আরশিযুগল প্রেম পর্ব ৬
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব-৬
রাত আটটা। মাঘের শেষেও ঠান্ডাটা যেন কামড়ে ধরছে শরীর। যানবাহনে পরিপূর্ণ উত্তরাও ঢাকা পড়েছে ঘন কুয়াশায়। ল্যাম্পপোষ্টের আলোতে কুয়াশাগুলো ধোঁয়ার মতো কুন্ডলী পাকাচ্ছে। কাছাকাছি আসতেই মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। এই শুভ্র কুয়াশার চাদর ভেদ করেই মেয়ের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে সাদাফ ও বাকিরা। বেশ সাজানো গুছানো ড্রয়িং রুম। ডানপাশের দেয়ালে বেশকিছু ফ্যামিলি ফটো। সেই ফটো গুলোতেই চোখ বুলাচ্ছে সাদাফ। হালকা নীল টি-শার্ট আর কালো ব্লেজারে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। সাদাফের সামনের সোফাটাতেই বসে আছেন একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। নাকের নিচে পুরুষালী গোঁফ। শক্তপোক্ত শরীর। বয়স পঞ্চাশের ঘর পেরুলেও চুলে আর গোঁফে পাক ধরেছে মাত্র। চোখে-মুখে কাঠিন্য স্পষ্ট। লোকটি ভারি গলায় আরাফের মা-মামার সাথে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে গল্প থামিয়ে সাদাফের দিকে তাকালেন। শান্ত গলায় বললেন,
—” উনাকে তো চিনলাম না।”
আরাফের মামা বিগলিত হাসি নিয়ে বললেন,
—” ও আরাফের বন্ধু। অসাধারণ একটা ছেলে। ছাত্রজীবনে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলো এখন চাকরিও করছে মাশাআল্লাহ! চাকরির দু’বছরের মাথাতেই বনানীতে ফ্ল্যাট কিনে হুলস্থুল কান্ড।”
লোকটি মৃদু হেসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সাদাফের মুখে। শান্ত গলায় বললেন,
—” নাম কি তোমার, বাবা?”
—“রাফাত আল সাদাফ।”
—” রাফাত আল সাদাফ! বেশ ভালো নাম। বাড়ির সবাই ভালো আছেন?”
সাদাফ মৃদু হেসে বললো,
—” জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।”
লিয়াকত সাহেব হাসলেন। হঠাৎ করেই খেয়াল করলেন অচেনা এই ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগছে তার। স্বল্পভাষী ছেলেটির নিঃসংকোচ কথাবার্তায় সে কি তেজ! কোনো কৃত্রিম ভঙ্গিমা নেই তার চোখে। কাউকে আকৃষ্ট করার জন্য মিথ্যা হাসিও ঝুলে নেই তার ঠোঁটে। সব যেন খুব সাধারণ এবং সত্য। ড্রয়িংরুমের পাশের রুমটিতেই শেফাকে সাজাতে ব্যস্ত ছিলো শুভ্রতা। শেফাকে নিয়ে বের হওয়ার আগমুহূর্তেই গম্ভীর কন্ঠে বলা “রাফাত আল সাদাফ” নামটা কানে এলো তার। কন্ঠের ঝংকার আর নামটা কানে যেতেই চমকে উঠলো শুভ্রতা। কন্ঠটা অর্ধ পরিচিত হলেও নামটা যে তারই। ঠিক এই নামের মানুষটির সাথেই তো…। শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই চাপা গলায় ডেকে উঠলেন সায়িদা বেগম,
—” কি রে শুভ্রতা? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? নিয়ে যা ওকে।”
সায়িদা বেগমের কথায় ঘোর কাটলো শুভ্রতার। ঢোক গিলে শুকনো গলা ভেজানোর বৃথা চেষ্টা করে বললো,
—” তততুমি নিয়ে যাও না, খালামনি। আমি বরং খাবার রেডি করি। প্লিজ?”
সায়িদা বেগম গরম চোখে তাকালেন। কিছু একটা ভেবে চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে শেফাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সাথে সাথেই পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলো শুভ্রতা। ডানপাশের সোফায় বসে থাকা সাদাফকে চোখে পড়লো তার। সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো বুক। হালকা নীল টি-শার্টের উপর কালো ব্লেজার, ডেনিম ব্লু জিন্স, পায়ে কেটস, ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর কপালে পড়ে থাকা সিল্ক চুলগুলোতে মাতাল করা সুন্দর লাগছে ছেলেটিকে। প্রথম দিন ট্রেনে দেখে তো এতোটা সুন্দর লাগে নি শুভ্রতার, তাহলে আজ কেন? আচ্ছা? তবে কি এই ছেলেটাই শেফা আপুকে দেখতে এসেছে? কথাটা ভেবেই আৎকে উঠলো শুভ্রতা। তাহলে কি শেফা তার সতীন হতে চলেছে? এসব অদ্ভুত চিন্তাভাবনার মাঝ পথেই ভ্রু কুঁচকালো শুভ্রতা। এসব কি ভাবছে সে? শেফার সাথে সাদাফের বিয়ে হলেই বা তার কি আসে যায়? নিজের মনে করা এই প্রশ্নের জবাবে বিরবির করে বলে উঠলো শুভ্রতা,
—” অবশ্যই আসে যায়। আপুর সাথে উনার বিয়ে হলে বছরে একশোবার দেখা হবে উনার সাথে। তখন যদি ব্ল্যাকমেইল করে? বাবা-মাকে যদি বলে দেয়? অথবা, পালিয়ে আসার জন্য চড় লাগায় গালে বা অধিকার চায়?”
কথাগুলো ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেলো শুভ্রতার। এই ঠান্ডার রাতেও কি ভীষণ গরম লাগছে তার। বুকের গহ্বরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। কি করবে এখন শুভ্রতা? শুভ্রতার হুট করেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এই গোটা বাংলাদেশে কি দেখতে আসার মতো শুধু শেফা নামক মেয়েটাই ছিলো? শুভ্রতার বরকে কি সব রেখে তার বোনকেই দেখতে আসতে হলো? নিচের ঠোঁট কামড়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো শুভ্রতা। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে হাজারও চিন্তায় কপাল ভাঁজ করলো সে। কিছুক্ষণ পর ওঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক পায়চারী করলো। নাহ.. কোনো বুদ্ধিই আসছে না মাথায়। হঠাৎ করে ব্রেনটা এমন অকেজো হয়ে গেলো কেন কে জানে? ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখের ঘাম মুছে মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো শুভ্রতা, যায় হয়ে যাক না কেন ছেলেটার সামনে যাওয়া চলবে না। কিছুতেই না। শুভ্রতার এই প্রতিজ্ঞা বেশিক্ষণ টিকলো না। সায়িদা বেগমের গরম চোখের সামনে টিকতে না পেরে বাধ্য হয়েই নাস্তা সাজিয়ে সামনে যেতে হলো তাকে। রান্নাঘরে হাজারো ভাবনা চিন্তায় নিজেকে শাসনে রাখলেও সাদাফের সামনে যেতেই ধুকপুক করে উঠলো বুক। সাদাফ আরাফের সাথে খুনশুটিতে ব্যস্ত। শুভ্রতাকে ঠিক খেয়াল করে নি সে। শুভ্রতা ধুরুধুরু বুকে সামনের টেবিলটাতে খাবারগুলো সাজিয়ে রাখতেই বেখেয়ালি দৃষ্টিতে তাকালো সাদাফ। দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই ভ্রু’দুটো কুঁচকে এলো তার। কি ভেবে, আবারও শুভ্রতার মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটাকে বড্ড চেনা লাগছে তার। কোথাও যেন দেখেছে সে। কিন্তু কোথায়? কথাগুলো ভাবতেই চমকে উঠলো সে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে শুভ্রতার নিমজ্জিত চোখদুটোর দিকে তাকালো। বুকের মাঝে হালকা-মৃদু ঢিপঢিপ শব্দটা ধীরে ধীরে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগলো। এমন সময় পাশ থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন মামা,
—” এই মেয়েটা কে, লিয়াকত সাহেব? ভারি মিষ্টি দেখতে।”
লিয়াকত সাহেব মৃদু হেসে বললেন,
—” আমার ছোট শালিকার মেয়ে শুভ্রতা।”
“শুভ্রতা” নামটা কানে যেতেই আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে নড়েচড়ে বসলো সাদাফ। অস্থির চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে আড়চোখে শুভ্রতার দিকে তাকালো। শুভ্রতাও গোপনে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সাথে সাথেই চোখাচোখি হয়ে গেল দু’জনের। চোখে চোখ পড়তেই দু’জনেই চোখ সরিয়ে নিলো দ্রুত। অস্বস্তিতে ভারি হয়ে এলো রুমের হাওয়া। দু’জনেই জেনে গেলো দু’জনার পরিচয়। এই অস্বস্তির বাতাসে ছেদ ঘটিয়ে হাসিমুখে বলে উঠলেন মামা,
—” ভারি মিষ্টি নাম। ও তো তাহলে আরাফের হবু শালি হলো, কি বলেন লিয়াকত সাহেব?”
শুভ্রতা সাথে সাথেই সাদাফের দিকে তাকালো। তারমানে বিয়েটা সাদাফের নয়। প্রথমে খুশিতে ঝলকে উঠলেও মুহূর্তেই মুখটা কালো হয়ে গেলো শুভ্রতার। যার সাথেই বিয়ে হোক না কেন বিয়েটা হয়ে গেলে তো বারবারই মুখোমুখি হতেই হবে তাদের, এখন উপায়? ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে শুভ্রতার। দু’সেকেন্ড পরই ঠান্ডা ছাপিয়ে প্রচন্ড গরমে অস্থির হয়ে পড়লো শুভ্রতা। কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়েই ভারি নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো সে। মন বলছে, “এই বুঝি কিছু হলো! এই বুঝি চিনে ফেললেন! এই বুঝি প্রকাশ করলেন সব।” এই ভয়মাখা ক্লান্ত মন নিয়ে শেফার পেছনে, সোফায় হাত রেখে মাথানিচু করে দাঁড়ালো শুভ্রতা। সাদাফ হালকা চোখে শুভ্রতাকে লক্ষ্য করলেও গম্ভীর মুখে বসে রইলো। শুভ্রতার আনত মুখের পাশ দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট চুলের খেলা করা, চাপা নাক, ভারি পল্লবে ঢাকা চোখ, হলদেটে ফর্সা মুখ আর নাকের পাশে কুচকুচে কালো তিল সব মিলিয়ে অন্যরকম একটা ভালো লাগা ছেয়ে গেলো তার মনে। এর আগে কোনো মেয়েকে এভাবে খেয়াল করে নি সাদাফ। তবে আজ কেন এতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে সে? ভাগ্যের ফেরে পেয়ে যাওয়া স্ত্রী বলে? নাকি, একগুচ্ছ হালাল অধিকার বলে?লিয়াকত সাহেবের কথায় সচেতন চোখে চায়ের কাপে চুমুক দিলো সাদাফ। লিয়াকত সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,
—” সেই তো।”
লিয়াকত সাহেবের উত্তরে হালকা হেসে কথা পাড়লেন মামা,
—” লিয়াকত সাহেব? বলছি কি? বিয়েটা আমরা তাড়াতাড়িই সেড়ে ফেলতে চাই। দু’পক্ষেরই যখন পছন্দ তখন দেরি করার তো কোনো কারণ দেখি না।”
লিয়াকত সাহেব খানিক ভেবে বললেন,
—” তা ঠিক। কিন্তু আমার শালিকার শশুড়মশাই আর আমার বড় ভাই দু’জনেই এ বছর হজ্জে যাচ্ছেন। উনারা দু’জনেই আমাদের গার্জিয়ান বলা চলে। তারা হজ্জ থেকে ফিরে এলেই বিয়েটা সম্পন্ন করতে চাইছি আমরা। এটা তো ফেব্রুয়ারি মাস। জুলাইয়ের শেষের দিকেই রওনা দিবেন উনারা। সেপ্টম্বরের দিকে ফিরে আসবেন। তো বিয়ের ডেটটা আমরা সাত/ আট মাস পরে ঠিক করলেই হয়তো বেশি ভালো হতো। এটা উনাদেরও মত।”
মামা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
—” আপনাদের সমস্যাটা বুঝতে পারছি। আসলে, কিছুদিন যাবৎ দুলাভাইয়ের শরীরটাও তেমন ভালো যাচ্ছে না। হায়াত-মউতের কথা তো আর বলা যায় না। কখন কি হয়ে যায়। তাই বলছিলাম, আপাতত কাবিনটা করিয়ে রাখলে হয় না? রিসেপশনটা না হয় আপনাদের সুবিধামতোই করলেন।”
বড়দের গুরুগম্ভীর কথার মাঝেই শেফাকে নিয়ে সরে গেলো শুভ্রতা। হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে তার। সাদাফ যখন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো শুভ্রতার চোখে লজ্জা, ভয় আর অস্বস্তিতে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলে তার। কি মোহাবিষ্ট দৃষ্টি তার! রুমে ঢুকেই বেড-টেবিলের উপর থেকে কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা তুলে নিলো শুভ্রতা। এক চুমুকে সবটা শেষ করে গ্লাস হাতেই ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়। শেফা তার দিকে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—” কি হয়েছে তোর? দেখতে এসেছে আমাকে আর ভয়ে মরে যাচ্ছিস তুই। কাহিনী কি?”
শুভ্রতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। শেফাকে কি করে বুঝাবে তার অস্থিরতা? কিছুক্ষণ মৌন থেকে নিজেকে শান্ত করলো শুভ্রতা। মৃদু গলায় বললো,
—” তোমার যে বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়ে যাচ্ছে আপু। বিয়েটা কি তুমি করছো?”
শেফা লাজুক হেসে মাথা নাড়লো। শুভ্রতা যেন লাফিয়ে উঠলো। গ্লাসটা টেবিলে রেখে তাড়াহুড়ো করে শেফার সামনে বিছানায় পা তুলে বসলো সে। ক্ষেপা গলায় বললো,
—” দু’মিনিট দেখেই রাজি হয়ে গেলে আপু? একটুও ভাববে না? চরিত্র কেমন কে জানে? আজকালকার ছেলেরা কতটা বাজে হয় ধারনা আছে তোমার? এইসব ছেলেরা দশটার সাথে ডেটিং করে বেড়ায়। রুমডেট হেনতেন কতো কিছু করে। আর এই ছেলেটাকে দেখেই তো আস্ত চিট মনে হচ্ছে। দেখতেও অনেকটা বলদের মতো৷ এই বলদকে বিয়ে করবে তুমি?”
শেফা সরু চোখে তাকালো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
—” “এখনকার ছেলেরা” এই দুটো শব্দ বলেই তো সব সমস্যার সমাধান করে দিলি রে বোন। দেখ, এখনকার সব ছেলেদের চরিত্রই যদি ফোর টুয়েন্টি হয় তাহলে সবার জামাই-ই এমন। এতে আমার একার চাপ নেওয়ার তো কিছু নেই। সবাই যদি দশ মাইয়ার বাবুকে বিয়ে করে খুশি খুশি হানিমুনে যেতে পারে তাহলে আমি একা ভার্জিনিটি খুঁজতে গিয়ে চিরকুমারী থাকতে যাবো কেন? একটু চালাক হ বুঝলি? বিয়ের পর এমন টাইট দিবো না চরিত্রে হান্ড্রেডে হান্ড্রেড হয়ে যাবে আমার জামাই। সো নো চাপ! আর, বলদ কোথায় দেখলি? দেখতে তো বেশ ভালো। যদিও পাশের ছেলেটা হেব্বি ছিলো,এক্কেবারে জোশ কিন্তু প্রবলেম কি জানিস? ব্যাটা খুবই গম্ভীর। আমার বাবা এতো গম্ভীর ছেলে ভাল্লাগে না। সো আমি রাজি।”
কথাটা শেষ করেই দাঁত বের করে হাসলো শেফা। শুভ্রতা ব্যর্থতা ঘেরা চোখে তাকালো। বোনকে এতোকিছু বুঝানোর পরও যখন বিয়ের খুশিতে নাচছে। সেখানে আর কিইবা বলতে পারে সে?
________________
রাতের খাবার নিয়ে ব্যস্ত সবাই। আরাফের মায়ের জোরাজোরিতে সায়িদা বেগমকেও চেয়ার টেনে বসতে হয়েছে পাশে। যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা বাধ্য হয়েই খাবার সার্ভ করতে হচ্ছে শেফাকে। তাকে একটু আধটু সাহায্য করছে শুভ্রতা। খাবার টেবিলে সাদাফের চোখে না পড়ার মতো জায়গা বেছেই দাঁড়িয়েছে শুভ্রতা। সাদাফ থেকে নিজেকে আড়াল করার কতো উদযোগ তার। কিন্তু “নিয়তি” নামক বস্তুটি শুভ্রতার এই লুকোচুরিকে খুব একটা প্রশ্রয় দিলো না। তার সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে হুট করেই গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন লিয়াকত সাহেব,
—” শুভ্রতা মা? সাদাফকে ভাত দাও। ওর প্লেটটা খালি পড়ে আছে তো।”
লিয়াকত সাহেবের কথায় চমকে উঠলো শুভ্রতা। সাদাফও অস্বস্তিতে উশখুশ করে উঠলো। লিয়াকত সাহেবের তাড়ায় বাধ্য হয়েই সাদাফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শুভ্রতা। কিছুটা ঝুঁকে সাদাফের প্লেটে ভাত দিতে গিয়েই সাদাফের গায়ের হালকা মিষ্টি গন্ধ ধাক্কা দিয়ে গেলো নাকে। শুভ্রতার শুষ্ক অনুভূতিগুলো হঠাৎই যেন ভরা বর্ষার মাতাল নদীর মতো টলমলে হয়ে উঠলো। কাঁপা হাতে ভাত দিতে গিয়ে কিছু ভাত পড়ে গেলো সাদাফের গায়ে। শুভ্রতার অস্বস্তি আর কাঁপা হাত দেখে মৃদু গলায় বলে উঠলো সাদাফ,
—” ইটস ওকে। আর লাগবে না। আমার হয়ে গেছে।”
শুভ্রতা মাথা হেলিয়ে সরে দাঁড়ালো। সায়িদা বেগম বেশ কয়েকবার শুভ্রতাকে দেখে নিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। আজকের আগে শুভ্রতাকে এতো শান্ত আর ভদ্র হয়ে থাকতে দেখে নি কেউ। শেষ পর্যন্ত তাহলে মেয়েটার বাচ্চামোটা গেলো? খাওয়া-দাওয়া শেষ করে দশটার দিকে ফেরার জন্য উদযোগ করলো তারা। লিয়াকত সাহেবের থেকে বিদায় নেওয়ার ফাঁকে আড়চোখে এক-দুবার শুভ্রতার দিকে তাকালো সাদাফ। মেয়েটা যে ভয়ে সিটিয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে সাদাফ। আচ্ছা? কিসের এতো ভয় ওর? ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে? নাকি ভালোবাসার কেউ আছে? সেই ভালোবাসার মানুষটিকে আঁকড়ে রাখতেই কি সাদাফকে ভয় পাচ্ছে শুভ্রতা? কথাগুলো ভেবে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সাদাফ। সবার থেকে বিদায় নিয়ে সাদাফরা বেরিয়ে যেতেই মনের এককোনায় বেজে উঠলো এক স্পষ্ট সুর —” সে আমার বর!” মনের এই অযাচিত ভাবনায় নিজেই চমকে উঠলো শুভ্রতা। এসব কি ভাবছে সে?
________________
বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ফোন স্ক্রল করছিলো শুভ্রতা। শেফা ড্রেসিন টেবিলের সামনে বসে রাতের শেষ লোশনটা লাগাচ্ছিলো গায়ে। এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন সায়িদা বেগম। বিছানায় বসে অদূরে সুরে ডাকলেন,
—” শেফা? এদিকে আয় মা।”
শেফা লোশনের কৌটাটা ড্রেসিন টেবিলের উপর রেখে সায়িদা বেগমের পাশে গিয়ে বসলো। সায়িদা বেগম বিগলিত গলায় বললেন,
—” ওরা এখনই কাবিন করতে চায়। তোর বড় চাচা আর বড় দাদুর মতে সামনের শুক্রবার বাদ মাগরীবে কাবিনের ব্যবস্থা করে হচ্ছে। তোর কোনো সমস্যা নেই তো, মা?”
কথাটা কানে যেতেই ধপ করে উঠে বসলো শুভ্রতা। মনে মনে বলতে লাগলো, “নো আপু, ছে নো। এই বিয়া করিস না মেরি মা। আমাকে এভাবে ফাঁসাছ না, প্লিজ! প্লিজ! হে আল্লাহ্ তোমার এই মাসুম বান্দাটাকে এ বারের মতে বাঁচায় দাও। একটু রহম করো। আমি মসজিদে একহাজার টাকা দান করমু আল্লাহ। প্লিজজজজ। ” শুভ্রতার এতো এতো দোয়ায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে শেফা লাজুক হাসলো। মেয়ের পজিটিভ সাইন পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লেন সায়িদা বেগম। কিন্তু শুভ্রতা? শুভ্রতা নাক ফুলিয়ে বসে রইলো। এই মুহূর্তে শেফার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। একবার শেফার হবু বরের কারণে সাদাফের সাথে জড়িয়ে পড়েছে এখন আবার সেই হাদারামের হবু বউয়ের জন্য ঝামেলায় ফাঁসতে যাচ্ছে। উফফ! শুভ্রতার এতো এতো রাগ কারো চোখে পড়লো না। সায়িদা বেগম মেয়ের গালে আলতো আদর করে বললেন,
—” তিনদিন পরই তো শুক্রবার। পরশু আরাফ দেখা করতে চায়। এর আগে তো কথা-বার্তা হয় নি তোদের। পরশু দু’জন মিলে আলাদা কথা বলার সুযোগ পাবি। যাবি তো মা?”
শেফা মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো। সায়িদা বেগম হাতে চাঁদ পেয়েছেন এমন ভাব নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সায়িদা বেগম বেরিয়ে যেতেই ক্ষেপা বাঘিনীর মতোন শেফার দিকে তাকিয়ে রইলো শুভ্রতা। এই মেয়েটাকে এই মুহূর্তে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। বেয়াদব একটা। বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছে। কেন রে? শুভ্রতার বরের ফ্রেন্ড ছাড়া বিয়ে করার মতো আর কোনো ছেলে জুটতো না তোর কপালে? শুভ্রতার এই মুহূর্তে পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কেঁদে কেটে দুনিয়া ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। শুভ্রতার এই পরিকল্পনাটাকেও ভেস্তে দিয়ে বিছানা কাঁপিয়ে তুমুল শব্দে বেজে উঠলো মুঠোফোন। শুভ্রতা বিরক্তি নিয়ে ফোনের দিকে তাকালো। ফোনে “মা” নামটা দেখে আরো একদফা বিরক্ত হলো সে। বিরক্তি নিয়েই ফোনটা রিসিভ করলো,
—” হ্যালো?”
শুভ্রতার মা, রাদিবা আহমেদ আগ্রহ নিয়ে বললেন,
—” হ্যাঁ রে শুভি? তোর খালামনি বললো শেফার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”
—” হ্যাঁ হয়েছে তো?”
রাদিবা আহমেদ খুশি হয়ে বললেন,
—” বাহ! আলহামদুলিল্লাহ।”
শুভ্রতা চরম বিরক্ত হলো। সে টেনশনে মরে যাচ্ছে আর আর তার মা খুশিতে নাচানাচি করছেন ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না তার। শক্ত গলায় বললো,
—” আশ্চর্য! এতো খুশি হচ্ছো কেন বুঝলাম না। তোমার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা শেফা আপুর নয় তোমার ঠিক হয়েছে। এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি যার জন্য তোমাকে আনন্দে পাগল হয়ে যেতে হবে, মা।”
রাদিবা আহমেদ অবাক হয়ে বললেন,
—” আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আর শেফার বিয়েতে আমি খুশি হবো না? এটা তোর কাছে আনন্দের ব্যাপার মনে হচ্ছে না?”
শুভ্রতা স্পষ্ট কন্ঠে বললো,
—” নাহ্। মনে হচ্ছে না। এবার ফোনটা রাখো তো। আমার বিরক্ত লাগছে মা। অসহ্য!”
মেয়ের হঠাৎ এমন ব্যবহারে হতবাক হয়ে গেলেন রাদিবা আহমেদ। শুভ্রতা কখনো তো এমন অভদ্রের মতো কথা বলে না। তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো মেয়েটার? রাদিবা আহমেদ চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোন কেটে স্বামীর কাছে দৌঁড়ালেন। স্বামী শাহিনুজ্জামানকে এই মুহূর্তে ঘটনাটা খুলে বলতে হবে তার। অতিরিক্ত পড়াশোনায় মেয়েটা পাগল হয়ে গেলো কি না কে জানে?
#চলবে….