#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২১
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পরপর একই কন্ঠ শোনা গেল আবারও। বেশ গম্ভীর কন্ঠে এবার পুরুষটি আওড়ালো,
-“শুনলাম আমার বউকে নাকি কারা বিয়ে দিচ্ছে। তাই আমিও চলে এলাম। দেখি কার বুকে কত বড় পাটা আমার বউয়ের বিয়ে দিবে।”
উপস্থিত সবাই চমকালো। বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে এক যোগে তাকালো সদর দরাজার পানে, দেখা মিললো তুর্যের। শরীরে জড়ানো কালো শার্টের হাতাটা গোটাতে গোটাতে এলো ভিতরে। ছেলেটা আশেপাশে একবার তাকিয়ে তাকালো পৃথার পানে সাথে সাথেই থমকে গেল। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো মুহুর্তেই। কালো শাড়িতে কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। মুখে কোনো সাজ নেই, গায়ের রংটা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা অর্থাৎ তুর্যের গায়ের রঙের তুলনায় বেশ চাপা তবুও মেয়েটাকে যেন পরীর ন্যায় মনে হচ্ছে তুর্যের নিকট। ছেলেটার দৃষ্টি মুগ্ধ হলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে বউকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। অমনি একটু আগে ঠান্ডা হওয়া মেজাজটা চটে গেল আবারও। এদের কি সাহস তার দেওয়া শাড়ি পড়িয়ে তার বউকেই অন্য পাত্রপক্ষের সম্মুখে বসিয়েছে। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে একটু তুর্য একটু শান্ত করলো নিজেকে। অতঃপর গিয়ে দাঁড়ালো সোফায় বসা পাত্রপক্ষের পাশে। একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সকলের পানে তাকিয়ে পাত্রপক্ষের সাথে আসা দুই প্রবীন পুরুষকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
-“আঙ্কেল একটু চেপে বসুন। আমার ছোট খাটো দেহটা নিয়ে আপনাদের মধ্যে একটু বসার স্থান দিন।”
প্রবীন পুরুষ দুইজন ভরকে গেলেন তুর্যের কথায়। এ ছেলে আবার কে? আর হঠাৎ এসেই কেন এমন সব কথায় নেমে পড়েছে? জোর পূর্বক হাসলেন একজন প্রবীন। একটু সরে বসে বললেন,
-“বসো বাবা।”
এ পর্যায়ে আর চুপ থাকতে পারলেন না পলাশ শিকদার। কন্ঠে ক্রোধ এটে বললেন,
-“এসব কেমন ধরনের অসভ্যতামো? আর তুমিই বা এখানে কেন এসেছো?”
তুর্য পাত্তা দিল না পলাশ শিকদারের কথায়। সে বসে পড়লো সোফার ফাঁকা স্থানে। শার্টের গলার কাছের দুটো বাটোন খুলে গা এলিয়ে দিল সোফার সাথে। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“কি গরম? মনে হচ্ছে এখনই ডিমের মতো সিদ্ধ হয়ে যাব।”
থামলো তুর্য। পলাশ শিকদারের পানে তাকিয়ে বলল,
-“এত বছর রা’জা’কা’রী করে জীবনে কি করেছেন শ্বশুর মশাই? পথে ঘাটে দুই চারটা এসি লাগিয়ে রাখতে পারলেন না? আপনি জানতেন না এই পথে আপনার মেয়ের জামাই আসবে, তার গরম লাগতে পারে?”
পলাশ শিকদার দাঁতে দাঁত চাপলেন। কটমট করে বললেন,
-“চুপ থাকো বেয়াদব ছেলে। আর তুমি এখানে কেন এসেছো? আমার বাড়িতে পা রাখার সাহস তোমাকে কে দিয়েছে?”
তুর্য অবাক হওয়ার ভান ধরলো। বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলল,
-“সে কি শ্বশুর মশাই এসব কি ধরনের কথাবার্তা বলছেন? আমার বউয়ের বিয়ে আর আমি আসবো না সে কখনও হয় নাকি?”
কথাটা বলেই চোখ মুখে বিষন্ন ভাব ফুটিয়ে তুললো তুর্য। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
-“তবে আমার বউয়ের বিয়েতে আমাকে দাওয়াত না করায় আমি কিন্তু ভীষন কষ্ট পেয়েছি শ্বশুর মশাই। এই কাজটা কিন্তু আপনি একদম ঠিক করেননি।”
পিয়াস এবং পিয়াল উপস্থিত ছিল ঐ স্থানেই। তুর্যের হঠাৎ আগমন এবং এমন অদ্ভুত বাক্যে ক্ষেপে গেল দুই ভাই ই। পিয়াস শক্ত কন্ঠে বলল,
-“এসব কেমন ধরনের বেয়াদবি। এটা ভদ্র বাড়ি, ভদ্রভাবে কথা বল।”
তুর্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পিয়াসের পানে। হেঁয়ালিপূর্ণ কন্ঠে বলল,
-“এটা ভদ্র বাড়ি? ওহ আমার জানা ছিল না।”
থামলো ছেলেটা। চোখ মুখ শক্ত করে আবার বলল,
-“তা ভদ্র বাড়ির মেয়েদের বুঝি তালাক হীনা অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়? স্বামী জীবিত থাকতেও অন্য পাত্রপক্ষের সম্মুখে বসানো হয় রূপ দেখানোর জন্য?”
তুর্যের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই তার কথার উত্তর দিলেন পলাশ শিকদার। তাচ্ছিল্য করে বললেন,
-“স্বামী জীবিত অথচ স্ত্রীর কোনো খোঁজ খবর রাখেনি টানা সাত বছর। স্ত্রী বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে একটাবার জানার প্রয়োজনবোধ করেনি। তাকে কি আদৌ স্বামীর কাতারে ফেলা যায়?”
তুর্যের কন্ঠ নরম হয়ে এলো। অপরাধীর কন্ঠে বলল,
-“আমি জানি আমি ভুল করেছি তার জন্য আমি আপনাদের এবং পৃথার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। তবে এখন সেই ভুলটা শুধরে নিতে চাইছি, স্ত্রীকে আপন করে নিতে চাইছি। দয়া করে আপনারা আমার ভুল শুধরানোর জন্য একটা সুযোগ অন্তত দিন।”
পৃথা এতক্ষন চুপচাপ শুনছিলো সবটা। বোঝার চেষ্টা করছিলো কিন্তু এদের একেক জনের এক এক স্থান থেকে এক এক ধরনের কথায় বোধগম্য হচ্ছিলো না কিছুই। তার মধ্যে আবার তুর্য কি বলল, সে পৃথার নিকট ক্ষমা প্রার্থী আবার স্ত্রীকে আপন করে নিতে চাইছে। এ পর্যায়ে মেয়েটা আর নিজের ধৈর্য্য রাখতে পারলো না। উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,
-“এখানে কি হচ্ছে কেউ একটু বলবে আমাকে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
পৃথার কথা শুনে তার পানে তাকালো সবাই। হঠাৎ তুর্যের আগমনে তো তারা সবাই পৃথার কথা ভুলেই বসেছিল। মেয়েটা নিশ্চই সবটা শুনে নিয়েছে। আর লুকানো গেল না কিছু, হয়তো লুকানো টাও ঠিক হবে না। পলাশ শিকদার হাত রাখলেন মেয়ের মাথায়। শান্ত কন্ঠে বললেন,
-“তোর জীবনের অনেক কথাই এখনও তোর অজানা। আমরা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম জানতে দেইনি তোকে। ভেবেছিলাম সবটা জানলে তুই হয়তো ভেঙে পড়বি, মেনে নিতে পারবি না। আর তাছাড়া তখন তুর্যের ফিরে আসারও সম্ভাবনা ছিল না তাই জানাইনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তোকে সবটা জানানো উচিৎ। তোর জীবন সুতরাং তোর জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছু জানার অধিকার তোর আছে।”
থামলেন পলাশ শিকদার। মেয়ের মাথায় হাত রেখেই বলতে শুরু করলেন,
-“ছোট বেলা থেকেই তুর্যের মা এবং তোর মা ভীষন ভালো বান্ধবী ছিলেন। আবার আবার তাদের বিয়েও হয়েছিল প্রায় পাশাপাশি স্থানে। তুর্যদের বাড়ি এবং আমাদের বাড়ি কাছাকাছিই ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষদের ভীটে রাজশাহীতে হলেও আমরা বাসিন্দা ছিলাম রাজধানী ঢাকার। তুর্যের বাবা মায়ের বিয়েতেই তোর মাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। তারপরে তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই আর তারপরে বিয়ে।
এইটুকু বলে আবার থামলেন পলাশ শিকদার। একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করলেন,
-“পাশাপাশি বিয়ে হওয়ার দরুন তোর মা এবং তুর্যের মায়ের বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল। তারা দু’জনই চেয়েছিল তাদের ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে এই সম্পর্কটা আরও মজবুত করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তুর্যের মা তাহমিনা এবং তোর মা দুজনেরই প্রথম সন্তান ছেলে হয়। এরপরে আবারও তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে শুরু করেন দ্বিতীয় সন্তানের। কিন্তু এবারও দু’জনেই পুত্র সন্তানের জননী হন। তৃতীয় বারের বেলায় তাহমিনা আবারও পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেও আমাদের কোল আলো করে তুই এসেছিলি। তাহমিনা তখনই বলে রেখেছিলেন তোকে তার বড় ছেলে তুর্যের বউ করে নিবে। আমি তখন তোর আর তুর্যের বয়সের পার্থক্যের কথা ভেবে বিষয়টা মানিনি। তারপর আর এ নিয়ে কথাও ওঠেনি। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো যখন তোর বয়স ১০ হলে। তখন তুর্য ২০ বছরের এক তরতাজা, খামখেয়ালি যুবক। তার ঠিক যা ইচ্ছে হয় সে তাই করে বেড়ায়। এখানে সেখানে মা’রা’মা’রি, নেতাগীরি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সভা সমাবেশ সব স্থানে তুর্যের নাম। অল্প বয়সে এলাকার ছোট খাটো এক নেতাও হয়ে উঠেছিল সে। তাহমিনার ভয় বাড়ে, ছেলের এমন বখে যাওয়াকে মেনে নিতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে দিবেন ছেলের। ছেলেকে ঘরমুখো করতে এ ছাড়া নাকি আর উপায় নেই। আমার কাছে তোর হাত চেয়ে বসে তখন। আমিও তুর্যে বখে যাওয়া স্বভাব এবং তোদের বয়সের পার্থক্য ভেবে তার প্রস্তাবে সরাসরি না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহমিনার অনুরোধ এবং তোর মায়ের কান্নাকাটিতে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারিনি। তোর মাত্র ১০ বছর বয়সে এক প্রকার গোপনেই তোর বিয়ে দিয়েছিলাম তুর্যের সাথে। কিন্তু সেই কর্মটাই ছিল আমার জীবনের চড়ম ভুল। তুর্য তোকে মেনে নেয়নি। বিয়ের আসরেই তোর মুখ না দেখেই তোকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। তারপর আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম তুর্যের সাথে যোগাযোগ করার, সবটা ঠিক করার কিন্তু সে করেনি। ধীরে ধীরে বিষয়টা লোক জানাজানি হতে শুরু করলো। ফলস্বরূপ সমাজে তোর গায়েও একটু একটু করে কলঙ্ক লাগতে শুরু করেছিল। ছোট বলে তারা তোকে ছাড়া দেয়নি মা। অনেকেই কথা তুলছিলো টাকার লোভে তুর্যের সাথে তোর বিয়ে দিয়েছি অথচ তুর্যদের থেকে অর্থবিত্তে কোনো অংশেই কম ছিলাম না আমরা। শুরু হলো সমাজে তোকে হেয় প্রতিপন্ন করা। যে অল্প সংখ্যক আশেপাশের মানুষ তুর্য আর তোর বিয়েটা সম্পর্কে জানলো তারা দিন দিন হেয় করতে শুরু করলো তোকে যা বাবা হিসেবে আমি মানতে পারছিলাম না। আর আমি এও চাইনি আমার ভুলের কারনে তোর শৈশব নষ্ট হোক, তুই সবটা জেনে ভেঙে পড়িস। তাই পুরোপুরিভাবে লোক জানাজানি হওয়ার আগেই তোদের নিয়ে এলাকা ছেড়েছি আমি। ঘাঁটি গেড়েছি রাজশাহীতে।”
পৃথা সবটা শুনলো মনোযোগ দিয়ে, আঁখিদ্বয় ভরে উঠলো মেয়েটার। এখন তার কাছে সবটা পরিষ্কার। তুর্য কেন তার ঠিকানা খুঁজেছিল, কেন এতদিন তার সম্মুখে প্রেমময় বাক্য আওড়াতো সবটা পরিষ্কার। কিন্তু এই পুরুষ তো তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো, ত্যাগ করেছিল। পৃথার যে নিজের ১০ বছর বয়সে বিয়ের কথা মনে ছিল না তা নয়, ঠিক মনে ছিল। কিন্তু যখনই বাবা মায়ের কাছে এ বিষয় কিছু জিজ্ঞেস করেছে তারা বলেছে ওটা পুতুল বিয়ে ছিল, পুতুল তো কথা বলতে পারে না তাই পুতুলের হয়ে তাকে কবুল বলানো হয়েছিলো। পৃথাও আর সে বিষয়ে ততটা মাথা ঘামায়নি। তার মাথাতে একবারের জন্যও এ চিন্তা আসেনি তার মা বাবা তাকে মাত্র ১০ বছর বয়সেই বিয়ের পীড়িতে তুলে দিয়েছে। পৃথার অজান্তেই তার জীবনে এত কিছু ঘটে গেল। বিয়ে হলো, স্বামী ত্যাগী হলো অথচ সে জানতেই পারলো না। সবাই এরা সবাই মিলে তাকে ঠকিয়েছে। বাবা মা নিজেদের সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য ১০ বছরের এক মেয়েকে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর যার সাথে বিয়ে দিয়েছিল সেই পুরষটাও শুধুমাত্র নিজের কথা ভেবে তাকে ত্যাগ করে ঠেলে দিয়েছিল অন্ধকারে। কেউ তার কথা ভাবেনি একটা বারের জন্যও। যে যার নিজের স্বার্থে শুধুমাত্র ব্যবহার করেছে পৃথাকে। মেয়েটার ভাবনার মধ্যেই শোনা গেল তুর্যের কন্ঠস্বর। অপরাধীর কন্ঠে সে বলল,
-“আমি আমার কর্মের জন্য অনুতপ্ত। আমি পৃথাকে ছেড়ে গিয়ে বুঝেছি আমি কতটা ভুল করেছি। ধীরে ধীরে ভীষন বাজেভাবে আটকে গেছি ওর মায়ায়। আমি ভালোবেসে ফেলেছি পৃথাকে। তাই তো আবারও ছুটে এসেছি ওকে ফিরিয়ে নিতে।”
পৃথা পিছন ঘুরে তাকালো তুর্যের পানে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-“আপনি আমাকে ছেড়ে গিয়ে বুঝলেন আমাকে ভালোবাসে ফেলেছেন। আমার বাবা মা বুঝলো তারা ভুল করেছেন। আফসোস শুধুমাত্র আমিই বুঝলাম না আমার অগোচরে আমার কাছের মানুষগুলোর নিকট তাদের সম্পর্ক রক্ষায়, স্বার্থ রক্ষায় আমি ভীষন বাজেভাবে ঠকে গেছি।”
চলবে…..