সাদিয়া শওকত বাবলি
#পর্ব_৪
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পৃথা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছিলো কলেজের পানেই। ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই আজ দেরী হয়ে গেছে। কাল হাতের ব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারেনি একটুও। শেষ রাতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফলস্বরূপ উঠতে উঠতে দেরী হয়েছে সকালে আর কলেজে আসতেও দেরী। পৃথা হাত উঁচিয়ে হাত ঘড়ি দেখলো। ক্লাসের বাকি আর মাত্র পাঁচ মিনিট। দ্রুত পা চালালো মেয়েটা। হন্তদন্ত হয়ে কলেজে ঢুকতে গিয়েই বাঁধা পেল। কারো শক্তপোক্ত বক্ষের সাথে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ে গেলি নিচে। গতকালের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে আবারও আঘাত পেল। চোখ মুখ কুঁচকে কন্ঠে “আহহ” মূলক ব্যথাতুর ধ্বনি তুললো মেয়েটা। ব্যথার স্থানে আবারও ব্যথা পেয়ে চোখ জোড়া টলমল হলো। মাথা তুলে সম্মুখের দিকে তাকাতেই আবিষ্কার করলো অতীব মাত্রায় এক সুদর্শন যুবককে। কানে মোবাইল নিয়ে বেশ গম্ভীরভাবে কথা বলছে কারো সাথে। এদিকে তার হাতির মতো দেহের সাথে ধাক্কা খেয়ে এক রমনী যে নাজেহাল অবস্থায় মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেদিকে বিন্দুমাত্রায় ভ্রুক্ষেপ নেই যুবকের। পৃথার রাগ লাগলো। ডাগর ডাগর নয়নে সে তাকালো সুদর্শন যুবকের পানে। কালো প্যান্টের উপরে শক্তপোক্ত পুরুষালী শরীরে শুভ্র রঙা এক খানা শার্ট জড়িয়েছে যুবক। গলার কাছে এক খানা কালো চশমা ঝুলন্ত। পৃথা তাকালো লোকটার মুখ পানে। একটু বেশিই ফর্সা মনে হচ্ছে ছেলেটাকে কেমন ইংরেজদের মতো। ফর্সা গালে আবার গাঢ় কালো চাপ দাঁড়ির স্থান। কিঞ্চিৎ মাত্রায় বড় চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে রাখা। পৃথার ভ্রু কুঁচকে এলো। লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছে দেখেছে মনে হচ্ছে। হ্যা, এ তো গতকালকের সেই লোক। যে লোকের গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগেছিল পৃথার। লোকটা টাকার গরমও দেখিয়েছিল বেশ। ভাগ্যিস এই লোককে দেখে ক্রাশ খেতে খেতে বেঁচে গেছে। নয়তো এমন একটা ব্রিটিশ লোকের উপরে ক্রাশ খেয়ে জীবনটা বরবাদ হয়ে যেত। মানুষ সুদর্শন হলেই যে তার মন সুন্দর হয় না এই লোক তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। নাক মুখ কুঁচকে নিচ থেকে উঠে দাঁড়ালো পৃথা। তার কানের কাছে বেজে উঠলো তুর্যের বলা গতকালের সেই কথাটা,
-“কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় কর এটাকে।”
কথাটা মনে পড়তেই ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করে উঠলো মেয়েটা। সে কি ভিক্ষুক নাকি যে টাকা দিয়ে বিদায় করবে? নাকি টাকার জন্য ষ’ড়’য’ন্ত্র করে লাফিয়ে গিয়ে তার গাড়ির সম্মুখে পড়েছিল। উল্টো তারা দু’র্নী’তি করে ট্রাফিক নিয়ম ভেঙে গাড়ি সামনে তুলে দিয়ে জখম করেছিল তাকে। টাকার বিষয়টা বেশ অপমানে লেগেছে পৃথার। এমনি মেয়েটা বড্ড শান্ত নম্র। কিন্তু এই টাকার অপমানটা মেনে নিতে একদম ইচ্ছুক নয়। অবশ্য টাকার কথাটা না বললে মেয়েটা এতটাও রাগতো না। গতকাল আর আজকের রাগ নিয়েই তুর্যের পানে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো পৃথা। কন্ঠে ক্রোধ এটে বলল,
-“এই বড়লোকের অ’হংকা’রী ছেলে! আপনি আমাকে ধাক্কা মে’রে ফেলে কেন দিলেন?”
তুর্য ভ্রু কুঁচকালো মেয়েটার কথায়। মোবাইলে থাকা ব্যক্তিকে বলল,
-“পরে কথা বলছি।”
কলটা কাটলো তুর্য। আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
-“জ্বী আমাকে বলছো?”
-“আপনাকে ছাড়া তো এখানে আর কাউকে দেখছি না। আর ধাক্কাটাও আপনার হাতির মতো দেহের সাথেই লেগেছে আমার।”
তুর্যের চোখ বড় বড় হলো। নিজের দেহের পানে তাকালো সে। যথেষ্ট সুঠাম দেহের অধিকারী তুর্য। আর এই মেয়ে কিনা তাকে বলছে হাতির মতো দেহ। তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল,
-“তুমি কি বললে আমাকে আমার হাতির মতো দেহ? নিশ্চই চোখ নষ্ট তোমার। চোখের ডাক্তার দেখাও অতি দ্রুত।”
থামলো তুর্য আবার বলল,
-“আমি তোমাকে ধাক্কা মে’রে ফেলে দেইনি। বরং তুমি তোমার ঐ পাঠ কাঠির মতো দেহ নিয়ে মাছির মতো আমার উপরে উড়ে এসে পড়েছিলে। আমি আবার আমার দেহের উপরে কোনো মাশা মাছি সহ্য করতে পারি না তাই টোকা মে’রে ফেলে দিয়েছি।”
পৃথা ফুঁসে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“এই! এই কি বললেন আপনি? আমি পাটকাঠির মতো? মোটেই না। আমি একদম ঠিক আছি, ব্রিটিশ লোক একটা।”
তুর্য কটমট করে তাকালো পৃথার পানে। অত্যন্ত ক্রোধের সাথে শুধালো,
-“কি বললে তুমি আমি ব্রিটিশ লোক?”
-“দেখতে শুনতে তো ব্রিটিশদের মতো। অবশ্য মনটাও ব্রিটিশগিরীতে ভরপুর।”
-“মুখ সামলে কথা বলো বেয়াদব মেয়ে। তুমি জানো তুমি কার সাথে কথা বলছো?”
মুখ বাঁকালো পৃথা। ভেংচি কেটে বলল,
-“জানি তো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে পালানোর সময় তাদের কোল থেকে ভুলবশত বাংলার মাটিতে পড়ে যাওয়া ব্রিটিশের বাচ্চা আপনি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে যার ব্রিটিশগিরী। ব্রিটিশদের বংশধর কোথাকার।”
এবার যেন ক্রোধে ফেটে পড়লো তুর্য। অগ্নি কন্ঠে বলল,
-“একটু খানি পাঁচ আঙ্গুলের মেয়ে? বড়দের কিভাবে সম্মান করতে হয় জানো না তুমি? পরিবার থেকে এই টুকু শিক্ষাও পাওনি নাকি অভদ্র মেয়ে।”
পৃথা চোখে চোখ রাখলো তুর্যর। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“পরিবার থেকে ঠিকই শিক্ষা দিয়েছে। তবে সম্মান বড় ছোট দেখে হয় না, হয় মানুষের মন মানসিকতা আচার আচরণ দেখে। আমি অবশ্যই কোনো অ’হং’কা’রী টাকার গরমওয়ালা ছেলেকে সম্মান করি না। গতকাল…”
পৃথার কথার মধ্যেই তুর্যর মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রীনে আরুশের নাম দেখেই কলটা ধরলো সে। পৃথার পানে এক পলক তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
-“হ্যা আরুশ বল।”
আরুশ তেমন কথা বাড়ালো না। সরাসরিই বলল,
-“আপনার মুরগির বাচ্চার মতো বউকে পেয়ে গেছি স্যার। ভিতরে আসুন।”
তুর্যর কলিজা শীতল হলো। একটু আগে চটে যাওয়া মেজাজটা ঠান্ডা হলো মুহূর্তেই। কল কেটে তাকালো সে পৃথার পানে। ফুরফুরে মেজাজে বলল,
-“নিহাত মন মেজাজটা ভালো হয়ে গেছে আমার। আর ভিতরেও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা পড়ে গেছে। নয়তো তোমাকে দেখে নিতাম আমি, বেয়াদব মেয়ে।”
কথাটা বলেই কলেজের ভিতরের দিকে পা বাড়ালো তুর্য। পিছন থেকে পৃথা মুখ বাঁকালো। গলা উঁচিয়ে বলল,
-“আরে যান যান। অহংকারী ব্রিটিশ পুরুষ।”
তুর্য শুনলো পৃথার কথাগুলো তবে পাত্তা দিল না। এখন তার মন পড়ে রয়েছে কলেজের ভিতরে। এত দিনের অপেক্ষা বুঝি এই শেষ হলো। মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে একটা দর্শনের জন্য মনটা আনচান আনচান করে উঠলো। পৃথাও আর কিছু বলল না। পিছন ঘুরে রওনা হলো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আজ আর ক্লাস করবে না। এমনিই দেরী হয়ে গেছে। কলেজে গেলে স্যাররা এখন বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, বকা দিবে। তার থেকে বরং বাড়িতে গিয়ে মা বাবাকে হাতের ক্ষত দেখিয়ে কেঁদে কেঁ’টে কলেজে কল করিয়ে অসুস্থতার বাহানা দিবে।
৬.
সময় গড়ালো। তুর্য বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো প্রধান অধ্যাপকের কক্ষে কিন্তু পৃথার দেখা নেই। দপ্তরি এসে জানান দিল,
-“পৃথা আজ কলেজে আসেনি।”
আবারও হতাশ হলো তুর্য। বিরবিরিয়ে বলল,
-“ফাঁকিবাজ বউ একটা।”
তবে এবার আর ভুল করলো না ছেলেটা। কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং পৃথার সাথে পড়া ছাত্রীদের থেকে মেয়েটার বাসার ঠিকানা নিয়ে নিল অতঃপর যাত্রা শুরু করলো শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
***
ক্ষানিক সময়ের মধ্যেই তুর্য এসে পৌঁছালো পৃথাদের বাড়িতে। বেশ বড়সড় শৌখিন বাড়িটা। তুর্য ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হাসলো। আরুশের পানে তাকিয়ে বলল,
-” নিশ্চই আমার রা’জা’কা’র শ্বশুর আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে আটকে রেখে রা’জা’কা’রে’র মতো এর ওর টাকা মে’রে দিয়ে এত সুন্দর বাড়িটা করেছে।”
আরুশ প্রতিউত্তর করলো না কোনো। এমনিও তুর্যর এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলা উচিৎ জানা নেই তার। তুর্য এগিয়ে গেল পৃথাদের ঘরের দরজার সম্মুখে। কলিংবেল বাজাতে হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিল। নিজেকে একবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিল যে সব পরিপাটি আছে কিনা। প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে এসেছে যদি সকলের নজরই না কাড়তে পারে তবে এত সুদর্শন হয়ে লাভ কি? নিজের পর্যবেক্ষণেও সন্তুষ্ট হলো না ছেলেটা। আরুশের পানে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“সব ঠিক আছে তো আরুশ?”
আরুশ আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো তুর্যর। অতঃপর হাসিমুখে বলল,
-“একদম স্যার।”
তুর্য আস্বস্ত হলো। হাত বাড়িয়ে বাজালো কলিং বেলটা। মিনিট খানেকের মধ্যেই একজন যুবক এসে দরজাটা খুললো। নম্র কন্ঠে তুর্যকে প্রশ্ন করলো,
-“জ্বী আপনারা কারা? আর কাকে চাই?”
-“এটা পলাশ সিকদারের বাড়ি না?”
-“জ্বী।”
-“উনি কি বাড়িতে আছেন?”
-“হ্যা, আপনারা ভিতরে আসুন।”
তুর্য আরুশকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ছেলেটা তাদের দুজনকে বসতে বলে একটু গলা উঁচিয়ে ডাকলো পলাশ সিকদারকে। বলল,
-“বাবা তোমার সাথে দেখা করতে কারা যেন এসেছে।”
পলাশ সিকদার নিজের কক্ষে ছিলেন। কেউ তার সাথে দেখা করতে এসেছে শুনেই কক্ষ থেকে বাইরে এলেন। বসার কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
-“কই কারা এসেছে?”
তুর্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ভালোভাবে তাকালো পলাশ সিকদারের পানে। অনেক বছর আগে দেখেছিল সে এই লোকটাকে। আগের মতো তরতাজা এখন আর নেই তিনি। চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, চুলগুলোও শুভ্র রং ধারন করেছে। মাথার মধ্যেও টাক পড়েছে বিশাল। তবে চেহারায় মিল আছে। তুর্য স্বস্থি পেল, নাহ সে ভুল স্থানে আসেনি। এটাই তার শ্বশুর বাড়ি। তুর্য এগিয়ে গেল পলাশ সিকদারের পানে। অত্যন্ত নম্র কন্ঠে বলল,
-“আসসালামুয়ালাইকুম শ্বশুর মশাই।”
পলাশ সিকদার ভ্রু কুঁচকালেন। তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তুর্যের পানে। ছেলেটাকে বোধহয় চিনলেন না তিনি। আবার শ্বশুর বলে সম্বোধন করছে। পৃথা ছাড়া তো কোনো মেয়ে নেই তার। তাহলে এই ছেলের শ্বশুর সে কিভাবে হলো? পলাশ কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলেন,
-“তুমি কে?”
তুর্য বিস্মিত হলো। তার একমাত্র শ্বশুর তাকে চিনতে পারছে না? কি এক মর্মান্তিক ঘটনা। তুর্য মনের কষ্টে কাঁদতে গিয়েও কাঁদলো না। নিজের মনকে শান্তনা দিল,
-“রা’জা’কারা আমার মতো ভালো মানুষকে চিনে না।”
অতঃপর ছেলেটা একটু এগিয়ে গেল পলাশ সিকদারের পানে। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলল,
-“আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না শ্বশুর মশাই? আমি আপনার একমাত্র মুরগির বাচ্চার মতো মেয়ের হাসের বাচ্চার মতো জামাই। তুর্য চৌধুরী।”
পলাশ সিকদার চমকালেন। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন তুর্যের পানে। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
-“তুমি! তুমি তুর্য?”
তুর্য হেসে বলল,
-“জ্বী। আপনার একমাত্র মেয়ের জামাই।”
তুর্যর উত্তর আসার সাথে সাথেই গম্ভীর হলো পলাশ সিকদারের মুখশ্রী। তার স্বরণে এলো পৃথার বিয়ে, তুর্যর চলে যাওয়া এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি গুলো। মনে মনে ক্রোধ জন্মালো বয়স্ক লোকটার। থমথমে কন্ঠে বলল,
-“তুমি হঠাৎ এখানে? ডিভোর্স দিতে এসেছো? তা না আসলেও চলতো। পৃথার সাথে তোমার বিয়ে হওয়ার সময়ে ওর বয়স কম ছিল তাই রেজিস্টি হয়নি। আইনি ডিভোর্সের ঝামেলা নেই এখানে। তবে মুখে তালাক দেওয়ার একটা বিষয় আছে যেহেতু তোমাদের বিয়েটা হয়েছিল তবে তা সামনে না এসে দূর থেকে দিলেই ভালো হতো।”
চলবে…..