#অবন্তিকা_তৃপ্তি
ধ্রুব তন্ময়ের সামনে গিয়ে অদিতির চেয়ারটায় বসলো, তারপর বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো-‘হ্যা-লো তন্ময়! আমি ধ্রুব, ধ্রুব ইয়ামিন।’
তন্ময় কান থেকে হেডফোন খুলে অমায়িকভাবে হাসার চেষ্টা করে চেয়ার থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করলো ধ্রুবর সাথে,—‘ভেরি নাইস ঠু মিট ই্যয়ু ধ্রুব।’
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকাল, দুজনেই চেয়ারে বসলো মুখোমুখি! তন্ময় আশেপাশে ধ্রুবর থ্রি ইডিয়েটসকে দেখে, সবাই ওর দিকে রাগান্নিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন এক্ষুনি ওরা তিনজন তন্ময়কে কামড়ে-কুমড়ে খেয়ে ফেলহে, খেয়ে ঢেকুর অব্দি তুলবে না। তন্ময় ওদের দিকে চেয়ে আবার হেসে চোখ সরিয়ে ধ্রুবকে দেখল। ধ্রুব স্বাভাবিক গলায় বললো-‘ দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’
তন্ময় উত্তর দিলি-‘ভালো, পড়াশোনার চাপ বেশি অবশ্য।’
সুমন পাশ থেকে কড়া গলায়, অথচ গা জ্বালানো হেসে বললো—‘টপারদের তো পড়ার চাপই থাকে।আমগো লাইফ বিন্দাস, নো চাপ।’
তন্ময় সুমনের দিকে চেয়ে হাসার চেষ্টা করলো, কিন্তু ওর আগুন চোখ দেখে নিমিষেই হাসিটুকু গিলে নিয়ে সরাসরি ধ্রুবর দিকে চেয়ে বললো—‘দ্য ফেইমাস ধ্রুব ইয়ামিনের সঙ্গে টপারদের কোনো সখ্যতা নেই বলেই আমি জানি। আমার কাছে কেন আসা হলো, শুনি?’
ধ্রুবর বলা লাগলো না কিছুই। পাশ থেকে ইমন টেবিলে হাত রেখে তন্ময়ের দিকে ঝুকল, তন্ময় মাথাটা একটু পিছিয়ে নিলো তখন। ইমন কড়া গলায় জানিয়ে দিল-‘যারে মিয়া তুমি লাইন মারতেসো, ওই মেয়ে আমাদের ধ্রুবর না হওয়া গার্লফ্রেন্ড। তাই; চোখটা নামিয়ে।আজ থেকে ওই মেয়ে তোমার ভাবি? কি ডাকবা? ভা-বি।’
ইমন টেনেটেনে স্পষ্ট গলায় ‘ভাবি’ শব্দটা কানে গেঁথে দিল তন্ময়ের। তন্ময় হাসল ওর কথায়। যেন ইমনের কণ্ঠে কৌতুক ছিলো। ও হেসে হেসেই বললো—-‘ভাবি? গার্লফ্রেন্ড? আর অদিতি?ডোন্ট বি লাইক অ্যা জোকার।’
ধ্রুব এবার নিজে কথা বললো- ‘অদিতি তোরে পাত্তা দিসে? তার মানে ও কমিটেড। এটুকু বোঝার জন্যে আমার মনে হয় কষ্ট করা লাগে না কোনো ছেলের।’
তন্ময় নিজের কথায় অটুট, ও বললো—-‘নো, আমি বিশ্বাস করলাম না। অদিতি ধ্রুবকে ভয় পায়, আমি তো সেটাই জানি।’
রাজু এবার রেগে গেল, ধ্রুবর সঙ্গে এমনভাবে হেঁয়ালিভাবে কথা বলা ওর মোটেও পছন্দ হলো না, ও দু কদম তেড়ে গিয়ে বললো—‘ঔ পোলা, ভাইর লাগে মজা লস? চিনোস আমাদের ভাইরে?’
তন্ময় রাজুর থেকে চোখ সরিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকাল, খোচা দিয়ে বললো-‘চিনব না কেন? একটা বখাটে, ইউজলেস ছেলে তোমাদের ধ্রুব ভাই।ধ্রুবর পরিচয় জানতে আমাকে বেশিদূর যাওয়া লাগবে না, এই ক্যান্টিনে যারা আছে এদের যেকোনো একজনকে জিজ্ঞেস করলেই হরহর করে বলে দিবে তোমাদের ভাই কেমন আর কে?’
এতক্ষণ তন্ময়ের বকবকানি ধ্রুব শুনে, এতক্ষণ মুখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণে আনলেও, এবার যেন মাত্রা ছাড়ায়। একটা অকাতের বাইরের ছেলে ধ্রুবর পরিচয় চেনাচ্ছে?
রাজু আর কিছু বলবে; তার আগেই ধ্রুব রেগে উঠে,হিসহিসিয়ে বললো-‘সব বাদ, মোদ্দা কথায় আয়! নেক্সট টাইম অদিতির পিছু নিতে দেখলে তোর বাপ-মা আর ছেলের মুখ দেখবে না, তন্ময়।এইখানেই কোথাও তাদের টপার ছেলেরে গেড়ে রেখে দিব।’
তন্ময় হাসে, টিটকারী হেসে বলল-‘ওপস; ভয় পাইলাম।’
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেলে। তন্ময় হাসে! ধ্রুবর দিকে ঝুঁকে এসে ধ্রুবর চোখে চোখ রাখে। ভীষণ শান্ত গলায়, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দিয়ে ধ্রুবকে আগাগোড়া পরখ করে বলল—‘অদিতি তোমার গার্লফ্রেন্ড নয়; আমি জানি। আমাকে বড় গলায় হুমকি না দিয়ে, ওকে নিজের প্রেমে ফেলে দেখাও। অদিতি তোমাকে ভালোবাসলে, আমি নিজে তোমার কাছে স্যারেন্ডার করবো; স্বেচ্ছায়।’
ধ্রুব ভ্রু কুচকে চায়, মুখোমুখি দুটো মুখ! ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বল -‘অদিতি আমার জন্যে কোনো গেইম না। ওকে আমি ভা-‘
ধ্রুব থেমে গেল হঠাৎ। ধ্রুবর দোনা-মোনা দেখে তন্ময় হাসে,ওসব কথা পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করে বললো-‘জিতে দেখাও ওকে। বেট লাগালাম; যে হারবে সে ভার্সিটির সবার সামনে উইনারের পা ধরবে। হোয়াটস সে?’
ধ্রুব তাকায়, হঠাৎ করে ওর তীক্ষ্ম চোখগুলোতে যেন উজ্জ্বলতা খেলে গেল। ও একপর্যায়ে হেসে উঠে, তন্ময়ের দিকে চেয়ে বিশ্বাসী গলায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো-‘পাক্কা।’
তন্ময়ও হেসে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল -‘পাক্কা।’
ধ্রুবর পুরো দল ওদের দুজনের দিকে ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে ছিলো পুরোটাক্ষণ। ধ্রুব নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে একটা অকাতের বাইরের ছেলের সঙ্গে বেট লাগিয়েছে? ওদের যেন এই বিষয়টা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে।
_______________
ধ্রুব আপাতত ওদের আড্ডাখানায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাকিরা তখনও ধ্রুবকে দেখে যাচ্ছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে। ধ্রুব ইতিমধ্যেই অদিতির পুরো ডিটেইলস জোগাড় করে ফেলেছে। ও একজনের কাছে ফোনকলে অদিতির সম্পর্কে সবকিছু জেনে মাত্রই ফোন রাখল। এবার কথা বলার সুযোগ পেয়ে ইমন কথা তুলল, অবিশ্বাস নিয়ে বললো-‘তুই বেট লাগালি ধ্রুব? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না বাই গড। ওই পোলা তোর পায়েরও যোগ্য নয়।’
ধ্রুব হাতের ক্যানটায় চুমুক দিতে দিতে গা ছাড়া ভাবে বলল-‘জানি।’
‘তাহলে? কোন দুঃখে এমন ফালতু বেট লাগালি?’- ইমন এবার যেন ভীষণ বিরক্ত হলো।
ধ্রুব ক্যানটা আঙ্গুলের ফাকে নিয়ে ঝাকিয়ে আবারও চুমুক দিল, তারপর বিশ্রী হেসে বললো-‘কারণ হি নিডস সামথিং স্পাইসি।’
কেউই বুঝলো না ধ্রুব কি বোঝাতে চাইছে। রাজু বলল -‘মানে ভাই?’
ধ্রুব ক্যান ফেলে দিল রাস্তাতে । জিন্সের পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে ক্যানকে জুতো দিয়ে বলের মতো গড়িয়ে সামনে নিতে নিতে বলল-‘মানেটা হচ্ছে; ফ্রম নাও অ্যাই ক্যান সি, তন্ময় ভার্সিটির সবার সামনে আমার পা ছুয়েছে, আর আমি ওর মুখের মধ্যে লা/থি দিচ্ছি।’
ইমন বলল-‘তার মানে তুই একদম শিউর? অদিতি তোকেই ভালোবাসবে?’
ধ্রুব একদম চুপ হয়ে গেল, কথা বাড়াল না এই প্রশ্নে। নিজের মতো করেই ক্যান নিয়ে খেলছে ও। সুমন কিছুটা ভাবুক হয়ে বললো-‘ভাই, ভাবিকে পটানো এতটাও সহজ হবে না আমার মনেহয়। এত্ত ভয় এনার ভেতরে, আপনাকে দেখলেই তো পালিয়ে যায়।’
ধ্রুব এবার কিছুটা হাসলো, সুমনের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে আবার মুখ গম্ভীর করে খেলায় মন দিয়ে বলল -‘আর পালাবে না, আমি এসে গেছি।’
ধ্রুব ক্যানটা গড়িয়ে নিতে নিতে নিজের বাইকের সামনে নিয়ে এলো। ক্যানটা আবার জুতো দিয়ে পি/ষে দুমড়ে মুচড়ে ছুড়ে ফেলে বাইকে চড়ে বসলো। ইমন বলল -‘কোথায় যাচ্ছিস এখন আবার?’
ধ্রুব বাইকের ইঞ্জিন চালু করতে করতে জবাব দিল ছোট করে-‘মহাখালী।’
‘তোদের ফ্যাক্টরিতে?’
‘ উহু! আমাকে দেখে যার আত্মা কাঁপে, দেখি তার কাঁপুনি কমাতে পারি কিনা।’
_________
অদিতি সবে টিউশন করিয়ে বেড়িয়েছে,ওর জন্য ধ্রুব ওদের ফ্যাক্টরির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ও ওদিকে দাঁড়াতেই গলির মোড়ে যতগুলো ছেলেপেলে আড্ডা দিচ্ছিলো, সবাই সুড়সুড় করে চলে এলো সেখান থেকে। ধ্রুব ওদের যাওয়ার দিকে চেয়ে বাঁকা হাসে। যখন কেউ ধ্রুবকে ভয় পায়, ওর ভীষণ ভালো লাগে, আত্মিক একটা তৃপ্তি মেলে তখন।
ধ্রুব একটা আধতৈরি দেয়ালের উপর বসে পরে অপেক্ষা করতে লাগলো অদিতির আসার। ওর হাতে বরাবরের মতোই সিগারেট! ফু করে ধোঁয়া উপরের দিকে উড়িয়ে দিতে ব্যস্ত সে। অদিতি যখন ওই পথটা পেরুলো, ও তখন দেয়াল থেকে আরকি লাফে নেমে দাঁড়ালো দ্রুত। প্যান্টের ময়লা দ্রুত ঝেড়ে, কলার ঠিক করে অদিতির দিকে তাকায়। অদিতি আনমনে হাঁটছে। অন্যদিকে ওর মন তেমন নেই। ধ্রুব এগিয়ে গেল দু কদম।হঠাৎ করে কি মনে করে আটকে গেল ওর পা, আর এগুতে পারে না; পা-দুটো থেমে গেল ওর। ফুরফুরে মনটা ওর সংকীর্ণ হয়ে যায়। ধ্রুব যতই মন্ত্রীর ছেলে হোক! ও তো অদিতির কাছে সেই একই রাস্তার বখাটে একটা ছেলে, যার কাজ মা/রধ/র করা, মানুষকে হ্যানস্থা করা। এতকাল ধ্রুব নিজের কাজগুলো নিয়ে একবারও ভাবে নি; কিন্তু এখন যেন অদিতির ওর প্রতি ভয় চোখে ব্যাপারগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
ধ্রুব অদিতির দিকে দূর থেকেই চেয়ে রয়।মেয়েটা আজ একটা সাদা রঙের কুর্তি, চুড়িদার পায়জামা পরেছে,সুতির ওরনা শালীনভাবে গায়ে জরিয়ে রাখা। কাউকে মুগ্ধ করার তাড়া যেন তার নেই। অথচ ধ্রুব এই মলিন-বিমুগ্ধ মেয়েটাকেই দূর থেকে মনটা ভরে দেখে যাচ্ছে।সাদা গায়ে অদিতির সৌন্দর্য যেন রীতিমত চোখে লাগছে ধ্রুবর। ও স্থির ভাবে রোবটের মতো চেয়ে রয় ওর দিকে। অদিতি হেঁটে একটা ফোনের দোকানে ডুকছে।ধ্রুব কি মনে করে হঠাৎ! নিজেই বরাবরের মতো নিজের সংকীর্ণ মনের সঙ্গে বে/ইমানি করে, ওকে চমকে দিয়ে বড়বড় পা ফেলে নিজেও ফোনের দোকানে ঢুকে পরে।
#চলবে
সবাই রিয়েক্ট-কমেন্টস করবেন প্লিজ।
পর্ব ভালো লাগলে বা না লাগলে, আপনারা গ্রুপে এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।