#চেম্বার কথন পর্ব ৩৭
ভদ্রমহিলা, ” আমার বিয়েটা টিকবে না! আমার জীবনসঙ্গীর ধারণা আমি তাকে বঞ্চিত করি! সে যেভাবে দৈহিক সম্পর্ক চায় আমি পারি না সেইগুলি করতে। আমি নাকি তার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছি। আমাকে বিয়ে করে নাকি সে খুব ভুল করেছে। আমার বাইরের চেহারাটা নাকি চকচকে দামি প্যাকেট, আসলে ভেতরে ফাঁপা মাল। দিনের পর দিন একই কথা! চাপা রাগ! এখন তো অল্পতেই যেকোন কিছুতেই ফোঁস করে ওঠে। আমি আর পারছিনা।”
আমি, ” আপনারা এর জন্য ডাক্তার দেখিয়েছেন?”
ভদ্রমহিলা, ” হা, আমাদের দুজনেরই শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ও যা যা চায় বিশেষ মুহূর্তে, বিছানায় সেই কাজগুলো করতে আমার প্রচন্ড বিতৃষ্ণা কাজ করে। ঘেন্না করে! তারপরও আপ্রাণ চেষ্টা করেছি; কিন্তু যাই করি কিছুতেই মন ভরে না। ভীষণ রাগ করে। সমস্ত দুর্ব্যবহারের মাত্রা ছাড়িয়েছে। এখন সবকিছুতেই আমার দোষ। আমি জানি মূল কারণটা কি। কিন্তু আমি কি করবো? আমার বমি আসে। আর পারছিনা!”
আমি, ” তিনি কি বলছেন?”
ভদ্রমহিলা, ” বলছে আমি নাকি হোপলেস! বারবার বলে দেওয়ার পরেও কেন পারিনা? আসলে আমার নাকি সংসার টিকানোর কোন ইচ্ছাই নাই। কিভাবে বোঝাবো ওকে যে এটা কতো বড় ভুল! “
ভদ্রমহিলার জীবনসঙ্গী পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। ফলে স্বামী এমন কিছু আচরণ স্ত্রীর কাছে দাবি করেন যেগুলো রূপালী পর্দায় দেখেন। স্বভাবতই এই আচরণগুলোর সুস্থ মানসিকতার পর্যায় পড়ে না।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সব ধরনের যৌন আচরণ কি সম্ভব? অবশ্যই নয়। পারভার্সন বা যৌন বিকৃতি বলে একটা শব্দ না হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে থাকত না। এ ধরনের যৌন বিকৃতিতে যারা ভোগেন তাদের ভেতরে জীবনসঙ্গীকে কোন আচরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার একটা অসুস্থ্য প্রবণতা দেখা যায়।
এখানে নিজেকে খেয়াল করতে হবে যে, আমি যখন খুব নিয়ন্ত্রণ করবার প্রবণতা থেকে জীবনসঙ্গীকে বদলানোর চেষ্টা করছি তখন কিন্তু সেটা মানসিক নির্যাতনের পর্যায়ে চলে যায়। শরীরে মারের দাগ দেখানো যায়। কিন্তু মানসিক নির্যাতনের দাগ দেখানো যায় না। বাইরের মানুষ বলে ফেসবুকে এত সুন্দর হাসি মাখা হিংসে করার মত ছবি। অথচ ভিতরে ভিতরে নারী অথবা পুরুষ যে কেউ পুড়ে যেতে পারেন। দাম্পত্য সম্পর্ক শুধু মানসিক নয় শারীরিক অংশও আছে।
একটু খেয়াল করব যে, আমি আমার মানসিক এবং শারীরিক সম্পর্কের ভাবনাগুলো জীবনসঙ্গীর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে কিনা? এখানে যৌন আচরণগুলাও আলোচনায় আসবে। আমি যেভাবে আশা করছি আমার জীবনসঙ্গী, আমার সাথে যৌন আচরণ করবেন তিনি হয়তো সেটা করতে পারছেন না; কিন্তু তার জন্য আমি চাপ দিতে পারব কি?
বিশেষ করে আমাদের দেশে একটা ভ্রান্ত ধারনা আছে যে মেয়েদের যৌন চাহিদা থাকতে পারে না। এবং এটা যদি কেউ প্রকাশ করে তাকে খারাপ মনে করবার একটা সংস্কৃতি আমাদের সমাজে প্রচলিত। তাই নিজের চোখের সামনে নিজেরই আসলে একটা আয়না ধরা দরকার, যে এই চাপটা আমাকে পরিবর্তিত করার জন্য, অন্য কেউ, যদি আমাকেই দিতো, তাহলে আমি কি অনুভব করতাম? কি চিন্তা করতাম? কি আচরণ করতাম?
কারণ মনে রাখা দরকার আমার দাম্পত্যকে ভালো রাখতে হলে আমি জীবনসঙ্গীকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি, কিন্তু চাপ দিতে পারি না। আমার বিশ্বাস এবং আমার আচরণের জায়গাটা যদি ইতিবাচক হয় তাহলে কিন্তু অপরপক্ষ নিজেই সেটা বেছে নেবেন। আমি মডেলিং করতে পারি আচরণের মাধ্যমে চোখে আংগুল দিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যে, “দেখো আমার এই বিশ্বাসের জায়গাটা, আমার এই আচরণের জায়গাটা কতটুকু ভালো”।
মানুষের মস্তিষ্কে মিরর নিউরন নামে স্নায়ু কোষ থাকে যার দ্বারা আমরা অন্য মানুষের আচরণকে অনুকরণ করতে পারি । আমার আচরণই জীবন সঙ্গীর কাছে প্রমাণ করতে পারে এই মূল্যবোধ কেন আমি বিশ্বাস করি। চাপ দিয়ে নয়। খোলামেলা আলোচনা, নন ভার্বাল (মুখে না বলে) আচরণে প্রমাণ করাটা খুব বেশি জরুরি।
কাজেই আগে নিজের মনের সাথে নিজেকেই বুঝে নিতে হবে, আমি কি চাপাতে চাই নাকি তাকে আসলেই মমতার সাথে উদ্বুদ্ধ করতে এই নিদৃষ্ট আচরণটা করছি। মনে রাখবো, জীবনসঙ্গীর উপর যেকোনো কিছু চাপাতে চাওয়াটা অস্বাস্থ্যকর। এতে জীবনসঙ্গী আমার যতই দৈহিকভাবে কাছে থাকুন, মানসিকভাবে তিনি আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমি ভালোবাসি তাই বদলাতে চাই। এই কথা আমি বলতে পারি কি না? রবীন্দ্রনাথেই ফিরি, “ভালোবাসায় ট্রাজেডি সেখানেই ঘটে যেখানে পরস্পরকে স্বতন্ত্র জেনে মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি..”
কাজেই ভালোবাসার সম্পর্কে আরেকজনকে পরিবর্তন করতে চাইলে পরিণতি সম্পর্কের জন্য অস্বাস্থ্যকর।
(কথোপকথনের অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কনফিডেনশিয়ালিটি বজায় রেখে প্রকাশ করা হলো!
পুনশ্চ: এখানে ভদ্রমহিলা কি সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা মুখ্য নয়। আমি নিরপেক্ষভাবে নিজের চোখে, নিজের আসল চেহারাটি দেখতে কতটুকু আয়না ধরতে পারি সেটাই মূখ্য!)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া,
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।