#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৮
( সর্তকতা: সহিংসতা আছে।)
সন্ধ্যা নেমেছে। হিলচিয়া গ্রামের আকাশ ধীরে ধীরে গভীর অমানিশায় ঢেকে যাচ্ছে। ধানখেতের আলপথ ধরে দিনের শেষে ঘরে ফিরছে মানুষ। কেউ কাঁধে কাস্তে, কেউবা মাছভরা ঝুড়ি হাতে। বাঁশঝাড়ের মাথায় সূর্যের শেষ আলো ফিকে হয়ে এসেছে। নদীর বুকে রক্তিম আভা ফেলে ডুবে গেছে দিনের শেষ সূর্য। দূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজান। সেই সুরের মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে জেলেপাড়ার ঘর থেকে ভেসে আসা হারিকেনের টিমটিমে আলো।
জলিল আজ খুশি। অনেকদিন পর কপাল খুলেছে। বড় বড় রুই আর পাঙ্গাশ ধরা পড়েছিল কাল রাতে জালে। বাজারে ভালো দামও পেয়েছে। হাতে টাকা এসেছে। তাই ভাবল আজ জুনাইফার পছন্দের কিছু আনবে। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা তার বউ। কতো কিছুই তো খেতে ইচ্ছে করে এই সময়।কিন্তু সে কখনো কিছু চায়নি। জলিল নিজেই নিয়ে এসেছে দু’টো কবুতরের বাচ্চা। জুনাইফার কবুতরের মাংস অনেক পছন্দ।আঁধার ঘনিয়ে এসেছে ।এখন শুধু বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই হয়।জলিলের বাড়ি ঘোড়াউত্রা নদীর তীরে।জেলেপাড়ার মানুষ সে।জলিলের স্ত্রীর পরিবারে কেউ নেই।এতিম মেয়ে সে।আজ কবুতর দু’টো দেখলে হয়তো অনেক খুশী হবে। হেসে বলবে,
“এগুলা আমার জন্নে আনছেন?আচ্ছা আমনে আমারে কতোখানি ভালোবাসেন?”
জলিল তখন জুনাইফার কপালে চুমু খেয়ে বলবে,
“ওই যে নদীর পানি দেখতাছত না, জুনাইফা? আমার ভালোবাসা তার চেয়েও বহুত।তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি আমি তোরে।”
ভ্যানগাড়ি রাখার পরপরই সে হাঁক ছাড়ল, “কিরে জুনাইফা? কই গেলি? দেখ, তোর লাইগা কি আনছি!”
কোনো সাড়া নেই। আশপাশ নীরব, শুধু রাতের পোকাদের একঘেয়ে ডাক।জলিল বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে কবুতর দু’টো জমিনে রেখে লুঙ্গির গিট ঠিক করে একবার চারপাশে তাকায়।বাড়ি আজ কেমন যেন অন্ধকার আচ্ছন্ন।জুনাইফা বাহিরে হারিকেন কেনো জালালো না?জলিল আরো কয়েকবার জুনাইফার নাম ধরে ডেকে ঘরে প্রবেশ করল।মাটির ঘর তাদের।জলিলের আজকে আর দরজায় কড়া দেওয়ার প্রয়োজন হয় নি।দরজা আগে থেকেই খোলা ছিল।জলিলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।সে ধীর পায়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল।ঘরের মধ্যে টুকটাক কিছু জিনিস ছিল।তাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।বুকের ভেতর কেমন যেন একটা চিনচিনে ভয় জেগে উঠল জলিলের।সে ফাঁকা ঢোক গিলে শয়নকক্ষে যেতেই ভেতরটা থমকে যায়।ঘরের মধ্যে কুপী জ্বলছে।মৃদু তার আলো।চার-পাঁচজন যুবক রুমের ভেতর উপস্থিত। দু’জন বসে আর তিনজন দাঁড়িয়ে। জলিলের চোখ তার স্ত্রীকে খুঁজে। জুনাইফাকে চৌকির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে।মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া।হাত পা বাঁধনে আবদ্ধ।শাড়ির আঁচলটা বুকের ওপর থেকে সরে মাটিতে হামাগুড়ি খাচ্ছে।শরীরের নানা জায়গায় ক্ষত।কপাল থেকে একদলা মাংস উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।সেখানটায় তাজা র*ক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে গেছে।জলিল দৌড়ে জুনাইফার দিকে এগিয়ে আসতেই দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে তিনটে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর।
“তোরা আমার জুনাইফার লগে কি করছোত?কেডা তোরা?”জলিলের ক্ষিপ্ত কন্ঠ।
কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিল না। বরং একজন দমকা হাওয়ার মতো উঠে এসে তার পাঁজরে রডের বারি বসিয়ে দিল। মুহূর্তেই একটা বিকট শব্দ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে, হাড় ভাঙার শব্দ।
“উফফ…”জলিলের মুখ থেকে বেরিয়ে এল গুমড়ে ওঠা শব্দ।তবুও তারা থামল না। একের পর এক আঘাত আসতে লাগল। মাথা ফেটে র*ক্ত ঝরছে,চোখ ফুলে অন্ধকার।জুনাইফা ছটফট করছে। তার গোঁঙানি কান্নার মতো শোনাচ্ছে। চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।একটা চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল এক যুবক। মুখে ব্যঙ্গের হাসি। তার নাম সিফাত। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে রডের মাথাটা জলিলের চিবুকে ঠেকিয়ে বলল,
“শা*লা মারা খাইয়াও দেখি তোমার হম ফুরায় না দেখি? শরীর ভরা চুলকানি কেন এত?”
জলিল আবারো গর্জে উঠার চেষ্টা করে তবে কিছু করার আগেই পিঠের ওপর আরেকটা বারি পড়ে।আবারো পিঠ ভেঙে নুইয়ে পড়ে জলিল।সে অস্পষ্টভাবে ফোঁসফোঁস করল, “আমার বউরে ছাইড়া দে…”
“তুই জানোস তোর আজরাইল কেন এখানে আসছে?ওলে বাবা জানোস না?খাঁড়া একটা ডোজ নিয়া লই।তারপর তোরে আরামসে সব কইতাছি।”
সিফাত পাশের ছেলেটার দিকে তাকাতেই সে পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে হাতে তুলে দেয়।সিফাত হোলস্টার থেকে একটা পিস্তল করে সিরিঞ্জের সঙ্গে মেঝেতে রাখল।তারপর দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই সোহেল রাম দা কই?ওইডাও দে।”জুনাইফার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সোহেল হাতের রাম দা টা এগিয়ে দেয় সিফাতের দিকে।সিফাত দা,পিস্তল আর ড্রাগস তিনটাই জলিলের সামনে সাজায়। ঘাড় চুলকে র*ক্তের দিকে চেয়ে বলে,
“জীবনে কিছু জিনিস দেইখাও না দেখার ভান ধরতে হয়।সব কিছুতেই যদি এত ফাল পারোস তো মারা তো খাইবিই।মানলাম আমাগো বড় ভাইয়ের কোনো একটা কাম তোর চোখে পইড়াই গেছে তাই বইলা তুই পুরো কিশোরগঞ্জেরের ওলিতে গলিতে সব কইয়া বেড়াইবি?”
সিফাত জুনাইফার দিকে তাকালো।ফের জলিলের দিকে চেয়ে বলল,
“বউয়ের বাচ্চা হইবো?..ভালো।তবে বাচ্চাডার কপাল পুড়ারে..চ্যাহ।না পারবো হেয় দুনিয়াতে আইতে,না পারবো মাডারে দেখতে আর না পারবো বাপরে দেখতে।খাড়া সোনা তোর বাচ্চারে বাহিরে আইনা কই,তুই দুনিয়ায় আসার আগেই মরছোত তোর বাল পাকনা বাপের লইগা।”
জলিলের চোখে জল।তার কন্ঠ মিইয়ে এসেছে। তবুও সে বলল,
“আমারে যা করার কর।আমার বউ বাচ্চারারে ছাইরা দে।”
ছেলেগুলো উচ্চস্বরে হেসে উঠল।সিফাত এবার হাতের রডটা শরীরের শক্তি দিয়ে জলিলের গলার মধ্যে ডুকিয়ে দেয়।গলার রগ ছিঁড়ে তাজা র*ক্ত বেড়িয়ে আসে।জলিল র*ক্ত বমি করে।শরীর তার ঢলে পড়ে।শরীরে আর একফোঁটাও শক্তি বেঁচে নেই।জলিলের চোখ এখনো খোলা।তবে চোখে কেবলই অশ্রু জমে আছে।এই চোখে লুকিয়ে আছে স্ত্রী সন্তানকে বাঁচানোর অর্তনাদ।সিফাত ছেলেগুলোর দিকে ইশারা করতেই তারা জুনাইফার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেয়।জুনাইফা হাতড়ে স্বামীর কাছে যেতে নিলে সোহেল তার চুলের মুঠি টেনে ধরে চৌকিতে ধুরুম করে ফেলে।উপুড় হয়ে পড়াটাতে পেটে ভয়ানক ব্যাথা অনুভব হয়।আল্লাহ বলে চিৎকার করে উঠে।চারজন ছেলে মিলে শক্ত করে চেপে ধরে জুনাইফার হাত পা।সিফাত হাতে বড় ছুড়িটা নিয়ে এগিয়ে আসে। মুখে বিশ্রী হাসি এঁকে জলিলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমাদের ভাইয়ের নামে অভিযোগ করার ফল দেখ জলিল, ভালো কইরা দেখ।আমরা মানুষরে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেই না।নদীর ঘাটে যা দেখছোত তা পেটের মধ্যে রাখলে হয়তো আজকে ভাই তোর অবস্থাই বদলাইয়া দিত।তবে সবই হইলো কপাল।”
সিফাত জুনাইফার পেটের দিকে তাকায়। হেসে ছেলেগুলোকে বলে,
“চল দেখা যাক বাচ্চাটা মাইয়া নাকি পোলা।”
জলিলের দেহে তখনও খানিকা নিভু প্রাণ ছিল।তবে সে কিছুই করছে পারছে না।শুধু জলই গড়াচ্ছে।মাটির তৈরি মেঝে র*ক্তের বন্যায় ভেসে গেছে।আরেকটু পর এই মাটির দেহও হয়তো মাটিতে মিশে যাবে।তবে মৃ*ত্যুটা এত জঘন্য ভাবে, কাপুরষের মতো না হলেও পারত।মৃ*ত্যুর থেকে যন্ত্রণা হচ্ছে স্ত্রী, সন্তানকে বাঁচাতে না পারা।তাদের নিষ্ঠুর পরিনতি নিজ চোখে দেখা।জুনাইফাও নিজেকে বাঁচাতে একসময় ব্যর্থ হয়।জুনাইফা হাফ ছেড়ে দিয়ে নেতিয়ে পড়লে সিফাত প্রাণ ভরে হাসে।নিজের কাজ শেষ করে শার্ট পড়তে পড়তে ছেলেগুলোকে বলে,
“ওগোরে আর মারতে হইবো না।আমরা ভাইয়ের কাম কইরা দিছি।তবে প্রামানও তো রাখা যাইবো না।ঘরে আগুন লাগাইয়া দে।মানুষ মনে করবো দূর্ঘটনায় জান খোয়াইছে।”
ছেলেগুলো তাই করে। আগুন লাগতেই বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে সবাই।ঘাটে নৌকা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।নৌকা দিয়ে কিছুটা গিয়ে ট্রলারে উঠবে সবাই।অনেকটা পথ গিয়ে সিফাত আরেকবার পেছন ফিরে তাকায়।দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।হয়তো এতক্ষণে গর্ভের বাচ্চাটাও আগুনের আঁচ টের পেয়েছে।মনে মনে হয়তো মায়ের প্রতি খুব করে অভিমান করে বলছে,
“আমাকে কেনো বাঁচালে না মা?আমার তো কোনো দোষ ছিল না।”
–
সন্ধ্যা হয়েছে সেই কখন।ফারাজ চিত্রার পেটের ওপর থেকে শাড়ি সরিয়ে শক্ত করে তার কোমর চেপে ধরে উবুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে।গা উদাম।শরীরে কাপড় থাকলে নাকি এলাহী সাহেবের আবার ঘুম আসে না।গরম লাগে,চা চুলকায়।এলার্জির সমস্যা আছে।কত কি আরো?আচ্ছা মেয়েদের কি এসব সমস্যা হয় না?কই তারা তো এভাবে ঘুমায় না?চিত্রার ভীষণ রাগ হয়।তার ওপর এই লোক আবার স্বামীর অধিকার দেখাচ্ছে।কি শক্ত ভাবে চেপে ধরে আছে তার সরু কোমরটাকে।মনে হচ্ছে বাপ-দাদার সম্পত্তি।বৈধ স্বামী বিধায় সব সহ্য করছে।তা না হলে জায়গা মতো গুটো মেরে বংশের বাতি ফুটো করে দিত।চিত্রা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য নড়েচড়ে উঠে।তাতে কাজ হয় না বরং ফারাজ তাকে নিজের বুকে আরো শক্ত ভাবে গেঁথে নেয়।চিত্রা ঠোঁট উল্টে বলে,
“এর মানে আপনি ঘুমান নি?ইচ্ছে করে এসব করছেন?ছাড়ুন।”
ফারাজ চিত্রার বুকের মধ্যিখানে মুখ গুঁজে জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“আরে বউ এত নড়াচড়া কেন করো?মির্কি রোগ আছে নাকি?”
“আমার তো নেই।তবে মনে হচ্ছে আপনার আছে।আচ্ছা আপনার গা থেকে সবসময় এলাচীর গন্ধ আসে কেনো?”
ফারাজ মাথা উঠিয়ে বলে,
“আমি ক্লাইভ ক্রিস্টিয়ান পারফিউম উইজার যে।কত দাম এটার ধারণা আছে?গন্ধ গন্ধ করছ কেনো?ঘ্রাণ বলো।”
চিত্রা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে,”ভালোই তো! এত টাকা খরচ করে আপনি তাহলে ছাইপাঁশও কিনেন দেখছি।”
ফারাজ ভ্রু কুঁচকে চিত্রার দিকে চোখ তুলে তাকায়।গালে একটা চুমু দিয়ে বলে,
“তোমায় দেখে না আমার বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। কাছে আসো বিবিজান ।”
“দূরে যান তো।কাছে আসার চেষ্টা করলে ঘুষি মেরে নাক বোঁচা করে দিব।”
ফারাজ হেসে এক ঝটকায় উঠে, চিত্রার ওপরে ঝুঁকে হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“আজ তো আজকে ভালোবাসবই। দেখি কিশোরগঞ্জের আগুন সুন্দরী আমার ভালোবাসা থেকে নিজেকে কি করে বঞ্চিত করে।”
ফারাজ চিত্রার আরো কাছে এগিয়ে আসতেই চিত্রার ভয়ে চোখমুখ খিঁচে আসে। ফারাজ ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাওয়ার আগেই চিৎকারে মনোযোগ নষ্ট হয় তার।অন্দরমহল থেকে কারো কান্নার শব্দ আসছে।আর্তনাদের শব্দ ভেসে উঠছে।চিত্রা ছটফট করে উঠে,
“সরুন বলছি আমাকে যেতে দিন।”
ফারাজ বিরক্ত হয়ে চিত্রাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ গোমড়া করে বলে,
“ফারাজ এলাহীরে খোদা মনে হয় তোর কপালে বাপ হওয়া লেখা নাইরে। ছ্যাহ!”
চলবে?
(আজকের পর্বটা কেমন লেগেছে তা অবশ্যই জানাবেন।আপনাদের কমেন্ট পড়ার জন্যই নিয়মিত গল্প দেই।)