#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১২
বৃষ্টি থেমেছে বহুক্ষণ।তবু ধরণীর বুক এখনো ভিজে অনুরণিত। বাতাসের শরীরে মিশে আছে কাদামাটির সোঁদা ঘ্রাণ।বাড়ির পেছনের আতশ্যাওলা পুকুরটায় জল থৈ থৈ করছে।কালো নিথর জলে আকাশের ছায়া ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে বৃষ্টির টলটলে স্মৃতিতে।
বাঁশঝাড়ের শীর্ষে নিশ্চুপ বসে আছে এক মাছরাঙা। গাঢ় নীল-সবুজ ডানা ভাঁজ করে অপেক্ষমাণ। তার ক্ষুধা মিটেনি এখনো। ধৈর্যের সর্বশেষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ রাখছে জলের নিচে লুকিয়ে থাকা শিকারের ওপর। মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি সরাচ্ছে না। কারণ সে জানে “সময়ের শিকারে মুহূর্তই অস্ত্র।”
শেষ রাতের ঠান্ডা বাতাস গা ছুঁয়ে যায় কাঁপন ধরিয়ে। চিত্রা ঘুমিয়ে আছে। নিষ্পাপ একটা মুখ।ফারাজের চোখ চিত্রার গলার দিকে গেল,ইশরে লালচে দাগ বসে গেছে। মেয়েটার সঙ্গে এতটা পাষণ্ড হওয়া মোটেও ঠিক হয় নি। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে হয়তো। তবে ফারাজের কি যেন হয়েছিল রাতে। কেন জানি সোহাগের নামটা একেবারে তীরের মতো করে বুকে বিঁধেছিল তার। চিত্রা তার স্ত্রী। সে পরপুরুষের নাম কেন নিজের মুখে আনবে? ফারাজ নিজের ভাগ অন্যকে দিতে শিখেনি। শুধুই শিখেছে কেঁড়ে নিতে,ছিনিয়ে নিতে। তবে এমন বাসরের স্বপ্ন ফারাজ কল্পনা করে নি। কিন্তু……
ফারাজ চিত্রার ব্যাথার জায়গায় ঠোঁট ছোঁয়াল। চিত্রা অস্থিরভাবে নড়ল। কিন্তু জেগে উঠল না। ফারাজ একটু থমকে গেল। তারপর ধীর পায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোল। দরজার হাতলে হাত রাখতেই একটা দ্বিধা জেগে উঠল তার ভেতর। মুহূর্তের জন্য থমকালো। তারপর আবার ফিরে এলো বিছানায়। চিত্রার পাশে বসে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তার শান্ত মুখের দিকে।অস্পষ্ট স্বরে ফারাজ বলল,
“শুনেছি ব্যথার ওপর ব্যথা দিলে নাকি ব্যাথা সারে?আমি তোমার সেই সকল ব্যথা হতে জন্মাতে চাই…তুমি না হয় ব্যাথার ওপর আরো খানিকটা ব্যাথা দিয়ে দেহের সঙ্গে আমার মনের ব্যাথাটাও মুছে দিও প্রিয়তমা।”
চিত্রার ঘুম ভেঙে হালকা হয়ে আসে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সে। ব্যথার ভারে শরীর অবশ লাগছে। সে কিছুক্ষণ ফারাজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি অনুভূতিহীন, নির্বিকার। ফারাজের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ জিনিসটায় সে অভস্ত্য নয়। তাই এবার ভুল হয়ে গিয়েছে। তবে আর কখনো এমন ভুল হতে দেওয়া যাবে না। ফারাজ তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“শরীর কেমন লাগছে এখন?”
চিত্রা অনড় কণ্ঠে উত্তর দিল,
“যেমন রেখেছেন, তেমনই।”
ফারাজের চোখে একটু কুঞ্চন ফুটে উঠল। “ত্যাড়ামি করো কেন?”
চিত্রা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “ত্যাড়ামি সহ্য করছেন কেন? মেরে ফেলুন না!”
ফারাজ এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর শান্ত গলায় বলল, “তুমি মরলে আমিও মরে যাবো।”
চিত্রার ঠোঁট একবার কেঁপে উঠল।কিন্তু নিজেকে সামলে নিল। “বেঁচে থেকে কী পেয়েছেন?”
ফারাজ এক চিলতে হাসল। “তোমায়।”
চিত্রার হৃদস্পন্দন এক লহমায় থেমে গেল যেন। সে ফিসফিস করে বলল, “আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
“মনকে জিজ্ঞেস করো।”
“ভালোবাসার প্রমাণ আছে? দিতে পারবেন?”
ফারাজ তার গভীর চোখ দুটি চিত্রার চোখে স্থির করে বলল, “প্রমাণ তো তুমি নিজেই, প্রিয়তমা। তুমি আজ মিসেস ফারাজ এলাহী। এটুকু কি যথেষ্ট নয়?”
চিত্রা নীরব হয়ে গেল। এই লোকের সঙ্গে যুক্তিতে পেরে ওঠা অসম্ভব। সে উঠে বসার চেষ্টা করল।কিন্তু পারল না। শরীরের কোথাও যেন প্রচণ্ড ব্যথা ছড়িয়ে আছে।বিশেষ করে বাম হাতে।ফারাজ তাকে ধরে বসিয়ে দিল। মুখে কোনো অনুভূতির ছাপ নেই।শুধুই শীতল এক দৃষ্টি।
“মাঝরাতে বাড়ি ঘুরে দেখার শখ হলো কেন?”
চিত্রা আসল কারণ বলল না। বললে হয়তো ফারাজ ব্যঙ্গ করে হাসবে।তার দুর্বলতাকে উপহাস করবে।
“এমনি। মন চাইল, তাই।”
ফারাজ ঠোঁট বাঁকাল। “তাই বলে যেই মেয়ে অন্ধকারকে ভয় পায় তার একা অন্ধকারের মাঝে হাঁটা কি বিপদজনক নয়?”
চিত্রার চোখ বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল। তার মানে ফারাজ তার ভয়,তার অন্ধকারভীতি সম্পর্কে জানে!
সে ধীরে বলল, “আর কী জানেন আমার বিষয়ে?”
ফারাজ মুচকি হাসল। তারপর গভীর স্বরে বলল,
“ওই যে ওইটাও।তুমি যেটা জানো না ওইটাও আমি জানি। যা দেখো নি তাও দেখেছি।”
চিত্রার মুখমণ্ডল রাগে লাল হয়ে উঠল। মনে মনে ফারাজকে শত শত গালি দিল। লোকটার মুখ থেকে কখনো মধু ঝরে না, সবসময় সাপের মতো বিষ ঝরে। জন্মের পর মধুর বদলে বিষ খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল নাকি? বমি করে বিষ মুখ দিয়ে না বের করে পেছন দিক দিয়ে বের করেছে বিধায় আজ এই হাল। ফারাজ ধীরে ধীরে চিত্রার দিকে এগিয়ে আসে। ফারাজের প্রতিটি কদমে চিত্রা এক পা দু পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ চিত্রা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
” কি করছেন? উদ্দেশ্য কি আপনার?”
ফারাজ চিত্রার মাথায় একটা মৃদু গাট মেরে বলে,
~Hain Jo Iraaden Bata Doon Tumko Sharma Hi Jaaogi Tum
Dhadakanen Jo Suna Doon Tumko Ghabraa Hi Jaaogi Tum
Hamko Aata Nahi Hain Chhupana Hona Hain Tujhmein Fanaa~
চিত্রা চোখ মেলে তেজি দৃষ্টিতে ফারাজের দিকে তাকায়। ফারাজ হেসে চোখ মেরে বলে,
❝তাহার চোখে চাইলে মনের অসুখ হয়
প্রিয়তমার তরে এ হৃদয় ক্ষয়…❞
–
সকালটা অদ্ভুত এক আবেশে মোড়ানো। চিত্রা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি পরানো হচ্ছে তাকে। প্রতিদিন নিলুই এই কাজটা করত। তবে আজ সে আসেনি। এমনকি নিলুর মা-ও কাজে আসেননি।একটু আগেই রুমানা বড় একটা বাক্স এনে চিত্রার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। ভারী গহনায় ভরা সেই বাক্স। মুখে একটা কঠিন হাসি এনে বলেছিলেন,
“আমাদের বাড়ির বউরা খালি গলায় থাকে না। হাত-পা স্বর্ণে ঢাকা থাকে। ফারাজের বউয়ের জন্যও জমিদারির গহনা তুলে রাখা ছিল। এখন থেকে এসবের মালিক তুমি।”
চিত্রা বাক্স খুলতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এত গহনা! প্রতিটাই ভারী, জমকালো। কাজের মেয়ে যখন একটা ভারী হার তার গলায় পরানোর চেষ্টা করল, চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল,
“এসব আবার কেমন অত্যাচার? আমি এসব পরতে পারব না! মরেই যাব দম বন্ধ হয়ে!”
ফারাজ তখন আয়নার উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে নিজের শার্টের বোতাম ঠিক করছিল। কালো রঙের একটা শার্ট। চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো।পারফিউমের গাঢ় গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ঘরে। সে টেবিলের ওপর রাখা একটা হুইস্কির বোতল খুলে চিত্রার সামনেই ঢকঢক করে গিলে অর্ধেকটা সাবাড় করে ফেলল।চিত্রা বিরক্ত চোখে তাকাল। সকাল সকাল মানুষ মদ খায়? এই লোক তো পুরো বিদেশি হয়ে ফিরে এসেছে! আবার এমনও হতে পারে, ছোটবেলা থেকেই এমন ছিল!ফারাজের দৃষ্টি আচমকা বিছানার দিকে গেল। র*ক্তের ছোপ ছোপ দাগ এখনো লেগে আছে সাদা চাদরে। ফারাজও সেটা লক্ষ করল। চোখ সরু করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। রাতে কি তবে এই রক্তের ওপরেই ঘুমিয়েছিল সে? কী অবস্থা!চিত্রার চেঁচিয়ে ওঠা শুনে ফারাজ ধীর পায়ে তার দিকে ঘুরে তাকাল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিদ্রূপাত্মক হাসি নিয়ে বলল,
“তোমাকে তো আমি মারবো বউ। এসব গহনার তোমাকে মারার কোনো অধিকার নেই।”
তারপর কাজের মেয়ে মিতালির দিকে তাকিয়ে হুকুমের সুরে বলল,
“আমার বউকে ছেড়ে দাও। আর জলদি বিছানার চাদর বদলে ফেলো। চিত্রা নাস্তা করে এসে যেন সব ঠিকঠাক পায়।”
মিতালি সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। “জে, ভাইজান”
ফারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “কিসের ভাইজান রে? আজকে ভাইজান, কাল ছাইয়াজান? আমার বউ আছে।আমি বিবাহিত পুরুষ। ভবিষ্যৎ ১১ বাচ্চার আব্বা।তাই আজ থেকে আমাকে খালু বলে ডাকবি। মোটা মাথায় কথা ঢুকেছে তো? নাকি রিপিট করতে হবে?”
মেয়েটা ঘাবড়ে গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “জি, ভা… না মানে, খালুজান!”
” মারা খাও বাল !জাস্ট খালু ডাক মুখ থেকে কি বের হয় না? জান লাগাতে হবে কেন? আই অ্যাম ওনলি মাই ওয়াইফ’স।”
–
ডাইনিং টেবিলে সাজানো সকালের নাস্তা। বাড়ির বউরা স্বামীদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।তবে চিত্রা ব্যতিক্রম। ফারাজ তাকে জোর করেই নিজের পাশে বসিয়েছে। শাশুড়ি একবার সরু চোখে চিত্রার দিকে তাকালেন। মনের ভেতর কোথাও অসন্তোষ জমে আছে। হয়তো গহনা না পরার কারণে।টেবিলে পুরুষ বলতে রোশান বসে আছে। সুলেমান সাহেব এখনই চলে আসবেন। রাজন ও জোহান ভোরে ফিরেছে, তারা উঠবে সোজা সন্ধ্যায়।চিত্রা খাবারের দিকে তাকাল। এই কয়জনের জন্য এত আয়োজন! বড়লোকদের বড়লোকি কারবার।সুলেমান টেবিলে বসতেই চিত্রা সালাম দিল।জিজ্ঞেস করল, “আব্বু, আপনি কেমন আছেন?”
সুলেমান স্নিগ্ধ হেসে বললেন, “তোমাগো দোয়ায় ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। তো, বাড়িতে কেমন লাগতাছে? মন বসছে তো?”
চিত্রা মৃদু মাথা দোলাল। ফারাজ তখনো স্থির, চুপচাপ।রোশান বলল, “আজকে একটা জরুরি কাজ আছে কিন্তু।”
ফারাজ কোনো উত্তর দিল না।নদী তার সামনে খাবার রাখতে গেলে বলে উঠল, “উফস ভাবী! আমি ডায়েটে আছি। ঘাস-লতাপাতা কিছু থাকলে দেন। তবে দুপুরে আসব।আজ কিন্তু বিরিয়ানি রান্না করবেন। কতদিন হলো আপনার হাতের বিরিয়ানি খাই না!”
নদী কোনো জবাব দিল না। শুধু মাথা নত করে সম্মতি জানাল।তবে চিত্রার গা জ্বলে উঠল। মনে মনে শুধাল। এত সুন্দর ফিট বডি নিয়েও আবার ডায়িট। আচ্ছা মানলাম সে ডায়িট করে তবে ডায়িটিংয়ে বিরিয়ানি কে খায়?সবাই খাচ্ছে। তবে সবার সামনে তার ক্ষেতে লজ্জা করছে। চিত্রা কাচুমাচু করছে। ফারাজ লক্ষ করল। সে চিত্রার পাউরুটি থেকে মোটা অংশটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
“জলদি খাও।খেয়ে শক্তি কামাও।দুপুরে এসেই পরিমাপ করবো শক্তি কতখানি বেড়েছে?” চিত্রা নিচের দিকে তাকিয়ে রয়।ভীষণ লজ্জা করছে তার।ফারাজ চিত্রার লজ্জা ভাঙাতে সকলের সামনে গালে একটা চুমু খায়। এত দ্রুত এমন ঝড় চলে আসবে বিষয়টি চিত্রা বুঝে উঠতে পারে নি। চিত্রা লজ্জা জর্জরিত চোখে সকলের দিকে তাকায়। কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।সবাই যার যার মত করে খাচ্ছে। তবুও চিত্রার মন চাইছে হাতের কাঁটাচামচটা ফারাজের গলায় বসিয়ে দিতে।সুলেমান গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “মোহনা একটু পানি দাও।”
মোহনা চুপচাপ গ্লাসে পানি ঢেলে দিল। সুলেমান এক ঢোক গলায় ঢাললেন। কিছু বলতে যাবেন, ঠিক তখনই ঘরের নীরবতা চিরে এক মেয়েলি আর্তনাদ ভেসে এল।ঘরের সবাই একসঙ্গে দরজার দিকে তাকাল।চিত্রার ভ্রু কুঁচকে উঠল। মনে মনে শুধালো,
“নিলুর মা না?”
চলবে?…………..
(চোখে ঘুম নিয়া কি লিখছি জানি না।বানান টানান কিছুই চেক দেওয়া হয় নি।কালকে এডিট করে দিব।এখন আর চোখে মেলে রাখার শক্তি নাই।শুভ রাত্রি।)