ফ্রিজ পর্ব ১৪
রাতটা এত বড়ো লাগছে কেন! মনে হচ্ছে কত সময় ধরে শুয়ে আছি। সময় শেষই হচ্ছে না।
আপা কি ঘুমিয়ে পড়েছে, না-কি আমার মতো আপার সময়ও থেমে আছে?
“রেনু, “আলগা স্বরে আপার ডাক।
“হুঁ। “
“ঘুমাসনি!”
আপা আমার দিকে মুখ ঘুরাল।” কী রে ঘুমাসনি এখনো?”
“ঘুম আসছে না আপা।”
“আমারও ঘুম আসছে না রে!”
“আপা বলো তো কোন ফ্রিজটা সবচেয়ে ভালো হবে?”
“জানি না রে। মনে হয় লাল রংয়েরটা কিনলে ভালো হয়।”
“আমারও লালটা খুব ভালো লেগেছে! বাবা যে কোনটা কিনবে?”
“আমরা যেটা বলব বাবা সেটাই কিনবে।”
আনোয়ার চাচা যদি বলে, “লালটা ভালো হবে না।”
“এটা অবশ্য বলতে পারে। আনোয়ার চাচার ফ্রিজটা তো কালো।”
“কালো হলেও খারাপ হয় না আপা।”
“তা অবশ্য ঠিক।”
কিছু সময় নীরব কাটে। আমরা ভাবতে থাকি। আঁধারে আপার মুখ ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না। আপা আমার গায়ে হাতে রেখে বলল,” রুনু চল ছাদে যাই।”
“এত রাতে ছাদে যাবা? মা কিন্তু বকা দিবে আপা।”
“মা বুঝতেই পারবে না।”
রাতের ঢাকা দেখতে বেশ সুন্দর! আকাশে অবশ্য চাঁদ নেই নেই। চারিদিকে অন্ধকার। দুয়েকটা ফ্লাটের আলো এখানো জ্বলছে।
রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আপা বলল, “কী সুন্দর লাগছে শহরটা!”
আমার কাছে বেশি সুন্দর লাগছে না। কেমন উত্তেজনা কাজ করছে। কখন যে সকাল হবে! টুপ করে গিয়ে ফ্রিজটা নিয়ে আসব। যখন ইচ্ছে ঠান্ডা পানি খাও। চাইলে আইসক্রিম। মা কি ঘ্যানর ঘ্যানর করবে? এতবার ফ্রিজ কেন খুলছিস! মায়ের যা ধাত! একটু কিছু হলেই বকা দেয়।
“গল্প শুনি রুনু?”
“হুঁ।”
“তুই তো আবার গল্পের বই পড়িস না! কেন যে পড়িস না? গল্পের বই পড়লে কত কী জানা যায়। ঘুরে আসা যায় দেশ বিদেশে।”
আমি কিছু বললাম না। আপার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দূরের হালকা আলোতে আপাকে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে।
আজ যে বইটা পড়লাম। সেই গল্পটাই তোকে বলি। একজন লোকের স্বপ্ন একটা বাইক কিনবে। গরীব মানুষ আয় রোজগার খুব একটা ভালো না। কী করে এতগুলো টাকা জোগাবে জানে না। তবুও স্বপ্ন দেখে।
একটু একটু করে টাকা জমায়। যা আয় করে তার একটা অংশ জমায়। এভাবে অনেক বছর কেটে গেল। কত টাকা জমেছে তাও সে জানে না। বয়সও অনেক হয়ে গেছে। এখন আগের মতো আয়ও করতে পারে না।
মোটরবাইক কেনার ইচ্ছাটাও কেমন মিইয়ে গেছে! তার জমান টাকাটা খুব কাজে লাগল শেষ বয়সে।
আপা একটা ছোটো শ্বাস ছেড়ল। “মানুষের স্বপ্ন খুব কম সত্যি হয় রে!”
আমি ঠিক বুঝলাম না। আপা এ সময় এমন গল্প কেন বলল! আর হয়ত কয়েক ঘন্টা পরে আমাদের এতদিনের একটা স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।
“আপা চলো ফিরে যাই। অনেকটা সময় কেটে গেছে। রাতও ফুরিয়ে এসেছে।”
“হ্যাঁ রে চল যাই।”
ঘুম ভাঙলো মায়ের কান্নার শব্দে। এত সকালে মা কাঁদছে কেন! মনের ভিতরে কেমন করে ওঠল! আপা এখনো শুয়ে আছে।
আমি গুটি গুটি পায়ে বাবা মায়ের ঘরে গেলাম। মা ফ্লোরে বসে আছে। মায়ের চোখদুটো কেমন ফুলে গেছে! বাবা বসে আছে খাটে। বাবার চেহারা কেমন কালো হয়ে গেছে!
কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে দেখেই মা রেগে গেলেন। আগুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝাল কন্ঠে বললেন, “এ দিকে আয়।”
আমি ভয়ে ভয়ে মায়ের সামনে গেলাম। মা আমাকে প্রচন্ড জোরে একটা চড় মারলেন।
“রাতে কোথায় গেছিল বল?”
আমার কান্না পেল। চোখদুটি ভিজে গেছে। বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
বাবা বললেন,” ওর সাথে এমন করছ কেন! ওর কী দোষ।”
“ওদের জন্যই তো আমার এমন সর্বনাশ হলো!”
মায়ের আওয়াজ শুনে আপা ছুটে এসেছে। আমি এখনো কিছুই বুঝতে পারছি না। রাতে বাইরে গেছি বলেই কি মা এমন ক্ষেপে গেছে! আপা কে বলেছিলাম” মা রাগ করবে। আমার কথা শুনলোই না! এখন সব দোষ আমার হয়েছে।
আপা মায়ের পাশে বসে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, “কী হয়েছে মা?”
“সব শেষ হয়ে গেছে রে মিলি!”
আপার চোখে পানি জমেছে। আপা কি বুঝতে পারছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
“কী হয়েছে বলো তো মা।”
বাবা বললেন, ” তোর মার টাকা চুরি হয়ে গেছে রে মা। রাতে টাকার ব্যাগটা আলমারির উপরে রেখেছিল। সকালে উঠে নাকি খুঁজে পাচ্ছে না!”
“কী বলো বাবা!”
আপার চোখে জমে থাকা জল এখন ঝরে পড়ছে! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! মা কত কষ্ট করে টাকাগুলো জমিয়েছে। সব টাকা চুরি হয়ে গেল! কী করে জানল? আমাদের ঘরে এতগুলো টাকা আছে।
আনোয়ার চাচা ব্যাপারটা জানলেন। খুব দুঃখ করছেন। কী করে এসব হলো? বারবার জানতে চাচ্ছেন। কী হবে আর এ সব বলে? আমাদের তো সর্বনাশ হয়েই গেছে! এতদিন ধরে দেখা স্বপ্ন এক মহুর্তে শেষ গেছে!
মা এখন কেমন জানি হয়ে গেছে! মাঝে মাঝে কেমন ঝিম মেরে বসে থাকে। সে সময় কারো সাথে কথা বলে না। মায়ের হাসিতে আগের মতো প্রান নাই। কেমন ফ্যাকাসে হাসি দেয়! আমার খুব খারাপ লাগে। কেন যে সেদিন রাতে আমরা ছাদে গেছিলাম! ছাদে না গেলে এমন হতো না।
শীত শেষ হয়ে আবার গরম পড়েছে। আমাদের ফ্রিজ আর কেনা হয়নি! সময় সব ঠিক করে দেয়। সত্যি কি ঠিক করে? না স্মৃতিটা কে ঝাপসা করে দেয়। ভুলা তো যায় না! মা এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছেন। হয়ত আবার টাকাও জমাচ্ছেন। আমাদের কিছু বলেন না।
আজ প্রচন্ড গরম পড়েছে। স্কুল থেকে আমি আগেই চলে এসেছি। এখন আর আপার জন্য দাঁড়িয়ে থাকি না। ফ্রিজের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে আসার সময় ভিতরটা কেমন শুন্য শুন্য লাগে! টুম্পা প্রায়ই বলে,” রুনু কী হয়েছে রে তোর!”
“কী আবার হবে? তুই যে বলিস না টুম্পা!” টুম্পা চুপ হয়ে যায় কিছু বলে না। হয়ত কী বলবে খুঁজে পায় না। ফট করে কোনো খাবারের কথা বলে। “চকলেট খাবি রুনু?”
আমি না বলি। তবুও মাঝে মাঝে টুম্পা চকলেট নিয়ে হাজির হয়। কখনো নিই আবার কখনো নিই না।
আপা কলেজ থেকে ফিরেছে। সারা দেহ কেমন ঘামে ভিজে গেছে। আমায় বলল, “রুনু চাচার বাসা থেকে এক বোতল পানি নিয়ে আয়। যা গরম পড়েছে! “
আমি চাচার বাসায় গেলাম। চাচা আমাকে দেখে বলল, “কে রুনু? ” কেমন আছিস রে মা। পানি নিবি?”
আমি কোনো জবাব দেই না। ফ্রিজটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। চাচা টুকটুক করে নানা কথা বলতে থাকেন। এক সময় ফ্রিজটা খুলে পানি নিয়ে চলে আসি।
আমাদের টাকা চুরি হয়েছে এক বছর হয়ে গেছে। একদিন স্কুল ছুটি হয়ে গেল তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসলাম। বাসায় ভালো লাগছিল না। আপা এখনো ফিরেনি।
আমি আনোয়ার চাচার বাসায় গেলাম। ঘরে চাচা নেই। মনে হয় বাথরুমে গেছেন। বাথরুমে গেলে চাচার অনেক সময় লাগে।
আমি ঘরে ঢুকলাম। একটা ডায়েরি পড়ে আছে খাটের ওপরে। ভিতরে কলম রাখা। চাচা মনে হয় কিছু লিখছিলেন।
আমার খুব কৌতূহল হলো। কেন হলো জানি না! ডায়েরিটা খুললাম। একটা চিঠির মতো একটা কাগজ। দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন আগের চিঠি।
আমি চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।
বাবা এই চিঠিটা যখন তুমি পড়বে তখন আমি মায়ের কাছে থাকব। তুমি চাইলেও আমাকে এ জীবনে দেখতে পারবে না। অবশ্য আমাদের কাউকে তোমার প্রয়োজনও নেই। তোমার দরকার শুধু টাকা।
তুমি মা কে অনেক কষ্ট দিয়েছ! একা একা মা মারা গেছে! তোমার সময় হয়নি দেখার। তুমি শুধু টাকার পিছনে দৌড়িয়েছ। জানি তোমার টাকার চাহিদা শেষ হয়নি। কত টাকা হলে হবে তাও জানি না। তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও আমি তো তোমাকে ভালোবাসতাম বাবা।
তাই যাবার আগে তোমার চাহিটা কিছুটা মিটানোর চেষ্টা করলাম। জানি না কতটা মিটবে? হয়ত মিটবে না। তোমার জন্য আমার সারাজীবনের আয় এক মিলিয়ন ডলার রেখে গেলাম। জানি তুমি আমাদের ছাড়া ভালোই থাকবে।
এ লেখা হয়ত তোমার কাছে বিরক্তিকর মনে হবে! শেষবারের মতো না হয় একটু বিরক্ত করলাম বাবা।
তোমার হতভাগা মেয়ে।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ