#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৫
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
মনে মনে ক্রোধ জন্মালো বয়স্ক লোকটার। থমথমে কন্ঠে বলল,
-“তুমি হঠাৎ এখানে? ডিভোর্স দিতে এসেছো? তা না আসলেও চলতো। পৃথার সাথে তোমার বিয়ে হওয়ার সময়ে ওর বয়স কম ছিল তাই রেজিস্টি হয়নি। আইনি ডিভোর্সের ঝামেলা নেই এখানে। তবে মুখে তালাক দেওয়ার একটা বিষয় আছে যেহেতু তোমাদের বিয়েটা হয়েছিল তবে তা সামনে না এসে দূর থেকে দিলেই ভালো হতো।”
থামলেন পলাশ সিকদার। আবার বললেন,
-“পৃথা এই বিয়ে সম্পর্কে কিছুই জানে না। ওর বয়স তখন ছিল মাত্র ১০। বিয়ে, সংসার, স্বামী কোনোটাই ওর জ্ঞানে ছিল না তেমন। পরবর্তীতে তুমিও ওকে ছেড়ে দিলে। আমরা চাইনি আমাদের ভুলে জন্য ছোট্ট মেয়েটার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক। তাই ঐ বিয়েটা সর্বদা ওর সম্মুখে আমরা পুতুল বিয়ে বলেই উপস্থাপন করেছি। সুতরাং এখন যদি তুমি ওর সম্মুখে এসে ওকে তালাক দিতে চাও বিষয়টা হিতে বিপরীত হতে পারে। ওর মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগতে পারে। আশাকরি তুমি বুঝতে পারছো আমার কথা। তাই তালাকটা দূর থেকে দিলেই ভালো হয়।”
পলাশ সিকদার গড়গড় করে বললেন কথাগুলো। হঠাৎ এতদিন পর তুর্যকে সম্মুখে দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল পৌঢ় লোকটা। পৃথার অল্প বয়সে তাদের ভুলের কারনে যে মেয়েটার জীবনে কত বড় দূর্ঘটনা ঘটে গেছে তা মেয়েকে জানতে দিতে একদম ইচ্ছুক নন পলাশ সিকদার। সে কোনো ভাবেই চান না মেয়ের জীবনে আর কোনো দূর্যোগ নেমে আসুক, মন ভাঙুক বা তাদের ভুল বুঝুক। বড় আদরের মেয়ে যে তার। তাই তো এলাকা ছাড়লো, এতগুলো দিন ধরে মেয়ের থেকে এত বড় সত্যিটা লুকিয়ে রেখেছেন। আর আজ কিনা সেই সত্যিটা হেঁটে এসে দাঁড়িয়েছে তার দ্বারে? ছেলেটার প্রতি ভীষন ক্রোধও জন্মাচ্ছে আবার মেয়ের জন্যও চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটা কোনো ভাবে যদি কখনও জীবনের এত বড় সত্যের মুখোমুখি হয়ে তবে প্রতিক্রিয়া হবে ভেবে পাচ্ছেন না পলাশ সিকদার। তার উপর যদি জানতে পারে বিয়ের দিনই বিয়ের আসরে তার স্বামী তাকে ত্যাগ করেছিল তখন কি করবে? পলাশ সিকদার ঠিক জানেন তার মেয়েটা উপরে উপরে ভীষন চঞ্চল, চটপটে হলেও ভিতরে ভিতরে একদম নাজুক, ভীষঝ আবেগী। নিজের জীবনের এত বড় সত্যি জানলে হয়তো আরও নাজুক হয়ে পড়বে। না, তিনি বেঁচে থাকতে তার মেয়ের উপর আর কোনো ঝড় ঝাপটা আসতে দিবেন না। এমনিই তাদের ভুলে অল্প বয়সে মেয়েটাকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
তুর্য শুনলো পলাশ সিকদারের বলা কথাগুলো। বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে গেল তার। যে বউয়ের জন্য তার এত প্রতীক্ষা, এত অস্থিরতা সেই বউ কিনা জানেই না বিয়ের কথা? তার রা’জা’কা’র শ্বশুরটা তার এত্ত বড় এক খানা বিয়েকে পুতুল বিয়ে বলে চালিয়ে দিয়েছে? তুর্যর মুখশ্রী থমথমে হলো। গম্ভীর কন্ঠে সে বলল,
-“আমি কোনো তালাক টালাক দিতে আসিনি শ্বশুর মশাই। আমি এসেছি আমার বউকে সাথে করে নিয়ে যেতে।”
তুর্যর কথায় যেন বিস্ফোরন ঘটলো উপস্থিত সকলের মধ্যে। এতদিন পর ছেলেটা এসে এমন কিছু বলবে কল্পনাও করেনি কেউ। পলাশ সিকদার চুপ রইলেন। বুঝতে চেষ্টা করলেন তুর্যের মুখভঙ্গি। ছেলেটা কি সত্যিই বলছে নাকি এর পিছনে অন্য কোনো কারন লুকিয়ে আছে? পলাশ সিকদার চুপ রইলেও চুপ থাকতে পারলো না তার দুই ছেলে পিয়াস আর পিয়াল। এই ছেলেটা যে তুর্য সে বাক্য কর্ণে পৌঁছাতেই তাদের মেজাজের পারদ হইহই করে তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল। শুধুমাত্র বাবার নরম কন্ঠের সম্মুখে থেমে রয়েছিল এতক্ষন। কিন্তু এখন আর ধৈর্য্যে কুলালো না। তার ছোট্ট বোনটার জীবনের সাথে এত বড় একটা খেলা খেলে এখন আবার এসেছে তার বোনকে নিতে? গর্জে উঠলো পিয়াস। অত্যন্ত ক্রোধের সাথে বলল,
-“ঠাট্টা করছিস এতদিন পর এসে? তোর সাথে আমাদের সম্পর্কটা হাসি ঠাট্টার হলেও এখন আর তা নেই। তুই যেদিন আমার বোনকে বিয়ের আসরে ফেলে চলে গিয়েছিলি সেদিনই সে সম্পর্কর ইতি ঘটেছে।”
তুর্য তাকলো পিয়াসের পানে। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না। আমি আমার বউকে নিতে এসেছি আর নিয়েই যাব।”
হুংকার তুললো পিয়াল। তুর্যের পানে তেড়ে গিয়ে বলল,
-“কার বউ? কিসের বউ? এক্ষুনি বেরিয়ে যা তুই আমাদের বাড়ি থেকে। আগে জানলে তোকে বাড়িতেই ঢুকতেই দিতাম না আমি।”
-“কেউ স্বীকার করুক বা না করুক আজ থেকে সাত বছর আগে পৃথার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল। সেই অনুপাতে সে এখনও আমার বউ। আর আমার বউকে না নিয়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
পিয়াল ক্রোধের বশে আবার তেড়ে গেল তুর্যর পানে। তবে তুর্যকে কোনো আঘাত করার আগেই তাকে থামিয়ে দিলেন পলাশ সিকদার। থমথমে কন্ঠে সে তুর্যকে বললেন,
-“সে কথা তোমার সেদিন ভাবা উচিৎ ছিল যেদিন আমার মেয়েকে বিয়ের আসরে ফেলে গিয়েছিলে। তাছাড়া সেদিন তো বেশ বড় মুখ করে বলেছিলে এ বিয়ে তুমি মানো না। তাহলে আজ কি হলো?”
তুর্যের মুখশ্রীতে অপরাধী ভাব ফুটে উঠলো। নত কন্ঠে সে বলল,
-“আমি সেদিন ভুল করেছিলাম আমি জানি। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্তই করতে এসেছি আজ। আমি সবটা মেনেই পৃথাকে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাইছি।”
-“কিন্তু আমি আমার পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাইছি না আর। আমি আমার মেয়েকে কখনওই আর তোমার হাতে তুলে দেব না। তুমি এখন আসতে পারো।”
ভিতরে ভিতরে ক্রোধে ফেটে পড়লো তুর্য। ভীষণভাবে বলতে ইচ্ছে হলো,
-“আমার বউকে আমি নিয়ে যাব আপনি বাঁধা দেওয়ায় কে?”
তবে মুখে কিছুই বলল না ছেলেটা। হাজার হলেও এটা তার শ্বশুর মশাই। তার উপর আজ প্রথম দিন শ্বশুর বাড়ি এবং শ্বশুরের মুখোমুখি হয়েছে সে। এদের সম্মুখে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করে আর খারাপ হতে চাইলো না। এমনিই বিগত দিনে কম ভুল সে করেনি। ওষ্ঠ টেনে জোরপূর্বক হাসলো তুর্য। চোখ মুখে নীরিহ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল,
-“দয়া করে আমার সাথে এমন রা’জা’কার’দের মতো ব্যবহার করবেন না শ্বশুর মশাই। আমি আমার ছোট খাটো মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে ছাড়া একদম ভালো নেই। আমার বউটাকে দয়া করে আমাকে দিয়ে দিন। আমি চলে যাই।”
পলাশ সিকদার হতবম্ব হলেন। এই ছেলে নির্লজ্জের মতো এসব কি বলছে? ছোট বেলা থেকে যতদূর ছেলেটাকে তিনি দেখেছিলেন তাতে জানতেন তুর্য রাগচটা, গম্ভীর, জেদি ছেলে। এখন তো দেখা যাচ্ছে এ ছেলে নির্লজ্জও ভীষন। ভাগ্যিস সেদিন তুর্য বিয়ের আসর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর বিয়ে মানবে না বলেছিল। নয়তো এই নির্লজ্জটা আজ মেয়ে জামাই হিসেবে তার গলায় বিঁধে থাকতো। অবশ্য না বিঁধে বাকি রয়েছে কোথায়? এখনও যেহেতু তালাক হয়নি। তার মানে এই নির্লজ্জটা এখনও তার মেয়ের জামাই। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন পলাশ সিকদার। থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“বেয়াদব।”
-“একদম ঠিক বলেছেন শ্বশুর মশাই। আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে ছাড়া আমি দিন দিন বেয়াদবে পরিনত হচ্ছি। আমার ভিতরে একটু আদব ফিরিয়ে আনতে হলেও আমার বউটাকে আমায় ফিরিয়ে দিন আপনি। একটু দয়া করুন আমার উপর।”
পলাশ সিকদার হয়তো বলতে চাইলেন কিছু একটা। কিন্তু তার আগেই পিয়াস মুখ খুললো। বাবার পানে তাকিয়ে বলল,
-“এটাকে এখনও সহ্য করছো কেন বাবা? এটাকে তাড়াতাড়ি বের করে দাও বাড়ি থেকে। পৃথা একটা বার এ সম্পর্কে কিছু জানতে পারলে কি হবে ভেবে দেখেছো?”
পিয়াসের কথায় দাঁতে দাঁত চাপলো তুর্য। বিরবিয়ে বলল,
-“আগে তো ভেবেছিলাম শুধুমাত্র রা’জা’কা’র শ্বশুর মশাই আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে আটকে রেখেছেন। এখন তো দেখছি রা’জা’কা’রের সাথে দু দুটো আল’বদর, আল শা’মস ও যুক্ত আছে।”
আরুশ পাশেই ছিল। তাই তুর্য বিরবিরিয়ে কথাগুলো বললেও সে বেশ ভালোভাবেই শুনেছে সবটা। ছেলেটা একটু ঝুঁকে গেল তুর্যর পানে। ফিসফিসিয়ে বলল,
-“এখন শুধু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ইয়াহিয়া খান, আর ভূট্টই বাকি আছে স্যার। তারা চলে আসলেই ষোলোকলা পূর্ণ।”
আরুশের কথা শেষ হতে না হতেই তার পানে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো তুর্য। কটমট করে বলল,
-“চুপ থাক আহাম্মক। এদের কথা একদম মুখেও উচ্চারণ করবি না। ঘষেটি বেগম , রাজা’কার, আল বদর, আল শা’মস এদের সাথেই পারছি না। তার মধ্যে যদি আবার এই তিন বাট’পার চলে আসে। এদের সাথে আমি একা মানুষ বুদ্ধিতে কুলাতে পারবো নাকি?”
আরুশ আমতা আমতা করলো। কিছুটা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
-“তবুও স্যার। সবাই যখন এসেছে এরাও যদি চলে আসে।”
তুর্য তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো আরুশের পানে। কটমট করে বলল,
-“তাহলে এই তিনটার সামনে তোকে ধক্কা মেরে দাঁড় করিয়ে বলবো এই আহাম্মক টাকে মে’রে আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে স্বাধীন করে দিয়ে যান।”
আরুশ চুপসে গেল। আর বলল না কিছুই। পলাশ সিকদার তেতে উঠলেন এবার বেশ। কন্ঠে ক্রোধ নিয়ে বললেন,
-“আমার মেয়ের সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি চলে যাও।”
তুর্য তাকালো পলাশ সিকদারের পানে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
-“আপনি বললেই তো আর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে না। পৃথা আমার বিয়ে করা বউ। ওকে ডাকুন, বউ নিয়ে চলে যাই।”
পৃথা ঘরেই ছিল। বসার কক্ষে হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে এদিকেই আসছিলো সে। তবে বসার কক্ষে ঢোকার আগেই তাকে থামিয়ে দিল সুফিয়া বেগম। তাড়াহুড়ো করে বললেন,
-“কোথায় যাচ্ছিস?”
-“ওখানে ভাইয়ারা তারপর বাবা চিৎকার চেঁচামেচি করছে কেন তাই দেখতে যাচ্ছিলাম।”
সুলতানা বেগম ঢোক গিললেন। মেয়েকে কিছুতেই ওখানে যেতে দেওয়া যাবে না এই মুহুর্তে। তাহলে যে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। একবার মেয়ে যদি সবটা জেনে যায় ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসছে সুফিয়া বেগমের। আমতা আমতা শুরু করলেন তিনি। এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলে বললেন,
-“তোর বান্ধবী রিদি কল করেছিল। কি নাকি জরুরী কাজ আছে এক্ষুনি ওদের বাসায় যেতে বলেছে তোকে।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। তার জানা মতে রিদির এখন কলেজে থাকার কথা। সে আজ কলেজে যায়নি বলে রিদিও কি যায়নি? হয়তো যায়নি। যাক আজ বেশ অনেক্ষণ আড্ডা দেওয়া যাবে। পৃথা মায়ের পানে তাকালো। বলল,
-“আচ্ছা আমি তাহলে রিদিদের বাসা থেকে ঘুরে আসি।”
-“হ্যা যা।”
মায়ের অনুমতি পেতেই পৃথা সম্মুখের দিকে পা বাড়ালো। কলিজা কাঁপলো সুফিয়া বেগমের। হন্তদন্ত হয়ে সে হাত ধরে আটকালেন মেয়েকে। দ্রুততার সাথে বললেন,
-“ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস পিছনের দরজা দিয়ে যা।”
পৃথার কপালে ভাঁজ পড়লো। তার মায়ের আচার আচরণ কেমন একটা লাগছে আজ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেশ দেখা যাচ্ছে। তার মা কি লুকাচ্ছে কিছু? পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কন্ঠে শুধালো,
-“মা কিছু কি হয়েছে? আমার কাছ থেকে লুকাচ্ছো কিছু?”
জোরপূর্বক হাসলেন সুফিয়া বেগম। আমতা আমতা করে বললেন,
-“না কি হবে? তুই বরং রিদির সাথে দেখা করে আয়। মেয়েটা কল করেছে অনেকক্ষন।”
পৃথা আর কথা বাড়ালো না। তবে মায়ের আচরনও সন্দেহজনক। সে যাক, রিদিদের বাড়ি থেকে এসে না হয় দেখা যাবে কি হয়েছে। পৃথা আবারও পা বাড়ালো বসার কক্ষের দিকে। সুফিয়া বেগম ব্যস্ত হয়ে আটকালেন আবারও অতঃপর বললেন,
-“পিছনের দরজা দিয়ে যা।”
চলবে…..