#ইশরাত_জাহান_জেরিন
‘বিয়ে তো শেষ।এবার আমার বউকে আমি বাড়ি নিয়ে গেলাম। বুঝতেই তো পারছেন এই মাঝ রাতে সদ্য আমার বিয়ে হয়েছে।এখনো বাসরটা বাকি।সেটাও তো সারতে হবে?’
সবাই হা হয়ে ফারাজের দিকে তাকিয়ে আছে। সকলের মনে হচ্ছে মাঝরাতে তাদের বাড়ির ওপর দিয়ে কোনো বড়সড় ঝড় চলে গেছে।অথচ তারা আচ পেয়েও কিচ্ছুটি করতে পারছে না।আর চিত্রা তো মোমের তৈরি পুতুলের মতো নির্বাক হয়ে পড়ে আছে।যে না সে আসছে আর তাকে গলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।সে না পারছে কিছু সহ্য করতে আর না পারছে চিৎকার করে বলতে,আমি মানুষ।আমারও দুঃখ আছে।আমারো যন্ত্রণা হয়।দুনিয়ায় সে কার ওপর খানিকটা ভরসা করবে তার জানা নেই।মামী সহ গোটা পরিবারটা একটু আগেই তাকে বিক্রি করে দিচ্ছিল।দিনের বেলায় মেয়ে নিয়ে কুমিল্লা গেলে ঝামেলা হতে পারে দেখে মিজান মাঝরাত করে কাজ সারতে এসেছিলেন। কুমিল্লায় নিয়ে মিজান হয়তো চিত্রাকে কিছুদিন নিজের কাছে রাখত।তারপর তাকেও চোরা পথে ডুবাই কিংবা অন্য কোনো দেশে পাচার করে দিত।তবে এখানে বসে থাকা কেউ একবার জানতে চাইল না অসহায় চিত্রা কেন বাপের বয়সী লোকের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হয়েগিয়েছিল।একবারটিও কেউ জিজ্ঞেস অব্ধি করল না।চিত্রার হুট করে মামার কথা মনে পড়ে যায়।মানুষটা একদিন তাকে বাঁচাতে গিয়েই গাড়ি এক্সিডেন্ট করেন।টাকার জন্য ভালো চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় নি।লোকটির ওপর আগে থেকেই অনেক ঋণ জমা আছে।এখন যদি মামার জন্য নিজের সুখ চিত্রা বিসর্জন করতে না পারে তবে তো সম্পর্কের সঙ্গে বেইমানি করা হবে।মামার চিকিৎসার টাকার কথা ভেবেই তো বিয়েতে রাজি হয়েছিল চিত্রা।কিন্তু মাঝ থেকে আরেকটা ঢেউ এসে সব কিছু নিজের আধিপত্যে ধ্বংস করে চলে গেলো।তবে লোকটার চোখে কোনো করুণা আছে কিনা চিত্রার জানা নেই।আপাতত সে জানে এই লোকটাই তার সব।তার অভিভাবক। তার বৈধ পুরুষ। তবে তিন অক্ষরের কবুলে সম্পর্ক হলেও ভালোবাসা তো হয়ে যায় না?নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে চিত্রার।সোহাগের সঙ্গে সে তো অন্যায় করে ফেলেছে।সোহাগ যদি জানতে পারে তার চিত্রা আজ তার কথা না ভেবেই এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন কি হবে? চিত্রা জানে তার উল্টে যাওয়া জীবন আর ঠিক হওয়ার নয়।এমন কপাল নিয়ে কেউ জন্মায়? মানুষ এত অভাগা হয়?
চিত্রার চোখের কোণে জল।বাড়িতে সোহাগ নেই।চিত্রার জানা নেই সে কোথায় আছে।বাসাতেই ছিল সে।কিন্তু এখন আর নেই।থাকলে কি চিত্রার এমন পরিস্থিতির পরেও বেড়িয়ে আসতো না?গাড়িতে উঠার আগে মামাকে শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিল চিত্রা তবে ফারাজ এলাহী দেখতে দেয় নি।তার হাতে নাকি সময় নেই।অন্ধকার রাতে হাজারো স্মৃতি মোড়ানো বাড়িটিকে একবার নয়নভরে দেখল সে।তারপর শাড়ি সামলে গাড়িতে উঠে বসল।ফারাজের কালো মার্সিডিস।আগে পিছে আরো দুটি গাড়ি।অস্ত্রহাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো সেইসব গাড়িতে উঠে বসল।গাড়ি ছেড়ে দিলো।চিত্রা জানে না তার গন্তব্য কোথায়?ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?কি লেখা আছে তার অভাগা কপালে?
‘কান্নাকাটি বন্ধ করো বা*ল।মেয়ে মানুষের কান্না আমার সহ্য হয় না।খুবই বিরক্তিকর।তোমার তো খুশী হওয়ার কথা বুড়োর বউ না হয়ে তুমি এলাহী বাড়ির ছোট বউ হয়েছো।’ফারাজের টানটান গলার স্বর।
চিত্রা আচল দিয়ে চোখের জল মুছে ফারাজের দিকে তাকায়।জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি কে?আমাকে বিয়ে করলেন কেন?’ফারাজ হাতের সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে জানালার গ্লাস নামিয়ে টোকা মেরে অন্ধকার অজানায় ছুঁড়ে ফেলে।কপাল চুলকে জবাব দেয়,
‘কৈফিয়ত জিনিসটা আমি বড্ড অপছন্দ করি।ফারদার আমায় এভাবে হুটহাট প্রশ্ন করবে না মিসেস এলাহী।আর আমি কে? সেটা জানানোর জন্যই তো বিয়েটা করলাম।তোমারো তো জানার হক আছে তোমার স্বামীকে? ডোন্ট ওয়ারি।আজ হয় না হয় কাল অবশ্যই জানতে পারবে।’হাসল ফারাজ।
ফারাজকে ভালো করে একবার পরখ করলো চিত্রা।গায়ে সাদা শার্ট।কালো একটা প্যান্ট পড়া।গায়ের সুট টা খোলার পর আর পড়ে নি।হাতের কব্জিতে রোলেক্স ঘড়ি।চোখের মনি কালো নাকি বাদামি কে জানে?অদ্ভুত রং।গালে চাপ দাঁড়ি।উজ্জ্বল চেহারায় আভিজাত্য আছে বলতে হবে।উরুর ওপর রেখে ল্যাপটপে কি যেন ঘাটাঘাটি করছে।চিত্রা চোখ নামিয়ে জানালার দিকে তাকায়।ভেতরটা আবারও তার ভেঙে আসে।চিনে না জানে না এমন একটা লোকের সঙ্গে তার বিয়েটাও হয়ে গেলো।
‘আবার কবে এই বাড়িতে আসবো?মামার সঙ্গে এখনো দেখা করতে পারি নি।’
ফারাজ এক ঝটকায় ল্যাপটপ বন্ধ করে চিত্রার দিকে তাকায়,
‘এই বাড়ি?এখনো তো এলাহী বাড়ি গেলেই না এরই মাঝে এই বাড়ি আসার নাম নিচ্ছো?ভুলে যাও।’
‘ভুলে যাবো?’
ফারাজ এগিয়ে এসে চিত্রার গালে হাত ভুলিয়ে থুতনি চেপে ধরে,
‘হ্যাঁ এই বাড়ির নাম, ঠিকানা সব স্মৃতি ব্রেনের স্টোরেজ থেকে পারমানেন্ট ডিলেট মারো।তা না হলে তোমার ব্রেনটাকে আমি রিসেট মারলে কিন্তু নিজের নামটাও ভুলে যাবে মিসেস চিত্রাঙ্গনা চিত্রা এলাহী।’
এলাহী চিত্রাকে ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে রাখা মদের বোতলের কর্কটা খুলে গটগট করে মদ গিলে।মুহুর্তেই গাড়িটা বিশ্রী গন্ধে লেপ্টে যায়।ভয়ে কেঁপে উঠে চিত্রার শরীর।লোকটার গলার স্বর গম্ভীর হলেও কেমন যেন বিষ মিশে আছে সেখান টায়। ভয় করছে চিত্রার।খুব ভয় করছে।তবে কেনো জানি মনে হচ্ছে তার পাশে বসে থাকা মানুষটা তার নাড়িনক্ষত্র দেখেই এখানে হিসেব কসতে এসেছে।পাক্কা খেলোয়াড় সে।
–
বসার রুমে সবাই নির্বাক হয়ে বসে আছে।মার্জিয়া গর্জে উঠে মিজান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ভাই কি হইলো এসব?ওই ছেড়া কেডা?আর হেয় তো আপনার সামনেই ওই মাইয়ারে বিয়া কইরা নিয়া গেছে।চুপ কইরা বইসা ছিলেন কেন আপনে?’
‘বইসা থাকমু না তো কি করমু?জানের প্রতি মায়া সবার আছে।এলাহী বাড়ির পোলার বিরোধিতা কইরা কি মারা খাইমু নাকি?আগে যদি জানতাম ফারাজ এলাহীর এই বাড়ির মাইয়ার ওপর নজর আছে তাইলে ভুলেও এইখানে আসতাম না আমি।এখন আমার ভয় করতাছে ভয়।’
‘কি বলতাছেন?তারে তো আমরা চিনি না।আজ প্রথম দেখলাম।’বলল মারিয়া।
‘চিনেন না এখন ঠিকই চিনবেন। আর এমন চিনা চিনবেন কখনো ভুলতেও পারবেন না।আল্লাহ জানে তাগো লগে কিসের ঝামেলা আপনাগোর।চিত্রার কপালে তো ভাঙ্গন লাগছেই সঙ্গে আপনারাও ভাইঙ্গা যাইবেন।’
মিজান সঙ্গে আনা লোকেদের নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাতের মধ্যে গ্রাম ছাড়তে হবে তাঁদের। ফারাজের নজর বাজপাখির মতো আর মতলব শকুনের মতো।তাকে দিয়ে ভালো কিছু আসা করা যায় না। কখন কোন দিক দিয়ে মারবে বুঝে উঠাও দায়।সবাই চলে যাওয়ার পর মাহাদী ধাপ করে মাটিতে বসে পড়ল। মাথা কাজ করছে না তার।কি হয়ে গেলো একটু আগে?সে একটুও বিরোধিতা করার সাহস পায় নি।কিন্তু কেন?মারিয়া দৌড়ে স্বামীর কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে হাউমাউ করে বলে,
‘কি হইছে তোমার?কি হইছে?’
মার্জিয়াও ছেলের কাছে যান।তারও একই প্রশ্ন।মাহাদী নিজের চুল খামচে ধরল। বিরবির করে বলল,
‘সব শেষ। এখনো তো কিছুই হয় নাই।হইবো।ধ্বংস হইবো সব।ফারাজ এলাহী আম্মা মানুষ না।জা^নোয়ার। সবাইকে শেষ কইরা ফেলবো সে।আচ্ছা আম্মা সোহাগ কই?’
–
ঘন্টা খানেক পর গাড়ি থামলো এলাহী মেনশনের সামনে।জমিদার বাড়ি।এলাহীদের পূর্ব পুরুষগণ জমিদার ছিলেন।নামি-দামি জমিদার।সেইসব কথা এখন কেবল পুরোনো গল্প মাত্র।তিনতলা বিশিষ্ট একটা ভবন।কিশোরগঞ্জ শহরের মাঝ বরাবর এই বাড়ির অবস্থান হলেও বেশ দৃষ্টি নন্দন।চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা সে নিজেও জানে না।দু’জন মহিলা কাজের মেয়ে ঘুমন্ত চিত্রাকে জাগাতে আসলে ফারাজের বাজের মতো দৃষ্টি তাদের থামিয়ে দেয়।ফারাজ সবাইকে ধীর গলায় বলে,
‘ওর ঘুম যদি কারো শব্দে ভাঙ্গে তবে এখানেই কবর দিবো।’
কারোর আর সাহস হয় নি ঘুমন্ত চিত্রার ধারে কাছেও ঘেরার।ফারাজ আস্তে করে চিত্রাকে পাঁজা কোলে তুলে নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে দোতালার ঘরটায় যায়।দোতলার সবচেয়ে বড় ঘরটা ফারাজ এলাহীর।যদিও এই বাড়িতে তার কম। বরং ঢাকায় অবস্থিত ফারাজ নিবাসে তার বেশী থাকা হয়।আর বাংলাদেশে ফারাজ থাকেই বা কতদিন?বিদেশেই তো তার সব কাজ।সেখানেই তার আসল বসতি।ফারাজ চিত্রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে গলার নেকটাইটি খানিকটা ঢিলে করে ডিভানে পা ছড়িয়ে বসল।হুইস্কির কর্কটা খুলে গ্লাসে ঢেলে নিলো কিছুটা।তাতে দুই এক টুকরো আইস কিউব ছেড়ে দিয়ে একচুমুকে সবটা গিলে ফেললো।চিত্রা নিজেও কি জানে সে এমন গভীর ঘুমে কি করে মগ্ন হলো?জানে না।আর ফারাজ তাকে না জানালে সে জানতেও পারবে যে গাড়িতে ফারাজ তাকে যেই পানির বোতলটা দিয়েছিল তাতে স্লিপিং ড্রাগস মিশ্রিত ছিল।তবে সামান্য একটুখানি।ক্লান্ত শরীর ছিল বলে ড্রাগস চিত্রাকে ভালোই জব্দ করেছে।ফারাজের চোখ চিত্রার ধবধবে ফর্সা পেটের দিকে যায়।শাড়িটা সরে যাওয়াটাতে পেট দেখা যাচ্ছে।ফারাজ সিগারেট জ্বালিয়ে চিত্রার দিকে এগিয়ে যায়।বাম হাতে তার হুইস্কির বোতল।চিত্রা তখনো ঘুমে বিভোর। ফারাজ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দেখল চিত্রাকে।নিষ্পাপ একটা চেহারা।
‘অভাগীদের সাহসি হওয়াও ভালো না আর বেশি দয়ালু হওয়া তো মোটেও না।তোমরা সুন্দররা আসলেই একটু বেশি বোকা।নিজের কবর নিজে খুঁড়তে বেশ পটু।’ফারাজ ঝুঁকে পড়ে চিত্রার ওপর।
‘এত শান্তিতে তোমাকে কি করে ঘুমাতে নেই বলো?যেখানে তুমি নিজেই আমার ঘুম বরবাদ করে ঘুমাচ্ছো।’
ফারাজ হুইস্কির বোতল কাত করে ঘুমন্ত চিত্রার মুখের ওপর ঢেলে দেয়।ঘুমন্ত চিত্রার ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠে।মুখ,বুক সব ভিজে গেছে।
‘ওফস সরি ডার্লিং গ্লাস ভেবে তোমার মুখে ঢেলে দিয়েছি।আই মিন হুইস্কি।শাড়িটা বদলে আসো।”
চিত্রার ঘুম এক নিমিষেই হাওয়া।কাশতে কাশতে জীবন শেষ।কি বাজে গন্ধ। উটকো একটা বাজে গন্ধ। চিত্রা আবারো কান্না করে উঠল,
‘আমাকে ছেড়ে দিন।দয়াকরে আমাকে ছাড়ুন।আমি চির কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো।’
‘ওমা বউ আমার এসব কি বলে?আমি তো তোমাকে এখনো ধরলামই না।আমি ধরলে তো টিকতে পারবে না সোনা।আর কৃতজ্ঞতার কথা বলছো?ফারাজ এলাহীর ওসব ছোটলোকি জিনিসের ওপর কেনো ইন্টারেস্ট নেই।ওসব তোমার কাছেই রাখো।আই ডোন্ট নিড অল দিস। আই জাস্ট ওয়ান্ট ইউ।’
ফারাজ নেকটাইটা খুলে শার্টের বোতামে হাত দেয়।চিত্রার দিকে যতটা ঝুঁকা যায় ঠিক ততটা ঝুঁকে।চিত্রার ভয় করছে।কে বাঁচাবে তাকে?এই লোককে শরীর ছোঁয়ার অধিকার কিছুতেই দিতে পারবে না চিত্রা।মনে মনে একবার সোহাগ বলে চিৎকার করল সে।
‘দয়া করুন।প্লিজ।’
‘ওই একটা জিনিসই আমি করতে জানি না।দয়া… মাই ফুট।আই জাস্ট হেইট দিজ। প্রিয়তমা কাম হেয়ার।”
চলবে?
(এই গল্পে এমন সব ভায়োলেন্স আর লোমহর্ষক ঘটনা থাকবে যা সবাই নিতে পারবেন না।যাই হোক গল্প কেমন হয়েছে সবাই কমেন্ট করবেন।আর এই গল্প নিয়ে নিদিষ্ট কিছু ব্যাক্তি সমালোচনায় নেমেছে।তাদের মতে ফারাজ তার চাচার হবু বউকে বিয়ে করছে জোর করে।বাই দ্যা ওয়ে চারিদিকে এমনিতেও বিনোদনের কমতি নাই।আমি বরং একটু এনজয় করি।আপনারা কি বলেন?