#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৭
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
গম্ভীর কন্ঠে আরুশকে বলল,
-“তুই যা এখানকার সব কাজ কর্ম মিটিয়ে নে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি এক্ষুনি।”
আরুশ আর দরজা ধাক্কালো না। চুপচাপ প্রস্থান করলো নিজের কাজে। তুর্য মিনিট দশেকের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। আরুশকে এদিকের কাজে রেখে সকালের নাস্তা না করেই চটজলদি বেরিয়ে পড়লো পৃথার কলেজের উদ্দেশ্যে। যদি ভাগ্যের জোরে বউয়ের দেখাটা আজ সে পায়। এমনিই কয়েকটা দিন ঢাকায় কাটাবে বিধায় বউকে খোঁজা হবে না। বউটাকে খুঁজে না পেয়েই এই যে কয়েকটা দিনের জন্য সে আবার ঢাকায় যাচ্ছে এতে কি নিদারুন যন্ত্রনার স্বীকার হচ্ছে তা কি তার মুরগির বাচ্চার মতো বউটা জানে? উঁহু একদমই জানে না। মেয়েটা তো এই টুকুই জানে না যে তার মতো এত সুন্দর হাঁসের বাচ্চার মতো একটা জামাই আছে। তুর্য পৃথার কলেজের সম্মুখে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো।
পৃথা আর রিদি আজ এক সাথেই কলেজে আসছিলো। শুভ্র রঙা কলেজ ড্রেসে আবৃত মেয়েটার উজ্জ্বল শ্যামরঙা নরম দেহখানা। মাথায় আবার শুভ্র রঙা হিজাব বাঁধা। পৃথাদের কলেজ ড্রেসটা সম্পূর্ণ সাদা। মাঝে মাঝে পৃথার মনে হয় এটা কলেজ ড্রেস নয় বরং এটা বি’ধবা ড্রেস। তখন পৃথার খুব করে ইচ্ছে হয় কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানাতে যে,
-” আপনারা দয়া করে আমাদের এই বিধবা পোশাকটা বাতিল করুন। বিয়ের আগেই কেন আমাদের জামাই গুলোকে মেরে বি’ধবা বি’ধবা অনুভূতি দিচ্ছেন?
মনে মনে কথাগুলো বললেও মুখে কখনও এ কথা প্রকাশ করতে পারে না মেয়েটা। এত সাহস তার নেই। তাছাড়া এইসব কথা কলেজ কর্তৃপক্ষের নিকট বললে তারা নিশ্চই তাকে বেয়াদব ভাববে। রাস্তার ফুটপাত ধরে হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতেই পৃথার হঠাৎ চোখ পড়লো তুর্যর পানে। ছেলেটা একটা কালো গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কপালে ওয়ান টাইম একটা ব্যান্ডেজ জ্বলজ্বল করছে। পৃথার স্মরণে এলো গতকাল তার ঢিল ছোড়ার কথা। মেয়েটার মনে অপরাধ বোধ জন্মালো। মায়া হলো তুর্যর জন্য। তবে পৃথার চিন্তার মধ্যেই হইহই করে উঠলো রিদি। তুর্যের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
-“এই, এই লোকটাই তো তোকে কাল খুঁজছিলো। আমাদের কাছ থেকে তোর বাড়ির ঠিকানাও নিয়েছিল।”
পৃথার ভ্রু কুঁচকালো। এই লোকটাকে তো সে সেদিন দূ’র্ঘট’নার আগে কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না, চিনেও না। তাহলে তাকে কেন খুঁজছিলো? পৃথা কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ভাবলো। হঠাৎ তার মনে ভয়ের সঞ্চার হলো। আচ্ছা কাল খারাপ ব্যবহার করেছে বলে লোকটা বাবার নিকট তার নামে নালিশ জানাতে তাকে খোঁজেনি তো। এই মুহূর্তে অপরিচিত একজন পুরুষের তাকে খোঁজার কারন হিসেবে এই একটা ছাড়া আর কোনো কারন মস্তিষ্কে আসছে না। এর জন্যই বোধহয় গতকাল তাদের বাড়ির সম্মুখেও দেখেছিল তুর্যকে। একটু আগে তুর্যর জন্য পৃথার হৃদয়ে জন্মানো মায়া ফুঁস করে উড়ে গেল। সাথে সাথে ক্রোধের পারদটা তরতর করে বেড়ে গেল। লোকটা তাকে দু’র্নী’তি করে গাড়ির চাকা দিয়ে পিষে মারতে চেয়েছিল, তারপর দুঃখিত না বলে টাকার গরম দেখিয়েছিল বেশ। আবার কাল ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে কত অপমানমূলক কথা বলল। তার বেলায় কিছু না। সে কি না কি একটু বলেছে তার জন্য একদম বাবার কাছে নালিশ দিতে পর্যন্ত চলে গেছে? লোকটা যে সামান্য একটা কারন নিয়ে এমন বাচ্চামির পরিচয় দিবে ভাবতেও পারেনি পৃথা। নাহ এখনও অব্দি বাবা পর্যন্ত বিষয়টি যায়নি। আর যেতেও দেওয়া যাবে না। তার আগেই এই ব্রিটিশ লোকটাকে শাসাতে হবে। নয়তো বাবার কানে একবার কথাগুলো গেলে বাবা আর আস্ত রাখবে না। পৃথা শক্ত ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো তুর্যের মুখোমুখি। কিঞ্চিৎ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“আপনি যে সামন্য একটা বিষয় নিয়ে এত দূর যাবেন আমি ভাবতেও পারিনি।”
তুর্য ভ্রু কুঁচকালো পৃথার কথায়। গাড়ির সাথে হেলান দিয়েই থমথমে কন্ঠে বলল,
-“মানে?”
-“হ্যা এখন তো বুঝতেই পারবেন না। বুঝতে পারবেন আমার বাড়িতে আমার নামে নালিশ দিতে যাওয়ার সময়। কি একটা ছোট ঘটনা যেখানে বেশি অপরাধ আপনার। অথচ আপনি আমার বাবার নিকট আমার নামে নালিশ দিতে এত তৎপর?”
তুর্যর কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া আরও কুঞ্চিত হলো। চোখ ছোট ছোট করে সে প্রশ্ন করলো,
-“আমি তোমার নামে তোমার বাবার নিকট নালিশ কেন জানাবো? আজব!”
পৃথা কপাল কুঁচকালো। সরু দৃষ্টিতে তুর্যর পানে তাকিয়ে বলল,
-“আপনি বলতে চাইছেন আপনি আমার বাবার কাছে আমার নামে নালিশ দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছেন না?”
তুর্য নিজের দুই হাত বগলদাবা করলো। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
-“না। আমার অত অযথা সময় নেই যে তোমার মতো একটা অভদ্র, বেয়াদব মেয়ের নামে তোমার বাবার নিকট নালিশ দেব।”
তুর্যের প্রথম বলা “না” কথাটায় পৃথা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেও পরের কথাগুলো কর্ণে পৌঁছাতেই তেতে উঠলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“এই ব্রিটিশ লোক কি বললেন আপনি? আমি অভদ্র বেয়াদব? তাহলে আপনি তো বদ, পাজী, দু’র্নী’তি গ্রস্থ পুরুষ মানুষ।”
তুর্য চেতে গেল মুহুর্তেই। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“এক থাপ্পরে গাল লাল করে দেব বেয়াদব মেয়ে। মুখ সামলে কথা বলো। নয়তো তোমার মুখটাই আমি ভেঙে দেব।”
পৃথা ভেংচি কাটলো। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-“ভেঙে দেখুন তো। একদম নারী নির্যাতনের মামলায় ১৪ বছরের জন্য জে’লে পুরে দেব। আর তা অবশ্যই আপনার ঐ ইংরেজদের বড়লোকী জে’ল হবে না, হবে আমাদের বাঙালিয়ানা গরীব জে’ল।”
তুর্য হতবম্ব হলো। এই টুকু পাঁচ আঙ্গুলের মেয়ে কিনা তাকে জে’লে পুরে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে? এই মেয়ে কি জানে তার আসল পরিচয়? জানলে অবশ্যই জে’ল শব্দটা তার সম্মুখে উচ্চারণ করারও দুঃসাহস দেখাতো না। তুর্য হিসহিসিয়ে উঠলো। পৃথার দিকে তেড়ে গিয়েও নিজেকে সংযত করলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আমাকে জে’লে’র ভয় দেখাচ্ছো? তুমি জানো আমি কে? ইচ্ছে করলে তোমাকে…”
থামলো তুর্য। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। নাহ নিজের ক্রোধ কিছুতেই বাহিরে আসতে দেওয়া যাবে না। তাহলেই ঝামেলা হয়ে যাবে। খুব সহজে তার স্বরূপ প্রকাশ পেলে চলবে না। তবে এখানে আর কিছুক্ষন থাকলে এই বেয়াদব মেয়ের তাড়নায় হয়তো নিজের খোলস ছাড়তে হবে। ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করতে করতে নিজের গাড়িতে উঠে বসলো তুর্য। দ্রুত গাড়ি স্টার্ট করে মুহুর্তেই সাঁই সাঁই করে পৃথার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল। পৃথাও ভেংচি কাটলো। তাচ্ছিল্য করে বলল,
-“আসছে কোন দেশের লাট সাহেব যেন। যতসব ইংরেজদের বংশধর।”
কথাট বলতে বলতেই মেয়েটা ঢুকে গেল কলেজের ভিতরে। একটু পরেই ক্লাস শুরু হবে তার।
৯.
সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মি। গরমে দিশেহারা প্রাকৃতি। গাছের পাতাগুলোও কেমন নেতিয়ে পড়েছে সূর্যের প্রখর তাপে। এই তীব্র তাপদাহকে মাথায় নিয়েই রাজশাহী টু ঢাকা মহাসড়কে সাঁই সাঁই করে চলছে তুর্যের কালো রঙের গাড়িটা। তবে হঠাৎই আরুশ রাস্তা পরিবর্তন করলো। মহাসড়ক থেকে গাড়িটা নমিয়ে নিল এক জঙ্গলের রাস্তা ধরে। বেশ ক্ষানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে গাড়িটা এসে থামলো এক ঘন জঙ্গলে। আশেপাশে জনমানবের চিহ্ন মাত্র নেই। শুধুমাত্র গাছে গাছে কিছু খেচর শ্রেনীর প্রানী এবং কিট পতঙ্গের সমাগম। তুর্য নেমে দাঁড়ালো গাড়ি থেকে। আশেপাশে একবার সজাগ দৃষ্টি বুলিয়ে এগিয়ে পা বাড়ালো সম্মুখ পানে। কিঞ্চিৎ পথ পাড়ি দিতেই সম্মুখে দৃশ্যমান হলো পুরোনো ভাঙাচোরা একট বাড়ি। আরুশকে সাথে নিয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে ঢুকলো তুর্য। দুই জনই এসে থমকে দাঁড়ালো একটা শেওলা পড়া স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষের সম্মুখে। কক্ষের দরজায় বিশাল এক তালা ঝুলিয়ে পথ রোধ করে রাখা হয়েছে। তুর্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরুশের পানে। আরুশ তাড়াহুড়ো শুরু করলো। দ্রুত পকেট থেকে চাবি বের করে খুললো তালাটা। তুর্য সময় ব্যয় করলো না। পুরোনো কাঠের দরজাটায় ক্যাচ ক্যাচ ধ্বনি তুলে ভিতরে ঢুকলো। খোলা দরজা থেকে আসা আলোয় আলোকিত হলো অন্ধকার রুমটা। সম্মুখে দৃশ্যমান হলো চেয়ারের সাথে হাত পা, বাঁধা, মুখ বাঁধা অবস্থায় এক অর্ধ বয়স্ক পুরুষকে। দূর্বল তার চাওনি। শরীরের পোশকের অবস্থা বেহাল। মনে হচ্ছে কেউ ভীষন নির্মমভাবে টেনে হিচড়ে এখানে তুলেছে। তুর্য তেতে উঠলো। গলা চড়িয়ে বলল,
-“এটাকে চেয়ারের সাথে বেঁধেছিস কেন আহাম্মক? চেয়ার কি মাগনা পেয়েছিস? আমার টাকায় কেনা চেয়ারে কেন এই দূষিত লোকজনকে বসিয়েছিস বেয়াদব?”
আরুশ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল চেয়ারের নিকট। চেয়ার থেকে দ্রুত লোকটাকে খুলে ছুঁড়ে ফেলল নিচে। তুর্য বাঁকা হাসলো, হাঁটু মুরে বসলো লোকটার পাশে। হাত বাড়িয়ে এক টানে খুলে নিল লোকটার মুখে লাগিয়ে রাখা এতক্ষনের কস্টিপটা। সাথে সাথে শোনা গেল লোকটার গগন বিদারী চিৎকারে ধ্বনি। তুর্য খুব একটা পাত্তা দিল না সেদিকে। লোকটার পানে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
-“শাহীন মির্জা। জাল টাকা, ড্রা’গ, ই’য়া’বা সহ আরো অনেক অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত। স্ত্রী সবটা জানতে পারায় তিন বছর আগে স্ত্রীকেও খুন করেছিলি।”
কথাটা বলেই ভ্রু কুঁচকালো তুর্য। ঘাড় বাঁকিয়ে আরুশের পানে তাকিয়ে বলল,
-“আমারও কি এখন আমার বউকে মে’রে দেওয়া উচিৎ আরুশ? বউটা না আমার নিকট ধরা দিচ্ছে আর না জ্বালানো কমাচ্ছে।”
আরুশ কাঁচুমাচু মুখ করলো। আমতা আমতা করে বলল,
-“বউকে মা’র’লে আপনি বউ পাবেন কোথায় স্যার?”
তুর্যর কপালে ভাঁজ পড়লো। ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,
-“তাও ঠিক।”
কথাটা শেষ করে তুর্য আবার তাকালো সম্মুখের অবহেলায় পড়ে থাকা শাহীন মির্জার পানে। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
-“বউ না হয় তোর কালো দুনিয়া সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল বলে মে’রে’ছি’লি। কিন্তু শ্বশুরকে কেন মা’র’লি? তোর শ্বশুরও কি আমার শ্বশুরের মতো রা’জা’কা’র ছিল নাকি?”
শাহীন মির্জা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যর পানে। কম্পিত কন্ঠে বলল,
-“আআআপনি কে?”
তুর্য বাঁকা হাসলো। আরুশের পানে ইশারা করে শাহীন মির্জাকে বলল,
-“ঐ ছেলেটাকে চিনিস? ওর নাম আরুশ শেখ।”
“আরুশ শেখ” নামটা কর্ণে পৌঁছাতেই কেঁপে উঠলো শাহীন মির্জা। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো আরুশের পানে। অস্ফুট কন্ঠে বলল,
-“আরুশ শেখ!”
তুর্য উঠে দাঁড়ালো। আরুশের পানে তাকিয়ে বলল,
-“মুরগির বাচ্চার মতো বউটার জন্য কলিজাটা কেমন ছ্যাত ছ্যাত করছে আরুশ। আমি বরং গাড়িতে গিয়ে বসি একটু। কল্পনায় বউয়ের সাথে বাসরটা সাড়ি। ততক্ষণে তুই এটার সেবা যত্ম কর।”
কথাটা বলেই তুর্য ধুপ ধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। আরুশ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সেদিকে একবার। অতঃপর আবার তাকালো শাহীন মির্জার পানে। এতক্ষনের কাঁচুমাচু খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো ছেলেটা। মুহুর্তেই আরুশের চোখে মুখে ফুটে উঠলো ভ’য়ং’ক’র হিংস্রতা। কক্ষের এক কিনার রাখা মোটা রডগুলোর একটা রড হাতে তুলে নিল। বাঁকা হেসে বলল,
-“ওয়েলকাম টু হেল বেইব।” ( নরকে তোমাকে স্বাগতম বেইব )
চলবে…..