#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩৬
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
তুর্য চোখে হাসলো। চোখ মেরে বলল,
-“খোঁজ নিয়ে দেখো তুমি ঠিক যতটা লজ্জা পাচ্ছো না ওরা তোমার এই লজ্জার থেকেও অধিক আমাদের নিয়ে ভেবে ফেলেছে।”
পৃথা কটমট করে তাকালো তুর্যের পানে। লোকটার মুখটা কি দিয়ে বানানো হয়েছে কে জানে! সর্বক্ষন উল্টা পাল্টা নির্লজ্জ ধাঁচের কথা বেরুতেই থাকে। তার বাপ মা খুঁজে খুঁজে এই নির্লজ্জ লোকটাকেই পেয়েছিল তার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য? দশ বছর বয়সে যখন বিয়ে দিয়েছে তখন একজন ভালো, সুশীল, ভদ্র ছেলের সাথে বিয়ে দিতো। তা না একটা অসভ্য, বর্বর লোকটাকে গছিয়ে দিয়েছে তার মতো এক কিশোরীর সাথে। পৃথা দাঁতে দাঁত চাপলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“আজেবাজে কথা বন্ধ করে ছাড়ুন আমাকে। মা সেই কখন খেতে ডাকছেন।”
তুর্য ছাড়ালো না পৃথাকে। দুষ্টু হেসে বলল,
-“বিয়ে করেছি সাত বছর অথচ বউকে একটা গাঢ় চু’মু খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আমার। আজ যখন একটা সুযোগ পেয়েছি, উড়ন চন্ডী বউটাও পোষ মেনে কাছে এসেছে তখন এভাবে ছেড়ে দেব? না, কখনও না। জীবন থাকতে না।”
থামলো তুর্য। ওষ্ঠ গোল করে আবার বলল,
-“শুধুমাত্র একটা চু’মু’ই তো। খেতে দাও না বউ। বেশি সময় নেব না মাত্র ত্রিশ মিনিটেই শেষ করবো পাক্কা প্রমিস।”
পৃথা বিষম খেল। চোখ বড় বড় করে তাকালো তুর্যের পানে। ত্রিশ মিনিট ধরে মাত্র একটা চু’মু খাবে তাও বেশি সময় না? সবচেয়ে বড় কথা হলো, ত্রিশ মিনিট ধরে চু’মু খেলে সে বাঁচবে? দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাবে তো। পৃথা হতবাক কন্ঠে বলল,
-“ত্রিশ মিনিট মাত্র? আর ত্রিশ মিনিট ধরে একটা চু’মু! আপনি কি মানুষ?”
তুর্য কপালে ভাঁজ ফেললো। বেশ গুরুত্বপূর্ণ অভিপ্রায় নিয়ে বলল,
-“২০১৩ সালে থাইল্যান্ডের পাটায়া শহরে এক দম্পতি টানা ৫৮ ঘন্টা ৩৫ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড অর্থাৎ প্রায় তিনদিন একে অপরকে চু’মু খেয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম চুম্বনের রেকর্ড করেছিল। সেখানে আমি বিয়ে করেও প্রায় সাত বছর “চু’মু অনাহারে” কাটানোর পর বউকে মাত্র ত্রিশ মিনিট ধরে একটানা চু’মু খেতে চেয়েছি। এই সময়টা কি তোমার নিকট খুব বেশি নাকি?”
পৃথা বিস্মিত হলো। টানা ৫৮ ঘন্টা ৩৫ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড এত লম্বা চু’মু ছিল? কোন দম্পতি এই চু’মু খেয়েছে? তারা মানুষ তো নাকি অন্য কোনো গ্রহের প্রানী মানুষের রূপ ধরে পৃথিবীতে হানা দিয়েছে? পৃথা বিস্মিত সুরেই প্রশ্ন করলো,
-“এরা কি এই প্রায় তিন দিন খাওয়া দাওয়া ছেড়ে চু’মু খেয়েছিল? ওদের পেটে ক্ষুধা লাগেনি? গলায় পানির পিপাসা লাগেনি? ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি? আচ্ছা ওরা বেঁচে আছে তো?”
তুর্য মাথা ঝাঁকালো। বিশ্বাসের সহীত বলল,
-“অবশ্যই বেঁচে আছে। এখন তুমিও আমাকে এক খানা চু’মু দিয়ে বাঁচিয়ে দাও।”
কথাটা বলে থামলো তুর্য। ভাবুক ভঙ্গিতে আবার বলল,
-“ত্রিশ মিনিট একদম কম হয়ে গেছে। দীর্ঘ সাত বছর চু’মু অনাহারে থাকার পর আমার অন্তত এক টানা সাত দিন চু’মু খাওয়া উচিৎ। নয়তো এই চু’মু’র দুনিয়ায় আমার মান ইজ্জত বলে আর কিছু থাকবে না।”
পৃথা হতবাক হলো। চু’মু’র দুনিয়া আবার কোন দুনিয়া! বাপের জন্মে তো এই নাম শোনেনি সে। লোকটা কি পাগল টাগল হলো নাকি ? অবশ্য এ নতুন করে আর কি পাগল হবে। এ তো আগে থেকেই পাগল, বদ্ধ উন্মাদ।পৃথার ভাবনার মধ্যেই তুর্য নিজের প্রথম চু’মু খাওয়ার প্রস্তুতি নিল। ধীর গতিতে নিজের ওষ্ঠ এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলো মেয়েটার ওষ্ঠের নিকট। ভরকে গেল পৃথা। হৃদয়ে কড়া নাড়লো সাত দিনের চু’মু’র প্রসঙ্গটা। প্রথম ত্রিশ মিনিট চু’মু’র ব্যাপরটা শ্রবণেই তো তার মাথা ঘুরে উঠেছিল তার আর এখন সাত দিন? পৃথার মাথা ঘুরে উঠলো। এই চু’মু খেতে গিয়ে নিশ্চিত তাকে উপরে চলে যাওয়ার টিকিট কাটতে হবে। তারপর বাংলাদেশের পেপার পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল গুলো বড় বড় করে তাদের শিরোনামে লিখবে
-“চুমু খেতে গিয়ে মৃ’ত্যু তুর্য এবং পৃথা নামক এক দম্পতির।”
ব্যস মান ইজ্জত সব মাটিতে। জীবন থাকতে তো এই ব্যাটার জ্বালায় মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি লাগতো মিনিটে মিনিটে। এই যেমন একটু আগে ইরার সম্মুখে লেগেছিল। তারপর যদি আবার চু’মু খেতে গিয়ে মৃ’ত্যু হয় তাহলে মান ইজ্জত পেপার, পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলে গড়াগড়ি খাবে। উপরে বসে বসেও এই লোককে বিয়ে করার জন্য কপাল চাপড়াতে হবে পৃথার। নিজের কল্পনায় নিজেই শিউরে উঠলো পৃথা। দ্রুত নিজেকে তুর্যের বাঁধন থেকে মুক্ত করতে ব্যস্ত হলো। কিন্তু পারলো না। তুর্যের মতো অমন এক হাতির মতো মানবের শক্তির সাথে পৃথার মতো পিঁপড়ার কি পেরে ওঠা সম্ভব নাকি? তবে নিজেকে ছাড়াতে তো হবেই নয়তো নির্ঘাত সাত দিনের চু’মু’তে টিভি চ্যানেলের শীর্ষে চলে যাবে। পৃথা আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরালো, হুট করেই নিজের পা দ্বারা আঘাত করলো তুর্যের পায়ে। আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে উঠলো তুর্য। অসাবধানতাবশত হাতের বাঁধনটাও আলগা হলো। ব্যস এই সুযোগ। পৃথা নিজের দুই হাত তুলে ধাক্কা মারলো তুর্যকে। সব দিক মিলিয়ে টালমাটাল হারালো বেচারা, নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পেরে ঠাস করে বসে পড়লো মেঝেতে। তুর্য যেন মেঝেতে নয় আকাশ থেকে পড়লো মাত্রই। বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
-“বউ তুমি আমাকে ফেলে দিলে? এক প্রকার মা’র’লে আমাকে? তাও কি একটা চু’মু খেতে চেয়েছি সেই অপরাধে?”
কথাটা বলেই তুর্য নিজের কপাল চাপড়াতে শুরু করলো। আহাজারি করে বলল,
-“আল্লাহ! কি কলিযুগ এলো রে দুনিয়ায়। বউ একটা চু’মু খেতে চাওয়ার অপরাধে শেষ পর্যন্ত মা’র’লো আমাকে। এই মুখ আমি এখন আমি লোকসমাজে কিভাবে দেখাবো? কিভাবে?”
প্রথম তুর্যকে পড়ে যেতে দেখে খারাপ লেগেছিল পৃথার। সে এত জোরেও ধাক্কা মা’রে’নি যে পড়ে যাবে তবুও পড়েছে। একটু সহানুভূতিও দেখাতে চেয়েছিল মেয়েটা স্বামীর প্রতি কিন্তু এই মুহূর্তে এর কথা শুনে সহানুভূতি তো দূরে থাক আরেকবার জোরেশোরে ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। পৃথা কটমট করে তাকালো তুর্যের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“নাটকবাজ একটা।”
তুর্যের আহাজারি বাড়লো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
-“ছিঃ ছিঃ বউ তুমি আমাকে এত বড় একটা অপবাদ দিতে পারলে? আমি নাটকবাজ!”
পৃথা হতাশ হয়ে তাকালো তুর্যের পানে। এই লোক ঠিক কোন ধাতু দিয়ে বানানো সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। তবে এর সাথে এই মুহূর্তে আর কিছু বলে হয়তো লাভ হবে না কোনো। সে যাই বলুক না কেন তা নিয়ে এই লোক টানা হেঁচড়া করতে করতে ঢাকা থেকে রাজশাহী নিয়ে যাবেই যাবে। পৃথা আর কথা বাড়ালো না। কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
-“ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন তাড়াতাড়ি।”
৩৯.
সময় গড়িয়েছে কিছুটা। ইতমধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ সবার। খাওয়ার পরে সবাই যার যার কক্ষে চলে গেলেও ইরা, তুর্য, পৃথা, তারেক এবং তৌফিক বসে রয়েছে বসার কক্ষেই। অল্পস্বল্প গল্প গুজবে মত্ত হয়েছে তারা। এর মধ্যেই আরুশ কোথা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলো বসার কক্ষের ভিতরে। দুই হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-“স্যার! স্যার আমি এসেছি?”
আরুশের কন্ঠ শ্রবণ হতেই উপস্থিত সকলে তাকালো তার পানে। হাঁটুতে হাত দিয়ে এখনও হাপাচ্ছে ছেলেটা। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মুখশ্রীতে তার ক্লান্তি ভাব স্পষ্ট। পরিশ্রমের দরুন নাকের ডগায়, কপালে মুক্ত দানার ন্যায় বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্বের দেখা মিলছে। ছেলেটার পেশিবহুল শক্তপোক্ত দেহে জড়ানো শার্টটাও ঘামে ভিজে লেপ্টে রয়েছে দেহের সাথে। সকলেই আরুশকে এই অবস্থায় দেখে কিঞ্চিৎ চকিত হলো। পৃথা অবাক কন্ঠেই বলল,
-“একি আরুশ ভাই আপনার এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা থেকে দৌড়ে এসেছেন।”
আরুশ ঢোক গিললো। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-“তার থেকে কম কিছু করিনি। পুরো দুই কিলোমিটার রাস্তা দৌড়ে এসেছি।”
আরুশের কথা শেষ হতে না হতেই ইরা এক গ্লাস পানি নিয়ে দাঁড়ালো আরুশের সম্মুখে। তাড়া দিয়ে বলল,
-“পানিটা খেয়ে নিন আরুশ ভাই, তারপর কথা বলবেন।”
ইরার কন্ঠ শুনে চোখ তুলে তাকালো আরুশ। ওষ্ঠে ফুটে উঠলো তার সূক্ষ্ম হাসির রেখা। যাক এত দৌড়ে একটু তো উপকার পাওয়া গেল। আরুশ তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ইরার হাত থেকে পানির গ্লাস নিতে নিতে বলল,
-“ধন্যবাদ।”
ঐ যে পানি খুশি হয়ে পানি নিল ঐ পর্যন্তই। সে পানি আর খাওয়া হলো না বেচারার। তার আগেই তুর্য ঝড়ের গতিতে এসে পানির গ্লাসটা ছিনিয়ে নিল আরুশের হাত থেকে। অতঃপর সেই হতেই আবার এক বোতল মিনারের ওয়াটার ধরিয়ে দিল। ইরার পানে তাকিয়ে বলল,
-“আরুশ আবার মিনারেল ওয়াটার ছাড়া খায় না। ওর গলায় এলার্জি আছে তো তাই।”
আরুশের চেহারা অসহায় ভাব ফুটে উঠলো। তুর্য যে ইচ্ছে করে তার সাথে এমনটা করেছে তা বুঝতে বাকি নেই তার। না পারছে ছেলেটা কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। এই প্রথম সে নিজের প্রেয়সির হাতে একটু কিছু পেয়েছিল। তাও সহ্য হলো না এই লোকটার। আরুশ রাগে দুঃখে মিনারেল ওয়াটারের বোতল খুলে গলায় পানি ঢাললো। মনে মনে তুর্যকে অভিশাপ দিয়ে বলল,
-“অন্যের প্রেমে ব্যাগরা দিস তো। দেখবি তোর বউও তোকে পাত্তা দিবে।”
৪০.
রাত নেমেছে ধরনীতে। দিনের উজ্জ্বল সূর্যটা ডুবে গিয়েছে অনেক আগেই। শহরের বুকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে কৃত্রিম সোডিয়ামের আলোয়। তুর্য আজ আর নিজের কাজে যায়নি। বেশ অনেকটা দিন পর আজ একটু ব্যস্তহীনভাবে সময় কাটাতে চাইছিল বউয়ের সাথে। কিন্তু সে কপাল কি আর তার আছে? সে ঘরে বসে রয়েছে বউয়ের সাথে একটু একাকী সময় কাটানোর জন্য। আর তার বউ বাইরে বাড়ির মানুষের সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত। ঐ যে বসার কক্ষ থেকে হাসাহাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তুর্যের মেজাজ গরম হলো। বাড়ির লোকজন তো তার কথা ভাবেই না আর তার বউটাও না। তুর্য গলা উঁচু করলো। চড়া গলায় ডাক দিল,
-“পৃথা! পৃথা।”
তুর্য ডাকতে না ডাকতেই এক মগ কফি হাতে কক্ষে প্রবেশ করলো পৃথা। তুর্যর পানে কফির মগ এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছেন কেন? বাড়ির মানুষ শুনে কি বলবে?”
তুর্য কফির মগটা হাতে নিল। থমথমে কন্ঠে বলল,
-“আমি যে বাড়িতে আছি সে খেয়াল আছে তোমার? কই এতদিন পর স্বামী বাড়িতে আমার চারপাশে একটু ঘুরঘুর করবে আমাকে জ্বালাবে তা না কোথায় না কোথায় গিয়ে বসে আছো।”
-“বসার রুমে ছিলাম সবার সাথে।”
তুর্য কফির মগে চুমুক দিতে দিতেই বলল,
-“তা আমি জানি।”
পৃথা কিঞ্চিৎ সময় চুপ রইলো। একটু উসখুস করে বলল,
-“আপনার সাথে একটা কথা ছিল।”
-“কি?”
-“আমি রাজশাহী আব্বু আম্মুর কাছে যেতে চাইছিলাম একটু।”
থামলো পৃথা আবার বলল,
-“কিছুদিন পরই তো টেস্ট পরীক্ষা তারপর এইচএসসি। এরপর আর সময় পাবো না যাওয়ার তাই এখনই আপনি যদি একটু দিয়ে আসতেন ভালো হতো।”
তুর্য থমকে গেল দিল। গোল গোল দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। হতবাক কন্ঠে বলল,
-“এখনও অব্দি আমার বউকে চু’মু খাওয়াও হলো না, বউয়ের সাথে বাসর করা হলো না এর মধ্যে বউ বাপের বাড়ি যেতে চাইছে?”
চলবে…..