কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৫
“রাগ কমাতে না পেয়ে মে**রে ফেললে তিন্নিকে? “
” তিন্নিকে মা**রি**নি আমি। রাগ কমাতে পারছিলাম না ঠিকই, তবে সে-ই রাগের জন্য তিন্নিকে মা**রার কথা ভাবতেও পারি না। এতটা জ*ঘ*ন্য আমি নই।”
” কি বলতে চাও তুমি? যা বলার ঠিক করে বলো, তাছাড়া আমি যে তোমাকে চিনি না এমন তো নয়। তোমার পক্ষে মিথ্যা বলা কোন ব্যাপার না। “
” হয়তো বা! রাগ কমাতে না পেরে দুপুরে দিকে একটু সেজে ছিলাম। হাতে চুড়ি পরেছিলাম। সেজেগুজে বাড়ির সামনে গেছিলাম। তিন্নি তখন সেখানে খেলছিলো। “
” তারপর? “
টেবিলের উপর রাখা গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে নিলো। তারপর দুপুরের ঘটনা বলতে শুরু করলেন।
সেদিন দুপুরে,
রিয়া বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তাঁর। তিন্নির জন্য ভাইয়ের হাতে চ”ড় খেয়েছে, না হলে ভাইয়া ভাবিকে একটু বকাঝকা করতো, ভাবিকে কথা শোনাতে বেশ লাগে রিয়ার। হয়তো ভাইয়া আবার নতুন একটা শাড়ি কিনে দিতেন, কিন্তু সেসব কিছু হলো উল্টো অপমান হতে হলো। নিজের উপরও প্রচন্ড রাগ হচ্ছে রিয়ার, কেন যে ঈদের আগে শাড়ি পরে ছিলো! রিয়াদের বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা, কতগুলো ফুল গাছ লাগালো সেখানে, মেহগনি, কড়াই এসব বড় গাছও আছে। প্রায় সময়ই গাছের ছায়ায় বাচ্চারা খেলা করে।
চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নিতে লাগলো রিয়া, কোথায় শুনেছে এভাবে রাগ কমে যায়।
” তোমাকে একদম পরির মতো লাগছে!”
কথাগুলো কানে গেলে চোখ খোলে রিয়া। তিন্নি সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কথাগুলো তিন্নিই বলেছে। তিন্নি দেখে রিয়ার রাগ বেড়ে যায়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, ” আমাকে যেমন লাগবে লাগুক। তাতে তোর কি যায় আসে?”
” এভাবে বকা কেন দিচ্ছো নীল পরি? আমি কি ভুল বলেছি নাকি? সত্যিই তুমি খুব সুন্দর দেখতে, নতুন চাচুও বলেছে। “
“তুই যাবি এখান থেকে?”
” ফুপি তোমার কি মন খারাপ? সকালে কাকা তোমাকে ওইভাবে মা*র*লো কেন? ইসস, সুন্দর গালটা একদম লাল হয়ে গেছে।”
” কেন মে*রে*ছে তা জেনে তোর কি কাজ? তুই আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা। “
তিন্নি দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে যায়। মিনিট দুয়েক পর এক টুকরো বরফ হাতে ফিরে আসে।
” ফুপি তোমার গালটা এদিকে দেও তো।”
” কেন?”
” কাকু তখন তোমাকে মা*র*লো না , এইটা দিলে ঠিক হয়ে যাবে। অনেক ব্যাথা করছে তাই না? সেদিও সবুজও আমাকে মেরেছিলো এভাবে, খুব ব্যাথা পেয়ে ছিলাম। পরে আম্মু বরফ লাগিয়ে দিয়েছিলো।
“আমি কি করবো?”
” তোমাকে কিছু করতে হবে না। আমি তোমার জন্য বরফ নিয়ে এসেছি, লাগিয়ে দিলে ব্যাথা কমে যাবে। আমি কাকাকে অনেক বকা দিয়ে দিবো। “
তিন্নির কথায় হতভম্ব হয়ে যায় রিয়া। চোখমুখ থেকে রাগী ভাব সরে যায়৷ সত্যিই তো তিন্নি একটা বাচ্চা মেয়ে, এখনও ভালো মন্দের পার্থক্য বোঝে না। যা দেখে যা শোনে তাই বলে দেয় সবাইকে। রিয়া বসে পড়ে, ছোট্ট হাতে রিয়ার গালে বরফ লাগিয়ে দেয় তিন্নি, মাঝে মাঝে ফু দিয়ে দিচ্ছে। রিয়ার চোখ পানিতে ভরে যায়। তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে।
” ফুপি তোমার হাতে চুড়িগুলো খুব সুন্দর। “
” পরবি নাকি তুই?”
” এ বাবা এতো বড় চুড়ি কি আমার হাতে হবে নাকি! এইটা তো অনেক বড়। “
“পাকা বুড়ি একটা, তোর হাতটা দে তো এদিকে।”
তিন্নি হাত বাড়িয়ে দিলে রিয়া কয়েকটা চুরি পরিয়ে দেয়। মুচকি হেসে বলে, ” দেখ কি সুন্দর শব্দ হচ্ছে, এগুলো কাঁচের চুড়ি। সাবধানে রাখবি কিন্তু না হলে ভেঙে যাবে। “
তিন্নি খুশিতে লাফাতে লাফাতে বাড়ির ভিতর চলে যায়। রিয়াও বাড়িতে ফিরে আসে। মন অনেকটা হালকা হয়ে গেছে তাঁর। সত্যিই বাচ্চাদের ভিতর মন ভালো করে দেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। এরপর বিকালের দিকে শোনে তিন্নির আর নেই, সে-ই থেকে রিয়া চুপচাপ হয়ে গেছে৷ “
দুপুরের ঘটনা বলা শেষ, ফুফু উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অবিশ্বাসী চোখে ফুফুর দিকে তাকালাম। এই মহিলাকে এতো সহজে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। ছোট থেকে দেখছি কেমন করে মা’য়ের পিছনে লেগে আছে। আগে অবশ্য আমাকে বেশ স্নেহ করতো। কিন্তু এখন মুখের উপর সব বলে দিই তাই তেমন সহ্য করতে পারে না।
” চুড়ির টুকরোগুলো আমার কাছ একটু দে তো বাদশা। “
অনিচ্ছা শর্তেও চুড়ির টুকরোগুলো ফুফুর হাতে তুলে দিলাম। চুড়ি হাতে পাওয়ার কয়েক মুহুর্তের ভিতরে ফুফু সেখান দিয়ে দৌড় দিলেন। কোথায় যাচ্ছো বলে চিৎকার করতে করতে ফুফুর পিছনে দৌড়াতে লাগলাম। ফুফু দৌড়ে গিয়ে পাত কূয়োর ভিতর চুড়িগুলো ফেলে দিলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো, ” আমি তোকে বিশ্বাস করি না, তুই এই চুড়িগুলো নিয়ে আমাকে ফাঁ*সি*য়ে দিতে পারিস। তাই আগে দিয়েই ব্যবস্থা করে রাখলাম। “
নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হলো। কি করে এমন ভুল করতে পারলাম আমি! বিকালে পুলিশের কাছে দিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো এগুলো।
” বুঝতে বাকি নেই, তুমি নির্দোষ নও। চিন্তা করো না, তোমার বিরুদ্ধে আমি ঠিক প্রমাণ খুঁজে বের করবো। ”
ফুফু কিছু না বলে হাসতে লাগলো। সারা রাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। নানান দুশ্চিন্তা আমাকে চেপে ধরেছে যেন। ফুফু খু*নি হিসাবে ধরা পড়তে আমার বাড়ির কি অবস্থা হবে! পরিবারের মানসম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? পরিবারের একজন
অপরাধ করলে তার ফল বাকিদেরও ভুগতে হয়।
অনেক মাথা ব্যাথা করছে। হয়তো সারা রাত ঘুমাতে পারিনি সেজন্য। সেহেরির সময় ঠিকমতো খেতে পারিনি। সাইকেলটাও ঠিকমতো চালতে পারছি না। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে স্যারের বাড়ি অনেক বেশি দূরে। গন্তব্য দূর হলেও যেতে হবে, এটাই নিয়ম।
স্যারের কাছে পড়া শেষ হওয়ার পর আরো একটা দূঃসংবাদ পেলাম। ব্যবসায়ী কাকার কাছ গেছিলাম খাবার ডেলিভারি দিতে হবে কি জানতে। কিন্তু সেখানে,
” আসসালামু আলাইকুম কাকা। “
” জ্বি বলো।”
” কাকা ওই খাবার ডেলিভারি দিতে হবে কিনা সে-টা জানতে এসেছিলাম। “
” সে আমি নতুন লোক রেখেছি। তুমি বাচ্চা মানুষ, এতো কাজ করতে পারবে না। “
” সেদিন তো বললেন আমি ভালো কাজ করেছি। “
” হ্যাঁ, তা সেদিনের কথা বাদ দেও। কাল আসলে না কেন?”
” আমার একটা বোন মা*রা গেছে। “
” আপন বোন নাকি?”
” না বাড়ির পাশের। “
” এমন বোন ম*রার অযুহাত বহুবার দিয়েছি জীবনে। তুমি আসতে পারো। তোমাকে আর লাগবে না। “
” তাহলে আগের দিন টাকাটা দিন। “
ব্যবসায়ী কাকা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।
” এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই কাকা। আমি পরিশ্রম করেছি, তার মূল্য পরিশোধ করে দিন। “
লোকটা পকেট থেকে ষাট টাকা বের করে দিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো। আমি বিশ টাকার তিনটে নোট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সত্যিই আমি মা’কে শাড়ি কিনে দিতে পারবো না!
নিজেকে কখনো এতোটা অসহায় মনে হয়নি। সবকিছু কেমন অন্ধকারে ঢেকে গেছে, ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো অপূর্ণ থাকাটা কি খুব জরুরি! ঈদের দিন সকালে মা’য়ের হাতে একটা সুন্দর শাড়ি তুলে দিয়েছি আমি। মা খুব খুশি। শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে, আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে দিলেন। এমনটাও তো হতে পারতো তাই না? খুব কি অসুবিধা হতো এমনটা হলে? একদিন আমিও বড় হবো, আমার পক্ষে একসাথে গোটা দশেক শাড়ি কেনাও কোন ব্যাপার হবে না। তবে তখন এই ইচ্ছেটা থাকবে না। কৈশোরের আবেগ থাকবে না, মা’য়ের হাসিতে তৃপ্তি খোঁজার সময় হবে না। ভিষণ ব্যস্ত থাকবো আমি, সারাদিন কাজের পর ঘরে ফিরে বড্ড ক্লান্ত! মা’য়ের সাথে দু’চার মিনিট কথা বলার সময়ও নেই। কেন? আমি কৈশোরকাল ছেড়ে এসেছি। এখন এসব আবেগ আমার জন্য মানানসই হয়! সত্যিই কি মানানসই নয়?
উদ্দেশ্যহীনভাবে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি, গন্তব্য নির্ধারিত। বাড়িতে ফিরছি, তবুও উদাসীনতা! সাইকেল রেখে রুমে চলে এলাম। একটু ঘুমাতে চাই। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। শান্তিতে ঘুম না এলেও ক্লান্তিতে ঘুম চলে এলো।
ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বেলা এগারোটা, মাত্র এক ঘন্টা ঘুমিয়েছি। রুম থেকে বের হয়ে দেখলাম মা থালা হাতে কোথাও যাচ্ছে।
” মা কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
” এইতো তিন্নিদের বাড়িতে যাবো। এই প্লেটটা দিতে।”
” আমার কাছে দেও, দিয়ে আসছি। “
মা মুচকি হেসে থালাটা আমার কাছে দিলেন। মায়ের একটা কথা ভিষণ দাগ কেটেছে মনে, তিন্নিদের বাড়ি! মানুষ না থাকলেও তাঁর নামটা থেকে যায়, হয়তো স্মৃতিতে নয়তো ভালোবাসায়! ধীর পায়ে হেঁটে ওদের বাড়িতে চলে গেলাম। দরজায় কড়া নাড়তে যাবো। এমন সময় নজরে এলো ঘরের ভিতর একটা লোক কাকি মায়ের হাত ধরে আছে। জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে স্বান্তনার দিচ্ছে। হঠাৎই কাকি মা লোকটিকে জড়িয়ে ধরলেন। এসব দেখতে ভালো লাগছে না, তাই এগিয়ে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম।
” কে?”
” আমি বাদশা। মা আপনার কাছে পাঠিয়েছে। “
কাকিমা দরজা খুললেন। আমার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” ভাই, এইটা নিয়ে রাখ। “
লোকটা এগিয়ে এসে প্লেট নিলো, তারপর ভিতরের দিকে চলে গেলো। এটাই তাহলে কাকি মা’র সেই ভাই। সারাজীবন খোঁজ নেয় না, এখন সহানুভূতি দেখাতে এসেছে। এ ধরণের লোক একদম পছন্দ নয় আমার৷ ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে আসতে আসতে কারো হাসির শব্দ কানে এলো। এই শোক পুরিতে কে হাসছে!
চলবে