#অবাধ্য পিছুটান পর্ব ৪৭
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব ৪৭
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
আরুশ দেরী করলো না মোটেই। এদিকের কাজ ফেলে রেখেই সে ছুটলো গাড়ির পানে। আর তুর্যও দ্রুত কোলে তুলে নিল পৃথাকে।
ক্ষানিক সময়ের মধ্যেই পৃথাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালো তুর্য। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়ায় পরিবারের লোকেরাও শপিং টপিং বাদ দিয়ে ওদের পিছু পিছুই এখানে এসেছে। তবে ভাগ্য খারাপ, এমন একটা সময়েও তুর্যের স্ত্রীর সাথে হাসপাতালে থাকার সময় হচ্ছে না তার। এমন একটা পরিস্থিতিতে এসব ঘটলো যে ছেলেটা না পারছে এদিকে যেতে আর না পারছে ওদিকটা ছাড়তে। এদিকে পৃথা তাকে ভুল বুঝেছে ওদিকে তার ঘাড়ের উপড়ে চলমান গুরু দায়িত্ব রয়েছে। যাকে ধরার জন্য, যার নাগাল পাওয়ার জন্য এতদিন হন্যে হয়ে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছে সেই খলিল ভূঁইয়া তার নিজের শহরেই এসে ঘাঁটি গেড়েছে। অনেক কষ্টে তার নাগাল পেয়েছে তুর্য। এই মুহূর্তে তাকে না ধরে যদি শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত জীবনের পিছনেই ছোটে তাহলেও তো হবে না। নিজের দায়িত্বও তো পালন করতে হবে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। নিজের সকল দায়িত্ব পালনের শেষে না হয় পৃথাকে বুঝিয়ে বলা যাবে সবটা। মেয়েটা অবুঝ নয় নিশ্চই বুঝবে তাকে।
৫২.
পুরো ২৪ ঘন্টা। গতকাল পৃথাকে হাসপাতালে রেখে যাওয়ার পরে পুরো ২৪ ঘন্টা বাইরে কাটিয়ে কেবলই নিজ বাড়ি মুখো হয়েছে তুর্য, আর আরুশ তার বাড়ি মুখো। কি আর করবে নিজেদের দায়িত্ব পালনে এ ছাড়া যে আর উপায় নেই। খলিল ভূঁইয়া এবং তার দলবলকে ধরতে কাল থেকে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে একটা কল পর্যন্ত করতে পারেনি বাড়িতে। পৃথা কি অবস্থায় আছে, জ্ঞান ফিরেছে কিনা সে খবরটা পর্যন্ত নিতে পারেনি। তবে এত জটিলতার মধ্যে একটা বড় জটিল কার্ডের সমাধান মিলেছে। এতদিনের প্রচেষ্টায় খলিল ভূঁইয়াকে গ্রে’ফ’তা’র করতে সক্ষম হয়েছে তুর্য এবং আরুশ। ব্যাটাকে ধরে কতৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করে তবেই যে যার বাড়িতে ফিরেছে তারা। এবার অন্তত ঝামেলাহীনভাবে নিজের বউকে একটু সময় দেওয়া যাবে, বুঝানো যাবে সবটা। তুর্য বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঢুকলো নিজের বাড়িতে। বসার কক্ষে পা রাখতেই চমকে উঠলো যেন। চৌধুরী বাড়ির বসার কক্ষটা যেন কানায় কানায় পরিপূর্ণ এই মুহূর্তে। বাড়ির লোকজন তো আছেই সাথে পলাশ সিকদার একদম স্বপরিবারে এসেছেন তুর্যদের বাড়িতে। তুর্য ভ্রু কুঁচকালো সকলকে দেখে। এই রাজাকার জনগোষ্ঠী আবার এখানে কি করছে? প্রথমে সকলকে দেখে একটু ভরকে গেলেও পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিল বেচারা। হাজার হলেও তার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর মশাই এই পলাশ সিকদার। তুর্য বেশ নম্র কন্ঠে তার পানে তাকিয়ে বলল,
-“আসসালামুয়ালাইকুম। কেমন আছেন আপনারা?”
পলাশ সিকদার থমথমে দৃষ্টিতে তাকালেন তুর্যের পানে। গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলেন,
-“ভালো আর তুমি থাকতে দিলে কই? ভালো থাকতে দিলে কি আর স্বপরিবারে আজ এখানে আমাদের উপস্থিত হতে হতো নাকি?”
তুর্যের তেমন একটা বোধগম্য হলো না পলাশ সিকদারের কথা, কপালে ভাঁজ পড়লো তার। পলক ঝাপটে শুধালো,
-“কেন আমি আবার কি করেছি?”
সাথে সাথেই ভেসে এলো তৌফিকের কন্ঠস্বর। বেচারা আমতা আমতা করে বলল,
-“ভাইয়া অনলাইনে দেখ।”
তুর্যের কপালের ভাঁজ আরও গাঢ় হলো। অনলাইনে আবার কি হয়েছে? কাল থেকে খলিল ভূঁইয়াকে গ্রে’ফ’তা’রে’র প্রচেষ্টায় এতটা ব্যস্ত ছিল যে অনলাইনে কেন মোবাইলটা ধরারই সুযোগ পায়নি সে। তুর্য কপালের ভাঁজ অব্যহত রেখেই পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করলো। ডাটা অন করতেই মেসেজ এবং নোটিফিকেশনে যেন মোবাইলটা হ্যাং হওয়ার উপক্রম। তুর্য ভরকে গেল। তড়িঘড়ি করে একটা নোটিফিকেশনে ঢুকতেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এ কি দেখছে সে? এ তো সেদিনের হোটেল রুমের ছবি। সেই নাউজুবিল্লাহ মার্কা মেয়েটার সাথে হোটেল রুমে যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুর্য যে কথা বলেছিল তখনকার ছবি। কেউ খুব চালাকির গোপনে সেই মুহূর্তগুলোর ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়িয়ে দিয়েছে। যদিও ছবিগুলোর মধ্যে খারাপ কিছু নেই। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে হোটেলে রুমে ফুল দ্বারা সুসজ্জিত এক কক্ষে খোলামেলা পোশাকধারী এক রমনীর সম্মুখে দাঁড়ানো তুর্য, আরেকটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে খোলামেলা পোশাকধারী মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইছে তুর্যকে, ব্যস এই টুকুই। তবে ছবি গুলোকে খারাপ বানিয়েছে এদেশে বসবাসকারী কিছু হলুদ সাংবাদিকের দল। কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমে ছবিগুলো আপলোড করে তাতে শিরোনাম হিসেবে লিখেছে,
“সিক্রেট পুলিশ সদস্য তুর্য চৌধুরীর সিক্রেট ফাঁস।”
কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমে আবার লিখেছে,
“সিক্রেট পুলিশ সদস্য তুর্য চৌধুরী হোটেল রুমে নারীদেহে মগ্ন”
আবার কোনো কোনোটায় দেওয়া হয়েছে,
“দেশের রক্ষকই যখন ভক্ষক।”
সংবাদগুলো দেখে মাথা ঘুরে উঠলো তুর্যের। পুরো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন তুর্যময়। কেউ কেউ আবার দাবি করছে তার কাছে নাকি তুর্যের লিংক ও আছে। তুর্য এবং হোটেল রুমের ঐ মেয়েটার ছবি পোস্ট করেছে উপরে ক্যাপশনে লিখেছে,
“লিংক চাইলে ইনবক্স করুন।”
তুর্য আশ্চর্য হলো। ঐ মেয়েটার সাথে তো তার কিছু হলোই না তাহলে লিংক এলো কোথা থেকে? আসলে বাঙালিরা বোঝে বেশি। এদের “ক” বললে “কলিকাতা” বুঝে নেয়। দুটো ছবি কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করলো কি করলো না এর মধ্যে এরা লিংক পর্যন্ত চলে গেছে। আর ছবিগুলোর পিছনে কি আছে না আছে কোনো বাছ বিচার না করেই সংবাদ মাধ্যমগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে সর্বত্র। একটা দেশের সংবাদ মাধ্যম গুলো থাকে ঐ দেশের জনগনের নিকট ভরসার স্থাল হিসেবে। চারদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে, দেশের কি অবস্থা, পৃথিবীর কি অবস্থা এসব কিছু সাধারন জনগনের নিকট পৌঁছে দেওয়ার এক মাত্র বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যমই তো হলো সংবাদ মাধ্যম। এখন তারাই যদি বিশ্বাসযোগ্যতার স্থান থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের উর্ধ্বে তোলার জন্য মিথ্যা তথ্য ছড়ায় তাহলে সাধারণ জনগণ বিশ্বাস রাখবে কাদের উপর? একজন পুলিশের যেমন প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা উচিৎ নয় তেমন একজন সাংবাদিকেরও প্রমাণ ব্যতীত কিংবা কোনো ধরণের বাছ বিচার ছাড়া কোনো তথ্য জনগনের নিকট পৌঁছে দেওয়া উচিৎ নয়। এতে মানুষের জীবনের উপরে প্রভাব পড়ে। তাদের একটা ভুল সংবাদের জন্য নিমেষেই একটা মানুষ, একটা পরিবার কিংবা একটা জাতি ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। প্রতিবছর এই সংবাদ মাধ্যম গুলোর বাছ বিচার ছাড়া মিথ্যা সংবাদ এবং মানুষের ভাইরাল ভাইরাল খেলায় যে কতগুলো নিরীহ মানুষের জীবন নষ্ট হয় তা কি এরা জানে? তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তুর্য। প্রমাণ ছাড়া কেন এই সংবাদ মাধ্যমগুলো এসব সংবাদ প্রকাশ করেছে এর জবাবদিহি তো তুর্য চাইবে তাদের নিকট। সাথে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু তার আগে তাকে ঘর সামলাতে হবে। গতকাল এমনি হাতে ব’ন্দু’ক দেখে ভুল বুঝেছে পৃথা। আজ আবার এই ঘটনা। মেয়েটা নিশ্চই তাকে আরও ভুল বুঝেছে। বোঝাটাও কি স্বাভাবিক নয়? মানুষ আমাদের যেভাবে বুঝাবে আমরা তো সেভাবেই বুঝবো। হলুদ সাংবাদিকগুলো খবরটা যেভাবে প্রকাশ করেছে তাতে সাধারণ জনতা ভুল বুঝতে বাধ্য। তুর্য অস্থির হলো। ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
-“এসব মিথ্যা। এগুলো আমাকে ফাঁসানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে।”
তুর্যের কথা শেষ হতে না হতেই পিয়াল মুখ খুললো। থমথমে কন্ঠে জবাব দিল,
-“কোনটা ফাঁসানোর জন্য আর কোনটা সত্যি তা এখন পুরো দেশের মানুষ জানে। প্রমাণ তো অনলাইনেই ঘোরাফেরা করছে।”
পিয়ালের কথার মধ্যেই পলাশ সিকদার থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“আমার মেয়েকে আর এক মুহূর্তের জন্যও এখানে থাকতে দেব না। ওর বাবা এখনও ম’রে যায়নি যে ওকে তোমার মতো একটা চরিত্রহীন ছেলের সাথে থাকতে হবে।”
তুর্যের বুক কাঁপালো। পৃথাকে তার বাবা নিয়ে চলে যাবে? তাহলে তার কি হবে? যে মেয়েটাকে ছাড়া তার একটা মুহুর্তও কাটে না, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। যাকে বুকে জড়িয়ে না ধরলে রাতে ঘুম আসে না তাকে ছেড়ে তুর্য থাকবে কিভাবে? না পৃথা কোথাও যেতে পারে না। পৃথা তার কাছেই থাকবে। তুর্য চোখ মুখ শক্ত করলো। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“আমি আমার বউকে কোথাও যেতে দেব না।”
সাথে সাথেই তেতে উঠলো পিয়াস। অগ্নি কন্ঠে বলল,
-“তুই বললেই হবে নাকি? আমরা আমাদের বোনকে তোর মতো একটা লম্পটের কিছুতেই থাকতে দেব না। ঘরে বউ রেখে হোটেল রুমে অন্য মেয়েদের সাথে ছিঃ ছিঃ, ভাবতেও অবাক লাগছে আমার।”
তুর্য নিজেও তেতে উঠলো এ পর্যায়ে। কেউ কিছু না জেনেই তার উপরে কি বিশ্রী একটা অভিযোগ এনেছে। পৃথাকে ছেড়ে দীর্ঘ আটটা বছর সে দূরে ছিল তখনই কোনো মেয়ের সান্নিধ্যে গেল না শুধুমাত্র নিজের বউ আছে এবং তাকে ভালোবাসে এই ভেবে। আর আজ পৃথাকে এতটা কাছে পেয়ে, নিজের করে পেয়েও অন্যত্র যাবে? তবে এই মুহূর্তে তুর্য সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হলো নিজের পরিবারকে দেখে। তাদের সম্মুখে পলাশ সিকদার এবং পিয়াস, পিয়াল এতগুলো কথা বলল তুর্যকে। চরিত্রহীনের উপাধি পর্যন্ত দিল অথচ কেউ একটু প্রতিবাদ করলো না। তার পরিবার কি তার উপর এই টুকু বিশ্বাস রাখতে পারলো না? এতটাই খারাপ তুর্য! খারাপ লাগলো ছেলেটার তবে এই মুহূর্তে সে এই খারাপ লাগাকেও সে দূরে সরিয়ে রাখলো। পৃথাকে কিছুতেই সে নিজের থেকে দূরে যেতে দিবে না। মেয়েটা যেতে চাইলেও জোর করে রাখবে। অন্তত নিজের ভালো থাকার জন্য হলেও পৃথাকে চাই তুর্যের। দিশেহারা হলো ছেলেটা। মুখ খুলে কিছু বলতে চাইলো। তবে সে সুযোগ আর হলো না। তার আগেই পৃথা হাত তুলে থামিয়ে দিল তুর্যকে। সকলের সম্মুখে অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“আমি আমার স্বামীকে রেখে কোথাও যাব না।”
-“কিন্তু…”
পিয়াল ফুঁসে উঠে বলতে চাইছিলো কিছু। পৃথা তাকেও থামিয়ে দিল সাথে সাথে। বিশ্বাসের সাথে বলল,
-“আমার স্বামীকে আমি বিশ্বাস করি। গতকাল রাস্তায় তাকে ব’ন্দু’ক হাতে দেখে তৎক্ষণাৎ আমার হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিল তবে আমার বিশ্বাস ছিল আমার স্বামী কোনো অন্যায় কর্মের সাথে যুক্ত থাকতে পারে না এবং আজ এই সংবাদের পর এটা অন্তত প্রমাণ হয়ে গেল যে সে সত্যিই কোনো অন্যায় কর্মের সাথে যুক্ত নয়। সে দেশের একজন রক্ষক হিসেবে কাজ করছে এবং আমি আমার স্বামীর এই পেশা নিয়ে গর্ববোধ করি।
থামলো পৃথা আবার বলল,
-“মানছি আমার স্বামী আমার থেকে নিজের পেশা লুকিয়েছে। এর মানে এই নয় যে সে অন্য নারীর সান্নিধ্যে চলে গিয়েছে। আমি আমার স্বামীকে যথেষ্ট বিশ্বাস করি এবং ভরসা করি সেখানে এই অনলাইনের তুচ্ছ একটা ঘটনা ধরে বাপের বাড়ি যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি আমার স্বামীর কাছেই থাকবো, কোথাও যাব না।”
চলবে…..