#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৫
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
তুর্য হাসলো। দাঁত দিয়ে নিচের ওষ্ঠ কামড়ে বলল,
-“প্রেম করতে। করবে আমার সাথে প্রেম?”
পৃথা মুখ বাঁকালো। ভেংচি কেটে বলল,
-“আপনার মতো ব্রিটিশ, আধ পাগল লোকের সাথে প্রেম করার সাথে কচু গাছের সাথে গলায় দ’ড়ি দিয়ে কতক্ষন টানাটানি করবো তাও ভালো।”
তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। বেশ দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“কিন্তু প্রেম তো তোমার আমার সাথেই করতে হবে। আমি ছাড়া তোমার কোনো গতি নেই।”
পৃথা জ্বলে উঠলো। গর্জানো কন্ঠে বলল,
-“একদম বাজে কথা বলবেন না ব্রিটিশ পুরুষ। রাত বিরাতে একটা মেয়েকে কল করে এমন নির্লজ্জ মার্কা কথা বলতে লজ্জা করছে না আপনার? আপনাকে আমি ব্রিটিশ, আধপাগল ভেবেছিলাম এখন দেখছি চড়ম অসভ্যও বটে।”
-“আমি তোমার ভাবনার চেয়েও অধিক অসভ্য মুরগির বাচ্চা। ধীরে ধীরে টের পাবে।”
পৃথা ভেংচি কাটলো। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
-“আপনার সাথে আর কথা হলে তো টের পাবো। আপনার সাথে তো আমার আর কথাই হবে না।”
তুর্য নিঃশব্দে হাসলো। ছোট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
– “আমাদের আবার দেখা হবে, কথা হবে।
এই বিশালতার আকাশের নিচে ছোট্ট একটা
ভালোবাসাময় ঘরে সুখময় সংসার হবে।”
– ( কলমে : সাদিয়া শওকত বাবলি )
তুর্যের বলা প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনলো পৃথা। হৃদয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি কড়া নাড়লো সাথে সাথেই। হৃদস্পন্দনও গাঢ় হয়ে উঠতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। তবে পরক্ষনেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো মেয়েটা। এই পুরুষ কেন এত রাতে তাকে কল করে এসব প্রেমময় বাক্য আওড়াচ্ছে? এ পুরুষ এখনও তার নিকট অপরিচিত মানবের কাতারেই পড়ে। দুজন দুজনের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা হয়ে ওঠেনি এখনও। খুব বেশিদিন হয়নি তাদের দেখা হয়েছে। তারপর থেকে একে অপরের শত্রুতাকেই বরণ করে নিয়েছিল দু’জন। হঠাৎ কি হলো মাত্র তিন চারটা দিন ধরে পরিবর্তন এলো এ পুরুষের ব্যবহারে। খুব করে ভালো ব্যবহার করছে পৃথার সাথে আবার সময়ে অসময়ে প্রমময় বাক্যবানে কাবু করার চেষ্টা চালাচ্ছে মেয়েটাকে। তাছাড়া একটু আগে কি সব বলল? কথাগুলোর শেষ লাইনে বেশ দৃঢ়তার সাথেই তো তুর্য নামক পুরুষটি তাকে জানান দিল,
-“ভালোবাসাময় ঘরে সুখময় সংসার হবে।”
পৃথার ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। তাদের সংসার কিভাবে হবে? কেন হবে? হুট করে এই অপরিচিত পুরুষের সাথে বিয়ে হবে তার? কোথা থেকে হুট করে উদয় হলো এই লোক? পৃথা কেমন হাঁসফাঁস করে উঠলো। বিভ্রান্তপূর্ণ কন্ঠে বলল,
-“আমি রাখছি। আপনি আমাকে আর কল করবেন না সাবধান।”
কথাটুকু বলেই মেয়েটা খট করে কেটে দিল কলটা। তুর্য হাসলো। মেয়েটাকে বিরক্ত এবং বিভ্রান্ত করতে বেশ ভালোই লাগছে তার। তুর্য ভাবলো আবারও কল করবে পৃথাকে, আর একটু বিরক্ত করবে। কিন্তু তার আগেই হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো আরুশ। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-“স্যার ওরা এসে গেছে।”
তুর্য পিছন ফিরে তাকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
-“কারা এসে গেছে?”
আরুশ তাড়াহুড়ো শুরু করলো। হরবরিয়ে বলল,
-“শাহিন মির্জা যে আমাদের হাতে বন্ধী তা তার দলের লোকেরা জেনে গেছে ইতমধ্যে। তার লেজ ধরেই রাজশাহী পর্যন্ত পৌছে গেছে ওরা।”
মুহুর্তেই তুর্যের চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠলো। গম্ভীর কন্ঠে সে বলল,
-“সিকিউরিটি বাড়িয়ে দে। যেটাকে যেখানে পাবি তুলে নিবি। একটা গাধার বাচ্চাও যেন রাজশাহীর মাটিতে পড়ে না থাকে।”
২১.
সুদীর্ঘ এক রাত গড়িয়ে সকালের দেখা মিলেছে। রাতের নিস্তব্ধতায় ঘেরা শহরটা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়তে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। তবে এই ব্যস্ততার মাঝে ভ’য়ং’ক’র রূপ ধারন করে আজ হা’মলে পড়েছে কিছু ভ’য়ং’ক’র শ্রেণীর লোক সমাজ। সচরাচর রাজশাহীর এমন মফস্বল শহরে স’ন্ত্রা’স কিংবা গো’লা’গুলি’র মতো ঘটনা দেখা যায় না তেমন। তবে আজ গু’লি চলেছে। তীব্র বেগে গু’লি, চিৎকার চেঁচামেচি এবং জনগনের বাঁচার হাহাকারের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে চারদিকে। আরুশকে দেখা যাচ্ছে সেই ভীর পূর্ণ গো’লা’গু’লি’ম’য় স্থানে। কাউকে কল করে সে বলছে কিছু একটা।
কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই ভীর ঠেলে বেরিয়ে এলো পরিপুষ্ট, বলিষ্ঠদেহী কিছু জনসংখ্যা। তারা বেরিয়েই দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেল। অর্ধেক লোক জনগণকে নিরপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়ার কাজে লেগে পড়লো মুহুর্ত ব্যয় না করে আর বাকি অর্ধেক নিজেদের নিকট সংরক্ষিত ব’ন্দু’ক হাতে তুলে পাল্টা গুলি ছুড়লো দুর্বৃত্তদের উপরে।
তুর্য এতক্ষন গাড়িতে বসে বসে অবলোকন করছিল আশেপাশের পরিস্থিতি। গতকাল রাতেই সে বলেছিল এ দুরাত্মা গাধার বাচ্চা গুলোকে তুলে নিতে। কিন্তু আহাম্মক গুলো তা পারেনি। ফলস্বরূপ আজ এই গো’লা’গু’লি। শুধু শুধুই সাধারণ জনগনের উপর এই ভোগান্তি নেমে এলো। এগুলোর একটাকে দিয়েও যদি কোনো কাজ হয়। তুর্য বিরক্ত হলো ভীষণ। একটু ঝুঁকে পায়ের গোড়ালির কাছ থেকে বের করে আনলো লুকায়িত এক খানা ব’ন্ধু’ক। মুখে কালো মাস্ক চাপিয়ে সে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। দুর্বৃত্তদের নিশানা করে পরপর দুটো গুলি ছুড়লো। একটা গিয়ে লাগলো একজনের ডান পায়ে এবং অন্যটা অন্য একজনের হাতে। তুর্য আরেকটা গুলি ছুঁড়তে উদ্যত হতেই পাশ থেকে শোনা গেল অতি পরিচিত কন্ঠের চিৎকারের ধ্বনি। ছেলেটা কিছুটা চমকালো। পাশ ফিরতেই আবিষ্কার করলো পৃথাকে। মেয়েটা কেমন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে তার পানেই, পড়নে কলেজের পোশাক আর পিঠে ব্যাগ। মেয়েটা বোধহয় কলেজে যাচ্ছিলো। তুর্য বিচলিত হলো, হাতে ধরে রাখা ব’ন্দু’ক’টা লুকিয়ে ফেললো প্যান্টের আড়ালে। পৃথা ভীত হলো বেজায়। এমন কোনো পরিস্থিতিতে এর আগে সে পড়েনি কখনও। এই যে সত্যিকারে ব’ন্দু’ক তাও সে আগে দেখেনি কখনও। তাই তো হুট করে সম্মুখে এত গো’লা’গু’লি, রক্তপাত, আহ’ত, চিৎকার চেঁচামেচি, লোকজনের ছোটাছুটি দেখে ভীত হয়ে পড়েছে মেয়েটা। তার উপর আবার তার সম্মুখে দাঁড়িয়েই একটা লোক গু’লি চালাচ্ছে কি দক্ষতার সাথে। পৃথার ভীতির মধ্যেই সে লক্ষ্য করলো তার সম্মুখে দাঁড়ানো এতক্ষনের গু’লি চালানো লোকটা এগিয়ে আসছে তার পানেই। মেয়েটা ভীত হলো আরও। লোকটা তার পানে কেন যাচ্ছে? তাকে গু’লি চালাতে দেখে ফেলেছে বলে বলে কি মে’রে দিবে এখন? দিতেও পারে এদের বিশ্বাস নেই কোনো। পৃথা ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। কম্পিত কন্ঠে বলল,
-“আমাকে মারবেন না প্লীজ। আমার এখনও বিয়ে করা বাকি। আমি ম’রে গেলে আমার জামাইটা বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যাবে।”
পৃথার কথায় ভ্রু কুঁচকালো তুর্য। মেয়েটা আবোল তাবোল এসব কি বলছে? মাথা ঠিক আছে তো? তুর্য আরও তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেল পৃথার পানে।
পৃথার হাঁটু কাপলো ভয়ে। এমনিই মাথা ঠিক নেই তার। মৃত্যু ভয়ে কি থেকে কি বলছে সে নিজেও জানে না। নয়তো সজ্ঞানে থাকলে এমন পরিস্থিতিতে এমন উদ্ভট কথাবার্তা অন্তত তার মুখ দিয়ে বেরুতো না। পৃথা নিজের প্রাণ বাঁচাতে পালাতে চাইলো। কিন্তু পারলো না তার আগেই তাকে ধরে ফেললো তুর্য। পৃথার কলিজা কাঁপলো। তার ভাবনা মতে মৃ’ত্যু সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তার। নাহ আর পারলো না। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত ভয়, চাপ এবং চিন্তায় মেয়েটা জ্ঞান হারাতে সময় নিল না বেশিক্ষণ। ঢলে পড়লো তুর্যের বক্ষে। তুর্য অস্থির হলো। হৃদয়ে ঝড় উঠলো। কি হয়েছে তার ছোট্ট বউটার? তুর্য বিচলিত কন্ঠে ডাকলো বউকে। বলল,
-“পৃথা! এই পৃথা, কি হয়েছে? চোখ খোলো।”
পৃথা চোখ খুললো না। তুর্যের অস্থিরতা বড়লো। সে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে বসালো গাড়ির ভিতরে। অতঃপর নিজেও সিটে বসে মেয়েটার মাথা নিল কাঁধে। আলতোভাবে কয়েকটা চাপড় দিল বউয়ের নরম গালে। আবারও ডাকলো,
-“পৃথু! এই পৃথু।”
পৃথার হুশ নেই কোনো। কথা বলছে না। তুর্য অস্থিরতায় নিজের মুখ থেকে মাস্কটা খুলে ছুঁড়ে মারলো গাড়ির পিছনের দিকে। গাড়ির ভিতরে থাকা পানির বোতল থেকে অল্প পানি হাতে নিয়ে ছিটা মারলো পৃথার চোখ মুখে। তবুও মেয়েটা চোখ খুললো না। তুর্য ভেজা হাতেই আবার আলতোভাবে কয়েটা চাপড় দিল মেয়েটার গালে। ব্যগ্র কন্ঠে শুধালো,
-“কি হয়েছে? কথা বলো বউ।”
ওদিকে গো’লা’গু’লি’ও থেমে গেছে ততক্ষণে। তুর্যের লোকেরা দুর্বৃত্তদের পুরো দলটাকে ধরে নিয়েছে স্থান পরিস্কার করে দিয়েছে। পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ অনুকূলে। কেউ এসে হুট করে বলতে পারবে না এখানে একটু আগে এত বড় গো’লা’গু’লি হয়েছে। আরুশ এসে বসলো গাড়ির ড্রাইভিং সিটে। পৃথাকে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তুর্যকে উদ্দেশ্যে করে জিজ্ঞেস করল,
-“ম্যামের কি হয়েছে স্যার?”
তুর্য পৃথার পানে দৃষ্টি রেখেই জবাব দিল,
-“গোলাগুলি দেখে ভয় পেয়ে গেছে।”
থামলো তুর্য। চোখ মুখ শক্ত করে পরক্ষনেই বলল,
-“গাধার বাচ্চা গুলোকে ততক্ষণ পেটাবি যতক্ষন না জ্ঞান হারায়। আমার বউকে ভয় দেখানো। ওদের বাপের নামই আমি ভুলিয়ে দেব আজ আমি।”
কথাটা শেষ করেই আবার ব্যস্ত ভঙ্গিতে পানি ছিটিয়ে দিল পৃথার চোখ মুখে। মেয়েটা ক্ষানিক বাদেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো। সাথে সাথেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো আবার। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
-“আমাকে মা’র’বে’ন না দয়া করে। আমি কাউকে কিছু বলবেন না।”
তুর্য দুই হাতে নিজ বক্ষের সাথে আগলে নিল মেয়েটাকে। আদুরে কন্ঠে বলল,
-“কেউ মা’র’বে না তোমাকে। আমি আছি তো।”
পৃথা বোধহয় ভরসা পেল তুর্যের কথায়। উত্তেজনা কমলো কিছুটা। তবে যখনই মেয়েটা আবিষ্কার করলো সে তুর্যের বুকে লেপ্টে রয়েছে সাথে সাথেই ছিটকে দূরে সরে গেল। লাজে গাল দুটো লাল হয়ে গেল পৃথার। ছিঃ ছিঃ সে কি এতক্ষন এক পুরুষের শরীরের সাথে লেপ্টে ছিল? এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো পৃথা। আমতা আমতা করে বলল,
-“ওখানে একটা লোক গু’লি চালাচ্ছিলো তো। তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আর কি।”
তুর্য স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক মেয়েটা তাকে চিনেনি। চিনলে হয়তো ঝামেলা হতো অনেক। এমনিই তাদের সম্পর্কের ঠিক নেই কিছু। তার মধ্যে এই যদি পৃথা কোনো মতে জেনে যেত এই গো’লা’গু’লি’র মূল সে তবে আর এ জনমে বউকে পাওয়া লাগতো না। ভাগ্যিস মাস্ক পড়েছিল। ঐ মাস্কটাই আজ বাঁচিয়ে দিল।
২১.
রাতের আঁধারে ছেয়ে গেছে চারপাশটা। চারদিক নীরব হতে শুরু করেছে একটু একটু করে। শিকদার বাড়ির সবাই রাতের খাবার খেতে বসেছে ইতমধ্যে। পৃথা খাবার নিয়ে শুধু বসে রয়েছে, খাচ্ছে না মোটেই। চোখের সম্মুখে বার বার তার ভেসে উঠছে আজ সারাদিনের ঘটনাগুলো। সারাদিনের স্মৃতিচারন করতে করতে হঠাৎই মেয়েটার স্মরণে এলো তুর্যের কথা। অমন একটা ভ’য়ং’ক’র পরিস্থিতির মধ্য থেকে ঐ লোকটাই তো তাকে বাঁচিয়েছিল। আচ্ছা এই তুর্য চৌধুরী আসলে কে? কি তার পরিচয়? পৃথার হঠাৎ মনে এলো সেদিন ছেলেটা বলেছিল তার বাবা তুর্যকে চিনে। চিনতেও পারে। তাই হয়তো তুর্য কলেজে তার বাড়ির ঠিকানা খুঁজেছিল কিন্তু সে মনে মনে ভুল ধারণায় মজেছিল। তাছাড়া পৃথার নিকটও তুর্য চৌধুরী নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে। তবে কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছে না ঠিক। পৃথা চোখ তুলে তাকালো বাবার পানে। উৎসুক হয়ে ডাকলো,
-“বাবা!”
পলাশ সিকদার খেতেই খেতেই জবাব দিল,
-“কিছু বলবে?”
পৃথা কোনো ভনিতা ছাড়াই সরাসরি প্রশ্ন করলো,
-“তুর্য চৌধুরী কে বাবা?”
চলবে…..