#চেম্বার_কথন 19
ভদ্রলোক, “আমার আপনার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিছু মনে করবেন না।”
আমি, ” এমনটা হতেই পারে। আমার সেই অভিজ্ঞতা আছে। আপনার পেছনের দোলনাটায় বসছি। Feel comfortable!”
বুঝলাম এটাই প্রথম সূত্র যে, ভদ্রলোক এমন কিছু বলবেন যেটা জীবনেও বলেননি।
বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ। ওনার পেছনের দোলনায় দোল খাচ্ছি। ভদ্রলোক পারফিউম মেখেছেন। সেইখানে কিছু একটা গোলমাল আছে, ঠিক ধরতে পারছিনা। সুগন্ধি নির্বাচনে মানুষের অবচেতন ব্যক্তিত্বর ছোঁয়া আছে।
ভদ্রলোক, “বেশ্যাদের প্রতি আপনার মনোভাব কি?”
আমি, “এই সেশনে সেটা কিভাবে সাহায্য করবে?”
ভদ্রলোক আবার চুপচাপ। অদ্ভুত সুন্দর দেখতে এই মানুষটি। এ্যাপোলো কি এমনই ছিলেন?
ভদ্রলোক, ” কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। হেল্প করবেন?”
ভরাট গলা। এই প্রথমবার মনে হলো আমি কোথায় যেন এই গলা শুনেছি। কারণ আমি টিভি নিতান্তই কম দেখি। গলার টোনে পেশাদারিত্ব। ইঙ্গিত পাচ্ছি তিনি মুখ খুলতে প্রস্তুত।
আমি, ” খোলামেলা বলে ফেলুন। জাস্ট বি ওপেন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্ট।”
ভদ্রলোক, ” আমি মিডিয়াতে কাজ করি। কাজ পাবার জন্য আমাকে পুরুষের সাথে শুতে হয়। শুধু তাই নয়, যিনি কাজ দিচ্ছেন তার নির্দেশে ক্লোজড গ্রুপে আরো কিছু পুরুষের সাথেও। সোজা বাংলায় খুশি করতে শুতে হয়। আমি আর পারছি না। না মন থেকে! না শরীর থেকে!”
আমি, “কাউন্সেলিং থেকে কি চান?”
ভদ্রলোক, ” আমি আর শুতে চাই না। নিজেকে বেশ্যা লাগে।”
আমি, ” না শুলে কি হবে?”
ভদ্রলোক, ” কাজ পাবো না।”
আমি, ” কতো বছর ধরে এই পেশায় আছেন?”
ভদ্রলোক একটা সংখ্যা বললেন।
আমি, “এতদিন যদি শুধু শোবার জন্যই কাজগুলি পান তবে আপনাকেই বলবো যে আপনার কর্মদক্ষতা কি পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে না? “
ভদ্রলোক, ” হ্যাঁ! তাইতো!”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন।
মৌনতা গড়িয়ে যেতে থাকলো। চা এসেছে। আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে দোল খেতে থাকলাম। বিড়াল দুটি বেশ খুনসুটি করছে পায়ের কাছে।
কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক স্বগোক্তি করলেন, যেন কূয়ার গভীর থেকে গলার শব্দগুলি উঠে আসছে, “আমি দ্রুত উপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজছিলাম। শর্টকাট রাস্তা। ইনস্ট্যান্ট নাম, টাকা, ক্ষমতা! কিন্তু তার জন্য যে এত দাম দিতে হবে… বুঝি নাই।”
আমার রবীন্দ্রনাথের সাধারণ মেয়ে কবিতার লাইন মনে পড়লো, কোথায় জানি একটা উহ্য আন্তমিল আছে।
“কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
মন যায় না সত্যের খোঁজে,
আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।”
আমি, “এই চক্রব্যূহ থেকে বের হয়ে আসলে কি হয়?”
ভদ্রলোক, “আর কাজ পাবো না!”
আমি, “বেশ তো! অন্য কিছু করবার কথা কি ভেবেছেন?”
ভদ্রলোক, ” না!”
আমি, ” এই পেশাটা আপনার প্যাশন নাকি লোভ? একটু ভেবে বলুন! তাড়াহুড়ো করে উত্তর দেবার কিছু নেই। সময় নিন। আমরা প্যাশন হলে এক পথে হাঁটবো, লোভ হলে ভিন্ন পথে!”
ভদ্রলোক অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। বিদ্যুৎ চমকের মত পারফিউমের রহস্য আমার মস্তিষ্কে ধরা পড়লো। এটা কামোদ্দীপক সুগন্ধি। পুরুষদেরকে আকর্ষণে ব্যবহৃত হয়। বহু বছর আগে এক ট্রেনিং এ শিখেছিলাম সুগন্ধির ব্যাবহার ও ব্যবহারকারীর চরিত্র বিশ্লেষণ।
আমার হজম শক্তি খুব প্রকট বলে দিব্যি সেই সব বিদ্যা বিলকুল মাথা থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। ইদানিং বারবার মনে হয়, এতো কম বুঝি! এতো কম জানি! আর কি কি জানি না সেটাও খুঁজতে জানি না। অথচ সবই চোখের সামনেই পড়ে থাকে।
ভদ্রলোক নিরবতা ভাঙলেন, আলতো করে বললেন, “লোভ!”
আমি, “এক্সাক্টলি! এইবার নিজের চোখেই আয়না ধরুন, এই লোভের মূল্য আপনি কেন? কিভাবে? কতো দিন ধরে? কোথায় কোথায় চুকাবেন… আগামী দিনগুলোতে? এই লোভের মাশুলই বা কি কি দিচ্ছেন?”
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে, ভদ্রলোক ঘুরে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।
তিনি বললেন, ” যথেষ্ট হয়েছে। Enough is enough! I’m done!”
আলোচ্য ভদ্রলোককে আমি স্যালুট দেই। কারণ খুব কম মানুষই পারেন লোভের থাবা থেকে নিজেকে বের করে নতুন ভাবে গুছাতে। আমরা সব সময় সস্তা পপুলারিটি খুঁজতে যেয়ে পানির দরে বিকিয়ে দেই নিজের মর্যাদা। নিজেই নিজেকে অসন্মান করি। আর আমি যদি আমাকেই সন্মান করতে না পারি, তাইলে অন্যরা কেমনে করবে? কিভাবে অন্যের থেকে সন্মান আশা করবো? তাই না!
“পাছে লোকে কিছু বলে”তে কিন্তু আত্মমর্যাদা নষ্ট হয় না। আমার আত্মমর্যাদা তখনই নষ্ট হয় যখন আমি জানি, যে আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই এই প্যাঁচটা কষলাম। অন্যরা টের পাবেন না আমার এই প্যাঁচ এটাই তো স্বাভাবিক। সূক্ষ্ম প্যাঁচ মানুষ তখনই লাগায় যখন ‘আংশিক সত্য’কে নিয়ে সে কাজ করে। ফলে সুবিধা হয়, ‘আংশিক সত্য’কে সে সত্য বলেই বুক ফুলিয়ে সবার সামনে বলে। তার সাথে খুব সামান্য পরিমাণে একটু অদৃশ্য প্যাঁচ মিশিয়ে দেয়। কার সাধ্যি তখন সেটা ধরা? কিন্তু সে ভুলে যায় যে আশেপাশের মানুষ ঠিকই প্যাটার্নটা বুঝতে পারে। বিশেষ করে এটা যখন সে বারবার ঘটায়। অন্যের বুদ্ধিমত্তাকে খাটো করে দেখা নির্বুদ্ধিতা। যেমন আমরা মনে করি, বাচ্চারা কিছুই বুঝেনা। আসলে কিন্তু বাচ্চারা সবই বুঝতে পারে। বাচ্চারা বাচ্চাদের মতো করেই বোঝে। কোনো ভেজাল নেই তাতে।
কেউ না ধরতে পারলেও দিনশেষে নিজের চোখে আয়নাটা ধরলে প্যাঁচ লাগানো মানুষটি ঠিকই জানেন যে প্যাঁচটা তারই সূক্ষ্ম চালাকিতে করা। চিকন বুদ্ধির ফসল। ফলে নিজের স্বপক্ষে তিনি অনেক যুক্তি দিতেই পারেন। তাতে কথা লঘু (ডাইলুট হবে) কিন্তু প্যাঁচ, প্যাঁচানোই থাকবে। কথার উপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চাইবে। তাতে মূল প্রসঙ্গ তো আর বাদ হয়ে যায় না! কি বলেন?
খুব সহজ একটা উদাহরণ দেই। অন্যের অগোচরে তাঁকে নিয়ে কথা বলা অশোভন। একজনের কথা আরেকজনকে চুপি চুপি বলা, এই আচরণটাকে “কথা চালাচালি” বলে। কারণ এখানে selctive information purposefully shared হয়।
নৈতিকতার জায়গা থেকে এই ধরনের আচরণ অগ্রহণযোগ্য, এর পক্ষে যতই যুক্তি খোঁজা যাক।
আজ যে অন্যের সম্পর্কে আমার কাছে এসে কথা লাগায়, কাল সে অন্যের কাছে যেয়েও আমাকে নিয়ে কথা লাগাবে। এটাই মনস্তত্ত্বের সাধারণ ফর্মুলা।
হাজার বার বললেও মিথ্যে বা ‘আংশিক সত্য’ জাতে উঠবে না। পূর্ণাঙ্গ সত্য, সত্যিই! ধ্রুব!
(কথোপকথনের অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা ভদ্রলোকের অনুমতি সাপেক্ষে কনফিডেন্সিয়ালিটি বজায় রেখে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশে প্রকাশ করা হলো।
পুনশ্চ:
*এখানে ভদ্রলোকের চরিত্র বিশ্লেষণ না করে, একটু খেয়াল করে দেখুন, আমরা নিজেরা কিভাবে,
১. লোভের শিকার হই?
২. লোভের বশবর্তী হয়ে আংশিক সত্যকে প্যাঁচ লাগিয়ে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করি? সেই প্রবণতার দিকে নিজের চোখে আয়না ধরতে অনুরোধ করবো।
* অন্যের সমালোচনা সর্বতোভাবে পরিহারযোগ্য)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া।
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।