেকে বিরক্তি নিয়ে বলল,
—-” আমি শুভ্রব।”
পৃথা সরু চোখে তাকাল। কিছু একটা ভেবে খুশি হয়ে বলল,
—-” শুভ্রব! তারমানে আপনি ছোট ভাবির ভাই, তাই না? নাম তো মিলে মিলে যায়।”
শুভ্রব কপাল কুঁচকালো। চোখ ছোট ছোট করে বলল,
—-” ভাবি? কিসের ভাবি? সরি! আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি।”
পৃথা সন্দিহান চোখে তাকাল। বলল,
—-” আপনি কি ইংলিশ মিডিয়্যামে পড়েছেন নাকি?”
শুভ্রব খানিকটা ভরকে গিয়ে বলল,
—-” না। কেন?”
—-” তাহলে ভাবি অর্থ বুঝতে পারছেন না কেন?ভাইয়ের বউকে ভাবি বলে। আপনার বোনকে আমার ছোট ভাইয়া বিয়ে করলে উনি আমার ছোট ভাবি হয়ে গেল না?”
শুভ্রব নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
—-” ও আচ্ছা। আপনি সাদাফ ভাইয়ের বোন?”
পৃথা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। শুভ্রব কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে পৃথাকে পাশ কাটিয়ে
বসার ঘরের দিকে হাঁটা দিল। শুভ্রবের এমন অদ্ভুত ব্যবহারে অবাক হল পৃথা। পেছন থেকে ডেকে উঠে বলল,
—-” শুভ্রব ভাইয়া?”
শুভ্রব দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
—-” জি?”
—-” ছোট ভাবির রুম কোনটা?”
শুভ্রব হাতের ইশারায় কোণার রুমটা দেখিয়ে দিল। পৃথা মুচকি হেসে বলল,
—-” অলমোস্ট পেয়ে গিয়েছিলাম, থেংক্স। আচ্ছা! তখন কি আপনিই গিটার বাজাচ্ছিলেন? দারুণ বাজিয়েছেন।”
শুভ্রব উত্তর না দিয়ে হেঁটে পর্দার আড়ালে হারিয়ে গেল। শুভ্রবের এমন ব্যবহারে প্রথম দফায় অপমান এবং দ্বিতীয় দফায় প্রচন্ড রাগে ফেঁটে পড়ল পৃথা। কি দরকার ছিল অযথা এত কথা বলার? আর এসব অহংকারী মানুষের সাথে কথা বলারই বা কি দরকার? পৃথার সাথে সবসময়ই এমন হয়। প্রথম দফায় এতো বেশি বকবক করে যে পরে নিজের প্রতি নিজেরই রাগ হয়। এখনও রাগ হচ্ছে। এই অহংকারী ফালতু ছেলেটাকে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আপনাকে যে বলেছিলাম আপনি দারুণ গিটার বাজান ওটা মিথ্যা। সত্যটা হল, আপনার গিটারের শব্দটা মশার ভনভনের চেয়েও বিরক্তিকর। এর থেকে কাকের ডাক ভালো শুনায়। আপনার উচিত এই গিটার বিক্রি করে লজেন্স কিনে খাওয়া। তাহলে এটলিস্ট মুখের বুলিটা মিস্টি হবে। অসহ্য!’
___________________
শুভ্রতা সোফায় বসে আছে। তার একপাশে সাদাফের মা আর অন্যপাশে সাদাফের মেজো ভাবি। চট্টগ্রামে সাদাফের বাবার সাথে দেখা হয় নি শুভ্রতার। ধরতে গেলে সাদাফের বাবার সাথে আজই তার প্রথম দেখা। শুভ্রতা লজ্জার মাথা খেয়ে এক-দু’বার সাদাফের বাবার দিকে তাকিয়েছে। যারা সাদাফকে একবার দেখেছে তারা ভদ্র লোকটিকে দেখে চট করেই বুঝে যাবেন উনি সাদাফের বাবা। চেহারা, গাম্ভীর্য আর কথা বলার ভঙ্গিমা সব এক, শুধু বয়সটা আলাদা। শুভ্রতার মগ্ন দৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে পাশ থেকে গুঁতো দিয়ে উঠলেন মেজো ভাবি। শুভ্রতা ঘাড় নামিয়ে আড়চোখে তাকাতেই ফিসফিস করে বললেন,
—-” এই? তুমি নাকি সুইসাইড করতে গিয়েছিলে? কেন গো? কি হয়েছিল?”
ভদ্রমহিলার অতিরিক্ত কৌতূহল দেখে বিরক্তবোধ করল শুভ্রতা। চোখ-মুখ কুঁচকে মাথা নুইয়ে চুপ করে রইল। মেজো ভাবি আবারও গুঁতো দিয়ে বললেন,
—-” কি হলো? বললে না? কি হয়েছিল?”
শুভ্রতার বুক চিড়ে গাঢ় নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। অনেক ভেবেও মেজো ভাবিকে দেওয়ার মত জুতসই কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। শুভ্রতাকে এই অস্বস্তি থেকে বাঁচিয়ে দিতেই হয়ত দেবদূতের মত আবির্ভূত হলেন সাদাফের মা। শুভ্রতার ডানহাত টেনে নিয়ে একটা স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিয়ে আদুরে হেসে বললেন,
—-” আমাদের ঘরের নূর হয়ে এসো মা।”
শুভ্রতা লাজুক হেসে চোখ নামাল। সাদাফের মা শুভ্রতার ডানহাতটা নিজের হাতে রেখেই বললেন,
—-” মেয়ে আমাদের আগে থেকেই পছন্দ ভাইজান। ছেলের সুখটাই বড় সুখ। ওরা দুজন-দুজনকে পছন্দ করে সেখানে নতুন করে পছন্দ করা না করার ব্যাপার আসছে না। আমাদের দায়িত্ব হলো ওদের চারহাত এক করে দেওয়া।”
শাহিনুজ্জামান ম্লান হাসলেন। ধীর গলায় বললেন,
—-” আমাদের পক্ষ থেকেও কোনো আপত্তি নেই। আপনারা নিজেদের সুবিধামত একটা ডেইট দিন। সেই ডেইটেই নাহয় বিয়ের কাজটা শেষ হবে। আর একটা কথা। বলতে গেলে অনুরোধ, আমার বাবা মারা গিয়েছে একমাসও হয় নি। এর মধ্যে অতো ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করাটা সমীচীন নয়। ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। আপনাদের যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে…”
সাদাফের বাবা ভরাট গলায় বললেন,
—-” এখানে আপত্তি থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না শাহিনুজ্জামান সাহেব। বিয়েটা ছোট পরিসরেই হবে। সমস্যা নেই। ছেলেমেয়েদের ইচ্ছে থাকলে পরে নাহয় বড় করে রিসেপশন করা যাবে।”
সাদাফের মা হেসে বললেন,
—-” আপনাদের কথা ভেবে বিয়ের কথাটা আরো কিছুদিন পরই তুলতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ছেলে মানতে নারাজ। আজকালকার ছেলে-মেয়েরা ভীষণ অধৈর্য্য। তাছাড়া, একটা হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে না থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াটাই ভালো।”
শাহিনুজ্জামান সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। রাদিবা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। সাদাফের বাবা-মাকে ভীষণ ভালো মনে হচ্ছে উনার। এই মহিলার কাছে তার মেয়ে খুব একটা খারাপ থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এখন, শুভ্রতা সব সামলে নিতে পারলে হল। আলোচনার একপর্যায়ে সামনের শুক্রবার বিয়ে এবং শনিবার বউভাতের তারিখ ফেলা হল। শুভ্রতার মনটা খুশিতে বাকুম বাকুম নাচতে লাগল। আঁড়চোখে এককোনায় দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবীদের দিকে তাকাতেই চোখ টিপে দিল অর্পন। পুষ্পি দাঁত বের করে হেসে ঠোঁটের ইশারায় বলল, ‘কনগ্রাচুলেশন’। শুভ্রতা মুচকি হাসল। কিছুক্ষণ পর, নিজের ঘরে যাওয়ার অনুমতি পেয়েই দ্রুত উঠে গেল শুভ্রতা। করিডোর পেরিয়ে নিজের রুমে ঢুকতেই দরজায় খিল দিল অর্পন। শুভ্রতার ডানহাত টেনে ধরে গম্ভীর মুখভঙ্গি নিয়ে বলল,
—-” শুভ্রা! আজ আমি অনেক খুশি। তোমাকে আমি পেতে যাচ্ছি ভেবেই ভীষণ আনন্দ লাগছে আমার। সামনের শুক্রবারের পর থেকে আমরা দু’জন মিলে পুকুরে হাবুডুবু খাব।”
অর্পনের কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে গড়িয়ে পড়ল পুষ্পি আর প্রেমা। শুভ্রতা রাগী চোখে তাকানোর চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যর্থ হল। লাজুক হেসে বলল,
—-” একদম বাজে বকবি না অর্পন। ও কখনই তোর মত মিনিংলেস, উদ্ভট কথাবার্তা বলে না।”
শুভ্রতার কথায় বাকি তিনজনই সুর তুলে বলে উঠল,
—-” হায় হায়… ওওওওওওওওওওওও! ”
শুভ্রতা বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙানোর চেষ্টা করে বলল,
—-” আমি কিন্তু এখন রেগে যাচ্ছি।”
অর্পন আচমকা শুভ্রতার কোমর ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে সাদাফের মত করে বলার চেষ্টা করল,
—-” তাই? তুমি কি খুব রেগে যাচ্ছ শুভ্রা?”
—-” উফফ! দিন দিন আরো ফাজিল হচ্ছিস তুই।ছাড় বলছি।”
অর্পন ঢং করে বলল,
—-” কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু’টি চোখে…..
তোমাকে পাওয়ার পরও ফাজিল না হয়ে পারি বলো? তুমি হলে আমার ফাজিলময় পৃথিবী।”
পুষ্পি-প্রেমা এবারও হেসে গড়িয়ে পড়ল। অর্পন শুভ্রতাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় আয়েশ করে বসল। গম্ভীর গলায় বলল,
—-” দেখ শুভি? তুই খুব বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছিস। এতোক্ষণ ফ্রেন্ড হিসেবে তোর খুশিতে খুশি হলেও এখন আর পারছি না।”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
—-” আমি আবার কি করলাম?”
অর্পন সটান উঠে দাঁড়াল। শুভ্রতার দিকে তেড়ে গিয়ে বলল,
—-” কি করেছিস মানে? দেবর ছাড়া বর নির্বাচন করে আমাদের বন্ধাবীগত হক নষ্ট করেছিস। এখন এর মূল্য তোকে চুকাতে হবে। বাসর ঘরে আমাদের এলাউ না করলেও তোদের হানিমুনে আমাদের নেওয়া চাইই চাই। গাইস? এম আই রাইট?”
পুষ্পি প্রেমা হৈহৈ করে বলল,
—-” ইয়াপপপপ!”
#চলবে….
[ বিঃদ্রঃ আমি এডমিশনের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছি। দম ফেলার সময় পাচ্ছি না। সেখানে দু-তিন ঘন্টা টাইম নিয়ে গল্প লেখা দুষ্কর। তবু এই গল্পটা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এই গল্পটা শেষ করে তবেই লিভ নিতে চাইছি। কিন্তু প্রেমকথন লেখা একেবারেই অসম্ভব হয়ে উঠেছে এখন।
বিঃদ্রঃ২ রি-চেইক দেওয়া হয় নি।]