নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৬৭.
জীবন কখনোও রূপকথা হয় না। সুন্দর সকাল গুলো সবসময়ই স্বপ্নের মতো রঙ মাখায় না। প্রিয় মানুষগুলো রঙ পাল্টায়। দূরত্ব বাড়ে। হঠাৎ করেই খুব দূরের বনে যায়। হয়ে যায় অপরিচিত। অভিমান বাড়ে। মান-অভিমানের পাল্লায় হারিয়ে যায় সম্পর্কের সুতো। হাসাপাতালের সামনে ঠিক এমনই এক সময়ে এসে দাঁড়াল দুই বন্ধু। নীরব অভিমান নামক ধারালো ছুরির আঘাতে আচমকায় কেটে গেল সেই সুতো। ছেঁড়া সুতোর এক কোণা ধরে কেউ একজন হতবিহ্বল কান্নায় ভেঙে পড়ল, তো কেউ অভিমানের পাল্লা নিয়ে রিকশায় হুড তুলল। কমলা রঙের দুপুরটা দাঁড়িয়ে রইল নির্বিকার। দুপুরের চোখে জল নেই। সে বুঝি জানতো এসব হবে? নম্রতা ভীষণ ক্ষোভ নিয়ে রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরটাকে দেখল। ঝুড়ি ভর্তি অভিমান নিয়ে নীরব মাথা রাখল আরফানের বুকে।
নম্রতার বিয়ের তখন দিন তিনেক বাকি। হাসপাতালের ফটকের কাছে আরফানের অপেক্ষায় ছিল সে। বিয়ের আগে উদ্দাম ঘুরে বেড়ানোর আজকেই শেষ সুযোগ। নম্রতার জেদের কাছে কাজকর্মে সাময়িক অব্যহতি দিয়ে আরফানও রাজি। হঠাৎই ফটকের কাছে নীরাকে দেখতে পেয়ে ছুটে গেল নম্রতা। চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
‘ নীরু! তুই এখানে? চেকআপ করতে এসেছিলি?’
নীরা অসন্তোষ চোখে তাকাল। নম্রতার হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে জোরপূর্বক উত্তর দিল,
‘ হু।’
নীরার বিরক্তিকে খুব একটা পাত্তা দিল না নম্রতা। চির পরিচিত চঞ্চলতা নিয়ে মুখ ফুলাল। রাগ নিয়ে বলল,
‘ কাল থেকে ফোন দিতে দিতে অস্থির হয়ে গেলাম তবু তোর খোঁজ নেই। ফোন কই রাখিস তুই?’
পরমুহূর্তেই গলার স্বর নিচু করে বলল,
‘ আচ্ছা? অন্তু তোকে কাল অ্যাবোরশন নিয়ে খুব বকাঝকা করেছিল নাকি রে? জানিস আমাকে…’
নম্রতার কথার মাঝপথেই অয়নের হাত চেপে ধরে রিকশা ডাকল নীরা। রিকশাতে উঠার প্রস্তুতি নিতেই আবারও খপ করে হাত চেপে ধরল নম্রতা। খানিকটা অবাক হয়ে বলল,
‘ আরেহ! কথার মাঝে কোথায় চললি?’
নীরা বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমার কথা বলার সময় নেই। সামনের এক ফার্মেসীতে শাশুড়ী মা আপেক্ষা করছেন। যেতে হবে।’
নম্রতা জেদ ধরা কন্ঠে বলল,
‘ উহু। এখন কোথাও যাওয়া টাওয়া হবে না তোর। কত কথা জমে আছে জানিস? অয়নকে পাঠিয়ে দে। আমি আন্টিকে ফোন দিয়ে অনুমতি নিচ্ছি। খালামণি হয়ে যাচ্ছি এই খুশিতে একটা উপহার তো তোকে দেওয়া চাইই চাই। বাসায় গিয়েই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছি সবাইকে। আম্মু কত খুশি হয়েছে জানিস? আজ তোর প্রিয় খাবারগুলো হেল্থি হেল্থি উপায়ে রান্না চলবে বাসায়। প্লিজ, বাসায় চল। প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!’
নীরা ঝাটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ তোর এসব ঢং আরফান ভাইয়ের সামনে গিয়ে কর নমু। আমার সামনে না। উনার তোকে বাচ্চাদের মতো প্যাম্পার করার ধৈর্য থাকলেও আমার নেই। সবাই তো আর আরফান ভাইয়ের মতো নয় যে তোকে খুশি করার জন্য যা চাইবি তাই করবে।’
নম্রতা অবাক হয়ে বলল,
‘ আমাদের কথার মাঝে নিষ্প্রভকে কেন টানছিস নীরা?’
‘ কেন টানব না? সোনায় সোহাগায় ভালোবাসার মানুষ পেয়েছিস। তাকে পেয়েই তো চারপাশের মানুষের সুখ-শান্তি সহ্য হচ্ছে না। পা দুটো আকাশে নিয়ে ঘুরছিস। অন্যের জীবন অগোছালো করার নিরন্তর অবসরও পেয়ে যাচ্ছিস। উনি নিশ্চয় বাহবা দিচ্ছেন? দেওয়ারই কথা। উনি তো আবার তুই বলতে অন্ধ।’
নম্রতা ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইল। প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? কী সব বলছিস? কিছু বলার হলে আমাকে বল। বারবার ওকে কেন টানছিস?’
নীরা প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ তোর ‘ওকে’ টানার ইচ্ছে আমার বিন্দুমাত্র নেই। শুধু বলব, আমার থেকে দূরে থাক। আমার সামনে এসব নাটক, ফাটক, ন্যাকামোর প্রয়োজন নেই। আমার জীবনের এতোসব সমস্যার মূলীভূত কারণটা একমাত্র তুই-ই নমু। এখন আর সহ্য হচ্ছে না, আমি ক্লান্ত। বিয়ের আগে গোপন কথাগুলো বলে ঝামেলা পাকিয়েছিস। বিয়ের পর বাচ্চার কথা। আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে কে বলেছে তোকে? আমি বলেছিলাম? কে বলেছে এতো ভালো করতে আমার? আমার ভালো আমি বুঝি। দয়া করে আমার ভালো বুঝাটা বন্ধ কর। তার আগে অন্তুর সাথে যোগাযোগটা বন্ধ কর। খবরদার ওর সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ রাখবি না তুই। সবারই সহ্যের সীমা থাকে নমু। তোরা সবাই মিলে জীবনটা নরক করে তুলেছিস আমার। তোর মতো পেট পাতলা বন্ধু থাকতে শত্রুর কী কাজ? বিশ্বাসঘাতক।’
নম্রতা হতবিহ্বল চোখে চেয়ে রইল। নীরার কঠিন কঠিন কথাগুলো মস্তিষ্কে বলের মতো ঢপ খেতে লাগল বরংবার। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। নীরা তাকে এভাবে বলতে পারল? এতো নিষ্ঠুরভাবে? নম্রতা নিজেকে ধাতস্থ করে নীরাকে বুঝানোর চেষ্টা করল। ঠিক তখনই হাসপাতালের গেইটের কাছে আরফানকে দেখতে পেল নীরা। আরফান নীরাকে দেখে মৃদু হাসল। নীরার চোখে মুখে তখন রাজ্যের বিরক্তি। নম্রতা নীরার হাতটা আবারও ধরতেই অপ্রত্যাশিত এক কাজ করে বসল নীরা। নম্রতার হাতটা প্রচন্ড ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে রিকশার দিকে এগিয়ে গেল। নম্রতাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রিকশার হুড তুলল। হঠাৎ নীরার এমন ব্যবহারে থমকে দাঁড়াল আরফান। ভ্রু কুঁচকে নম্রতার দিকে তাকাল। নম্রতা কনুই চেপে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা ধাক্কা দেওয়ায় ডানহাতের কনুইটা লেগেছে চলতি রিকশার হুডে। চামড়া কেটে রক্ত ঝরছে। আরফান নম্রতার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল,
‘ হাতটা নাড়ানোর চেষ্টা করুন নম্রতা। চামড়া কেটে গিয়েছে। শীতের দিন এই ব্যথাটুকুই কতো ভোগাবে জানেন?’
নম্রতা উত্তর দিল না। আরফান ধমক দিয়ে বলল,
‘ আপনাকে বলেছিলাম না গাড়ির কাছে দাঁড়াতে? এখানে কেন এসেছেন? বিয়ের দিন “হাত ব্যথা” “হাত ব্যথা” করে চিল্লাবেন তো খবর আছে। সম্পূর্ণ হাত কেটে দিয়ে আসব।’
নম্রতা ছলছল চোখে চাইল। কনুইয়ের ব্যথার থেকেও পীড়াদায়ক এক ব্যথা ফোটে উঠল তার চোখে-মুখে। আরফান নরম কন্ঠে বলল,
‘ আপনি দাঁড়ান। আমি গাড়িটা আনছি। ড্রেসিং করতে হবে হাতে।’
নম্রতা উত্তর দিল না। নীরার কথাগুলো এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। নীরার পক্ষেও এভাবে কথা বলা সম্ভব? সত্যিই সম্ভব? আরফান গাড়িটা পাশে দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে দিল। নম্রতা চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসল। আরফান দরজাটা লাগিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিতেই হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল নম্রতা। আরফান সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতেই চোখ তুলে তাকাল। নম্রতাকে কাঁদতে দিয়ে ডানহাতটা কাছে টেনে ড্রেসিং করল। ব্যান্ডেজটা লাগিয়ে দিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। ড্রাইভিং হুইলে এক হাত রেখে চুপচাপ চেয়ে রইল নম্রতার মুখে। নম্রতা যখন কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলল তখন হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল তাকে। খোলা চুলে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ আর কত কাঁদে? ইট’স ওকে। বন্ধুদের সাথে মনোমালিন্য হলে এতো কাঁদতে হয়?’
নম্রতা উত্তর দিল না। বার কয়েক হেঁচকি তুলে বলল,
‘ স্কুল লাইফ থেকে এখন পর্যন্ত যতটা সম্ভব হয়েছে নীরার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি আমি। নীরার যখন পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তখনও একা, একমাত্র ওর পাশে ছিলাম আমি। মানছি, ওর অনুভূতির কথা বলে দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। কিন্তু কথাগুলো বলে দিয়েছিলাম বলেই তো একে অপরকে পাওয়ার স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে ওদের। নীরা কীভাবে অতগুলো কথা শুনাতে পারল আমায়? ওর কী একটুও কষ্ট হলো না? এতোদিনের বন্ধুত্বকে চোখের পলকে বিশ্বাসঘাতক বলে ফেলল? ও কীভাবে বলতে পারল, আমি যেন অন্তুর সাথে যোগাযোগ না রাখি? অন্তু কী আমার বন্ধু নয়? কাল রাতে অন্তুও ফোন দিয়ে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিল। বকাবকি করল। নীরার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে জেনেও কেন তাকে জানাইনি ইত্যাদি ইত্যাদি। ওরা আমাকে পেয়েছেটা কী?’
আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ আপনি তো জানেন, নীরা প্রেগন্যান্ট। কনসিভ করলে মুড সুয়িং হয়। মেজাজ খারাপ থাকে। নীরাও হয়তো আপসেট ছিল। এই সময় কী এতো ভেবেচিন্তে কথা বলে? আপনি ফ্রেন্ড হয়েই যদি রাগ করে বসে থাকেন তাহলে কীভাবে হবে? ওর মানসিক অবস্থাটাও তো বুঝতে হবে তাই না? নীরা নিশ্চয় ইচ্ছে করে বলেনি। হয়ে গিয়েছে, ইট’স ওকে। আর কান্নাকাটি করে নারে বাবা।’
‘ আপসেট থাকলেই এমন হার্ট করে কথা বলতে হয়? আমি তো কখনও বলি না। তবু মানলাম ওর মন খারাপ ছিল। আমাকে যা ইচ্ছে বলেছে। বলার অধিকার আছে। কিন্তু শুধু শুধু আপনাকে টেনে কথা কেন বলল? আমি তো কখনও অন্তুকে টেনে কিছু বলি না।’
আরফান এবার হেসে ফেলল। নম্রতা চোখ মুছে সরে বসল। কপট রাগ নিয়ে বলল,
‘ একদম হাসবেন না। হাসার মতো কিছু হয়নি। ও বলে, আপনি নাকি… ‘
নম্রতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরফান। নম্রতার আহত হাতটা আলতো করে নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল,
‘ আপনার বন্ধু আমাকে নিয়ে আপনাকে কী বলেছে সেটা আপনার আর আপনার বন্ধুর ব্যাপার। সেখানে আমি কেউ নই। অন্যের বলা কথা তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে আমি শুনব না। নীরার শুনানোর হলে আমার সামনেই বলত। সে যেহেতু শুনাতে চাইনি সেহেতু আপনি বলবেন না। আমিও শুনব না। এতে নীরাকে অসম্মান করে হবে। আর আমার শ্যামলতা কাউকে অসম্মান করে কথা বলতেই পারে না। তাই না?’
নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ উহু, ভুল ধারণা। আপনার শ্যামলতা অত্যন্ত বেয়াদব। কাউকে ছেড়ে কথা বলে না।’
আরফান ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘ তা তো দেখলামই। ধাক্কা খেয়ে হাত কেটে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলেও কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। মহারাণীর সব তেজ, অভিযোগ শুধু আমার সাথে।’
নম্রতা মন খারাপ করে বলল,
‘ আমি ভীষণ রেগে আছি। নীরা ‘সরি’ না বললে ওর সাথে একদম কথা বলব না।’
আরফান হাসল। মাথা এগিয়ে নম্রতার কপালে আলতো ঠোঁট ছু্ঁইয়ে বলল,
‘ আচ্ছা। বন্ধুদের সাথে বেশি বেশি রাগ করতে নেই। তবে, অল্প অল্প রাগ করা যেতে পারে। আপনি বরং অল্প একটু রেগে থাকুন।’
নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বসে রইল, উত্তর দিল না। কিছুটা সময় নীরব কাটল। আরফান গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তা ধরেই প্রশ্ন করল,
‘ বাসর রাতে উপহার দেওয়া নাকি বাধ্যতামূলক নম্রতা? আমার এই বিষয়ে কোনো আইডিয়া নেই। আপনি বলুন, উপহারে কী চান?’
নম্রতা সিটে গা এলিয়ে উদাস কন্ঠে বলল,
‘ কী দিতে চান?’
‘ আপনি যা চাইবেন তাই।’
নম্রতা এক পলক তাকাল। স্থির চেয়ে থেকে বিড়বিড় করল,
‘ যা চাইব তাই?’
নম্রতা উত্তর না দেওয়ায় ঘাড় ফিরিয়ে চাইল আরফান। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ কী হলো? বলুন, কী চাই?’
‘ কিছু না।’
আরফান কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কিছু না কেন?’
‘ উপহারটা তোলা থাকুক। আমি ভেবেচিন্তে চাইব।’
আরফান সন্দিহান চোখে চাইল। পরমুহূর্তেই হেসে বলল,
‘ আচ্ছা। রাজা উপহারটা তোলা থাকুক। সেটা যখন চাইবেন তখনই দেব। এখন একটা পেয়াদা উপহারের কথা বলুন নাহয়।’
নম্রতা কপাল কুঁচকে হাসল,
‘ পেয়াদা উপহার আবার কী?’
আরফানের সাথে থাকা সময়টুকু হাসিখুশি কাটলেও বাড়ি ফিরেই মন খারাপ হয়ে গেল নম্রতার। রাতে থেকে থেকেই কান্না পেল। আরফান ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দেওয়ার পরও মন ভালো হলো না। প্রচন্ড অভিমান নিয়েই শক্ত এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, বিয়েতে নীরার সাথে কথা টথা কিছু বলবে না। চুপচাপ বসে থাকবে। ডাকলেও তাকাবে না। নম্রতার প্রতিজ্ঞা বেশিক্ষণ টিকল না। নম্রতাকে অবাক করে দিয়ে অন্তু-নীরা বিয়েতেই এলো না। নাদিম নিরুদ্দেশ। ছোঁয়া, রঞ্জন ভিডিও কলে শুভেচ্ছা জানালেও অন্তুর ফোনটা এলো বিয়ের দিন সকালে। ভীষণ মন খারাপ কন্ঠে বুঝাল, ‘ কিছুদিন আগে চাকরীর পরীক্ষা দিয়েছিল তার ইন্টারভিউ কার্ড এসেছে। ইন্টারভিউ ডেইট আজই। ইন্টারভিউ রেখে বিয়েতে যাওয়া যাচ্ছে না৷ এদিকে নীরাও অসুস্থ। ওকেও একা বিয়েতে যেতে দিতে পারছে না। নম্রতা যেন রাগ না করে।’
প্রায় সাথে সাথেই রাগ নিয়ে ফোন কাটল নম্রতা। তার বারবার মনে হতে লাগল, ইন্টারভিউ টিন্টারভিউ কিছু নয়। নীরার সাথে ঝগড়া হয়েছে বলেই আসছে না ওরা। পুরো বন্ধুমহলের প্রতি ক্ষোভ জন্মাল নম্রতার। সবচেয়ে ক্ষোভ জন্মাল নাদিমের উপর। হঠাৎ কেন হারিয়ে গেল সে? ছোঁয়ার বিয়েতে নাদিম বলেছিল, নম্রতার বিয়েতে মোটা অঙ্কের টাকা উশুল করবে সে। সেই টাকা ভাগাভাগি করা নিয়েই বন্ধুদের মধ্যে কত বাকবিতণ্ডা হয়েছিল সেদিন! একদম বন্ধুহীনভাবেই বিয়েটা হয়ে গেল নম্রতার। আরফানের চেষ্টায় মন খারাপ ভাবটা তাড়া না করলেও অভিমান-অভিযোগে একবিন্দু ছাড় দিল না নম্রতা। রাগ করে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করল। নীরা-অন্তুর খোঁজ টোজও রাখল না আর। কঠিন সিদ্ধান্ত, কারো সাথে কথা টথা বলবে না। একদম না।
নম্রতার বিয়ের পরে সময়গুলো যেন হাওয়ার বেগে ছুটতে লাগল। হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যেতে লাগল সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা। নতুন সংসার সামলানো। নতুন সম্পর্কেগুলোতে মানিয়ে নেওয়া এসবেই কেটে গেল বেশ কয়েক মাস। এসবের মাঝে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগটা আর রইল না। সবাই সবার মতো ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা আর এক ঝাঁক অভিমানে নম্রতাও যোগাযোগের চেষ্টা করল না। বিয়ের প্রায় চার-পাঁচ মাস পর মাস্টার্সের ক্লাস জয়েন করতে গিয়ে হঠাৎ এক খবরে থমকে গেল নম্রতা। পরিচিত এক ক্লাসমেটের কাছে জানতে পারল, নীরার বাচ্চাটা বেঁচে নেই। প্রেগ্ন্যাসির বিশ-বাইশ সপ্তাহেই মিসক্যারেজ হয়ে গেছে তার। অন্তু-নীরা কেউই এখন ঢাকায় নেই। অন্তুর চাকরিটা চট্টগ্রামে। নীরাকে নিয়ে সেখানেই তার বাস। প্রায় এক দুই মাস আগে চট্টগ্রামের এক মার্কেটে দেখা হয়েছিল তাদের। পুরো খবরটা শুনে মনটা ভেঙে গেল নম্রতার। বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যথা করে উঠল! বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। এক সময়কার মজবুত সম্পর্কগুলো চোখের সম্মুখেই শিথিল হয়ে এলো। ছিঁড়ে গেল সুতো। আঁকড়ে ধরার চেষ্টাটা আর রইলো না। ব্যস্ততা, বাস্তবতা আর মান-অভিমানের করাঘাতে জীবনের কোমল ধারাগুলো অচেনা সাগরে ডুব দিল । মিশে গেল অতলে….
#চলবে….