#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৭
“আমার নামে মামলা ঠুকে কী লাভ? ওহ, আমাকে কারাবন্দি করে প্রিয় প্রেমিক সোহাগের কাছে যাওয়ার ফন্দি এঁটেছ?”ফারাজ এলাহীর কণ্ঠে বিদ্রুপের শীতল ঝলক। চিত্রা অবাক হলো না। কারণ সে জানে, ফারাজ এলাহী চতুর খেলোয়াড়।সে খেলায় জয়লাভের প্রস্তুতি নিয়েই মঞ্চে নেমেছে।
চিত্রার ঠোঁটে একরাশ তিক্ততা জমে। “আপনি সব জেনে-শুনেও আমাকে কেন বিয়ে করলেন? বলুন, কেন?”
ফারাজ নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়, “টাইম পাস করার জন্য।আসলে ৩০ বছর ধরে সুখে থাকতে থাকতে জীবনটা কেমন যেন বোরিং হয়ে গিয়েছিল।তাই বিনোদনের জন্য বিয়েটা করলাম আর কি।”
চিত্রার ভ্রু কুঁচকে যায়। “তাহলে আপনার কাছে বিয়ে মানে নিছক সময় কাটানো? টাইম পাস?কিন্তু আমাকেই কেন? আমাকেই কেন বেছে নিলেন?দুনিয়ায় কি সুন্দরী মেয়ের অভাব নাকি?”
“সুন্দরী মেয়ে তো দুনিয়ায় অহরহ আছে তবে তারা কেউ যে তুমি নও বউ।আমার যে তোমাকেই লাগত।”ফারাজ হেসে উঠল। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে ভাতের প্লেট বাড়িয়ে দিল চিত্রার দিকে। “ক্ষুধা পেয়েছে। নিজেও খাও, আমাকেও খাইয়ে দাও।”
চিত্রা ঠান্ডা চোখে তাকায়। “আপনার নিজের হাত নেই?”
“আছে তবে নিজের আপন একটা বউও তো আছে?”ফারাজ কণ্ঠে অবজ্ঞার ছোঁয়া এনে বলল, “তোমাকে বিয়ে করেছি কি শুয়ে বসে থাকার জন্য নাকি?নিজস্ব সম্পদের যত্ন নিজেকেই নিতে হয়। আজ থেকে আমার সব কাজ তুমি করবে। এমনকি আমার সুরক্ষাবস্ত্রটাও তুমি ধুয়ে দেবে। আর কতকাল নিজের সম্পদ পরের হাতে ধোয়াব?”
চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যুক্তি এখানে বৃথা। ফারাজ এলাহীর সাথে তর্কে নামা অর্থহীন। এ যেন এক অসম যুদ্ধে ক্ষয়িষ্ণু সৈনিক হয়ে দাঁড়ানো। তাই সে কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ভাতের থালা হাতে তুলে নিলো।লড়াইয়ে হার মানা মানেই পরাজয় নয়, কখনো কখনো তা প্রতিশোধের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। যদি ফারাজের খেয়াল প্রশমিত হয়, যদি সে একবার দয়া করে তাকে বাজিতপুরে নিয়ে যায় তাহলেই চিত্রার চলবে। অন্তত সোহাগের মুখোমুখি তো সে হতে পারবে! ওহ হ্যাঁ চিত্রা তো ভুলেই গিয়েছিল দয়া জিনিসটা যে ফারাজ এলাহীর কাছে মূল্যহীন,ছোটলোকি ব্যাপার কিংবা ক্ষমতার সুরেলা নিষ্ঠুরতায় বাঁধা এক পাষাণ শব্দ।চিত্রা বড় বড় লোকমা তুলে ফারাজকে খাইয়ে দেয়।ফারাজ নিঃশব্দে শুধু ভাত গপগপ করে গিলে।
“কাউকে খু*ন করে এসেছেন নাকি?শুনেছি মানুষ খু*ন করা খাটুনির কাজ।আর খাটুনির কাজ করলে ক্ষুধা একটু বেশিই লাগে।”
ফারাজের হেঁচকি উঠে যায়।চিত্রা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আমি বাড়ি যাবো।নিয়ে যাবেন?বাড়ির কথা মনে পড়ছে?আর এখনো কিন্তু আপনার থেকে আমার অনেক কিছু জানার বাকি।আমাকে বিয়ে করলেন কেন তার যথাযথ উত্তর কিন্তু আমি এখনো পাই নি।”
“আমি আর খাবো না।” ফারাজ উঠে ওয়াইন কুলার থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করে নিমিষেই কর্ক খুলে গটগট করে পান করল।ফারাজের বিশালাকৃতির রুম।জমিদারি বাড়ির মতো বাহ্যিক আভিজ্ঞান।কিন্তু ভেতরের আসবাবপত্র সবই বিদেশি, আধুনিক ডিজাইনে মোড়ানো। ফারাজের পুরো রুমটা কালো আর মেরুন রঙের সংমিশ্রণে সাজানো হয়েছে। কালো আর মেরুন রঙের প্রতি তার অদ্ভুত টান আছে। এ রঙ দুটো যেন তারই অপ্রকাশিত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।আলাদা ভাবে রং দু’টো পছন্দের কোনো কারন নেই।রং দু’টো ভালো লাগে হয়তো এটাই ভালো লাগার কারন।ফারাজ হুইস্কির বোতল নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। প্যান্টের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরে।তবে লাইটার?লাইটার কোথায় গেলো?
“কি লাইটার খুজচ্ছেন বুঝি মিস্টার এলাহী?”
চিত্রা লাইটার জ্বালিয়ে ফারাজের ঠোঁটে চেপে ধরা সিগারেটটা ধরিয়ে দেয়।ফারাজ অপলক দৃষ্টিতে চিত্রার দিকে তাকিয়ে সিগারেটে একটা টান দেয়।গাল ভর্তি ধোঁয়া ছাড়ে চিত্রার মুখের ওপর।ধোঁয়ার কারনে চিত্রার কাশি চলে আসে।সে আচল মুখে চেপে ধরে।ফারাজ সিগারেটটা টোকা মেরে বেলকনি দিয়ে নিচে ফেলে দেয়।চিবুক শক্ত করে প্রশ্ন করে,
“সামান্য সিগারেটের ধোঁয়া তুমি সহ্য করতে পারো না আর সারাটি জীবন ফারাজ নামক নিউক্লিয়ার বোমাকে কি করে সহ্য করবে?”
“আমাকে বিয়ে করেছেন কেন জবাব দেন?জবাব দেন বলছি।”
ফারাজের মুহুর্তেই মাথা গরম হয়।যেসব জিনিস সে পছন্দ করে না সে-সব জিনিসই বার বার সঙ্গে করা হচ্ছে।কেনো?বেশী ভদ্রতা দেখাচ্ছে তাই বলে?আসলেই দুনিয়ায় ভন্ডামি চলে ভদ্রতা নয়।ফারাজ বাম হাতে হুইস্কির বোতলটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে মুহুর্তেই ডান হাত দিয়ে চিত্রার গলা চেপে ধরে।হুট করে এমন আক্রমণ বোধহয় আশা করে নি চিত্রা।তাল সামলাতে না পেরে বেলকনির রেলিংয়ের সঙ্গে পিঠ ঠেকে যায় তার।ফারাজের মুখটা দগ্ধ হয়ে উঠেছে। ঠিক যেমন খড়ের গাদায় জলন্ত মশাল পড়লে আগুন জ্বলে ওঠে।চিত্রার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।ফর্সা মুখটা র*ক্তজবার মতো লাল হয়ে এসেছে। তার চোখ ক্রমে বিবর্ণ হয়ে এসেছে। দমবন্ধ হওয়ার পথে।চোখ উল্টে আসছে।ফারাজ দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“আরেকবার যদি তোর মুখ থেকে প্রশ্ন বেরোয় তাহলে জ*বাই করে তোর লা*শ আমি রাস্তার কুত্তাদের খাওয়াবো।কথাটা যেন তো কান দিয়ে ভালো করে ঢুকে।”চিত্রার চোখ বেয়ে অশ্রু ছলছল করছে। গলা থেকে তার ভোঁতা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসছে,
“ফা..ফারাজ..ম*রে যাচ্ছি।”
ফারাজ ছাড়ে না।বরং শক্তি আরো বাড়িয়ে দেয়।ছোট্ট একটা জান বের করতে এত পরিশ্রম? আসলেই মানুষ খু*ন করতে কষ্ট আছে।আচ্ছা এই তো একটু পর চিত্রার শরীর থেকে জানটা মুক্তি পাবি।তখন ফারাজ কি করবে?আবারো কি কলিজা ভুনা দিয়ে ভাত খাবে?ফারাজকে তখন ভাত খাইয়ে দিবে কে?চিত্রার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।চোখটা মেলার চেষ্টা করল সে। তবে পারল না, আর পারবে না।সময় যে শেষ।
“এই বউ?তুমি কি সাপ টাপ নাকি?মানে নাগিন?সাপেদের মতোন এমন চোখ মেলে ঘুমাচ্ছো কেন?”
চিত্রার হুশ ফিরে।সে নিজেকে একবার দেখে, ভালো করে দেখে।কই তার তো কিচ্ছু হয় নি?ফারাজের দিকে একবার তাকায় সে।ফারাজ কসরত করে এখন ঘর্মাক্ত। স্মিথ মেশিনের সাহায্যে বেন্চ এবং শোল্ডার প্রেস করে উঠেছে সে।ফারাজের ফকফকা নগ্ন বুক।পরনে কালো একটা ট্রাউজার।কসরত করা শরীরের ভাজে ভাজে পুরুষত্ব স্পষ্ট।বুকটা সামান্য কালো লোমশে আবৃত। বা বুকের ওপর একটা কাটা দাগ।চিত্রা চোখ সরিয়ে নেয়।
“না না চোখ সরাচ্ছো কেন?দেখো না একটু।ব্যায়াম করে তোমার জন্যই তো শরীর বানিয়েছি।”
চিত্রা উঠে যায়।চোখ মুখ এখনো ঘোলাটে লাগছে। মুখে পানি দিবে সে।এতক্ষণ সে কি দেখেছে এসব?ভয়ানক কল্পনা।
–
খাটের কোণে মেঝের ওপর বসে নদী কাঁদছে। শরীরে কোনোরকমে শাড়িটা দেওয়া।সিগারেটর জলন্ত আগুনে শরীরের নানা জায়গায় গর্ত হয়ে গেছে।শরীর জ্বলছে।তবুও নদী চিৎকার করে কান্নার সাহস পাচ্ছে না।সে জানে তার স্বামী রাজন মেয়ে মানুষের কান্না সহ্য করতে পারে না।কাঁদলে হয়তো এবার তাকে মেরেও ফেলতে পারে।রাজন ধূর্ত পুরুষ মানুষ।গালভর্তি চাপদাড়ি।সবসময় সাদা পাঞ্জাবি পড়ে থাকে।তাকে কখনো শার্ট পড়তে দেখা যায় না।অবাধ্যতা তার পছন্দ নয়।রাজন সিগারেট ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল।লুঙ্গি ঠিক করে নদীর দিকে চেয়ে বলল,
“রুহুর মায়া তোর কইমা গেছে তাই না?এডাই তোর শেষ সুযোগ। আরেকবার তোর পাকনামি দেখলে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মৃ*ত্যুটা আমি তোরেই দিমু জা*নোয়ারের বাচ্চা।”
রাজন ড্রয়ার থেকে আরেকটা সাদা লুঙ্গি বের করল।লুঙ্গিটা কাঁধে ঝুলিয়ে গোসলে চলে গেল।তবে যাওয়ার আগে নদীর পিঠে আরেকটা লাথি মা*রতে ভুলল না সে।নদী মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদছে।তাকে বাঁচাতে আগেও কেউ আসে নি। আর হয়তো কখনো কেউ আসবেও না।নদীর পাশের রুমের বারান্দায় রাজনের ছোট বোন দাঁড়িয়ে আছে।সে জানে তার ভাবীর সঙ্গে কি কি হয়েছে?তবে ভাবীকে রক্ষা করার মতো সাহস তার মধ্যেও নেই।এমনিতেও তার স্বামী এ বাড়ির ঘরজামাই।তাই তারা কেবলই এই বাড়ির আসবাবপত্রে জমে থাকা ধুলোর মতো।যার কোনো মূল্য নেই।যাকে কেউ পছন্দ করে না।
“ফারাজের বউয়ের নাম কিরে?”ফারিয়া পেছন ফিরে তাকায়।জোহানকে দেখতে পায়।জোহান তার রুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে নির্লিপ্ত হাসি।
“কিরে মৌনব্রত নিয়েছিস নাকি?”
“চিত্রা।কেন?”
“ফারাজের চয়েজ আছে বলতে হবে।কড়া জিনিস বাড়িতে এনেছে।”
“তোমার ভাবী হয় চিত্রা।অন্যের পাত্রে মুখ দেওয়া কবে বন্ধ করবে?”
জোহান এক লহমা চুপ থেকে জবাব দেয়,
“মুখ দিচ্ছি না রে,এই প্রথম ইচ্ছে করছে জীবনটা বের করে মিসেস এলাহীর হাতে ধরিয়ে দেই।”
চলবে?…………..
(আমার ঘুমন্ত পাঠক/পাঠিকারা আজকে অন্তত জাগ্রত হয়ে বড় বড় কয়টা কমেন্ট পড়ি।আজকে সবার সব উত্তর দিতে মন চাইছে।)