নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৫৮.
ঘড়ির কাটা দশটা পেরিয়েছে। রান্নাঘরের দরজায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে নীরা। আজ বিকেল থেকে মাথা ঘোরানোর ব্যামোটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে জাহানারার।কিছুক্ষণ পর পরই চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছেন তিনি। দুই তিনবার মুখ ভরে বমিও করেছেন। তবুও নিজের জেদ বজায় রেখে একা হাতে যাবতীয় কাজ সামলাচ্ছেন সেই সন্ধ্যে থেকে। নীরার পেছনে অসহায়মুখে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। কিছুক্ষণ পরই টেলিভিশনে দূর্দান্ত ক্রিয়েট ম্যাচ টেলিকাস্ট হবে। মাকে এই অবস্থায় রেখে টেলিভিশন অন করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না অয়ন। নীরা মিনমিন করে বলল,
‘ আপনার শরীর খারাপ মা। আপনি ছাড়ুন, আমি করছি।’
জাহানারা জবাব দিল না। ফ্যাকাশে চোখমুখ নিয়েই পানির কল খুলে হাঁড়ি-পাতিল ধোঁয়ায় মনোযোগ দিল। জাহানারার গম্ভীর মুখভঙ্গি দেখে আরও একবার অনুরোধ করার সাহস পেল না নীরা। বেশ কিছুক্ষণ পর ধৈর্যহারা হয়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আনিসুল সাহেব। তাঁকে রান্নাঘরের দরজার কাছে আসতে দেখেই নিজেকে আরও একটু গুটিয়ে নিল নীরা। শশব্যস্তভাবে মাথায় আঁচল টেনে নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল এক কোণায়। আনিসুল সাহেব রাগত কন্ঠে ধমকে উঠে বললেন,
‘ রাখো তুমি এসব। ছেলেদের জন্য বহু খেটেছ আর দরকার নেই। কামাই করে, রেঁধে বেড়ে খেতে পারলে খাবে নয়তো খাবে না। তুমি কেন কাজ করবা সারাদিন? আমি রোজগার করি না? ছেলে ছেলে করে মরে যাও। কোথায় এখন তোমার ছেলে? মাঝরাতেও বাড়ি ফেরার নাম নেই। বিয়ে করে বহু সেয়ানা হয়ে গিয়েছে আজকাল।’
আনিসুল সাহেবের ধমকা-ধমকির মাঝেই বাড়ি ফিরল অন্তু। ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে আসছে তার। রাত নয়টা পর্যন্ত ভার্সিটি লাইব্রেরিতে পড়াশোনা সেড়ে, নাদিমের সাথে দুই কাপ চা আর সিগারেট ধরিয়েছিল অন্তু। বন্ধুর সাথে পারিপার্শ্বিক আলাপচারিতায় চোখের পলকে কেটে গিয়েছে দীর্ঘ এক ঘন্টা। দশটার দিকে রওনা হয়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বাজল এগারোটা। সারাদিনের অভুক্ত শরীরে সিগারেট খাওয়ায় পাক দিয়ে ধরছে পাকস্থলীর নিম্ন ভাগ। মাথায় ঘুরছে পরীক্ষা, চাকরী, সংসার নিয়ে হাজারও চিন্তা। বাইকে তেল শেষ অথচ হাতে টাকা নেই। ছোঁয়ার বিয়ের জন্য উপহার আরও কত খরচা। অথচ আয়ের উৎসে পকেট খালি। এমন একটা মানসিক চাপের মাঝে বাড়ির এই হৈ-চৈ ভীষণ তিক্ত লাগল অন্তুর। ক্লান্ত শরীরে দাঁড়িয়ে থেকে আনিসুল সাহেবের তিক্ত খোঁটাগুলো হজম করল। কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করার চেষ্টা না করে রান্নাঘরে ঢুকল সে। জাহানারার হাত থেকে হাঁড়ি পাতিল সরিয়ে নিয়ে আচমকাই মাকে পাঁজা কোলে করে বেরিয়ে এলো। জাহানারা চমকে উঠলেন। বিস্মিত হলেন। অন্তু মাকে বসার ঘরের সোফায় বসিয়ে দিয়ে ফ্লোরে বসল। জাহানারার একহাত ধরে ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
‘ কি করতে হবে বলো, আমি করে দিচ্ছি। আমার বউ ছুঁলে সমস্যা। আমি ছুঁলে তো সমস্যা নাই আম্মা।’
জাহানারা জবাব না দিয়ে হাত টেনে নিলেন। অন্তু হাতটা আবারও নিজের হাতে নিয়ে বলল,
‘ সারাদিন খাই নাই আম্মা। তুমি তো জানোই তোমার ছেলে ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। বাড়ি ফিরে যদি তোমাকে এই অবস্থায় দেখি তাহলে কী আর খেতে ইচ্ছে করে বলো? ইরার ওভাবে কথা বলা অন্যায় হয়েছে। কিন্তু ইরা অন্যের বাড়ির মেয়ে আম্মা। সে অন্যায় করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার তো আমার নাই। কাজটা যদি ইরার জায়গায় নীরা করত তাহলে ভিন্ন কথা। আমার বউ আমার মাকে অপমান করলে আমি চুপ করে থাকব না। আমি বলছি না নীরা নির্দোষ। নীরার উচিত ছিল ইরার ভুল শুধরে দেওয়া। ও বুঝে উঠতে পারে নাই। এবারের মতো ওকে মাফ করে দাও।’
শেষ কথাটা বলে নীরার দিকে তাকাল অন্তু। অন্তুর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে দুই কদম এগিয়ে এলো নীরা। মৃদু বিনয়ী কন্ঠে বলল,
‘ ইরার বেয়াদবির জন্য আমি সরি মা। আমি ইরাকে বকাবকি করেছি। ওকে এ বাড়িতে আসতেও নিষেধ করেছি। ও আর এখানে আসবে না। আপনি এবারের মতো মাফ করে দিন। আর কখনও এমনটা হবে না।’
জাহানারা উত্তর না দিয়ে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। অন্তু বায়না ধরা কন্ঠে বলল,
‘ আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ। নীরার মাফ চাওয়াতে সেই কষ্ট কমে যাবে না। তবুও বলছি রাগ করে থেকো না আম্মা। আমি রাগের মাথায় কত কি করে বসি। তুমি কষ্ট পাও আবার মাফও করে দাও। নীরা তো আমারই বউ। তোমার ছেলের বউ তো তোমার মেয়েই হলো। এবারের মতো মাফ করে দাও। ও আর কখনও তোমায় অসম্মান করে কথা বলবে না। নীরা?খবরদার আম্মাকে অসম্মান করে কোনো কথা যেন না বলা হয়। আমার আম্মা কষ্ট পেলে কিন্তু আমি কাউকে ক্ষমা করব না। মনে থাকবে?’
নীরা মাথা হেলিয়ে সায় জানাল। জাহানারার চোখ টলমল করে উঠল। চোখের জল ঢাকতে ধমক দিয়ে বললেন,
‘ হয়েছে। এখন এতো ঢং না করে তোর বউকে বল খাবার দিতে। খেয়েদেয়ে ঘুমা। আম্মার জন্য এতো দরদ দেখাতে হবে না।’
অন্তু হেসে ফেলল। নীরাকে খাবার দিতে ইশারা করে জাহানারার হাত ধরে রেখেই বলল,
‘ তোমার সঙ্গে খাব। নীরা বলল তুমি নাকি ভাত, ঔষধ কিচ্ছু খাও নাই।’
টেবিলে খাবার দিতে দিতে মা-ছেলের দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল নীরা। জাহানারা যেমন শাশুড়ীই হোক, মা তো মা-ই হয়। মাঝেমাঝে এই মায়েরা বড় অভিমানী হয়। এক আকাশ অভিমান জমিয়ে রাখে সন্তানের একটু পরোয়া, একটু আদর পাওয়ার আশায়। সন্তানের একটু হাসিতেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয় সেই অভিমানের পাহাড়। চোখ টলমল করে। টলমল করে মা সত্ত্বাও। ইরা এখানে উপস্থিত থাকলে আবারও অশান্তি করত। নীরাকে মাফ চাইতে দেখে রাগারাগি করত। কিন্তু নীরার আনন্দ হয়। ইরার মতো প্রতিবাদী চিন্তা তার আসে না। এতটুকু মাথা নোয়ানোর ফলে যদি সংসার শান্ত হয় তবে তাতেই তার আনন্দ। এতটুকু মাথা নোয়ানোর ফলে যদি কোনো মা একটু তৃপ্ত হয় তবে এই মাথা নোয়ানোই তার শ্রেয়। পৃথিবীর সবার কি ইরা, নম্রতার মতো প্রতিবাদী হওয়া সাজে?
খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘরে যেতেই নীরার উপর চোখ পড়ল অন্তুর। নীরা শাড়ির আঁচল একপাশে তুলে দিয়ে বিছানা ঝাড়ছিল। অন্তুর অবাধ্য চোখ প্রথমেই গিয়ে থামল নিষিদ্ধ কোনো জায়গায়। অন্তু কেশে উঠল। তাড়াহুড়ো করে চোখ সরিয়ে নিতেই চোখ ফিরিয়ে তাকাল নীরা। অন্তু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ঘাড় চুলকাল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বিছানায় গিয়ে বসল। কন্ঠে গাম্ভীর্যতা এনে বলল,
‘ শাড়ি পরার কি দরকার?’
নীরা বিছানা তৈরি করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চুলগুলো হাত খোঁপা করতে হাত উঁচু করতেই ফিনফিনে শাড়ি সরে গিয়ে দৃশ্যমান হলো ফর্সা উদর। অন্তু কপাল কুঁচকে আয়নার দিকে চেয়ে রইল। আয়নার ভেতর দিয়েই চোখে চোখ পড়ল। নীরা অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
‘ মা বলেছে।’
অন্তু চোখ সরিয়ে নিল। শার্ট পাল্টে বিছানায় আসতেই ডাকল নীরা। অন্তু চোখে-মুখে জিজ্ঞেসা নিয়ে বলল,
‘ হুম?’
নীরা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। বহু দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে অসহায় চোখে তাকাল। অন্তু টি-শার্টের উপরের বোতাম খুলে কলারটা একটু ঠেলে দিয়ে আনমনে বলল,
‘ কি হলো?’
নীরার চোখ আটকাল অন্তুর বুকে। পেটানো শরীরে লোমশ বুক আর শ্যামবর্ণ গলদেশের দিকে চেয়ে আচমকায় বলে উঠল,
‘ ভালোবাসি।’
জীবনে প্রথমবার, এতো কসরত, এত আকাঙ্খা, এত অপেক্ষার পর নীরার বলা কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না অন্তুর। অমনোযোগী অন্তু চট করে মনোযোগী হয়ে উঠল। চোখ তুলে নীরার দিকে চেয়ে চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করল,
‘ কী?’
নীরার চোখ টলমল করছে। টলমলে চোখে তার আবেদনময়ী চাহনী। সেই সর্বনাশা চাহনির দিকে চেয়ে বুক শুকিয়ে এলো অন্তুর। অবাধ্য চোখদুটো জোরপূর্বক নেমে এলো অর্ধাঙ্গীর লতানো দেহে। পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিয়ে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ল অন্তু। ধরফর করা বুক নিয়ে কপাল কুঁচকাল। কপালে ডানহাত রেখে চোখ বন্ধ করল। ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
‘ কাল কথা বলি। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে, ঘুমাব। আলোটা নিভিয়ে দিলে ভালো হয়।’
_
রাত প্রায় দুটো। রাতের নিজস্ব ঝিমঝিম শব্দে ভরে উঠেছে চারপাশ। খাবার ঘরে গ্লাসে পানি ঢালল কেউ। বাবার রুমের ক্যাটক্যাটে ফ্যানটা বিশ্রী শব্দ দিচ্ছে। এই সবটাই অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘরটিতে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনল নম্রতা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কিছুক্ষণ ভূতগ্রস্তের মতো বসে রইল। তারপর ফোনটা নিয়ে এলার্ম বন্ধ করল। আরফানের ডিউটি শেষ হওয়ার কথা একটায়। সেই অনুযায়ীই দুটোই এলার্ম দিয়ে রেখেছিল নম্রতা। ঘুমটা খানিক কেটে যেতেই আরফানের নাম্বারে ডায়াল করল নম্রতা। প্রথম দফায় বিজি দেখিয়ে দ্বিতীয় দফায় ওয়েটিং দেখাল লাইন। নম্রতার কপাল কুঁচকে এলো। এতোরাতে কার এতো দরকার পড়ল আরফানকে? নম্রতা অপেক্ষা করল। দুই মিনিট পর ডায়াল করতেই আবারও ওয়েটিং দেখাল ফোন। নম্রতার মাথায় আসা খারাপ চিন্তাগুলো ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল নম্রতা। তৃতীয় বারে ফোন রিসিভ করল আরফান। নম্রতা মন খারাপ ভাবটা উড়িয়ে দিয়ে উচ্ছল কন্ঠে বলল,
‘ কি করছিলেন ডক্টর সাহেব?’
আরফান ছোট্ট করে উত্তর দিল,
‘ কিছু না। আপনি?’
নম্রতার মনটা একটু চুপসে গেল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম। আপনার সাথে কথা বলব বলে দুটোয় এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম জানেন?’
আরফান হাসল।
‘ এত কষ্ট না করে সকালে কল দিলেই হতো।’
‘ সকালে কল দিলে হবে কেন? আমার কত কথা জমা আছে জানেন? এগুলো আজ না বললে পেটের ভাতই হজম হবে না আমার।’
‘ আচ্ছা, বলুন।’
আরফানের আগ্রহহীন কন্ঠে ভেতরটা মোচড়ে উঠল নম্রতার। সে এতো আগ্রহ নিয়ে বসে ছিল অথচ আরফানের কোনো আগ্রহ নেই? আরফান কি খুব বেশি ক্লান্ত? আরফান ক্লান্ত ভেবে নিজেকে সামলে নিল নম্রতা। মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ আপনি মাত্র ফিরলেন। খুব ক্লান্ত বোধহয়। আপনি এখন রেস্ট নিন। আমি কথাগুলো কালই বলব।’
আরফান সাথে সাথেই বলল,
‘ আচ্ছা।’
নম্রতার হঠাৎই দুনিয়া ভেঙে কান্না পেয়ে গেল। আরফান হাজার ক্লান্ত থাকলেও এভাবে কথা বলে না। এতো অবহেলা ভরে তো কখনও না। ভয়ানক রেগে থাকলেও না। তবে আজ কেন? নম্রতা মন খারাপ করে ফোন রেখে দিল। বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও চোখে ঘুম ধরা না দেওয়ায় আবারও আরফানের নাম্বারে কল করল নম্রতা। কি আশ্চর্য! আবারও ওয়েটিং! নম্রতা শুয়া থেকে উঠে বসল। অনুভূতিশূন্য চোখে চেয়ে রইল তারাহীন অন্ধকার আকাশে। বেশকিছুক্ষণ পর আবারও কল করল নম্রতা। এবার সীম বন্ধ। নম্রতার মস্তিষ্কে হঠাৎই একটি অদ্ভূত প্রশ্ন জাগল, আরফান কী তার কলে বিরক্ত হয়েই ফোন বন্ধ করল? নম্রতা কী খুব বিরক্ত করে তাকে? কই! আরফান তো কখনও বলেনি। নম্রতা ফোনটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় গা এলাল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই আবারও এক বিষাক্ত ভাবনা উঁকি দিয়ে গেল মাথায়, এতোরাতে কার সাথে কথা বলছিল আরফান? নম্রতা মনেপ্রাণে ভাবতে লাগল, নিশ্চয় কোনো ফ্রেন্ড অথবা হসপিটালের কোনো কলে ছিল আরফান। ফোনে ওয়েটিং থাকা কোনো বড় ব্যাপার না। প্রয়োজন তো থাকতেই পারে। পরমুহূর্তেই কুটিল মস্তিষ্ক প্রশ্ন ছুঁড়ল, এত রাতে আরফানের ফোনে ফ্রেন্ডের কি কাজ? কি এত কথা যে এতোবার কল দিতে হয়? নম্রতার মাথা ঘোরাতে লাগল। নিজের চিন্তাকে যথাসম্ভব ইতিবাচক করার চেষ্টা চালাল সে। ইশ! একটা ঘুমের ঔষধ হলে বেশ হতো!
#চলবে….
[ রি-চেইক করা হয়নি। ]