ক্যামেলিয়া
পর্ব ২৪
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
স্বামীহীন একজন নারীর সমাজে টিকে থাকার লড়াইটা কেউ চোখে দেখে না।হায়েনার দৃষ্টি সব সময় সেই নারীর দিকে লেগেই থাকে।কেউ যদি সাহায্যের হাত বাড়ায় তবে সেই সাহায্যে থাকে এক অদ্ভুত নোংরামো করার দৃশ্য। আর? আরো থাকে দ্বিতীয় থাকে পুনরায় বিয়ে করে নিলেই পারে।শর্ত একটাই নিজের সন্তানকে রেখে আসতে হবে।কারোর
সংসারে দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে তার সন্তানকে মানুষ করতে হয়,অন্যের রেখে যাওয়া সংসারে দায়িত্ব নিতে হয় অথচ নিজের সাথে কিছুই থাকে না। মাশহুদের দাদার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর লড়াইটা কারোর চোখে পড়েনি।যুদ্ধের পর যে দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছিল, সেই সময় মারা যায় তার বাবা।ভাইয়েরা রাখেনি সংসারে।নিজের এক টুকরো জমিতে কোদাল তুলে মাটি ঝুরঝুরে করতে হতো তার। মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে একটা বছর।কারণ যুদ্ধ থেকে তখনো ফিরেনি তার শ্বশুর। ফিরে এলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিশোরী।ধীরে ধীরে ফিরতে থাকে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় কিন্তু ওই যে একটা বছর? অভিভাবকহীন ছিল? সেই সময় পুরো রাত ঘুমায়নি সে। ছেলেকে বুকে আগলে ধরে ঘরের দরজা দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো।তার সাথে থাকতো শাশুড়ি। অন্য জায়েরা তখন বাবার বাড়ি থেকে ফিরেইনি।তাছাড়া বাড়তি তিনটে মুখের অন্নের দায়িত্ব কে নিতে চাইবে?
সেই সময়গুলো হুট করেই তার চোখের সামনে ইদানীং ভেসে উঠে।সে এই দেশে আসতে চায়নি।মানুষটার আশায় আশায় থেকে জীবন পার করেছে। এক সময় নিজ থেকেই ভেবে নিয়েছিল সে মারা গেছেন।না হলে এতগুলো বছরে একটা বার তো তাদের সাথে যোগাযোগ করতো।হুট করেই একদিন বিকেল বেলা এই ছেলেটা এলো।সে এসে আধো ভাঙ্গা বাংলায় বলল সে নাকী তার নাতী।শুনেই বুকের ভিতর ধ্ক করে উঠেছিল তার।বার বার দৃষ্টি ভিজে এলো। শূন্য দৃষ্টিতে ত আবছা আলোয় ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল ছেলেটা মিথ্যা বলেনি।এই যে সেই বলিষ্ঠ দেহ, কাধ। পিছন থেকে দেখে তার মনে হয়, ফিরে এসেছে তার কিশোরী বয়স। যে বয়সে একটা ভালো ভবিষ্যতের আশায় তার স্বামী চলে গিয়েছিল বিদেশে। তবুও সে আসতে চায় নি।কিন্তু ছেলের লোভ?লোভের তাড়নায় সে তাকে টেনে হিচড়ে নিয়েই এলো।অথচ সে চেয়েছিল এক বুক অভিমান নিয়েই পাড়ি জমাবে পরকালে।
একটি সম্পর্কের সব থেকে মধুর সময়টা তখন থাকে যখন ধীরে ধীরে তার প্রেমের জলে পা ডুবতে থাকে।ভিন দেশে এসে এই ভিনদেশির প্রতি এক অমোঘ মায়ায় ডুবছে সুচিত্রা।মাশহুদ আজ নিজে এসেছে তাদের খোঁজ নিতে।আজ সকাল সকাল দাদীর শরীর বেশ খারাপ হয়ে পড়েছিল।উপায়ন্তর না পেয়ে সুচিত্রা কল দিয়ে বসে মাশহুদকে।কল রিসিভ করেছিল তার সেক্রেটারি। এমিলি এত সকালে সেখানে কি করছে?ভাবতেই চিন্তার রেখা উদয় হলো তার ললাটে। অপর দিকে দাদীর চিন্তায় ঘাম ছুটে যাচ্ছে।নিজেকে কোনো ভাবে সামলে সে বিস্তারিত বলতেই মাশহুদ নিজে এসেছিল।দাদীর জন্য চিকিৎসার সকল ব্যবস্থা নিজে থেকে করে তারপর ফিরেছেন।সুচিত্রা নিজ হাতে তাকে এক কাপ চা করে এনে দিয়েছিল।এমিলি বাধা দিচ্ছিলো কিন্তু মাশহুদ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দুই চুমুক দেওয়ার পর হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি চা তে অভ্যস্ত নই।তবুও বেশ ভালো হয়েছে।”
কথাটা শুনে সুচিত্রার মন বেশ খারাপ হয়ে গেল।তার বার বার মনে হতে লাগলো যে কেবল মাত্র তার মন রক্ষার জন্যই মাশহুদ চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছিল।
সকালের নাস্তাটা করে যাওয়ার অনুরোধ করলেও মাশহুদ বলল
“আজ নয়, অন্য একদিন।দাদু একটু সুস্থ হলে আপনারা মানসিক প্রস্তুতি নিন।কারণ সময় হয়ে এসেছে আপনাদের কে পরিবারের বাকী সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। কারণ আপনাদের এই মুহুর্তে পরিচয় প্রয়োজন।দাদা সাহেব কিংবা দাদুর অবস্থা বেশ ভালো নয়।মৃত্যু তো বলে কয়ে আসবে না।”
মাশহুদ চলে যাওয়ার সময় দরজা হাত দিয়ে সুচিত্রা এসে বলল,
“আবার কবে আসবেন?”
“সময় হলে আমায় পাশে পাবেন।”
(৫৪)
ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে মাশহুদের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠেছে। জাফরিন পায়ের উপর পা বসে বসে আপেল খাচ্ছে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যুদ্ধে যাবে।সামনে রাখা আছে কয়েক পদের রান্নার সময় ব্যবহৃত ছুড়ি।একবার তার মনে হয়েছিল,
“মেয়েটা আত্নহত্যাও তো করতে পারে।”
পরক্ষণেই মনে হয়, এটা জাফরিন শিকদার, অন্য কেউ নয়।যে সহজে ছেড়ে দিতে জানে।মাশহুদ ভাবছে তাকে সে নিয়ে এসেছে এটাই জাফরিন মনে করে।কিন্তু মাশহুদ জানে, তাদের এই কাজের এখানে আসার জন্য জাফরিন টোপ ফেলেছে। ওই যে ওই দিন জাফিরিনদের বাড়িতে আগুন লাগার ব্যাপারে মাশহুদ অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পেরেছিল।আগুন লাগবে এটা জাফরিন জানতো।কারণ আগুন না লাগলে তার মা-বোনেরা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।তারা তাকে দেশেই রেখে দিতে চাইবে কিন্তু জাফিরিনের ইচ্ছে এখানে চলে আসার।নিজের জীবনের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে হলেও।সে ভেবেছিল আগুন লাগবে এটাই ইস্যু হবে কিন্তু তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা তার চাচা করেছে এটা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে।
এসব অচেতন মনে জাফরিন নিজেই বলছিল।সে ভেবেছিল তার বাবা তাকে উদ্ধার করেছে। বাবার বুকে মাথা দিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে সে।তাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিল”
“আব্বা, আব্বা, ও আব্বা।আপনি আসছেন?আপনার কাছে যাওয়ার জন্যই তো এতকিছু।আম্মা যে যেতে দিতে চাচ্ছে না।আমি যে আপনার সেই বাসায় যেতে চাই।আপনার গন্ধ লেগে আছে যে বাসার প্রতিটা জিনিসপত্রে।”
মাশহুদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল”
“আগুন লাগবে যে তুমি জানতে?”
“হুম জানতাম।এজন্যই তো সবাইকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে এসেছিলাম।”
“তবে নিজে কেন গিয়েছিলে?”
“আম্মা আর আপাদের ভয় দেখাতে। নইলে তারা রাজি হবে না।আব্বা আমার মাথাটা ফাকা ফাকা লাগছে।আমি কী মরে যাচ্ছি?”
মাশহুদ আলতো স্পর্শে তার চুলে চুমু একে দিয়ে বলেছিল,
“ড্রাইভ ফাস্ট। আদার ওয়াইজ আই উইল ফিনিশড ইউ ব্লাডি বাফেলো’স।”
স্ক্রিনে থাকা জাফরিন নিজেই নিজ হাতের ব্যান্ডেজ খুলছে।গতকাল তার সময় নেওয়া ছিল ডাক্তারের কাছে কিন্তু ঘুমের কারণে যেতে পারেনি।আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।হাতের ঘা দেখে তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো।হুট করেই ভয় লাগতে লাগলো তার। মাশহুদ স্ক্রিনে থেকে চোখ তুলে নিয়ে এমিলিকে বলল,
“গাড়ি ঘুরিয়ে নাও। মিস শিকদারকে এখন প্রয়োজন।”
তারা যখন কলিং বেল চাপলো তখন জাফরিন নিজের হাতটা ওড়নায় ঢেকে উঠে এলো বাইরের দিকে।স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে এমিলি দাঁড়িয়ে আছে, সাথে দুজন ডাক্তার।দরজা খুলে ফিচেল হাসি হাসে জাফরিন।বুঝতে বাকী রইল না তার হাতের ড্রেসিং করা হবে।এই এমিলিটা কীভাবে সব বুঝে যায়?তার জন্য নিয়ে এসেছে বাঙালি খাবারটাও। কিন্তু ড্রেসিং করা হবে বুঝেই সে বলল,
“আমার হাত ঠিক আছে। আমি ড্রেসিং করবো না।”
“মিস শিকদার, আপনি স্যারের মেয়ে।তার কাছে আমি অনেক ঋণী। তাই আপনার ভালো মন্দের দায়িত্ব অবশ্যই আমাকে দেখতে হবে।”
“কিন্তু!”
তারা ভিতরে প্রবেশ করে ড্রয়িং রুমে বসলেন।এমিলি জাফরিন কে তাগিদে দেয় খাবার খেয়ে নিতে। খাবার খাওয়ার সময় বার বার তার মনে হচ্ছিল একটু পর তার মৃত্যু দন্ড কার্যকর করা হবে বলেই এতো আয়োজন চলছে। খাবার শেষ করে এসে বসতেই সে অনুরোধ করলো,
“লোকাল এনাস্থেশিয়া দিয়ে হাত অবশ করে নিন না।আমার সহ্য হবে না এত ব্যথা।”
ডাক্তাররা একে অপরের দিকে চাইলেন।একজন সম্মতি দেওয়াতে তার হাতে ইনজেকশন দেওয়া হলো।মুহুর্তেই জাফরিনের দুচোখ বুজে ঘুম নেমে এলো।সে ঢলে পড়লো কারোর বুকে।মুখ থেকে মাস্ক খুলে মাশহুদ তাকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে গেল বেডরুমে।শক্ত করে বুকের সাথে আগলে ধরে রইল।অপর দিকে চলছিল জাফরিনের হাতের ড্রেসিং।ঘুমে জড়ানো অবস্থাতেই মেয়েটা অপর হাতে জড়িয়ে নিলো মাশহুদের হাত। যেন খুব পরিচিত কাউকে বহুদিন পাওয়ার পর হারানোর ভয়।
চলবে ……