তামিমের শার্ট প্যান্ট ধুতে গিয়ে নবনী একটা মেয়ের পাসপোর্ট সাইজের ছবি পেলো।ছবির উল্টো পাশে একটা রবি নাম্বার লিখা।পাশে হার্ট সাইন আঁকা।লিখাটা তামিমের সে বিষয়ে নবনী শতভাগ নিশ্চিত।মুহুর্তে নবনীর পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। মনে হলো সে তলিয়ে যাচ্ছে কোনো এক অতল গহ্বরে।সেই অবস্থায় নবনী বসে রইলো দীর্ঘ সময়। হুঁশ এলো তামিমের ডাক শুনে। বেডরুম থেকে তামিম ডাকছে তাকে চা দেয়ার জন্য।
নবনী একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে উঠে গেলো তামিমের জন্য চা নিয়ে।সবে ঘুম থেকে উঠেছে তামিম।চোখে মুখে এখনো ঘুমের রেশ লেগে আছে।পরনে নীল লুঙ্গি আর খালি গা।ঘন কালো লোমশ বুকটি নবনীকে যেনো ডাকছে ইশারায়। অন্য সময় হলে নবনী ঝাঁপিয়ে পড়তো তামিমের খোলা বুকে।কিন্তু আজকে আর তাকে কিছুতেই এই বুক আকৃষ্ট করতে পারছে না।
চায়ের কাপ রেখে নবনী যেতে নিতেই তামিম হাত ধরে টেনে বিছানায় এনে শুইয়ে দিলো নবনীকে।তারপর নিজের নাক ডুবিয়ে দিলো নবনীর রেশমের মতো কালো চুলে।
নবনী ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে গেলো। তামিম কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো,”কি হয়েছে নবনী?”
নবনী থমথমে গলায় বললো,”কাজ আছে,বালতিতে তোমার এই সপ্তাহের কাপড় ভেজানো আছে,ওগুলো ধুতে হবে।আব্বা আম্মা উঠবে একটু পরে ওনাদের নাশতা সাজাতে হবে।লুবনার জন্য এখনো নুডলস রান্না করা হয় নি।”
তামিম কিছুটা রেগে বললো,”সবার সব কাজের কথা তোমার মনে থাকে,আমার টা ছাড়া। শুক্রবার একটা দিন বাসায় থাকি,একটু রোমান্স করবো তা না তুমি আমাকে কাজের ফিরিস্তি শোনাচ্ছ! এজন্যই ভাল্লাগেনা বাসায় থাকতে।যাও কাজ করো।”
নবনী আস্তে করে বললো,”আমি ও এখন বুঝি তোমার যে আমাকে ভাল্লাগেনা। “
তামিম বুঝলো নবনীর অস্পষ্ট কথা।নবনী দ্রুত পায়ে ঘর থেকে চলে গেলো। যাবার সময় হাতে করে নিজের ফোনটা নিয়ে গেলো।বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মোবাইলের ক্যামেরা অন করে মেয়েটার ছবির একটা ছবি তুলে নিলো এবং অপর পাশে থাকা নাম্বারটার ও একটা ছবি তুলে নিলো।তারপর ছবিটি আবারও জায়গামতো রেখে দিলো।
বুকের ভেতর একটা পাহাড় যন্ত্রণা নিয়ে সব ধুয়ে নবনী রান্নাঘরে চলে গেলো। এক চুলায় চায়ের পানি দিয়ে অন্য চুলায় নুডলস সিদ্ধ করার জন্য পানি দিলো।কাটিং বোর্ড নিয়ে দ্রুত হাতে পেয়াজ কাচা মরিচ কাটতে লাগলো।
দুচোখ বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে।নবনী চোখের জল মুছলো না।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে তামিম গান শুনছিলো। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে গেলো শার্টের পকেটে থাকা নিতুর ছবির কথা।এক দৌড়ে ছুটে এলো ছাদে,কিন্তু ছাদে কোনো ভেজা কাপড় পেলো না।হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসে নবনীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”নবনী আমার শার্ট-প্যান্ট ছাদে শুকাতে দাও নি?”
কান্না আড়াল করে নবনী বললো,”না,হাতের কাজ সেরে যাবো ছাদে।ওগুলো বাথরুমে রেখে এসেছি।তুমি ফ্রি থাকলে একটু শুকাতে দিয়ে এসো।”
তামিম ছুটে গিয়ে বালতির সব কাপড় ফেলে দিলো বাথরুমের ফ্লোরে। তারপর কালো শার্টটা বের করে পকেটে হাত দিলো।
ভয়ে এতোক্ষণ তার আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার যোগাড় হয়েছিলো।ছবিটা বহাল তবিয়তে আছে দেখে স্বস্তি পেলো।তারপর সব ভেজা কাপড় ছাদে শুকাতে দিয়ে মনে মনে নবনীকে ধন্যবাদ দিলো তার শার্ট-প্যান্ট এর পকেট চেক না করার জন্য।
প্রথম প্রথম নবনী সব চেক করে দেখতো।তামিমের ভুলো মন,পকেটে প্রায়২০,৫০,১০০, ৫০০,১০০০ টাকার নোট থেকে যায়। যাই পায় নবনী সব টাকা একটা মাটির ব্যাংকে রেখে দেয়।
একবার তামিমের মা তাহেরা বেগম দেখে ফেললো নবনী তামিমের পকেট থেকে টাকা বের করে শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখছে।মুহুর্তেই তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে গেলেন।
নবনীর বাবার বাড়ির অবস্থা কিছুটা খারাপ। বলতে গেলে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে নবনী।তাহেরা বেগমের মনে হলো নবনী এই টাকা এভাবে সরিয়ে হয়তো বাবার বাড়িতে দেয়।
তখন আর তিনি কিছু বললেন না।২ সপ্তাহ পর একদিন শুক্রবারে নবনীর ছোট ভাই সাব্বির এলো বোনকে দেখতে। হাতে করে নিয়ে এলো গাছের পাকা দুটো পেঁপে।
দুপুরে খাবার পর যাবার সময় রাহেলা বেগম বললেন,”ভাইয়ের পকেটে কতো টাকা গুঁজে দিয়েছো শুনি?”
প্রশ্নটা শুমে নবনীর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। হতভম্ব হয়ে বললো,”কি বলছেন মা এসব?”
রাহেলা বেগমের রাগ তুঙ্গে উঠে গেলো। চিৎকার করে বললো,”আমি জানি না ভেবেছ?
দুইদিন পর পর কেনো তোমার ভাইবোন আসে আমি বুঝি না কিছু?
তামিমের পকেট থেকে যে টাকা পাও ওসব টাকা কি করো তুমি?
ভেবেছো কেউ জানে না তোমার এই চুরির কথা?”
লজ্জায় নবনীর মাথা কাটা গেলো।সাব্বির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আপার শাশুড়ি তাদের অপছন্দ করে তা সাব্বির জানে।কিন্তু আপাকে যে এভাবে অপমান করতে পারে মিথ্যা অযুহাতে তা তার জানা ছিলো না।
নবনী নিচু স্বরে বললো,”স্বামীর পকেট থেকে টাকা নিলে সেটা যে চুরি হয়ে যায় জানতাম না আমি মা।”
এই বলে নবনী উঠে চলে গেলো তারপর আলমারির ভেতর থেকে ব্যাংক এনে তামিমের সামনে রাখলো।তামিম দেখলো ব্যাংকের গায়ে একটা কাগজে লিখা,”তামিমের নতুন ফোন কেনার টাকা।”
নবনী হাতুড়ি এনে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত ব্যাংকটা ভেঙে ফেললো।ভেতর থেকে বের হয়ে এলো ২টাকা থেকে শুরু করে ১০০০ টাকার নোট পর্যন্ত।
সব টাকা গুনে দেখলো নবনী,মোট ১৭,৪২০ টাকা হয়েছে। টাকাগুলো তাহেরা বেগমের সামনে দিয়ে নবনী বললো,”আমার বাবা গরিব হতে পারে,আমার পরিবার গরিব হতে পারে। কিন্তু চোর নয় মা।আমার বাবার আত্মসম্মান বোধ প্রবল। তার ছেলে মেয়েদের ও টাকা পয়সার অভাব থাকলে আত্মসম্মান আছে। “
তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”আর কোনোদিন এই বাড়িতে তোরা কেউ আসবি না।বাবা মা তোরা কেউ না।জেনে নিবি নবনী মরে গেছে।”
সাব্বির মাথা নিচু করে বের হয়ে আসে।পুরো ঘটনায় তামিম আর তামিমের বাবা হামিদুর রহমান নির্বাক ছিলেন।দিশা আর লুবনা ঠোঁট টিপে হাসছে।হামিদুর রহমান নবনীর কাছে এসে বললেন,”আমাকে মাফ করে দিস মা।তোকে আমার একার পছন্দে এই বাড়ির বউ করে আনা হয়েছে বিধায় এতো অপমানিত হতে হয় সব জায়গায়। আমি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি।তোর জীবন নিজ হাতে নষ্ট করেছি।”
তামিম মায়ের বাধ্য সন্তান।তাই মা’কে একটা কথা বলার সাহস তার হয় নি।তারপর থেকে নবনী আর তামিমের পকেট চেক করে না।পকেটে যাই থাকুক তা সহ ধুয়ে রাখে।
রান্নাঘরে এসে তামিম নবনীকে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। নবনী নিজেকে তামিমের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে বললো,”মা এসে পড়বে,এখান থেকে যাও।”
তামিম নবনীর কপালে আলতো চুমু খেয়ে চলে এলো নিজের রুমে।
নবনীর সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠলো। ইচ্ছে করলো ঝামা দিয়ে ঘষে ফেলতে তামিমের চুমু দেওয়া জায়গাটা।
নুডলস রান্না করতে করতে নবনী বুঝে গেলো এই বাড়িতে তার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে।
ডাইনিং রুম থেকে দিশার চিৎকার ভেসে এলো,”বড় ভাবী,সকাল নয়টা বাজে এখনো নাশতা রেডি হয় নি কেনো?”
নবনী কোনো জবাব দিলো না।দিশা নবনীর ছোট জা।বড়লোক বাবার আহ্লাদী মেয়ে বলে তাহেরা বেগম তাকে সমীহ করে চলে। নবনীর ইদানীং মনে হয় সে যেনো বাড়ির চাকর।সবার ফরমায়েশ পালন করতে করতে তার নিজের জন্য সময় হয় না আর।এক মগ ব্ল্যাক কফি,একটা ডিম পোচ,এক মুঠো ভেজানো কাঠবাদাম নিয়ে নবনী দ্রুত টেবিলে রেখ এলো দিশার সামনে।
গজগজ করে দিশা বললো,”তোমাকে কতোবার বলেছি আমার নাশতা যাতে ঘড়ি ধরে নয়টা বাজে দেওয়া হয় আমার রুমে।কি রাজকার্য করো তুমি ভাবী,এটুকুও মনে রাখতে পারো না?”
তাহেরা বেগম রুম থেকে বের হতে হতে বললো,”নিজেকে উনি রানী এলিজাবেথ মনে করে,তাই কোনো কাজ তার হাতে উঠে না।ছোট লোকের ঘরের মেয়ে বড় ঘরে বউ করে আনাটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।”
দাঁত কামড়ে নবনী রান্নাঘরে চলে গেলো সবার নাশতা আনার জন্য।
চলবে……
#তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর
পর্ব ১
রাজিয়া রহমান
পর্ব ২-১
https://kobitor.com/category/uponas/onno/page/5/
পর্ব ১২-৩
https://kobitor.com/category/uponas/onno/page/4/
পর্ব ২২- ১৩
https://kobitor.com/category/uponas/onno/page/3/
পর্ব ৩২- ২৩
https://kobitor.com/category/uponas/onno/page/2/
পর্ব ৩৩- ৪২ ও শেষ
https://kobitor.com/category/uponas/onno/