#তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর
পর্ব ২
রান্নাবান্না সেরে নবনী নিজের রুমে গেলো গোসলের জন্য কাপড় নিতে।তামিম মনোযোগ দিয়ে তার ফোন দেখছে।সেদিকে এক নজর তাকিয়ে নবনী চলে যেতে নিলে তামিম ডাক দিলো।ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,”তুমি জানো না দিশা টাইম টু টাইম খাবার খায়,সময়মতো ওর খাবার রেডি করে রাখতে পারো না।তাহলে তো আর সবার এতো কথা শুনতে হতো না।”
নবনী শুকনো হেসে বললো,”নিজের বউয়ের পক্ষে তো কোনোদিন একটা কথাও কাউকে বলতে পারো না।ছোটলোকের মতো নিজের বউয়ের কাছে ছোট ভাইয়ের বউয়ের চামচামি করতে লজ্জা করে না?আমার পক্ষ হয়ে কাউকে কিছু না বলতে পারো তো বলো না।তবে অন্যের হয়ে চামচামি করতে এসো না।”
নবনীর কথা শুনে তামিমের দুই কান লাল হয়ে গেলো। বিছানা থেকে নেমে এসে নবনীর গলা টিপে ধরে বললো,”চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতে শিখেছিস না-কি?
চামচামি করি আমি?নিজেকে তুই দিশার সাথে তুলনা করছিস?
দিশা হচ্ছে সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস আর তুই কি?
পাতি হাঁস ও না তুই।তোকে কি এই বাড়িতে এনেছি শোপিস হিসেবে সাজিয়ে রাখার জন্য না-কি? “
নবনীর চোখ উল্টে এলো,দম বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু তামিম ছাড়ছে না তার গলা।উপায় না পেয়ে নবনী এক লাথি বসালো তামিমের হাটুতে।তামিম মৃদু আর্তনাদ করে ছেড়ে দিতেই নবনী কাশতে লাগলো।
এক গ্লাস পানি খেয়ে নবনী বললো,”আমার বাবা মা এসে তোমার পায়ে পড়ে নি আমাকে বিয়ে করার জন্য।আমি গরীব ঘরের মেয়ে জেনেশুনেই বিয়ে করেছ।তবে আজ কেনো এসব বলছো?বিয়ে হয়েছে ৩ বছর,আসার পর থেকে চাকরের মতো খাটতে হচ্ছে তোমাদের বাসায়।তাও তোমাদের মন পেলাম না।আমার বিচার উপর ওয়ালার কাছে।”
তামিম কে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নবনী কমন বাথরুমে চলে গেলো।
এই বাসায় ৩ টা বাথরুম।একটা দিশার রুমের সাথে লাগোয়া,আরেকটা লুবনার রুমে।আর একটা কমন বাথরুম যেটা নবনীরা এবং শ্বশুর শাশুড়ি মিলে ব্যবহার করে। প্রায়শই ভোররাতে শাশুড়ির সাথে অপ্রস্তুত ভাবে দেখা হয়ে যায় নবনীর,তামিমের।তামিম সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিজের গোসল সেরে চলে যায় কিন্তু লজ্জায় পড়ে নবনী।মাসুল দিতে হয় তাকে।তাহেরা বেগম এসব নিয়ে সবসময় কথা শোনায় নবনীকে।বেহায়া,অসভ্য,নির্লজ্জ মেয়ে থেকে শুরু করে যতো নিকৃষ্ট গালি আছে সব দেন।
নবনী সবে গায়ে সাবান দিতে নিলো সেই মুহুর্তে তাহেরা বেগম বাথরুমের দরজায় নক দিলেন তাড়াতাড়ি বের হবার জন্য।তিনি গোসল করবেন।
নবনী কিছু না বলে বের হয়ে এলো। তাহেরা বেগম গোসল করতে করতে নবনী রান্নাঘরে চলে এলো। একটা ব্যাংকে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলো,আগামী বুধবার ইন্টারভিউ হবে।কিচেন যার্কের উপর থেকে সাজেশন বের করে ডাইনিং রুমে গিয়ে বসলো একটু পড়তে।নবনীর আজ হঠাৎ করে মনে হলো যেকোনো উপায়ে হোক তাকে চাকরিটা পেতেই হবে।এই বাড়িতে সে অতিথি মাত্র,সকালে যেই মেয়ের ছবি দেখেছিলো তামিমের পকেটে সেই হবে এই বাড়ির বড় বউ,নবনী এই বাড়িতে চিরদিন থাকতে পারবে না।
ভাবতেই নবনীর কান্না এলো।কেমন ঝাপসা হয়ে গেলো।ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলো হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে তামিম বের হয়ে যাচ্ছে। নবনী কিছু জিজ্ঞেস করার আগে তামিমে দুপদাপ পা ফেলে লিফটে উঠে গেলো।
নিতু পার্কের এক কোণে একটা বেঞ্চে বসে রইলো। হাতে একটা নীল ছাতা।বর্ষাকাল চলছে,মুহুর্তে আকাশ অন্ধকার হয়ে ঝঝরঝরিয়ে বৃষ্টি নামে।ছাতা ছাড়া কোথাও বের হওয়া যায় না।
পাশে একটা কদম গাছে থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। সেদিকে তাকিয়ে নিতু মুগ্ধ হয়ে গেলো। তামিম প্রথম যেদিন নিতুকে ভালোবাসার কথা বলেছিলো,একটা বেলি ফুলের মালা হাতে নিয়ে বলেছিলো।
ভাবতেই লজ্জা পেলো নিতু।অফিসে নিতু তামিমের আন্ডারে কাজ করে। ছয়মাস হলো নিতু চাকরিতে যোগ দিয়েছে।তার মধ্যে কিভাবে যেনো তামিমের প্রেমে পড়ে গেছে সে। আর পড়বে না কেনো,এরকম স্মার্ট একজন মানুষের সাথে দিনের মধ্যে সারাদিন একসাথে কাজ করতে গেলে ভালোবাসা এমনিতেই হয়ে যায়।
তামিম এলো কিছুক্ষণ পর। নিতু তামিমকে দেখে গাল ফুলিয়ে বললো,”কতোক্ষণ অপেক্ষা করেছি আমি?”
তামিম নিতুর নাকের সাথে নিজের নাক ঘষে বললো,,”বাব্বাহ,এটুকু অপেক্ষা করেই এতো রাগ।আর আমি যে তোমার প্রেমে পড়ার জন্য ২৯ বছর ধরে অপেক্ষা করে ছিলাম,আমি তো কখনো এরকম অধৈর্য হই নি।”
নিতু লজ্জা পেলো তামিমের কথা শুনে।তামিমকে বললো,”এভাবে আর কতো দিন,আমার আর ভালো লাগছে না।তুমি তোমার বাসায় বলছো না কেনো?”
তামিম একটু ইতস্তত করে বললো,”কি করবো বলো,ছোট বোনের বিয়ে না দিয়ে তো আমি বিয়ে করতে পারছি না।একটু বুঝার চেষ্টা করো আর একটা বছর অপেক্ষা করো নিতু।আমার ও তো তোমাকে ছেড়ে থাকতে ভালো লাগছে না।”
নিতু কথা না বাড়িয়ে তামিমের বুকে মাথা রাখলো। তামিম আস্তে করে বললো,”কাছেই আমার এক বন্ধুর বাসা আছে নিতু,যাবে আমার সাথে।কিছুক্ষণ আমরা নিরিবিলি সময় কাটাতে পারবো।”
কথাটা শুনেই নিতুর বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। তামিমকে সে যতোই বিশ্বাস করুক,ভালোবাসুক কিন্তু নিতু জানে ছেলেরা বিয়ের আগে মেয়েদের দেহের স্বাদ পেয়ে গেলে তারপর তাকে ছুঁড়ে মারতে একবার ও ভাবে না।যদিও তামিম তেমন ছেলে না তবুও নিতু এই ব্যাপারে কোনো রিস্ক নিতে চায় না।
এড়িয়ে গিয়ে নিতু বললো,”না,বিয়ের পরে এক মাসের ছুটি নিবো।তখন ২৪ ঘন্টা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দুজন নিরিবিলি সময় কাটাবো।এখন না।”
মেজাজ গরম হয়ে গেলো তামিমের নিতুর প্রত্যাখ্যান শুনে।নিতুকে তামিম যতোটা ভালোবাসে তার চাইতে বেশি ভালোবাসে নিতুর কোমল দেহটাকে।ফিটিং কামিজের মধ্যে দিয়ে নিতুর সুগঠিত দেহের অবয়ব তামিমকে পাগল করে দেয়।নিতুর শরীরের উষ্ণতা তামিমকে মাতাল করে দেয়। নবনী সুন্দর,নিতুর চাইতে বেশি সুন্দর হতে পারে কিন্তু নবনীর কাছে গেলে তামিমের নিজেকে এরকম পাগল পাগল লাগে না।এরকম ঘোর লাগে না।
নিতু উঠে দাঁড়িয়ে বললো,”চলো শপিং এ যাই।তুমি তো আমার পরিবারের সবার জন্য শপিং করে দিলে,আজ না হয় আমি তোমার পরিবারের সবার জন্য করে দিবো।”
তামিম উত্তর দেবার আগে নিতু নিজেই উঠে হাঁটা শুরু করলো।অগত্যা তামিম ও পিছু নিলো নিতুর।
বিকেলে বাসায় ফিরে দেখলো তামিম বসার ঘরে বাবা মা লুবনা দিশা বসে আছে। বাবা একটা পত্রিকা মুখের উপর তুলে নিয়ে বসে আছে। মা,দিশা,লুবনা মিলে কিছু নিয়ে আলোচনা করছে।
তামিমের হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ দেখে লুবনা হুমড়ি খেয়ে পড়লো।তারপর বললো,”আমার জন্য কি এনেছিস ভাইয়া?
তাড়াতাড়ি দেখা।”
নবনী সবার জন্য চা নিয়ে এলো।চা রেখে যেতে নিতে হামিদুর রহমান বললো,”যাচ্ছো কেনো,দাঁড়াও।তামিম সবার জন্য শপিং করে এনেছে। তোমারটা নিয়ে যাও।”
হামিদুর রহমানের কথায় তামিমের মনে হলো,সবার জন্য টুকটাক অনেককিছু কিনলেও নবনীর জন্য কিছু কেনা হয় নি।যেহেতু এসব কিছু আজকে নিতু কিনে দিয়েছে নিতু তো জানে না তামিমের স্ত্রী আছে। বাসায় ফেরার সময় আগে তামিমের স্টপেজ পড়ে তারপর নিতুর।তাই তামিম পরে আর কিছু কিনতে ও পারে নি নবনীর জন্য।
একে একে সবার উপহার সবাই পেলেও নবনী কিছু পেলো না।হামিদুর রহমান হতভম্ব হয়ে বললো,”নবনীর জন্য কই?”
তামিম আমতাআমতা করে বললো,”আসলে বাবা,টাকায় কুলোয় নি তাই নবনীর জন্য…… “
তামিম কথা শেষ করার আগে হামিদুর রহমান তার জন্য আনা পাঞ্জাবি পাজামা,আতর,টুপি,ঘড়ি সব কিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।
লজ্জায় নবনীর মাথা কাটা গেলো যেনো।নিজেকে মনে হলো ভীষণ লোভী কেউ।কেনো এখানে দাঁড়াতে গেলো শ্বশুরের কথা শুনে,তার জন্য অনুশোচনা হতে লাগলো।
তাহেরা বেগম উঠে নবনীর গালে সপাটে চড় মেরে বললো,”হ্যাংলার মতো এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে কে বললো তোকে?বাপের বাড়িতে তো কিছু চোখে দেখিস নি তাই লোভীর মতো দাঁড়িয়ে ছিলি নিজের জন্য আনা উপহারের আশায়?”
তামিম কাউকে কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেলো। তামিম যাওয়ার পর সবাই চলে গেলো। দাঁড়িয়ে রইলো শুধু নবনী।মূর্তির ন্যায় নিশ্চলভাবে,যেনো নড়াচড়া করার ক্ষমতা ও নেই তার।
কাউকে কোনো অভিযোগ করলো না।চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে বললো,”আল্লাহ তুমি আমার সহায় থেকো,আমি সহ্য করছি কিন্তু তুমি সহ্য করো না।আমাকে শক্তি দাও সবর করার।নিজের যোগ্য স্থান করে নিয়ে আমি যেনো এদের মুখে থুতু মেরে চলে যেতে পারি। “
হামিদুর রহমান বাসায় ফিরলেন রাত নয়টার দিকে।হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে ফিরলেন তিনি।তারপর সবাইকে ডেকে এনে বসালেন ড্রয়িং রুমে। নবনী আসতে চাইলো না কিন্তু তিনি জোর করে ধরে নিয়ে এলেন।
দিশা অনেক ব্যাগ দেখে বললো,”ইশ,আজকের দিনটি এতো ভালো যাচ্ছে কেনো?
বাবাও আমাদের জন্য শপিং করে এনেছেন দেখছি।”
লুবনা বললো,”তাড়াতাড়ি দেখাও না বাবা।”
হামিদুর রহমান একটা ব্যাগ খুলে একটা নীল সিল্কের শাড়ি বের করে নবনীর হাতে দিয়ে বললেন,”এটা তোমার জন্য মা।”
দিশা,লুবনা,তাহেরার মুখ কালো হয়ে গেলো। তামিম কিছুটা লজ্জা পেলো। আরেকটা ব্যাগ থেকে এক জোড়া জুতা বের করে নবনীকে দিয়ে বললেন,”এটা তোমার শাড়ির সাথে ম্যাচ করে নিয়েছি আমি।দেখো তো পায়ে হয় কিনা।তোমার জুতার সাইজ তো এরকমই। “
নবনী হতভম্ব হয়ে বসে রইলো শ্বশুরের কান্ড দেখে।হামিদুর রহমান আরেকটা ব্যাগ থেকে এক ডালা রেশমি চুড়ি বের করে নবনীর দিকে দিয়ে বললেন,”এগুলো তোমার। “
এরপরে বের করলেন তিনটি সুতি থ্রিপিস,একটা ল্যাভেন্ডার কালার, একটা কফি কালার আরেকটা বেবি পিংক কালার।সবগুলো নবনীর হাতে দিয়ে বললো,”এগুলো ও তোমার। “
দিশা আর লুবনা অধৈর্য হয়ে গেলো নিজেদের জিনিস দেখার জন্য।কিন্তু তবুও চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলো।
হামিদুর রহমান বড় ব্যাগটা থেকে একটা সোনালি রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি বের করলেন।শাড়িটির নিখুঁত কাজ,আর কালার কম্বিনেশন দেখে দিশা,লুবনা দুজনের মাথা নষ্ট হয়ে গেলো যেনো।
হামিদুর রহমান সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,”নবনী,এটা ও তোমার জন্য।”
আরেকটা ব্যাগ খুলে একটা পার্স বের করে বললেন,”এটা ও তোমার। “
নবনীর বিস্ময়ের সীমা রইলো না এতো কিছু দেখে।হামিদুর রহমান শেষ তিনটা ব্যাগ নবনীর হাতে দিয়ে বললো,”এগুলো আর বের করে দেখানোর কিছু নেই।আমি দোকানে গিয়ে সেলসগার্ল মেয়েটাকে বলেছিলাম আমার বউমার জন্য কিছু স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট দিতে।মেয়েটা বললো ওদের কম্বো আইটেম আছে।তারপর হাবিজাবি তেল,সাবান,শ্যাম্পু,বডিওয়াশ,ফেসওয়াশ,ক্রিমট্রিম কি কি মিলিয়ে যেনো এসব তিন ব্যাগ এনে দিলো।
ওদের ফেসবুক পেজের নাম ও দিয়ে দিয়েছে একটা কার্ডে,তোমার কোনো কিছু জানার দরকার হলে ওলে মেসেজ দিতে বলেছে।”
নবনীর চোখে জল টলমল করতে লাগলো। লুবনা রেগে গিয়ে বললো,”বাবা,আমাদের জন্য কিছু আনো নি?”
হামিদুর রহমান হাই তুলতে তুলতে বললো,”তামিম যখন তোদের সবার জন্য এনেছে তখন তো নবনী জিজ্ঞেস করে নি ওর জন্য কিছু এনেছে কিনা।তোরা তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেনো?তামিম তোদের উপহার দিয়েছে নবনী দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।এখন আমি নবনীর জন্য এনেছি তোরা দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিস। হিসেব বরাবর হয়ে গেলো। “
তাহেরা বেগম চেয়ারে একটা লাথি দিয়ে চলে গেলো। হামিদুর রহমান হাসতে হাসতে বললো,”তাহেরা,আগামীকাল তোমার গুণধর কন্যাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।সব কিছুর ব্যবস্থা করে রেখো।”
চলবে……
রাজিয়া রহমান