#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১৩
নিলুর মা বিলাপ করে কাঁদছেন। সারারাত কেটে গেল, নিলুর কোনো খোঁজ নেই। কোথায় গেল তার মেয়ে? ভয় আর উৎকণ্ঠায় দিশেহারা হয়ে তিনি সোজা চলে এসেছেন সুলেমান এলাহীর কাছে। চেয়ারম্যান মানুষ। ক্ষমতা আর প্রভাব দুটোই আছে। যদি কেউ নিলুকে খুঁজে বের করতে পারে, তবে তিনিই পারবেন।চেয়ারম্যানের বসার ঘরে চাপা উত্তেজনা। রোশান পরোটা দিয়ে মাংসের কালাভুনা মুড়ে মুখে পুরছে।অন্যদিকে মোহনা পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। কোনো কথা বলছে না, শুধু পরিবেশনে ব্যস্ত। ফারিয়া আর নিরু তবে মাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে। এতক্ষণ রান্নাঘরে ছিল তারা। রুমানা স্বামীর প্লেটে আরেকটা গমের রুটি দিতে দিতে বলল,
“কাইন্দো না নিলুর মা। নিলু ভালা মাইয়া। আছে হয়তো কোথাও। ফিইরা আসব।”
চিত্রার মন কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। কালই তো সে নিলুকে দেখেছিল, আর আজ রাত পেরোতেই উধাও? কিশোরগঞ্জে মানুষ গুমের ঘটনা বেড়ে চলেছে। অথচ পুলিশ নীরব দর্শক। কেউ কিছু করছে না। কেউ কিছু বলছেও না। চিত্রার মনে প্রশ্ন জাগে, নিলুর কিছু হয়ে যায়নি তো? নিলুর মাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সে দ্বিধায় পড়ে যায়। সে তো এই বাড়ির নতুন বউ। হুট করে প্রশ্ন করলে কে কি ভাববে? তাই ইচ্ছে থাকলেও কিছু বলতে পারে নি সে। সুলেমান এলাহী নিলুর মাকে আশ্বাস দেন। তিনি খোঁজ নেবেন। কথায় ভরসা রেখে নিলুর মা কান্নাভেজা চোখে ফিরে যান বাড়ির দিকে। কিন্তু সুলেমানের মনে শান্তি নেই । একের পর এক অপরাধের অভিযোগ এসে তার দরজায় হাজির হচ্ছে। অথচ পরিস্থিতির উন্নতি নেই। অপরাধের পাল্লা ভারি হচ্ছে প্রতিদিন। তবে সুলেমান এলাহী এখনো বিশ্বাস হারাননি। এত সহজে তিনি হাল ছাড়বেন না। কিছু একটা করতেই হবে, দ্রুতই। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না!
“তোমার কিছু লাগবে ফারাজ ভাই? কি সব সালাদ খাচ্ছো?”নিরু কৌতূহলভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করল।ফারাজ ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায়। বলে,
“হাওয়া লাগবে। দূরে যা… হাওয়া আসতে দে। এমনিতেই আমার বউ হচ্ছে আগুন সুন্দরী। তার পাশে বসলে আমার ভেতরের টেম্পারেচার অটোমেটিক বেড়ে যায়।”
চিত্রা লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।নিরু ফারাজের কথা হজম করতে পারল না। সে মুখটা ভেংচি কেটে চিত্রার দিকে তাকালো। গলার লালচে দাগগুলোর দিকে চোখ গেল নিরুর। ভেতরটা একেবারে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। ফারাজ এক চামচ সালাদ মুখে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে চিবোতে চিবোতে বলল,
“পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি । এই আব্বা ফায়ার সার্ভিসকে কল করেন।”
নিরু লজ্জায় আর এক মুহূর্ত দাঁড়াতে পারল না।তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। খাবার টেবিলে বসে থাকা সবাই একে অপরের দিকে চাইল যদিও রোশান বাদে। ফারাজের কথার আসল মানে কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি। সুলেমান এলাহী চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি পুড়তাছে?”
ফারাজ চোখের পলক না ফেলেই বলে,
“আবিয়াত্তাগুলোর মন আব্বা। জলদি বাড়ির আবিয়াত্তাগুলোরে নিকাহ করিয়ে দেন।”
সুলেমান এলাহীর হাতের গ্লাসটা প্রায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম। তীব্র কাশিতে গলা শুকিয়ে আসে তার। এই ছেলের মুখের ভাষা আর বন্দুকের গুলি সমান। একটা বের হলে জীবন কেড়ে নেয় আর অন্যটা বের হলে ইজ্জত!
–
দুপুরের কাঠফাটা রোদ। রাতের বৃষ্টির স্নিগ্ধতা এখন আর নেই। গরম আরো বেড়েছে মনে হচ্ছে। মাদ্রাসার ছাত্রীরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছে।রাস্তায় জাম জোট লেগে গেছে। ফারাজকে জলদি ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। অনেক কাজ জমে আছে। এলাহীদের ফিশ প্রসেসিং ফ্যাক্টরি আছে। সেখানে ধরা মাছ প্রসেস করা থেকে শুরু করে মাছ পরিষ্কার করা, কাটিং, ফ্রিজিং, প্যাকেজিং ইত্যাদি সব একত্রে করা হয়। তাছাড়া মাছকে বাজারজাত করার উপযোগী করে রপ্তানির জন্যও প্রস্তুত করা হয়। ফ্যাক্টরির পাশে অবস্থিত তিনতলা বিশিষ্ট বিল্ডিংটাকে এলাহীদের অফিস কার্যালয় কিংবা প্রশাসনিক ভবনও বলা চলে। প্রশাসনিক কার্যালয়ে রোশান, রাজন, ফারাজ সকলেরই আলাদা চেম্বার আছে। তবে ফারাজের চেম্বার বেশিরভাগ সময়ই খালি থাকে। প্রধান কারন তার দেশে আসা খুব একটা হয় না। তবে এবার তার হুট করে দেশে আসার বিষয়ে কারো কিছু জানা নেই। জিজ্ঞেস করার সাহসও নেই কারো।
ফারাজ হাতঘড়িটির দিকে একবার তাকায়। অফিসে আজকে নতুন একটা কাস্টমাস আসবে। তার সঙ্গে ডিল করতে হবে। লেট হলে কি করে চলবে?
“অভ্র তুই গিয়ে একটু দেখে আয় তো বাহিরে কার বাপ মরছে।”
অভ্র ফারাজের সহচর বলা চলে। তার প্রতিটি কাজের খবর অভ্রর জানা আছে। অভ্র ছেলেটার গায়ের রং শ্যামলা। তবে অদ্ভুত সুন্দর দেখতে। ফারাজের সব কাজ তদারকি করে সে । ফারাজ আবদার করলে হয়তো জানটা বের করে হাতে ধরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস তার আছে। অভ্র ফারাজের কথা শুনে গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। খানিকক্ষন বাঁধে ফিরে এসে ফারাজকে জানায় বাহিরে আন্দোলন হচ্ছে। মাদ্রাসা ছাত্রীকে গনধ*র্ষন করে হত্যা করা হয়েছে। তাতেই সবাই আন্দোলন করছে। হত্যাকারীর শাস্তি দাবি করছে। ফারাজ ফোনে গেমস খেলছিল। নির্বিকার ভাবে জিজ্ঞেস করল,
” কাদের কাজ এসব বলত?”
“আর কাদের হবে ভাই? সোহান পালোয়ানের লোকেদেরই কাজ। বালগুলোর ভিতরে যে এত নষ্টামি কই থেকে আসে?”
“আসলে কি আর বলবো বল?ব্যাডা মানুষের শরীরে কির্মি আছে। হুটহাট কির্মি নাড়া দেয় আর চুলকানি শুরু হয়। যাই হোক তুই গিয়ে রাস্তা খালি করা।”
অভ্র একটু চুপ থেকে বলল,
“ভাই আপনিও তো ব্যাডা মানুষ।”
ফারাজ ফোনের থেকে চোখ সরিয়ে অভ্রর দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে জবাব দিল,
“আমার শিরায় তো আবার চুলকানি নাই। যে মানুষ দেখলেই কুরকুরানি শুরু হয়ে যাবে। আমি এক জায়গায় ঠিকে থাকার মানুষ। ভন্ডামি করলে একজায়গায়তেই করবো। বারো ঘাটের পানি খাওয়া পাবলিক এই ফারাজ এলাহী নয় বুঝছো কুদ্দুসের বাপ?”
অভ্র জবাব না দিয়ে গাড়ি থেকে বের হতে নিলে ফারাজ পেছন থেকে তাকে আরেকবার ডাক দেয়।হেসে বলে,
“অফিসের কাজ শেষ হলে আজকে একটু তেনাদের নষ্টামি কমিয়ে দিয়ে আসব। শা*লার অনেকদিন ধরে ঝামেলা করি না। কি বোরিং একটা জীবন। লাইফে একটু বিনোদন না থাকলে কি চলে?”
–
সারা বাড়ি ঘুরে ক্লান্ত হয়ে চিত্রা নিজের রুমে এসে বসে।এই বাড়িতে করার মতো কাজ নেই। তাই সময় ফুরায় নয়। চার দেওয়ালের ভেতর কাটাতে কাটাতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাইরে গিয়ে একটু হাওয়া খাওয়ার খুব ইচ্ছে জাগছে মনে।চিত্রার মাথায় হঠাৎ ফারিয়ার কথা আসে। মেয়েটার স্বামী নাকি এই বাড়িতেই থাকে। তবে এখন অব্দি তার সঙ্গে দেখা হয় নি চিত্রার। আর জোহানের বাবা?তার সঙ্গেও তো এখনো কথা হলো না।যদিও জোহানের সঙ্গেও কথা হয় নি। চিত্রা ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ায়, আঁচলটা ভালো করে গুছিয়ে নেয়। তারপর একপা-দু’পা করে ফারিয়ার রুমের দিকে এগিয়ে যায়।ফারিয়ার রুমটার সঙ্গে নদী আর মোহনার রুম। নদীর রুমটা মাঝে পড়েছে আর ফারিয়া এবং মোহনার টা দু’পাশে। ফারিয়ার রুমের দরজা খোলা।নুড়ির সঙ্গে খেলছে সে। চিত্রা নুড়িটাকে শুরু থেকেই সে দেখেছে। ফারিয়ার সঙ্গ খুব পছন্দ করে মেয়েটা। একই রক্ত,সম্পর্কে ফুফু বলে কথা। চিত্রা রুমে ঢুকতেই তাকে দেখে ফারিয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। হেসে বলে,
“ভাবী আপনি? আসেন আসেন এখানে বসেন।আসলে রুমটা ঘুছানো হয় নাই। তাই কিছু মনে করবেন না।” ফারিয়ার মুখে লজ্জা মিশ্রিত হাসি।
চিত্রা খাটে গিয়ে বসে। মৃদু স্বরে বলে,
“একা একা ভালো লাগছিল না। তাই তোমার কাছে চলে আসলাম।”
“আপনার যখন ইচ্ছে তখনি চলে আসতে পারেন।”আন্তরিক কণ্ঠে বলল ফারিয়া।
চিত্রার দৃষ্টি আচমকা পড়ে টেবিলের ওপর রাখা অ্যালবামের দিকে। ফারিয়ার বিয়ের ছবি। উজ্জ্বল শাড়ি আর সাজে তাকে অপূর্ব লাগছে। পাশে শেরওয়ানি পরা একজন যুবক। বয়স খুব বেশি নয়, গায়ের রং শ্যামলা।
‘তুমি অনেক সুন্দর ফারিয়া।”ফারিয়া একটু লজ্জ পেল।পরক্ষণেই লজ্জা ভেঙে বলল,
মৃদু লজ্জায় ফারিয়া চোখ নামিয়ে আনে, তারপর বলল,”আপনার থেকে বেশি না।”
চিত্রা হেসে বলে,” এই বাড়ির সবাই সুন্দর। পুরুষ হোক কিংবা নারী।”
“পুরুষ মানুষের বেশি সুন্দর হওয়ার দরকার পড়ে না।তবে নারীদের সৌন্দর্য হচ্ছে তাদের অস্ত্র। যার সৌন্দর্য যতবেশি তার ক্ষমতা ততবেশি।”ফারিয়া মৃদু হাসে।
চিত্রা একটু চুপ থেকে বলে,”তা অবশ্য জানি। পুরুষ বাঁচে অর্থে আর নারী বাঁচে সৌন্দর্যে।”
একটু থেমে সে আবার বলে,
“বাহিরে যাবে?আমার এখনো বাড়ির আশপাশটা দেখা হয় নি।”
ফারিয়ার চোখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। লম্বা, সুঠাম গড়ন তার, ভাইয়ের থেকেও বেশি সুন্দর যেন! ভেতরে কোথাও একটা চঞ্চলতা আছে, যা প্রকাশ করতে চেয়েও যেন পারে না।
নুড়িকে কোলে তুলে নেয় চিত্রা। এত মায়াবী এই ছোট্ট প্রাণটা! তারও তো এমন একটা মেয়ে শিশুর শখ। কিন্তু বাচ্চার কথা মনে পড়তেই ফারাজের মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে।বাচ্চার বাবা কে হবে?ফারাজ এলাহী?
এলাহী বাড়ির চারপাশে বাগান।সামনের দিকে ফুলের বাগান তবে পেছনে ফলফলাদি সহ নানা রকম গাছেদের আস্তানা। বিশাল প্রাচীর ঘেরা জমিদার বাড়ি। বাইরে থেকে রীতিমতো পুরনো জমিদারি রীতির ছাপ। অথচ ভেতরে আধুনিকতার ছোঁয়া।বাড়ির সামনের অংশে একটা ফোয়ারা আছে। বাড়ির পশ্চিম পাশে আরেকটা পুকুর আছে। শানবাঁধানো পুকুর ঘাট। সেই পুকুরের যত্নের জন্যও আলাদা লোক আছে।তাহলে বাড়ির পেছনে থাকা পুকুরটা কি দোষ করেছে?তার কোনো যত্ন নেওয়া কেনো হচ্ছে না? শানবাঁধানো পুকুর পাড়টার সামনেই দোলনা আছে।ফারিয়া চিত্রাকে নিয়ে সেখানে যায়। দু’জনে দোলনায় গিয়ে বসে। দোলনার হালকা দুলুনির সঙ্গে বিকেলের স্নিগ্ধ বাতাস মনটাকে অদ্ভুত প্রশান্ত করে তোলে।
“ভাবী আপনি গান পারেন?”
চিত্রা মাথা নাড়ে,”না।”
“আমি পারি।”বলে হাসে ফারিয়া।
“একটা শুনাও তবে।”
ফারিয়া গুনগুনিয়ে গাইতে শুরু করল একটা রবীন্দ্রসংগীত। সেই মায়াবী সুর শুনতে শুনতে চিত্রার রাতের কথা মনে পড়ে যায়। কাল রাতেও তো এমনই একটা রবীন্দ্রসংগীত শুনেছিল সে!তার শরীর কেমন শিউরে ওঠে। ধীরে ধীরে মাথা তোলে তিনতলার দিকে। কাঠের জানালাগুলো বন্ধ। অথচ মনে হচ্ছে কেউ আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে!
চিত্রা গভীর কণ্ঠে বলে,”তিনতলায় কে থাকে?”
ফারিয়া চমকে তাকায়। মুহূর্তের জন্য কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তারপর স্বাভাবিক হয়ে মৃদু হাসে, “কেউ না। কেন?”
“না মানে ওইখানে তো যাওয়া হয় নি।”
“তুমি যাইতে চাও?”
চিত্রা মাথা নাড়ে, “হুম।”
ফারিয়া রহস্যময় দৃষ্টিতে বলে,”নিয়ে যাবো একদিন।”
চিত্রা চুপ করে যায়। চারপাশে তাকায় আবার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। ফারাজের দুপুরেই আসার কথা ছিল, কিন্তু এখনো আসেনি।ক্ষুধা পেয়েছে তার। কিন্তু রুমানা তাকে বলে দিয়েছেন,ফারাজ আসার পর তার খাবার পরিবেশন করেই যেন চিত্রা খেতে বসে। বাড়ির নিয়ম। এসব নিয়ম চিত্রার একদম ভালো লাগে না। চিত্রার পড়ালেখার শখ। এসএসসি দেওয়ার পর কলেজে পড়ার সুযোগ হয় নি তার। মামা এরই মাঝে এক্সিডেন্ট করে আর তারপর এক লহমায় সব স্বপ্ন চুরমার। চিত্রা শুনেছে স্বামী ভালো হলে নাকি বিয়ের পর বউকে পড়ালেখা করতে দেয়। তার স্বামীটা কতোটুকু ভালো? নির্জ্জলতা ছাড়া তার কি আর কোনো দোষ আছে?যদি না থাকে তবে কি সে চিত্রাকে পড়ালেখা করতে দিবে?কলেজে যেতে দিবে?চিত্রা একটা দীঘল শ্বাস ছাড়ে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে তার। মামাকে কতদিন ধরে সে দেখে না।আচ্ছা মামাকে ঠিক সময়ে ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে তো? মামী? কাজের সব ভার কি তার কাঁধে পড়েছে? নাকি মার্জিয়া ভাবী সাহায্য করছে?চিত্রার সোহাগের কথা হুট করে মনে পড়ে যায়।চোখের কোণে জল চলে আসে। নিজেকে মনে মনে গালমন্দ করে বলে,
“সোহাগ শুধুই ঘৃণার পাত্র। সোহাগরা কেবল প্রতারক হয়। তারা চিত্রাদের আবেগ নিয়ে শুধু খেলতে জানে। তারা শুধুই খেলতে জানে, ভালোবাসতে নয়।”
চিত্রা ধীর পায়ে বাগানের দিকে এগিয়ে যায়। সদর দরজার সামনে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে নেয়। ফারিয়া নুড়িকে কোলে নিয়ে পেছন পেছন আসছে। হালকা বাতাস বইছে। গোলাপের গন্ধ মিশে যাচ্ছে চারপাশে। চিত্রার চোখ গিয়ে পড়ে বাগানের লাল রঙের গোলাপগুলোর দিকে। সে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখে পাপড়িগুলো-নরম, মসৃণ, তবু কোনায় কোনায় সূক্ষ্ম কাঁটা লুকিয়ে। বাগানের ভেতর কয়েকজন কর্মী ব্যস্ত হাতে কাজ করছে। তাদের মধ্য থেকে দুজন লোক থমকে দাঁড়িয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করতে শুরু করে। প্রথমে চিত্রা বিশেষ পাত্তা দেয় না। কিন্তু একটু পর বুঝতে পারে, তাদের দৃষ্টি সুবিধার ঠেকছে না। কৌতূহল কিংবা বিস্ময়ের চেয়ে, সেই দৃষ্টির মধ্যে ছিল কিছুটা বেপরোয়া আগ্রহ।একজন বলে উঠল, “মাইয়াটা পুরাই কড়া! তবে এইডা কেডা? আগে তো দেহি নাই!”
আরেকজন হাসতে হাসতে জবাব দিল, “দেখবি কেমনে? আমরা তো এই বাড়িতে প্রথম কাম করবার আইছি!”এরপর দু’জনেই কুৎসিত হাসিতে ফেটে পড়ল।চিত্রার রাগে শরীর গরম হয়ে ওঠে। লজ্জা? না, ওর রাগ হচ্ছে। যেখানে সে নিজের স্বামীর ভালোবাসাই সহ্য করতে পারে না, সেখানে পরপুরুষের নোংরা মন্তব্য সহ্য করার কোনো প্রশ্নই আসে না। সে এক দণ্ডও দেরি না করে এগিয়ে গিয়ে ফুলগাছ থেকে একটা কাঁটাওয়ালা ডাল ছিঁড়ে নেয়। তারপর দৃঢ় ভঙ্গিতে লোক দুটোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গলার স্বর কঠোর ও তীক্ষ্ণ, মনে হচ্ছে আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ছে।
“আমি কে, তা জানা আছে?”
লোক দু’টো চমকে ওঠে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। হঠাৎ একজন চিত্রার পেছনে চোখ রাখে। মুহূর্তেই মুখে ভীতির ছায়া নেমে আসে।
“ব-বলেন না কেন? বলেন আমি কে?” চিত্রার কণ্ঠে দৃঢ়তা।
চিত্রার ঠিক পেছন থেকে একটা গম্ভীর গলা ভেসে বসল,”আপনি মিস্টার ফারাজ এলাহীর স্ত্রী!”
লোকদুটো এবার আর সময় নষ্ট না করে হাত জোড় করে সজোরে বলে উঠল, “মাফ কইরা দেন। আমরা বুঝতে পারি নাই আপনে ফারাজ সাহেবের বউ। তাইলে জীবনেও এমন আচরণ করতাম না!”চিত্রা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। ফারাজ দাঁড়িয়ে আছে।চোখে কালো সানগ্লাস। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে রেখেছে। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। নেই কোনো হাসির রেখা।চিত্রার কণ্ঠ খানিকটা নরম হলো, তবে ভিতরের তীক্ষ্ণতা হারালো না।
“আপনি কখন এসেছেন?”
ফারাজ কোনো উত্তর দিল না। শুধু চশমার আড়ালে চোখ দুটো স্থির রাখল লোকদুটোর দিকে। ফারাজ চোখ সরিয়ে চিত্রার দিকে তাকাল।কিছুক্ষণ চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকল।যেন চিত্রার চোখ থেকেই উত্তর খুঁজে নিতে চাইছে সে। কিন্তু চিত্রা মুখ ফিরিয়ে নেয়।তার ভেতরে একটা অনীহা কাজ করছে।
“কি হয়েছে এখানে?”ফারাজের কণ্ঠে উদ্বেগ।
চিত্রা গভীর শ্বাস নেয়। “আসলে আমি ফুলের জাত জানতে চেয়েছিলাম। আর ওনারা আমাকে আপা বলে ডেকেছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম আমি কে জানেন?”
ফারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ” তো কি হয়েছে?”
চিত্রা এবার তার দিকে সরাসরি তাকায়। “আপনি যদি জগতের সব মেয়ের খালু হতে পারেন, তাহলে আমিও তো সব পুরুষের খালা হতে পারি, তাই না?”
ফারাজের ঠোঁটে ব্যঙ্গমিশ্রিত হাসি খেলে যায়, কিন্তু আজকে সে হাসতে পারছে না।
“খেয়েছো?”
চিত্রা একপাশে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।
“এখনো না? আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?”
“ইশ! ঠেকা আমার?”চিত্রার কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ল।
ফারাজ হাসে। “না, ভালোবাসা।”
“দূরে যান। আপনার ভালোবাসাকে আমি কাঁঠাল পাতা বানিয়ে কবেই ছাগলকে খাইয়ে দিয়েছি।”
ফারাজ একবার পাশের দুজন অপরিচিত লোকের দিকে তাকায়। তারপর চোখের ইশারায় তাদের সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। লোকদুটো মুহূর্তে মিলিয়ে যায়।পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল ফারিয়া, কোলে ছোট্ট নুড়িকে নিয়ে। ফারাজ নুড়িকে দেখেই উচ্ছ্বাসে বলে ওঠে, “আম্মাজান!”
সে হাত বাড়াতেই নুড়ি আনন্দে নাচানাচি শুরু করে দিল। ফারিয়া হেসে বলল, “তোমরা দুজন তাহলে বাসায় যাও। ভাবী তো তোমার জন্য অপেক্ষা করে না খেয়ে বসে আছে।”
চিত্রার গাল লাল হয়ে উঠল। ফারাজ মুখে মুচকি হাসি রেখে নুড়ির ছোট্ট গাল দুটোয় চুমু খেলো। “তুমি কেমন আছো, আম্মু?”
নুড়ি ড্যাবড্যাব করে ফারাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তো আর কথা বলতে পারে না, তাই ছোটআব্বুকে কী করে বলবে যে সে ভালো আছে?ফারাজ নুড়িকে আবার ফারিয়ার কোলে তুলে দিয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো, আজ বাইরে গিয়ে খাওয়া যাক।”
চিত্রা বিরক্ত চোখে তাকাল। “না কেন? আমি খাবো না।”
“তুমি খাবো না তো তোমার ফোরটিন জেনারেশন এসে খাবে। চলো।”
চিত্রা ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই অবস্থায়?”
“রুমে চলো। বরকা পরে বের হবে।”
“তা কোথায় পাবো?”
ফারাজ চোখ টিপে হাসে। “আমার মুখ থেকে মধুর বাণী শোনার খুব শখ হয়েছে, প্রিয়তমা? এত বড় বড় দুটো আলমারি তোমাকে দেওয়া হয়েছে, খুলে দেখা হয়নি?”
চিত্রা হেসে ফেলে। “ইচ্ছে হয়নি, তাই খুলি নি।”
“তাহলে এত ফাল কেন পারো?”
একটুও দেরি না করে ফারাজ চিত্রার হাত শক্ত করে ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারিয়া তাদের চলে যাওয়া দেখে মৃদু হাসে। এটাই তো সে চেয়েছিল, তার ভাইয়ের পরিবর্তন।
–
গাড়িতে বসতেই অভ্র লম্বা একটা সালাম দিল,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাবী।”
চিত্রা কিছুটা অবোধ ভঙ্গিতে জবাব দিল,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
ফারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কিরে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তুই আবার কী করছিস?”
অভ্র ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দিল,
“নিরাপত্তা দিতে।”
ফারাজ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই চিত্রা কৌতূহলী হয়ে ফারাজকে জিজ্ঞেস করল,
“উনি আবার কে?”
ফারাজ এবার গর্বিত ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
“আমার জানের জিগার! আমরা এক হৃদপিণ্ডের দুই অংশ।”
চিত্রা একপলক অভ্রের দিকে তাকিয়ে নিকাবের নিচে মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“তাহলে ভাই, জলদি একটা সার্জারি করিয়ে আলাদা হয়ে যান! ওনার যা হৃদপিন্ড তাতে মনে হয় না একসঙ্গে থাকলে বেশিদিন বাঁচতে পারবেন।”
আকাশের গায়ে ধূসর মেঘের ভারী চাদর। যেন সূর্যের আলোকে গিলে খেতে চাইছে। বাতাসের ভেতর একটা ভেজা গন্ধ—দূর থেকে ভেসে আসা কর্দমাক্ত মাটির ঘ্রাণ। গুমোট হয়ে আছে চারদিক। গরম আর আর্দ্রতার ভারে দমবন্ধ লাগছে। সড়কের ওপরে ছুটে চলা গাড়িগুলোর হেডলাইট কেমন যেন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ফুটপাত ধরে হাঁটা মানুষগুলোর মুখে বিরক্তি, চোখে তাড়া। যেন তারা জানে, আর কিছুক্ষণ পরেই আকাশ ফেটে ঝরবে বৃষ্টি।ধুলোর ছোট ছোট ঝড় উঠছে পথের ধারে। কাগজের টুকরোগুলো পাক খেয়ে উড়ে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। গলির মোড়ে জটলা পাকানো চায়ের দোকানগুলোর সামনে ধোঁয়া উঠছে উষ্ণ কাপে। অথচ বাতাসের চাপে সেই ধোঁয়াও যেন টিকতে পারছে না।হঠাৎ বাতাসের একটা ঝাপটা এসে ছুঁয়ে যায়, সবার মনে একটাই প্রশ্ন, বৃষ্টি নামবে তো? নাকি এভাবে ঝুলেই থাকবে আকাশ?
হোটেল এক্সের পাঁচতলার ভিআইপি লাউঞ্জ।মৃদু সোনালি আলোয় চারপাশ নরম হয়ে এসেছে। খাবার খাচ্ছে চিত্রা। খাওয়ার সময় তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। খাওয়া জিনিসটা তার কাছে প্যাশন,একটা আরাধ্য। এ-র চেয়ে গুরুত্ব সে অন্য কিছুকে দিতে পারে নি আর পারবেও না। ফারাজ তার পাশেই বসে আছে। আজকেও ঘাস লতা অর্ডার দিতে যাচ্ছিল। তবে চিত্রা ওয়েটারকে ধমকে দু’টো কাচ্চি অর্ডার দেয়। ফারাজ কোনো আপত্তি করল না, শুধু চুপচাপ তাকিয়ে রইল। ফারাজের একটা লোকমা চিত্রার চার লোকমার সমান। ফারাজের খাওয়ার ধরন দেখে চিত্রা অবাক হয়। শেষবার কলিজা ভুনা দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় এভাবে খেতে দেখেছিল সে ফারাজকে। সেদিন যেমন ক্ষুধার্ত দেখাচ্ছিল আজকেও তেমনটাই দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে এসেছে। চিত্রা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটা এলাচ বের করে ফারাজের সামনে ধরে বলে,
” কাচ্চির মধ্যে এলাচ আর চিত্রার জীবনে এলাচী সাহেব।দুটোই একই সমস্যা,একই জাতের । তাহলে সমস্যার সমাধান কি?”
চিত্রা এলাচটা ফেলতে নিয়ে ফারাজ তার হাত ধরে ফেলে। চিত্রার হাত থেকে এলাচটা মুখে পুরে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল,
“সমস্যার একটাই সমাধান খেয়ে ফেলো,গিলে ফেলো। এলাচকে গিলে ফেলো আর ফারাজকে ভালোবাসা দিয়ে একেবারে খেয়ে ফেলো।”
চিত্রা চারপাশে একবার তাকায়। ভাগ্যিস এই ফ্লোরটা তার বড়লোক স্বামী পুরো বুকিং করেছিল তা না হলে তো লজ্জায় মাথা কাটা যেত।
পার্কিং লটে চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। ফারাজ আর অভ্র আলাদা ভাবে কি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। চিত্রাকে ফারাজ গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।তবে চিত্রা পার্কি লটের পাশেই একটা ফুচকা বিক্রেতাকে দেখে জলদি বেরিয়ে আসে। কত দিন ধরে ফুচকা খাওয়া হয় না। আজকে ফুচকাওয়ালা মামাকে টক বাড়িয়ে এক প্লেট ফুচকা দিতে বলবে। কিন্তু কি করে? তার কাছে টাকা থাকলে তো?বড়লোক স্বামীর ছোটলোক বউ সে। না আছে একটা ফোন না আছে ৫০ টা টাকা। দু’টো বাচ্চা ছেলে গপাগপ করে একটার পর একটা ফুচকা মুখে দিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে চিত্রা একটা ফাঁকা ঢোক গিলল। বাচ্চা মানুষের এত ফুচকা খেতে হয়? ওদের মা-বা শিখায় নি এসব যে অস্বাস্থ্যকর খাবার? চিত্রা আঁড়চোখে একবার ফারাজের দিকে তাকায়। ফারাজ তখনও কপাল কুঁচকে কি সব কথা বলছে। মনে তো হচ্ছে খুব রেগে আছে? নাকি অতিরিক্ত কাচ্চি খেয়ে জাতির খালুর পেট ছুটেছে? চিত্রা একটা শ্বাস নেয়। তারপর পা টিপে টিপে বাচ্চাদুটোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একবার আকাশের দিকে তাকায়। যে কোনো মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। চিত্রা ফারাজের দিকে আরেকবার তাকিয়ে নিজের পেটের দিকে তাকায়। একটু আগেই একপ্লেট খাসির কাচ্চি সাবার করেছে সে। কিন্তু তাতে কি? ফুচকার জন্য পেটের অর্ধেকটা এখনো ফাঁকা। চিত্রাকে দেখে ফুচকাওয়ালা মামা আন্তরিক স্বরে বলল,
“কি লাগবো, আপা?”
চিত্রা ইতস্তত করল। তারপর মৃদু হেসে বলল,
“না, কিছু না।”
সে পাশের ছেলেটার দিকে তাকাল। অনেক বেশি কিউট দেখতে। চুল এলোমেলো। গালে টক ঝাল ফুচকার দাগ লেগে আছে। চিত্রা ছেলেটার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,
“ওই যে বাবু, দেখেতো ওইটা কী?”
ছেলেটা বিভ্রান্ত হয়ে চিত্রার ইশারাকৃত জায়গায় তাকাল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তবে চোখ ফেরাতেই দেখল তার প্লেটের সর্বশেষ ফুচকাটি নেই। মুখ কালো করে বলে উঠল,
“আমার ফুচকা খাইছেন কেন, আন্টি?”
চিত্রা হকচকিয়ে বলল,
“কই?”
“আপনার মুখে!”
তাড়াহুড়োয় খেতে গিয়ে ভালোভাবে গিলতে পারেনি চিত্রা। মুখভর্তি ফুচকা নিয়েই বিড়বিড় করে বলল,
“আরে বাবু, এসব কুখাদ্য! বাচ্চাদের এত বেশি খেতে হয় না।”
ছেলেটা মোটেও সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। কপাল কুঁচকে রাগী গলায় বলল,
“আপনে কথা না বইলা পেট থেইকা ফুচকা বাইর করেন! না হইলে আম্মুরে ডাইকা আনমু!”
চিত্রা হতভম্ব!
“এই ছেলে! একটা ফুচকাই খেয়েছি। তোমার মাথা তো খেয়ে ফেলিনি! এত বেয়াদবি করো কেন?”
দুজনের তর্ক শুরু হয়ে গেল। ফুচকা বিক্রেতা বিব্রত হয়ে একবার চিত্রার দিকে। একবার বাচ্চাটার দিকে তাকাচ্ছে। ফারাজের কথা বলা শেষ। গাড়ির দিকে এগিয়ে আসে সে। হঠাৎ চিত্রার গলার স্বর শুনে থমকে দাঁড়ায়। ফুটপাতের ফুচকার দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখে, তার স্ত্রী একটা বাচ্চার সঙ্গে হাত নেড়ে তর্ক করছে! ফারাজ অভ্রকে গাড়িতে বসতে বলল। তারপর ধীর পায়ে চিত্রার দিকে এগোল।
“কি হচ্ছে এখানে?”
বাচ্চাটা মুখ গোমড়া করে চেচিয়ে উঠল,
“এই বোরকা ওয়ালী আন্টি আমার প্লেট থেইকা ফুচকা খাম মারছে! ওনারে কিন্তু আইজা পেট থেইকা আমার ফুচকা বাইর করতেই হইবো!”
ফারাজ চিত্রার দিকে তাকাল। চিত্রা চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।ফারাজ গভীর শ্বাস নিয়ে ফুচকাওয়ালা মামাকে বলল,
“এই বাবুটার জন্য আরেক প্লেট বানান।”
তারপর একটু থেমে যোগ করল,
“আর আমার বউ যতগুলো ফুচকা খেতে পারে, ততগুলোই বানান। ওর মুখেরটা শেষ হওয়ার আগেই যেন আরেকটা রেডি থাকে!”
চিত্রার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খুশিতে সে পারতে ধীর স্বরে ফারাজকে বলল,
“থ্যাঙ্কস।”
ফারাজ একপাশে ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলল,
“ধন্যবাদটা রাতের জন্য তুলে রাখো, বউ। আগেই তো বলেছিলাম, আমি কিছু দিলে তার চেয়েও বেশি কেড়ে নেই। রাতের জন্য প্রস্তুত থেকো।”
চিত্রা ফারাজের কথা শুনেও কিছু বলল না। শুধু একটা ফুচকা মুখে পুরে নিয়ে ধীর গলায় বলল,
“একটা খাবেন? যদি আমার আবার পেটব্যথা হয়? নেন, একটা খান।”
ফারাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ, তবে মানুষের পেছন চুলকে বানানো অমৃত আমার আবার হজম হয় না। এসবে এলার্জি আছে।”
চিত্রার মুখ রাগে লাল হয়ে গেল! এই লোকটা কীভাবে ফুচকাওয়ালার সামনেই তাকে বদনাম করতে পারে! মুখে একটুও যদি লাগাম থাকত! চিত্রা পুনরায় খাওয়ায় মন দিল। পাশের বাচ্চাটাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। ফারাজ ফোন ঘাঁটছে।চিত্রা একসময় মুখ তুলে বলল,
“মামা, আরেকটু মরিচ বাড়িয়ে দেন।”
ফারাজ এবার ফোন থেকে মুখ তুলে হেসে বলল,
“মামা! মরিচ দেন বাড়াইয়া, কইলজা-পিত্তি লাগাইয়া!”
চিত্রা কপাল কুঁচকে তাকাল।
“বেশি করছেন না এবার?”
ফারাজ মৃদু হাসল, “আরে বউ, সকালে যখন জ্বলবে, তখন বুঝবা বেশি করছি নাকি কম। বিছানার কান্না আর বাথরুমের কান্নার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সব কান্নায় সুখ থাকে না, প্রিয়তমা!”
চিত্রা থম মেরে গেল। চোখ গোল করে তাকিয়ে রইল ফারাজের দিকে।এই লোককে সে কি সত্যিই সারাজীবন সহ্য করতে পারবে?ফুচকার ঝাল এখন আর মুখে লাগছে না, লাগছে মনে!
হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো একটি ধারালো শিসের শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে ছুটে এলো গুলি, বিদ্ধ হলো ফারাজের একেবারে খুব কাছ দিয়ে।”ঠাস!”—একটা তীক্ষ্ণ, ধাতব শব্দে বাতাস কাঁপিয়ে উঠল। এক সেকেন্ডের জন্য চারপাশ নিশ্চুপ হয়ে গেল। কি থেকে কি হয়ে গেল ফারাজ ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে চোখের সামনে পড়ে যাওয়া দেহটার দিকে তাকিয়ে সে স্তব্ধ । মাটিতে ফুচকার প্লেটটা পড়ে আছে। উষ্ণ গরম র*ক্তে তলিয়ে গেছে রাস্তা। ফারাজ নির্বাক। কেবল ফারাজের কাঁপা গলা থেকে স্তব্ধতা ভেদ করে বেড়িয়ে এলো,
” চিত্রা।”
চলবে?
(৩.৫k শব্দের গল্প লেখার পরও এখন কেউ কেউ বলবে আরেকটু দিলে ভালো হতোআজকে একটু কমেন্ট কইরেন।বড় বড় কইরা।পর্বটা কিন্তু বিশাল দিলাম।আর দয়া কইরা কেউ আর কোনো গ্রুপে উল্টা পাল্টা পোস্ট কইরেন না।আমি এখনো পেইজ নিয়ে অনেক চিন্তায় আছি। আরেকটা কথা গল্পের প্রতিটি পার্ট আমি বদলে দিয়েছি,বয়স থেকে শুরু করে ফারাজের ডায়লগ এমনকি গালাগালির অংশ গুলোও। যারা আমার গল্পটা নিজেদের পেইজে পোস্ট করেন তারা দয়াকরে একটু এডিট করে নেন।)