#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১১
“আজকে বাসর না করতে পারলে আমি কিন্তু মদ খাওয়া ছেড়ে দিব প্রিয়তমা।”ফারাজের কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা।চিত্রার চোখে স্পষ্ট ভয়।শরীরে কেমন যেন অদৃশ্য কাঁপুনি অনুভব হচ্ছে তার।ভীত কন্ঠে সে বলল,
“কাছে আসবেন না।এমন একটা কিক মারবো না একেবারে ডেনমার্ক গিয়ে পড়বেন।”
“আরে বউ হানিমুনে ডেনমার্ক যেতে চাইছো সেটা সরাসরি বললেই তো পারো।এমন কিকফিকের কথা বলে বুঝানো লাগবে নাকি?”
“আমি কিন্তু মার্শাল আর্ট জানি।”
“তোমার বা*লের চুং চাং ফু আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।”
ফারাজ গায়ের সাদা শার্টটা খুলতেই লোমশ সুঠাম বুকটা উন্মোচিত হয় তার।চিত্রা সেদিকে তাকায় না।এখন তাকালে আরো বিপদ বাড়বে।ফারাজ প্যান্টের পকেট থেকে পেইন কিলারটা বের করে বিছানায় রেখে বলল,
“পেইন কিলারকে এখন থেকে নিজের সঙ্গী করে নাও প্রিয়তমা।একে সারাজীবন তোমার কাজে লাগবে। কারন এখন তো যন্ত্রণা পাওয়া কেবল শুরু। মৃত্যুর আগ অব্দি তোমাকে ক্ষত সহ্য করতে হবে,দহন সহ্য করতে হবে আর সবচেয়ে বড় কথা ফারাজ এলাহীকে সহ্য করতে হবে। ঔষধ দিয়েছি শরীরের ব্যথা সারানোর জন্য,মনের ব্যাথা তো ফারাজ এলাহী নিজেই। ঔষধে কেবল শরীরের ক্ষত দূর করা যায় তবে মনের ব্যাথা নয়। আই রিপিট ফারাজ এলাহী তোমার সেই ক্ষত যা কোনো ঔষধে সারানো সম্ভব নয়।এটা পারমানেন্ট। “
চিত্রা মুক্তির জন্য ধস্তাধস্তি করছে।তবে পুরুষ মানুষের শক্তি যে এত বেশি তা চিত্রার জানা ছিল না।চিত্রা হাত ছাড়ানোর জন্য যুদ্ধ করছে অথচ লোকটা নড়ছেও না চড়ছে না।কিন্তু ফারাজের এক হাতে সে একেবারে বন্দি!কি সুন্দর ভাবে এক হাত ব্যবহার করে তার দুই হাতকেই নিজের আয়ত্তে রেখেছে লোকটা।
” উফস তুমি বেশি নড়ো।”
চিত্রা এবার সহ্য না করতে পেরে গর্জে উঠল,
“দেখুন…আমার কাছে আসলে আপনাকে আমি খু*ন করবো।”
চিত্রার চোখের ওপর চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।ফারাজ চিত্রার গালে হাত বুলিয়ে চুলগুলো চোখের ওপর থেকে সরিয়ে বলল,
“লিখবো তোমার হাতে আমি আমার মরণ।”
“ফারাজ!”
” ধরলাম না, ছুঁইলাম না তবুও চিৎকার? ওহ মাই গড!”ফারাজ কথা না বাড়িয়ে চিত্রার কপালে একটা আলত চুমু বুলিয়ে দেয়। আক্রামণ নেই সেখানে।কেবল সবটা জুড়ে আছে মাতাল করা তৃষ্ণা। চিত্রা পাথর হয়ে যায়। আচ্ছা সে এমন করছেই বা কেন? হুট করে চিত্রাকে এমন স্তব্ধ হতে দেখে ফারাজ নিজেও কিছুটা ভ্রু কুঁচকায়। হঠাৎ চিত্রা কি ভেবে টলমল চোখে বলে উঠল,
” ছুবেন না আমাকে।আমি সোহাগকে ভালোবাসি।”
ফারাজ মুখ তুলে একবার চিত্রার দিকে তাকাল।তার চোখে আগুন জ্বলে উঠল।চেহারার দীপ্তি মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে চিত্রার গাল চেপে ধরল সে।আঙুল গভীরভাবে ঢুকে গেছে কোমল গালের মধ্যিখানে।
“তুই শুধু আমার।তোকে কেবল আমিই স্পর্শ করবো।তোর মুখ দিয়ে কেবল ফারাজ এলাহীর নাম বের হবে।বলে দিচ্ছি, সোহাগের কবর খুঁড়তে আমাকে বাধ্য করিস না।”
ফারাজ সবটুকু রাগ আর হিংস্রতা নিয়ে বিলীন হয়ে গেল চিত্রার মাঝে। মেজাজ গরম হওয়ার জন্য তার একটা কথাই যথেষ্ট।চিত্রা সেই একটা কথা বলেই সবটা নষ্ট করে দিয়েছে।এখন ত্রিশ বছরের হিংস্র, ক্ষুধার্ত সিংহের হাতে মরতে তো তাকে হবেই।চিত্রার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তবে শেষে আর সে বাঁধা দেয় নি। ফারাজ এলাহী যে তার স্বামী। তার জীবনের বৈধ পুরুষ। তবুও ফুল চোখের পানি ফুরাচ্ছে না। ফারাজের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।খেয়াল থাকবেই বা কেনো?শিকারী কি তার শিকার কখনো ছেড়ে দেয়?শিকারীর মনে মায়া থাকতে নেই।মায়া থাকলে পেট চলবে কেমন করে?
–
ট্রলারের কাঠের পাটাতনে বসে গরম চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালো সোহান।সর ওয়ালা মালাই চা।আকাশটা আজ মেঘাচ্ছন্ন।চারপাশে গুমোট এক অন্ধকার।আকাশের গায়ে ঝুলছে ভারী কালো মেঘ। বৃষ্টি নামার অপেক্ষায় পুরো প্রকৃতি থ মে*রে আছে।বাতাসে ভেজা লবণাক্ত গন্ধ।দূরন্ত হাওয়ায় সোহানের পাতলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। শরীরে সাদা ফতুয়া, লুঙ্গি।উদ্ভাসিত চেহারার মাঝে লুকিয়ে আছে অদৃশ্য আলোড়ন। সোহানের চোখের মণি কুচকুচে কালো।যেখানে নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি খানিকটা মায়াও বিদ্যমান।সোহান মনোযোগ দিয়ে চায়ের কাপ থেকে আঙুলের ডগায় সর তুলে সুরৎ করে মুখে পুরে দিল।তারপর ছপছপ শব্দ তুলে খেতে লাগল।খানিক সাদা তরল তার সিগারেটে ঝলসে যাওয়া ঠোঁটের দুধার বেয়ে দরদর করে নেমে আসতে লাগল।বিষয়টি সোহানের কাছে গ্রাহ্য পেল না।আবারও গ্লাসে আঙুল ডুবিয়ে সর তুলে বিচ্ছিরি শব্দ করে খেতে লাগল সে।দৃশ্যটা কেমন যেন গা গিনগিনে।হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছে নিয়ে সেই হাত আবার জিভ দিয়ে চাটতে লাগল সোহান। চোরা হাসিতে ঠোঁট বাঁকা হয়ে উঠল তার। চোখ দুটো সরু হয়ে এল। যেন সামনে কাঁপতে থাকা লোকটার প্রতিটি ধুকধুকানি, প্রতিটি শ্বাস সে গুনতে পারছে।সোহান গলা নামিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
“মরণরে ভয় পাও না মিয়া?”
লোকটা ঢোক গিলে জুলফি বেয়ে নেমে আসা ঘামের স্রোতকে অগ্রাহ্য করে বলল,
“ভাই দেখেন এসবে আমার কোনো দোষ নাই।এমন কিছু হইবো তা আমার জানাও ছিল না।আমি কি এসব জাইনা বুইঝা আপনার শত্রুর লগে জোড়া বানমু?এই চিনলেন আমারে ভাই।”
সোহান ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল। সেই হাসিতে ছিল বিদ্রূপ আর তাচ্ছিল্য।
“কামে গাফিলতি করছ দেইখাই তো এত বড় ভুল হইছে।সোহান তোমারে কি চিনবো?তুমি সোহানরে চিন্না রাখও।আমি ভুলের ক্ষমা করি না।ভুল কেন হইবো?যাগো ভুল হয় তাগোর দুনিয়ায় থাকার কোনো অধিকার নাই।”
ঠিক তখনই ইয়াসিন এসে সোহানের সামনে দাঁড়াল। ছেলেটার চোখমুখ উজ্জ্বল।আনন্দের ঝলক ফুটে উঠেছে তার চেহারায়।
“ভাই”
“কইয়া লা, আল্লাহর বান্দা।”সোহান আলসেভাবে তাকাল।
“মাইয়া একটা জোগাড় কইরা ফেলছি।মেলা সুন্দরী। সব চেক দিয়া লইছি।”
সোহান চায়ের কাপটা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা ছেলের হাতে তুলে দিল।উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে লুঙ্গিতে মুছতে মুছতে বলল,
“যাক তাইলে তো হইছে।লোকের হাতে সবগুলারে তুইলা দিলে এবার ভালো একটা প্রফিট আইবো।তুই আমার পিস্তলটা দে।খু*ন না করলে আমার আবার হাত চুলকায়।”সোহান সামনে পড়ে থাকা লোকটির দিকে চেয়ে বলল।একেবারে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। লোকটার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। ঠোঁট কাঁপছে, মুখ বিবর্ণ। চোখের ভেতর জমাট বাঁধা আতঙ্ক, মৃ*ত্যু ভয়।মৃ*ত্যুকে ভয় পাওয়া উচিত।
তবে সেটা কেবল আগ মৃ*ত্যুর মুহূর্তে নয়— বরং বুঝ হওয়ার দিন থেকেই।
–
রাত গভীর, অথচ মোহনার চোখে ঘুম নেই। বাইরে আকাশ অশান্ত। রোশান পাশেই ঘুমিয়ে। নগ্ন বুকে তার নিঃশ্বাসের ওঠানামা স্থির, নির্লিপ্ত। মোহনা নিঃশব্দে তার শরীর ছুঁয়ে দেয়, আঙুল বুলায় বুকে জন্মানো ঘন পশমের মাঝে। রোশান আজকে আর কাজে যায় নি। শরীর তার ভালো লাগছিল না।রোশানের যে নারী দোষ খুব একটা আছে তাও নয়।তবে একেবারে যে নেই তাও বললে ভুল হবে। এই বাড়ির কোন পুরুষ আবার ধোঁয়া তুলসী পাতা?যাদের ছোট থেকেই শিখিয়ে আসা হচ্ছে নারী কেবল ভোগের পাত্র তাদের থেকে শুদ্ধতা আশা করা যায়?তবে ফারাজ?থাক তার কথা বলার প্রয়োজন নেই।আদৌও কি সে এলাহী বাড়ির কেউ?এলাহীদের র*ক্ত কি তার ধমনীর মধ্যে প্রবাহিত?আচ্ছা মোহনা তো কম রূপবতী নয় তবুও তার স্বামীর চোখ অন্য নারীর দেহ খুঁজে কেন ?মোহনা একটা দীঘল শ্বাস ছাড়ল।মনেমনে খুব করে বলল,
“যদি পুনর্জন্ম বলে কিছু থাকত, তবে আমি ফারাজের মতো কাউকেই চাইতাম জীবনসঙ্গী হিসেবে।”
বিয়ের পাঁচ বছর পার হয়েছে, অথচ শূন্য কোলের ভার তার হৃদয়ে বেড়েই চলেছে। মা হতে ইচ্ছে করে। প্রতিবার যখন আশা জন্ম নেয়, নিষ্ঠুর পরিহাসে তা নিভে যায়। যদি চাইলেই সব পাওয়া যেত, তাহলে পৃথিবীতে এত দুঃখ-অভাগা থাকত না। মোহনা রোশানের হাত দুটোর দিকে একবার তাকায়। এই হাত…এই হাতে কত পাপ লিখা। এই পাপের কোনো অন্ত নেই। এই পাপ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই চলবে?মোহনার আপন বলতে কেউ নেই। কেবল একটা অতীত আছে কিন্তু সেই অতীত সে ভুলে গেছে। বেঁচে থাকতে হলে অতীত ভুলতে হয়। তবে তার একটা বান্ধবীও আছে। নাম নিশি। যার সঙ্গে বহুদিন কথা হয়নি। শেষবার একটা ইমেইল করেছিল নিশি। মোহনা রিপ্লাই দিতে পারেনি। সেদিন রোশান রাগের বশে তার হাতের ফোনটা ভেঙে ফেলেছিল। সেই থেকে আর যোগাযোগ নেই। নিশির দু’টো বাচ্চা আছে। পরিবার সহ নরসিংদী থাকে হয়তো। ইদানীং মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়।
মোহনা রোশানের বুক থেকে উঠে বারান্দায় গেল।বারান্দায় গিয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরল মোহনা। প্রথম টানটা নিতেই ধোঁয়া মিশে গেল রাতের হাওয়ায়। সমাজের চোখে এটা পাপ, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু পুরুষ যদি নেশায় দুঃখ ভুলতে পারে, তবে নারী কেন পারবে না? পুরুষের জন্য যা স্বাভাবিক, নারীর জন্য তা পাপ কেন?খোলা বাতাসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সে। কোঁকড়ানো চুল পিঠ ছুঁয়ে আছে। নীল জরজেট শাড়ির ভাঁজে ফর্সা শরীরের রেখাগুলো স্পষ্ট। হাতের সিগারেটটা ফেলে
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। রুমে এসে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কপাল থেকে টিপটা খুলে আয়নার গায়ে সেঁটে দিল। তারপর ঠোঁটে গাঢ় মেরুন লিপস্টিক ছোঁয়াল।আচ্ছা কত তারিখ?ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখল মোহনা।২৭.৩.২০২২…মোহনা বাঁকা হাসল তারপর দেরি না করে গোসলে চলে গেল।গোসলের আগে কেন জানি তার গাঢ় করে লিপস্টিক দিতে খুব ইচ্ছে করে।ইচ্ছে করে বিধায় সে দেয়।নিজেকে আর কত বেঁধে রাখবে?
–
রাত দুইটা পেরিয়ে গেছে। বাইরে ঝড়ের দাপট প্রকৃতির অস্থির রাগ প্রকাশ করছে। উত্তরের জানালাটা খোলা। বাতাসের ঝাপটায় সেটি বারবার দেয়ালে আঘাত করে ঝনঝন শব্দ তুলছে। একটা কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া অসহ্যকর শব্দ। ফারাজ উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। কালো ট্রাউজার পরা দেহটা শিথিল, নিঃশ্বাস ভারী। দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে কোলবালিশটাকে। রাতে কিছু না ধরলে তার ঘুম হয় না। এতকাল কোলবালিশ ধরেই ঘুমাতে হয়েছে। যদিও এখন একটা বিয়ে করেছে তাও শান্তি নেই। এমন রোমেন্টিক বৃষ্টিমুখড় পরিবেশেও তাকে কোলবালিশ জড়িয়েই ঘুমাতে হচ্ছে। অথচ মাথায় গোবর টাঁসা বউটা কিন্তু তার পাশেই শরীর গুটিয়ে শুয়ে আছে। ফারাজ নিজের খায়েশ মিটিয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে। একবার চিত্রাকে জিজ্ঞেস অব্দি করে নি, শরীরে কি খুব যন্ত্রণা হচ্ছে? কি নির্দয়! আবার দাবি করে সে নাকি ভালোবাসে। ভালোবাসা শব্দটাকে চিত্রার ইদানীং সবচেয়ে সস্তা বলে মনে হয়। যে যখন খুশী যাকে ভালোবাসি বলছে। কিন্তু তারা কি আদৌও জানে ভালোবাসার ডেফিনেশন কি? ভালোবাসা কি শুধুই দাবি? নাকি দায়িত্বও?
চিত্রার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেই। শরীরে অসহ্য ব্যথা।যেন প্রতিটি পেশির মধ্যে কেউ সূক্ষ্ম ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। তার ওপর পুরো ঘরটা ঢেকে আছে নিঃসীম অন্ধকারে। মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে, তীব্র আলোর ঝলকানিতে কিছু মুহূর্তের জন্য চারপাশ দৃশ্যমান হচ্ছে।তারপর আবার সেই দমবন্ধ অন্ধকার।অন্ধকার সহ্য করতে পারে না চিত্রা। বরং বলা ভালো, এটা তার জন্য ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের মতো। র*ক্ত আর অন্ধকার—এই দুটো জিনিসে তার ভয়াবহ ফোবিয়া। র*ক্ত দেখলে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। অন্ধকারে মনে হয়, কেউ তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার চেষ্টা করছে। অথচ আজ, আজকের রাতটায় সে বন্দি ঠিক এই ভয়ের মাঝখানে।সে শুনেছে, মৃ*ত্যুযন্ত্রণা অসহনীয়। কিন্তু দুনিয়ার যন্ত্রণাই যদি এতটা অমানুষিক হয়, তবে মৃ*ত্যুর সময় কী ঘটে? মানুষ কীভাবে সেই যন্ত্রণা সহ্য করে? নাকি মৃ*ত্যুর আগে শরীরের সমস্ত অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে যায়?চিত্রা দম আটকে আসে। মনে হয়, এই ঘন অন্ধকারের মধ্যেই সে হারিয়ে যাবে। কেউ জানবেও না, কেউ ফিরে তাকাবেও না।
চিত্রা ধীরে ধীরে উঠে বসল। অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট নয়। কেবল জানালার ওপারে বয়ে যাওয়া অশুভ এক পরিবেশ চোখে ভাসছে চিত্রার। ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে।তার সঙ্গে মিশে আছে অচেনা ক্ষুধার্ত প্রাণীর ডাক। ঘরজুড়ে একটা থমথমে আতঙ্ক।ঠিক অলক্ষ্যে কারও উপস্থিতির মতো। ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু একা একা অন্ধকারে কি করে যাবে সে? সুবিশাল একটা রুম। ওয়াশরুমটা রুমের একেবারে শেষদিকে।অন্ধকারে একা এতটা পথ কি করে যাবে? তাও এমন ভয়ানক গা ছমছমে শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিস্থিতিতে। ঘুমন্ত ফারাজের দিকে চিত্রা একবার চাইল। কি শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে সে। মনে হচ্ছে যুদ্ধজয়ী কোনো সৈনিক তার শৌর্য দেখিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। চিত্রার কি তাকে ডেকে তুলে সাহায্য চাওয়া উচিত? না না নিজেকে লোকটার সামনে এতটা অসহায় বানালে চলবে না। চিত্রা বেডসাইড টেবিল থেকে ফারাজের ফোনটা হাতে তুলে নেয়। লক করা। লক না খুলতে পারলে ফ্লাশলাইট অন করা সম্ভব নয়। তবে ফোনের স্ক্রিনে থাকা মৃদু আলো ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট । ব্যাথায় জর্জরিত শরীর নিয়ে চিত্রা উঠে ওয়াশরুমের গেল । ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ায়। শব্দ!কানে একটা শব্দ ঠেকছে। চিত্রা আরেকটু ভালো করে খেয়াল করল। নুপুরের ঝনঝনানি ভেসে আসছে। খুব ক্ষীণ সেই শব্দ। চিত্রার র*ক্ত হিম হয়ে আসে। এত রাতে এই নিস্তব্ধতার মধ্যে নুপুরের শব্দ? চিত্রার মনে হুট করে কৌতূহল জাগল। কৌতূহল তার শরীরের ভেতর একটা বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ল। শরীরের শাড়ির ঠিকঠাক করে হাতের ফোনটা নিয়ে রুম থেকে এক পা দুপা করে বেড়িয়ে এল। যাওয়ার আগে নিঃশব্দে পেছন ফিরে ফারাজকে একবার দেখল। না লোকটা আসলেই গভীর ঘুমে মগ্ন। নুপুরের শব্দ বাড়ছে। বৃষ্টির শব্দের মধ্যেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ঝনঝনানি। শ্বাস ভারী হয়ে আসে চিত্রার। কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেভাবে আলোয় পতঙ্গ এগিয়ে যায় মৃ*ত্যুর দিকে।
সারাবাড়িতে মৃদু বাতি জ্বলছে।চিত্রার এখন কিছুতেই ভয় হচ্ছে না। তবে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে।কৌতূহল জিনিসটাও নেশার মতো খারাপ।খুব বাজে। চিত্রা এক পা দুই পা করে হাঁটা শুরু করে।নিচের অন্দরমহলের দিকে একবার তাকায় সে। তারপর আবার দোতলার করিডোরের দিকে। ফারিয়া বলেছিল, দোতলায় তিনটা রুম। তিন ভাইয়ের তিনটা । ফারাজেরটা একেবারে শেষপ্রান্তে। বাকি দুটো পাশাপাশি।তবে শব্দটা দোতলার কোনো রুম থেকে আসছে না। চিত্রা শব্দের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে চোখ গেল দোতলায় অবস্থিত সিড়ির দিকে। এই সিঁড়ি সরাসরি তিনতলায় চলে গিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত চিত্রার সেখানে যাওয়া হয় নি।ফারিয়া কোথায় কোন রুম আছে সকালে চিত্রাকে জানিয়েছিল তবে তিনতলার বিষয়ে কিছু জানায় নি এমনকি বলেও নি। তাই চিত্রাও কিছু আর জিজ্ঞেস করে নি। তবে চিত্রার কেনো জানি মনে হচ্ছে শব্দটা তিনতলা থেকেই আসছে। সেখানে কি যাওয়া উচিত? ভাবল চিত্রা। তারপর আবারও এগিয়ে গেল। সিঁড়ির সামনে এসে হুট করে আবারও থমকে দাঁড়াল সে । গানের শব্দ আসছে। মেয়েলি কন্ঠস্বর। কে যেন সুরেলী গলায় রবীন্দ্র সংগীত গাইছে। গানের সুর শুনে তো তাই মনে হলো। সুর কেমন যেন অপার্থিব। তবে কোন গানটা গাওয়া হচ্ছে তা ঠিক ধরতে পারছে না চিত্রা। ফারাজের ফোনের স্ক্রিন অন করে চিত্রা দেখল। ৩ টার কাছাকাছি বাজে। ফোনে চার্জ নেই। ১%। না জানি কতক্ষণ ধরে ১% চার্জ দিয়ে কাজ চালানো হয়েছে। যে কোনো মুহুর্তে ফোনটা অফ হয়ে যেতে পারে।তিনতলার সিঁড়ি পুরো বিদঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। চিত্রা সাহস করে সিড়িতে এক পা রাখল।তবে আরেকটা পা রাখতেই হুট করে বিদ্যুৎ চলে যায়। চারিদিক মুহুর্তে অতল অমানিশায় ছেড়ে গেছে। যেন কেউ একটা অতিকায় চাদর টেনে ঢেকে দিয়েছে বাড়িটিকে। চিত্রার নিঃশ্বাস আটকে আসে। মনে হয়, কেউ তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।তার গলায় শীতল আঙুল ছুঁইয়ে দিচ্ছে। এই অন্ধকারে কেউ কি তাকে চুপিচুপি অনুসরণ করছে? কেউ কি তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলছে, “ফিরে তাকাবে না…”?ভয়ে হাতের ফোন চালু করতে গিয়ে দেখে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন চিৎকার করলেও তো কেউ রুম থেকে বের হবে না।চারপাশ নিস্তব্ধ…না, নিস্তব্ধ না। নুপুরের ঝনঝনানি… গানের সুর… এখন মনে হচ্ছে শব্দটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। চিত্রার সত্যি শরীর কাঁপছে। বাহিরে হুটহাট বজ্রপাত হচ্ছে। ভালো মানের বৃষ্টি পড়ছে। আগের তুলনায় বৃষ্টি কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। এখন চিৎকার করলেও তো কেউ তার গলা শুনতে পাবে না। হঠাৎ শীতল একটা হাত তার কাঁধে স্পর্শ করল। চিত্রা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। ভয়ে সে ঝাঁকি খায়। জ্ঞান হারানোর আগে শেষবারের মতো তার চোখে এক ঝলক দৃশ্য ভেসে আসে। গভীর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দৃষ্টি আটকে যায় একটা মোমের ক্ষীণ আলোতে। তারপর কেবল অস্পষ্টভাবে গলা থেকে বেরোয়,
“আপনি?”
চলবে?
(বড় পর্ব দিলাম শুধুমাত্র বড় কমেন্টের আশায়।আর বলছি কি ১০০% থেকে ৯০% মানুষ আছেন যারা ফলো না করে চুপিচুপি এসে গল্প পড়ে চলে যান, বলছি কি, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?)