#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১৫
“ভাই আপনি সোহান পালোয়ানের সঙ্গে শত্রুতা কেন করছেন? মানে কুত্তার লেজে পারা দিয়ে কামড় না খাওয়া অব্দি শান্ত হবেন না?১৪ টা ইনজেকশন খাওয়ার এতই শখ?”
ফারাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”আসছে পালোয়ানের উকালতি করতে। কয়টাকা সদকা দিয়েছে রে কুদ্দুসের আব্বা তোরে? “
অভ্র বিরক্ত মুখে বলল,” এই নামে ডাকা কবে বন্ধ হবে? বার বার কেন মনে করিয়ে দেন আমার যে বিয়েই হয় নাই? না মানে যেখানে বিয়েটাই হলো না সেখানে বাপ হওয়া কি বিলাসিতা নয়?”
ফারাজ বুকে হাত দিয়ে চোখ বুজে বলল,”উফস কি কষ্ট রে। মাইরি দুঃখে আমার পেছন ব্যাথা করছে।”
অভ্র ভ্রু কুঁচকাল,”ভাই কষা নাকি?”
” দূর হ ছাওয়াল ।আমার কষা হবে কেন?আমি লিটারে লিটারে মদ গিলি। তবে দেখিস সিঙ্গেল থাকার কষ্ট যেন তোর আবার কষা না হয়ে যায়। বি কেয়ারফুল। তোর কষা হয়ে গেল তো তুই আমার থেকে বাথরুমকে বেশি সময় দিবি। না বাবা! আমার থেকে অন্যকিছুকে বেশি সময় দেওয়া আমি মানতে পারব না। এসবে আমার মেজাজ খারাপ হয়। রাগে মূল্যবান জিনিসগুলোও জোনাকির পুক্কির মতো জ্বলে উঠে।”
অভ্র বিষম খেল। ছোট থেকেই ফারাজের সঙ্গে আছে সে। অথচ মানুষটার মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন লক্ষ করল না সে। মানুষ নাকি পরিবর্তনশীল তাহলে এই এলাহী এমন কেন?তবে কি সে কোনো মানুষ নয়?নরপিশাচ?
“ভাই আপনার কথা বার্তা শুনে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিক। অথচ আপনি আজটা কি করলেন?হারুনের কলিজা ভুনা করে তার গুরুকে খাইয়ে দিলেন? সঙ্গে আবার চিরকুট?”
ফারাজ হেসে বলল,”গুরুকে নয় গরুকে খাইয়ে দিয়েছি। কেন হে শালা তোমারও কি খাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?কাম তোমারটা বের করে রান্না করি। তারপর কবরে পার্সেল পাঠাবো। “
অভ্র নাক কুঁচকে বলল,”ভাই কি যে বলেন? গা ঘিন ঘিন করে। ওইসব কেমন করে রাঁধছেন ভাই? মানুষ কেমন করে মানুষের কলিজা খায়?”
“আমাকে দেখতে কি তোর আব্বা মনে হয় ? মানুষের কলিজা কেন রান্না করব? বাজার থেকে গরুরটা কিনেই রান্না করেছি। ওই কালা দামড়া কি এতসব বুঝবে? ওহ তো নিশ্চিত হারুনের কলিজা ভেবে বমি করেছে। ওরে একটু ভয় দেখালাম। যতদিন আমাকে সে ভয় পাবে ততদিন জিন্দা থাকতে পারবে। “
“ভাই!”
ফারাজ তখন বাগানের দোলনায় বসে হুইস্কির বোতলে চুমুক দিচ্ছিল এবং সিগারেটের টান বসাচ্ছিল। তার মুখে ছিল নিস্পৃহ ভাব। দুনিয়ার কোনো কিছুর তোয়াক্কা নেই চেহারায়।
” উঁহু একটা কথাও শুনতে চাই না।”ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে বলল।
“কিন্তু ভাই আমি কি বলি একটু শুনেন তো আগে।”
“হাসান আর ফারুকের লাশের কথা বলবি তাই না?কে তাদের মেরে পুকুরে ভাসিয়ে দিল?”
“সেটাই ভাই। কার কাজ এটা?কারন আমরাতো কিচ্ছু করি নি। বাড়ির মধ্যে ডুকে খুন করা হয়েছে। বুঝতে পারছেন?”
ফারাজ নিঃশব্দে এক মুহূর্ত বসে থাকল। তারপর বোতলটা পাশে রেখে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকাল সামনের দিকে। “না বুঝার কি আছে?এই বিষয় নিয়ে আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না। কিচ্ছু না।”
সে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্ত আগের সেই নিশ্চিন্ত উজ্জ্বলতা কোথাও যেন মিলিয়ে গেছে।
“গেলাম আমি। দুপুরে একটা কড়া ঘুম দিয়ে সন্ধ্যার দিকে উঠব। ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি ছাওয়াল মুড়ি খাও।”
–
চিত্রা দুপুরের পর থেকেই ঘরের এক কোণে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সকাল থেকে বাড়ির পরিবেশ থমথমে। ভোরে বাড়ির পুরুষেরা ফিরে আসার পরই খু*নের খবর জানতে পারে। তারপর কারও চোখে ঘুম নেই। মনে অজানা শঙ্কা। দুপুরে বাড়ির পুরুষরা একসঙ্গে খেয়েছে। ফারাজও খেয়েছে। কিন্তু চিত্রাকে আজ সে নিজের সঙ্গে টেবিলে বসাতে পারেনি। আজ প্রথমবারের মতো চিত্রা জুনায়েদ এলাহীর সঙ্গে কথা বলেছে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি আর বিয়ে করেননি। নিজেই ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছেন। চিত্রা আজ জোহানকেও লক্ষ করেছে।চঞ্চল, প্রাণবন্ত, সহজেই মিশতে মানুষের সঙ্গে মেশার গুন আছে। একেবারে তার বোনের বিপরীত। তবে এই পরিবারের মানুষগুলোকে বুঝতে চিত্রার বেশ কষ্ট হচ্ছে। কী অদ্ভুত এক সম্পর্ক এদের মধ্যে! একই ছাদের নিচে থাকলেও কেউ কারও সঙ্গে তেমন মেশে না, কথাও বলে না। খাবার সময় কখনো সবাই একসঙ্গে থাকে, কখনো বা কাউকেই দেখা যায় না। রুমানা বেগমও বিচিত্র চরিত্রের। রান্নার সময় ছাড়া তাকে বাইরে দেখা যায় না। রান্না শেষ হলে খেয়ে নিয়ে নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে যান। প্রয়োজন না হলে বের হন না। চিত্রা ভাবল, এই যে সে নিজের সব ছেড়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করল, কেউ কি একবারও জানতে চেয়েছে তার অতীত? তার পরিবার কেমন ছিল? কোথায় ছিল তার শৈশব? শ্বশুর-শাশুড়ির তো অন্তত এই প্রশ্নগুলো করা উচিত ছিল! তাদের আদরের ছেলে যে তাকে তুলে এনে বিয়ে করেছে, সেটা তারা জানে তো? ফারাজ যদি সেদিন তাকে না নিয়ে যেত, তাহলে আজ কী হতো? সেই বৃদ্ধ লোকটার হাতেই কি তার জীবনটা সঁপে দিতে হতো? ভাবতেই চিত্রার গা গুলিয়ে উঠল। আর সোহাগের কথা তো সে ভাবতেই চায় না। বিশ্বাসঘাতকদের জন্য তার মনে একটুও জায়গা নেই, যত কাছেরই হোক না কেন। চিত্রার ঠোঁটে এক ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটল। “বিশ্বাসঘাতক কি কখনো পর হয়? না, আমরা যাদের সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি, ভালোবাসি তারাই একদিন আমাদের পিঠে ছুড়িঘাত করে। প্রকৃত বিশ্বাসঘাতক তারাই।”
চিত্রা ধীরে ধীরে আলমারির দিকে এগোল। আলমারির সহ এই ঘরের প্রতিটি চাবি ফারাজ তার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল,
“নাও, আজ থেকে সব তোমার। এমনকি আমিও।”
লোকটা ঠোঁটকাটা, কিন্তু পিছনে কথা বলার অভ্যাস নেই। এমন ব্যক্তিত্ব চিত্রার পছন্দ। সেদিন যখন ফারাজ তাকে তুলে নিয়ে যায়, তখন সে মামীকে মিজান সাহেবের চেয়েও বেশি টাকা দিয়েছিল। কিন্তু একবারও সে বলেনি, “আমি চিত্রাকে কিনে নিয়ে যাচ্ছি।” বরং বলেছিল,
“এতগুলো বছর আমার বউটাকে খাইয়েছেন, পড়িয়েছেন সেসব তো চুকাতে হবে? মিসেস ফারাজ এলাহী কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, তা স্বামী হিসেবে কি করে মেনে নেই বলুন তো? টাকা গুলো দিলাম, যেন আমার বউটার ওপর কোনো দায় না থাকে। কম মনে হলে চেয়ে নিবেন। আমার অনেক আছে,দিতে অসুবিধা নেই।”
অথচ চিত্রা বিয়ের পর থেকেই সেই ফারাজের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে। এত অভিমান পুষে রেখে লাভ কী? অনাথদের কি অভিমান মানায়? তাদের রাগ করতে নেই, জিদ ধরতে নেই। শুধু মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে পারলেই জীবন সুন্দর। চিত্রার চোখের সামনে ভেসে উঠল তালুকদার বাড়ির স্মৃতি। তার নিজের বাড়ির স্মৃতি। বাজিতপুরের সেই অট্টালিকা আজ শুধুই ধ্বংসস্তূপ। তালুকদার বংশের অস্তিত্ব মুছে গেছে। এক রাতেই সব শেষ হয়ে গিয়েছে।বিয়েবাড়ি পরিণত হয়েছিল শোকের বাড়িতে। যদি সেদিন চিত্রাও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত! তাহলে হয়তো এই দুনিয়ার যন্ত্রণা তাকে বইতে হতো না।
দুনিয়া ফারাজ এলাহীর নীতির মতো,যা দেয়, তার চেয়েও বেশি কেড়ে নেয়। চিত্রা আলমারির দরজা খুলল। আলমারি সাজানো দামি পোশাক, প্রসাধনী, অলংকার।এসব সে আগে কখনো দেখেনি। ফারাজ সত্যি যদি তাকে ভালো না বাসত, তাহলে এত কিছু করত কেন? আজকাল শুধু দায়িত্বের খাতিরে কেউ এত কিছু করে না। এই বাড়িতে আসার পর মনে হচ্ছে তার নতুন জন্ম হয়েছে। আদৌও কি এটা তার পূর্ণজন্ম?নাকি সবই কেবল একটা স্বপ্ন? স্বপ্ন কেবলই ছলনা হয়। আর ছলনা মানেই ভয়। ভয়… খুব ভয়…
“আগুন সুন্দরী।”
চিত্রা চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকাল। ফারাজ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, টলমল করছে। মদের গন্ধ এতটাই তীব্র যে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
“মদ খেয়ে কী অবস্থা করেছেন! পুরোই মাতাল হয়ে গেছেন।”
ফারাজ হঠাৎ চিত্রার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে এল। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে বলল,
“আমায় মদে মাতাল করেনা, করেছে তোমার কাজলকালো চোখ দু’টি। কী তীক্ষ্ণ তার চাহনি! কী তার তেজ! আমায় মাতাল করার জন্য তোমার চাউনিই যথেষ্ট, প্রিয়তমা। এভাবে তাকিয়ো না… ঘায়েল হয়ে যাই তো!”
চিত্রা একদম স্থির হয়ে গেল। ফারাজ তার ঠোঁটে হালকা পরশ বুলিয়ে দিল। পরশ বুলিয়ে নিজের অধিকার ঘোষণা করল,
“তোমার চোখ আমায় মাতাল করে,
হিয়া করে ব্যাকুল।
আমি, প্রেমের স্রোতে ডুবে মরি,
পাই না একূল-ওকূল।”
চিত্রা ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। মুখে একটা কঠিন ভঙ্গি এনে বলল,
“ডুবে মরার আগে ব্রাশ করে মরবেন প্লিজ! পারলে গায়ে একটু পারফিউমও লাগাবেন। মদের গন্ধে তো আপনার প্রেম প্যান্টের ফুটো দিয়ে পালাবে।”
ফারাজ কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর দ্রুত নিজের নিচের দিকে তাকাল। কই! চেইন তো লাগানোই আছে! তাহলে বউ তার ফুটো পেল কই থেকে?
–
নিরু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লিপস্টিক ঘষছে ঠোঁটে। গাঢ় মেরুন রঙ। ফারাজ ভাইয়ের পছন্দের রঙ। আজ সে মেরুন রঙের কামিজও পরেছে। সে নিশ্চিত ফারাজ ভাই তাকে আজ দেখেই ফিদা হয়ে যাবে। হঠাৎ চিত্রার কথা মাথায় আসে। নাক কুঁচকায় নিরু। ঝামেলাটা দমকা হাওয়ার মতো তার ফারাজ ভাইকে কেড়ে নিয়েছে। যে করেই হোক ফারাজ ভাইকে পটাতেই হবে। ফারাজ একবার পটে গেলে নিরু তাকে বিয়ে করে নিবে। তারপর চিত্রাকে এমনিতেই চাল খাটিয়ে বাড়ি ছাড়া করবে। নিরু নিশ্বাস ছাড়ল। কি সব বকছে সে? মাথায় নির্গাত গ্যাসটিক হয়েছে?আয়হায় গ্যাসটিক থেকে যদি আলসার হয়ে যায়?আর তারপর যদি নিরু মারা যায়?তখন ফারাজ ভাইকে বিয়ে করবে কেমন করে? না প্লেন করতে হবে ঠান্ডা মাথায়। নিরু ঘড়ির দিকে তাকায়। সন্ধ্যা ৭ টা বাজতে এখনও ২ মিনিট বাকি আছে। জলদি নিরু টিভি ছাড়ল। রিমোট টিপে স্টার জলসা বের করল। একটু পর তার পছন্দের নাটক শুরু হবে। কিছুতেই মিস করা যাবে না। নাটক দেখে বুদ্ধি নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিত্রাকে বাঁশ দিতে হবে। নিরুর পাশের রুমটা জোহানের। এই বাড়িতে যদি কারও রুম সবসময় অগোছালো থাকে, তবে সেটা একমাত্র জোহানের। একটা বেপরোয়া ছেলে। ইচ্ছে করেই পড়াশোনা শেষ করেনি। শ্যামবরণ, লম্বাটে গড়ন। উসকোখুসকো চুল। দেখলে মনে হয় চিরুনির ধার মাড়ায়নি বহুদিন। একটা গিটার আছে তার। বিকেল হলেই সেটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে। সারাবছর ভণ্ডামি করে বেড়ায়। তবে জুম্মার দিন হলেই পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে হঠাৎ ইমানদার হয়ে ওঠে। এই যে, এই সন্ধ্যায় গোসল করতে গিয়েছে। ফাটা গলায় গান গাইছে। সেই কর্কশ শব্দ এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে। নিরুর সিরিয়াল দেখতে কষ্ট হচ্ছে। মন চাইছে টিভিটা তুলে ভাইয়ের মাথার ওপর ভেঙে ফেলে। সে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠল,
“ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন ভাই! নিজেকে আরিজিৎ সিং ভাবার দরকার নেই। তুমি সারাজীবন হিরো আলমই ছিলে, আছো, আর থাকবেও!”ওপাশ থেকে গানের আওয়াজ আরও বেড়ে যায়। নিরু রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। টিভি পুশ করে দিয়ে একেবারে জোহানের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তার ইচ্ছে করছে দরজা ধাক্কিয়ে এক ঝটকায় তার ভাইকে তুলে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলতে। ঠিক তখনই হুট করে কারেন্ট চলে যায়। পুরো বাড়ি নিমেষেই অন্ধকারে ঢেকে যায়।
“বালের কারেন্টের আব্বা মরছে নাকি। কি যে শুরু করছে।”
নিরু মোমবাতির জন্য অন্ধকারে রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে কেউ একজন পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখে। ভয়ে নিলু চিৎকার করতেই অপাশ থেকে তার মুখ চেপে ধরে। চিৎকারের শব্দ মুহুর্তেই গোঙানিতে পরিনত হয়।
চলবে?