: আমি আপনাকে বললাম, আমি আগেও বিয়ে করেছিলাম, তারপরও রাজি হলেন যে?
: করেছিলেন কিন্তু সংসার তো করেননি, আর সেটা সম্পর্কে কেউ জানেও না। কে জানে, বিয়ে ভাঙ্গার জন্য মিথ্যে বলেছিলেন কি না ..
: নিজের বিয়ে ভেঙ্গে আমার লাভ?
: হয়তো আমাকে পছন্দ হয়নি, অথবা বিয়েই করতে চান না। আজকালকার অনেক মেয়ে একটু বেশি শিক্ষিত হলেই বিয়ে করতে চায়না, একা থাকতে চায়, স্বাধীন জীবন।
: শিক্ষিত মেয়ে সম্পর্কে আপনার ধারনা তো বেশ উচ্চ!
: হা হা হা, রাগ করলেন? রাগ করলে কিন্তু আপনাকে বেশ দেখায়।
: এসব ছাড়ুন, সত্যি কথা বলুন, আপনি আসলেই সব জেনেশুনে বিয়ে করতে চান?
: জী চাই।
: কেন বলুন তো..
: দেখুন রূপকথা, আমি জানি না আপনি আসলেই বিয়ে করেছিলেন কিনা। করলে সেটা যে আপনি ইচ্ছে করে ভাঙ্গেননি সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কাজেই অন্যের দোষের দায়ভার সারাজীবন আপনাকে বয়ে বেড়াতে হবে কেন! আর আপনার একটা সময় কষ্টে গেছে, তাই বলে সারাজীবন কষ্টে থাকতে হবে সেটাও আমি মনে করি না।
কি, বেশি বড় লেকচার দিয়ে ফেললাম?
: একটু..
: আপনি কি কনভিন্স নাকি আরও লেকচার দিতে হবে?
আমি কোন কথা না বলে একটু হাসলাম, যার অর্থ দুটোই হতে পারে। আর কোন যুক্তি তর্কেও গেলাম না আশফাক সাহেবের সাথে। বুঝলাম, উনি সিদ্ধান্তে অনড়।
আজ বহুদিন পর আমি আবারও মানসিক টানাপোড়নে পড়লাম। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কি করব। একদিকে কষ্টকর স্মৃতির অলিগলি অন্য দিকে অনিশ্চিত কিন্তু সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতে। আমি সত্যিই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। শেষে সবকিছু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে বাবাকে বললাম,
: তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর বাবা, আমি নিজে নিজে কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইনা।
বাবা কি বুঝলেন কে জানে, আশফাক সাহেব আর উনার বাবার সাথে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেললেন। কথা হল এখন ছোট করে আকদ করা হবে আর আমাদের সব আত্মীয় স্বজন যারা বাইরে থাকেন, দেশে এসে পৌঁছলে হবে আসল অনুষ্ঠান।
আমার খুব অদ্ভুত লাগতে লাগল। আমার আবার বিয়ে! তবে এবার হয়তো আগের মতো আতংক, অস্হিরতা থাকবে না। থাকবে না কোন অনিশ্চয়তাও। সবকিছু নিয়মানুযায়ীই করা হবে।
আমার হবু শ্বশুর বনেদি বংশের লোক।আমার জন্য ইন্ডিয়া থেকে লাখ টাকা দামের কি এক কাতান না বেনারসী এনেছেন। সেটা বিয়ের আগেরদিন আমার হাতে দিতে আমার শ্বশুর নিজেই এলেন। শাড়িটা দিয়ে আমার মাথায় হাত রাখলেন। রেখে অনেকক্ষণ বিড়বিড় করে দোয়া পড়লেন। আমি তাকে সালাম করে ভেতরে চলে এলাম।
বিয়ের দিন সকাল হতেই বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন।
: আয় মা, বোস..
: বল বাবা
: নাশতা করেছিস?
: হুম।
: সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?
: হুম।
এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলাম। তারপর বাবাই আবার কথা শুরু করলেন।
: তুই খুব আশ্চর্য মেয়ে জানিস, এইযে এতোদিন তুই মা ছাড়া তবু কখনও তোর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করিস না।
: করলে তুমি কষ্ট পাবে তাই করিনা। তবে তুমিও তো আশ্চর্য বাবা, তুমি নিজে থেকে কখনও মার কথা বলোনা। আর বলনি যখন আজকেও বলতে হবে না।
আমি জানি মাকে নিয়ে বাবার কোন একটা গোপন কষ্ট আছে। সেটা কি এটা আমি জানি না। তবে এটুকু জানি, আমি ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মার মৃত্যু হয়। কিন্তু কি কারণে জানিনা, বাবা নিজেকে সেই অ্যাক্সিডেন্টের জন্য দায়ী মনে করেন।
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীর্ঘ সময় বিরতি নিলেন।
: তোর মা সেদিন আমার ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল, গাড়িও চালাচ্ছিল নিজেই, এজন্যই…
: থাক বাবা, আমি শুনতে চাই না।
বাবা ছোট শিশুর মতো কিছুক্ষণ কাঁদলেন। এরপর একটা চাবি দিলেন হাতে।
: এরমধ্যে তোর মায়ের সব গহনা আছে, নিয়ে পরিস।
বিয়ে উপলক্ষে ছোট খালা, ফুপু- ফুপা, চাচা সবাই এসেছে। ছোট ছোট ভাইবোন গুলো হুল্লোড় করে নানান প্ল্যান প্রোগ্রাম করছে। কিভাবে গেট ধরা হবে, কত টাকা নেওয়া হবে, বরের জুতা কোথায় লুকানো হবে আরও কত কি। ওদের আনন্দ দেখতেও ভালো লাগছে।
দুপুর হতেই ছোট খালা তাড়া দিলেন।
: কি রে, তুই এখনও বাসি কাপড়ে যে! তারাতারি চল, তোকে গোসল করিয়ে দেই।
আমার হাজার বারন সত্ত্বেও ছোটখালা, ফুপু মিলে ঘন্টা খানিক সময় নিয়ে গোসল করিয়ে দিলেন। আমি শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমার ঘরে এলাম। আমার শ্বশুরের দেওয়া শাড়িটা যত্ন করে নিজে নিজেই পরলাম। মায়ের আলমারিটা খুলে গহনাও বের করলাম।
মার আলমারিটা জিনিসপত্রে ঠাসা। একটা সময় হয়তো সব মা’র জিনিসই থাকতো, এখন সব আমার জিনিসপত্র। আমার ছোটবেলার জামা কাপড় থেকে শুরু করে এখনকার অনেক কিছুই আছে। সেসব জিনিসপত্র ঘাটতে গিয়ে গত চার বছরে আমার কাছে আসা চিঠি, উপহার, পার্সেল সেগুলোও পেলাম। বাবা কোনটা খুলেও দেখেননি। যখনই কোন কিছু এসেছে, আমাকে টেলিফোনে জানিয়ে এখানেই জমা করে রেখেছেন।
অনেক গুলো চিঠি পেলাম। বেশিরভাগই ক্লাসের মেয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে এসেছে। কোনটা বিয়ের দাওয়াত আর কোনটা কুশলাদি, খবরাখবর জানতে চেয়ে। এসব দেখতে দেখতে বড়সর একটা প্যাকেটের ওপর চোখ আটকে গেল। উপরে শুধু একটা নাম লেখা “রূপকথা” । বোঝাইযাচ্ছে হাতে হাতে এসেছে প্যাকেটটা। আর হাতের লেখাটাও আমার খুব চেনা।
কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেটটা ছিড়লাম। ভেতরে আমার সেই ছাই রঙা জামদানী। এখনও সেরকমই আছে, একদম নতুনের মতো। শাড়ির ভাঁজটা আলগা হতেই ভেতর থেকে একটা কাগজ মাটিতে পড়ল।
প্রিয় রূপকথা,
জানিনা তুমি কবে, কখন, কোন অবস্থাতে চিঠিটা পড়ছো তবে পড়ছো যে এটা নিশ্চিত। কেননা তোমার হাতে পৌঁছানোর জন্য শফিক কে দিয়ে তোমার বাসায় পাঠিয়েছি। কাজেই আশা করছি, চিঠিটা কখনও না কখনও তোমার হাতে পড়বেই।
আচ্ছা রূপকথা, তুমি কি বলতে পারবে, তোমার সাথে আমার প্রথম কবে দেখা হয়েছিল? আমি শতভাগ নিশ্চিত যে তুমি বলতে পারবে না।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য মাত্র সেদিনই ঢাকা শহরে এসেছিলাম। আমাদের গ্রামের একলোকের বড়ভাই দয়াপরশ হয়ে তার বাসায় কয়েকদিন থাকতে দিয়েছেন। কথা হয়েছে, হলে সীট পেলেই চলে আসব।
ভর্তির জন্য ক্যাম্পাসে গিয়েছি। অফিস রুমের সামনে বসে ফর্ম ফিলআপ করলাম। জমা দিতে যাব, সেই সময়ে দেখলাম তোমাকে। হাতে ফর্ম নিয়ে অস্হির হয়ে দাঁড়িয়ে আছো। পাশে এক ভদ্রলোক খুব সম্ভবত তোমার বাবা ড্রাইভারের সাথে রাগারাগি করছেন। একটু কাছে যেতেই শুনতে পেলাম, ড্রাইভার কে কলম কিনতে পাঠানো হয়েছিল, সে এমন একটা কলম এনেছে যেটা লিখছে না। এদিকে অফিসও বন্ধ হবার সময় হয়ে গেছে, অথচ তুমি ফর্ম ফিলআপ করতে পারছো না, এই নিয়েই রাগারাগি।
আমি এগিয়ে গিয়ে তোমার হাতে কলম দিলাম। তুমি কোনরকম একটা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে তারাতারি ফর্ম পূরণ করতে বসে গেলে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখলাম। কি অসম্ভব মায়াবতী যে তোমাকে লাগছিল তা বলার বাইরে।
ক্লাস শুরু হবার পর দেখা গেল তোমার আর আমার দুনিয়া সম্পূর্ন আলাদা। তোমাকে ঘিরে সবাই পঙ্গপালের মতো ওড়াওড়ি করে। আর উড়বেই বা না কেন, একে তো বিশাল গাড়ি নিয়ে আসো, তারওপর মারাত্মক রূপবতী। তোমার আশেপাশে থাকার অনেক চেষ্টা করেও প্রথম দুই বছর তো তোমার চোখেই পড়তে পারলাম না।
থার্ড ইয়ারে কি মনে করে তুমি আমাকে লিফট দিতে ডাকলে। বোধহয় দয়া করেই হবে। কেননা ততোদিনে ক্লাসের সবাই জেনে গেছে আমি কত গরীব ঘরের সন্তান, সারাদিন টিউশনি করে খরচ চালাই।
বুঝতে পারছিলাম তোমার কাছে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না তবু আগুন যেমন পতঙ্গ কে টানে, তেমনি তুমিও আমাকে টেনে নিয়ে গেলে। প্রথম দিনেই মনে মনে তোমার নাম দিয়ে দিলাম, রূপু, রূপকথা থেকে শর্টকাট, যে নাম ধরে শুধু আমিই তোমাকে ডাকব, আর কেউ না।
কিন্তু একটা সময়ে আস্তে আস্তে বুঝলাম তুমিও আমার প্রতি দূর্বল, তখন তোমাকে বারবার ফেরানোর চেষ্টা করলাম। নিজেও দূরে থাকবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। আর এর পরের ঘটনাগুলো তো তুমি জানোই।
তুমি জাপান যাবার পর প্রথম কিছুদিন ভালোই চলছিল। প্রতিদিন অফিস করা, অফিসে গিয়েই তোমাকে মেইল করা, ফিরতি মেইল পড়া। আমি যেন সুখের স্বপ্নে ভাসছিলাম। কিন্তু আমার সেই সুখের মাঝে আচমকাই ছন্দপতন হল। হঠাৎ করেই একদিন অফিসে পেট ব্যাথার সাথে বমি করলাম। এরকম আগেও মাঝে মাঝেই হতো। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া তো করতাম না আগে থেকেই। ভাবতাম অরুচি আর সেজন্যই হয়তো দিন দিন ওজনও কমে যাচ্ছিল। আর আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ছিল সেটা তো জানোই। তবে এবারের বমি করাটা সাধারণ ছিল না।
বাধ্য হয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হল। কিসব নানান হাবিজাবি টেস্ট করার পর ডাক্তার বললেন, শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে।ছড়িয়েও গেছে অনেক খানি। খুব চেষ্টা করলেও বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারব না।
আমার মাথায় কেমন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মা, দুটো বোন, বোনের বাচ্চা এদের কে আমি কার কাছে রেখে যাব! তারচেয়েও বেশি মনে হল তোমার কথা। কত আগ্রহ নিয়ে তুমি আমার কাছে এলে অথচ কাছাকাছি থাকাই হলো না!
কয়েকদিন প্রচন্ড অস্হিরতায় কাটালাম। তারপর একটা সময় শান্ত হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, তোমাকে জানাব না। জানালে তুমি হয়তো ছুটে চলে আসবে, শেষ কটা দিন আমার কাছে থাকার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে শুধু তোমার ভবিষ্যতটাই নষ্ট করা হবে, আমাকে তো ধরে রাখতে পারবে না। আমার শেষ কয়টা দিনের সুখের জন্য বাকি জীবন তোমাকে বিধবা থাকার দুঃখ আমি দিতে পারবো না রুপু। তাই বিয়ের মিথ্যে গল্প ফাঁদলাম। আর ছবির মেয়েটা আমার খালাতো বোন, শুধু বোনই সে, আমার বৌ নয়।
তবে শেষের দিকে খুব কষ্ট লাগছে রূপু। স্বার্থপরের মতো সত্যিই তোমাকে পাশে পেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সব ইচ্ছার কি মূল্য দিতে হয়, না দেওয়া উচিত বল।
যাইহোক, তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো, যতটা ভালো থাকা তুমি কল্পনা করতে পারো, তারচেয়েও অনেক বেশি ভালো।
আর আমার রূপকথার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা।
সোহেল
পড়তে পড়তে চোখের জলে কখন যে গলা বুক ভিজে গেছে টেরই পাইনি। লাখ টাকার বেনারসী তেও জলের দাগ লেগে গেল। তবু সেই বেনারসী গায়ে জড়িয়ে আমি প্রাণপণে বুকে জাপটে ধরলাম আমার সেই তেত্রিশ শো টাকার জামদানী, আমার অসম্ভব ভালোবাসার জিনিস। চোখ ভরা জল নিয়েই নিচ থেকে ভাইবোনদের আনন্দের চিৎকার শুনতে পেলাম..
বর এসেছে, বর এসেছে….
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক