#পঞ্চবিংশ_প্রহর
#Yasira_Abisha (#Fatha)
ভোর পেরিয়ে ঘড়িতে ৭ঃ৩০ বেজে গেছে, ইরাদ তৈরি হয়ে সকাল থেকেই বসে ছিলো কখন ৮টা বাজবে কখন সে বেড় হবে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। ঘড়ির কাটা ৭ঃ৩০ এ আসতেই ইরাদ বেরিয়ে পড়লো। রুহির সম্পর্কে জানার আগ্রহ নিয়ে সারারাত ঠিক মতো ইরাদের ঘুম হয় নি। তাই তো সে শুরু থেকেই সারারাত ধরে রুহির ডায়েরীটা পড়েছে। সেখানে লিখা ছিলো কিভাবে রুহি ইরাদকে প্রথম দেখে, কিভাবে ইরাদের প্রেমে পড়ে একটু একটু করে। মনের মধ্যে ইরাদের প্রতি তার কতটা ভালোবাসা রয়েছে। সবটা পড়ে ইরাদের খুব বেশি অস্থির লাগছিলো, ইরাদ কোনোদিন মনে করেনি ও ভুল করেছে রুহিকে রেখে এসে, কিন্তু কেনো যেনো এখন খুব বেশি দুর্বল লাগছে। এসব পড়ে মনে হচ্ছে “থাক রুহি যদি সত্যিই বিয়ে করে থাকে তাহলে ভালো হবে, আমি তো ওকে নিজের করতে পারি নি আর পারতাম ও না। মেয়েটা আগে বাড়লেই আমি খুশি ও সুখের সংসার করুক।”
ইরাদের মনে একটা ভীতি কাজ করছে, বিয়ে হলে ঠিক আছে আর যদি না হয় এর অর্থ রুহি এখনো ওকে ভালোবাসে যদি ভালোবাসা নাই থাকতো তাহলে তো অভিমান করে রুহি বলতো না ইরাদকে ও বিয়ে করে নিয়েছে। ইরাদ মনে প্রাণে চাইছে রুহি জীবনটা গুছিয়ে নিক। অন্য কারো হয়ে সেই সুখটা পাক, যার প্রত্যাশা ও ইরাদের কাছে করতো।
.
ইরাদ হাসপাতালে যাওয়ার পরে ফুল নিয়ে ওকে বরণ করা হয়েছে, নতুন পুরাতন সব ডাক্তাররা আছেন, সবাই এসে ইরাদের সাথে দেখা করছেন পরিচিত হচ্ছেন। তবে ইরাদের চোখ দুটো শুধু রুহিকেই খুজছে, রুহি কি এখানে আছে কি না? সবার নাম জানা হলো তবে এখানে কোনো রুহি নামের মেয়ে দেখলো না ইরাদ। তাহলে কি সে আংকেলের মেয়ে আসে নি এখানে?
ইরাদ শুধু জানতে চাচ্ছে সে রুহিটা কোথায়?
কিন্তু রাউন্ডের সময় হওয়ায়, ইরাদ সবার সাথে চলে গেলো, প্রথম রাউন্ড শেষ করে ওর কেবিনে গিয়ে বসেছে।
রুহি আজকে প্রথম দিন হওয়া স্বত্তেও বড্ড দেরি করে ফেলেছে আজকে, নতুন যে প্রফেসর আসবেন তার সাথে দেখা ও করা হবে না বোধহয়। উনি প্রথম রাউন্ডে যখন যাবে সকল ডাক্তারদের উপস্তিত থাকার কথা ছিলো কিন্তু এখন ঘড়িতে ১০টা বেজে গেছে। রুহি হরবরিয়ে ডিনের কেবিনে যায়। তার কাছে যাওয়ার পরে জানতে পারে আজকে সকালের পেশেন্টদের রুমে রাউন্ড দেওয়া শেষ। রুহি নিজের ডিউটি টাইমটা প্রথম দিন মিস করে ফেলবে এর জন্য রুহির ওপরে ডিন একটু রাগ ও করেছেন। রুহির ডিউটি টাইম এখন থেকে সকালে আর বিকেলে নতুন ডাক্তারের সাথে।
তানিয়া- রুহি এসেছ?
– হ্যাঁ অনেক বেশি দেরি করে ফেললাম।
– তা তো বটেই।
– আমাদের স্পেশাল গেস্ট ডক্টর এসে পড়েছেন। সকালেই তার সাথে দেখা হয়েছে, চলো তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই।
– ঠিক আছে
রুহি কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে ইরাদ। পেছনটা দেখেই ইরাদকে চিনতে অসুবিধা হয়নি রুহির, কাল ইরাদের সাথে দেখা হওয়ার মানেটা রুহির মাথায় কাল পর্যন্ত আসে নি, ইরাদ কেনো এসেছেন সিলেটে এই মুহুর্তে রুহি বুঝতে পারছে, নতুন স্পেশাল গেস্ট ডক্টর হলেন ইরাদ, রুহির কলিজাটা একদম খট করে উঠে ইরাদের আশেপাশে এখন রুহির থাকতে হবে। কিভাবে নিজেকে ও সামলাবে? ও জানে না।
কারো প্রবেশের শব্দ পেয়ে ইরাদ পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে ডক্টর তানিয়ার সাথে রুহি দাড়িয়ে আছে। রুহিকে দেখে ইরাদের চোখ দুটো একদম স্থির হয়ে যায়। ও চায়নি রুহিকে দেখতে এই জায়গায় এই রুহি হিসেবে।
তানিয়া- আসবো স্যার?
– জ্বি আসুন।
রুহি নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে
তানিয়া- স্যার উনি হচ্ছেন ডক্টর রুহি, আর রুহি উনি ডক্টর ইরাদ আহসান
স্যার, আজকে ও আসতে একটু দেরি করে ফেলেছেন তাই সকালে আপনার সাথে দেখা করতে পারেন নি। যদিও ওর বাসা এদিকেই তারপরেও দেরি হয়ে গেছে ওর।
ইরাদ একটা স্মাইল করে রুহির দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
– হ্যালো, ডক্টর রুহি
ইরাদের হাত বাড়ানো দেখে রুহি অবাক হয়ে ইরাদের দিকে তাকায়, তবে তানিয়ার সামনে কোনো রিয়েক্ট করলো না। চুপচাপ ইরাদের সাথে হ্যান্ডশেক করে।
রুহি চেষ্টা করছে ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলার। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করেও রুহি পারছে না। কালকে সেই কেক দেখে রুহির মনে খুব বড় একটা আঘাত এসেছে, কোনোক্রমেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। খুব কষ্ট আর রাগ হচ্ছে রুহির।
ইরাদ রুহির ব্যাপারে জানার জন্য বললো,
– আজকে আপনাদের দুজনের প্রথম দিন?
তানিয়া উত্তর দিলো,
– জ্বি স্যার।
– আপনাদের বাসা এখানেই?
– জ্বি স্যার আমি সামনের গলির উইমেন্স হোস্টেলে থাকি। আর রুহির বাসা ৫ মিনিটের দূরত্বে, জমিদার বাড়ি।
এবার আর ইরাদের বুঝতে বাকি রইলো না, কালকে সোবহান সাহেব যার কথা বলেছিলেন সেই রুহিই ইরাদের রুহি। রুহি মিথ্যা বলেছিলো, রুহির বিয়ে হয় নি। তার মানে রুহি এখনো ইরাদকে ভালোবেসেই আছে, একা আছে। এতো গুলো বছর এভাবে একা কাটানো কি আসলেই স্বাভাবিক ব্যাপার? কতোটা ভালোবাসা থাকলে একটা মানুষ পারে এমনটা করতে? রুহি আর তানিয়া চলে যাওয়ার পরেও ইরাদ তাই ভাবছিলো, কোনোক্রমেই এসব ভাবনা মাথা থেকে ইরাদ দূর করতে পারছিলো না।
বিকেলে ইরাদের পেশেন্ট দেখা শেষ হলো সে সময়ই, তানিয়া এলো
– স্যার ভেতরে আসি?
খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে তানিয়া কে।
– জ্বি আসুন।
– স্যার ডক্টর ইকবালকে দেখেছন?
– না দেখিনি উনি আমার কেবিনে আসেন নি।
– আচ্ছা স্যার।
– কি হলো ডক্টর তানিয়া?
– স্যার আমাদের পাহাড়িয়া অঞ্চলের দিকে ভূমিধস হয়েছে আজ দুপুরেই। অনেকের জীবন সংকটে, আমাদের রেস্কিউ টিম ম্যানেজমেন্ট বানিয়ে দিয়েছেন ডক্টর ইকবাল সহ মোট ৮ জন যাবো আমরা কিন্তু এখন উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের সবার বাসা কাছে হওয়ার কারণে এই টিমটাকে সিলেক্ট করা হয়েছে, উনি কি আসবেন না বুঝতে পারছি না আমরা, তার ফোন ও বন্ধ দেখাচ্ছে। সবাই রেডি এখন শুধু বেড় হবার পালা।
-সিনিয়র কোনো ডক্টর যাচ্ছেন আপনাদের সাথে?
– না স্যার।
– ঠিক আছে ডক্টর ইকবালকে খুজতে হবে না।
– তাহলে আমরা ৭জনই যাবো স্যার?
– না ৮ জন যাবেন। আমি আপনাদের সাথে যাচ্ছি।
চলুন বের হওয়া যাক, আমার হোটেল সে পথেই পড়বে আমার ব্যাগটা তখন তুলে নেওয়া যাবে।
ইরাদের কথা শুনে তানিয়া হা হয়ে রইলো, স্যার একে তো এতো বেশি অমায়িক মানুষ আর এতো বেশি দয়ালু ধরনের মানুষ। উনি যে এতো বড় বড় ডিগ্রিধারি একজন ডাক্তার, তা বুঝার উপায় নেই।
তার ওপরে এই জায়গায় প্রাণের রিস্ক ও আছে তারপরেও উনি যেতে রাজি হয়ে যাচ্ছেন। না বলার পরেও। তানিয়ার যেনো ইরাদের প্রতি সম্মান আরো বেড়ে গেলো।
তানিয়াকে ইরাদের কেবিন থেকে বেড় হতে দেখে রুহি ডাক দিলো
– তানিয়া দেখ, ডক্টর ইকবাল আমাকে মেসেজ দিয়েছেন সে নাকি আসতে পারবেন না। চিন্তা কর কি রকম খারাপ লোক? ডক্টর কেনো হয়েছেন তাহলে উনি? দায়িত্ব জ্ঞানহীন একজন লোক, আমার তো মেজাজই খারাপ লাগছে।
তানিয়া হেসে হেসে বলছে
– থাক এইরকম চেলা পুটি লাগবে না আমাদের টিমে।
তানিয়ার মুখে হাসি দেখে রুহি জিজ্ঞেস করলো,
– হাসির কি হয়েছে এই রকম সিরিয়াস মোমেন্টে?
তখন তানিয়া বলে,
– পিছে তো দেখো,
রুহি তাকিয়ে বলে,
– পেছনে ডক্টর ইরাদের কেবিন
– জ্বি, এবার বুঝে নে
– কি বুঝবো?
সে সময়ই ইরাদ কেবিন থেকে বেড় হয়।
এবং রুহি আর তানিয়া কে দেখে বলে,
একটা স্মাইল দিয়ে বলে,
– চলুন দেরি হয়ে যাবে নাহয়।
রুহি এক ভ্রু উঠিয়ে তানিয়ার দিকে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায়,
মানে ইরাদ যাচ্ছে কি না সাথে এটা জানতে চাচ্ছে?
তানিয়া একবার চোখের পলক ফেলে রুহিকে বুঝায় তুই যা ভাবছিস তাই ঠিক।
দুই মাইক্রোতে সবাই ভাগ হয়ে বসেছে, রুহি আর ইরাদ আকই মাইক্রোতে।
এই সময় রুহির কিছু কাপড় আর প্রয়োজনীয় সবকিছু টুনি এনে দিয়ে গেছে। এর মাঝে রুহিকে সোবহান সাহেব কল করেছেন রুহিকে,
– হ্যাঁ পাপা আমি ঠিকঠাক ভাবেই থাকবো তুমি চিন্তা করো না।
-ওকে পাপা আমি খেয়াল রাখবো আমার।
ইরাদ যাওয়ার পথেই নিজের ব্যাগ নিয়ে এলো,
রুহির বেশ অস্বস্তি লাগছে ইরাদের সাথে যেতে। বারবার মনে হচ্ছে এই লোকটা তো অন্যজনের, ইরাদকে যতবার রুহি দেখতে ততবারই ওর মনটা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, ইরাদকে দেখলে যেমন চোখে স্বস্তি আসে তেমনি মনের মধ্যে এক ঝড় বয়ে যায়।
এরই মাঝে রুহিকে ওর ছোট বেলার এক বান্ধুবী ফোন করলো সামনের মাসে তার বিয়ে,
রুহির কথা গুলোই শুধু ইরাদ শুনতে পারছে।
– আলিয়া আমি আসবো তোর বিয়েতে
– বয়সের ব্যাবধান কোনো সমস্যা না, ভালোবাসা আর আন্ডারস্টান্ডিংনেস থাকলে সবই হয়। তুই উনাকে ভালোবাসলে এসব কিছুই না।
– হ্যাঁ এইজন্যই বলছি, আর শোন নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার সবাই তা পায় না তুই পাচ্ছিস। এইজন্য এই জিনিসটা দূর হতে দিস না।
– নাহ আমার জন্য বয়সের ব্যাবধান কিছুই না, মায়া টান ভালোবাসা থাকলে ১৩ বা ১৪ যাই হোক এই ব্যাবধান কিছুই না।
– হ্যাঁ দোস্ত আমি আসবো ইনশাআল্লাহ। এখন রাখছি
তানিয়া- কে ছিলো রে?
– আলিয়া আমার ছোটোবেলার ফ্রেন্ড। ওর বিয়ে সামনে।
– বয়স নিয়ে কি বলছিল?
– ওর হবু বড় ওর থেকে ১৪ বছরের বড় তবে ওকে খুব ভালোবাসে। এই নিয়েই ভাবছিলো থাকতে পারবে কি না? বা সামনে সমস্যা হবে কি না?
– বয়সটা আসলে ফ্যাক্ট করে না তেমন
– হ্যাঁ আসলেই করে না। আমি বললাম তুই ভালোবাসলে উনাকে বিয়ে কর কারণ প্রেম সবার জীবনে আসে তবে সত্যিকারের ভালোবাসা সবাই পায় না। আর শান্তি অনুভব করা অনেক বেশি জরুরি, যার সাথে থাকলে আমি শান্তি পাবো তাকেই বিয়ে করা উচিত। এই মানসিক শান্তি কোটি টাকা দিয়েও পাওয়া যায় না। যা নিজের আওই মানুষটাকে দেখলে পাওয়া যায়।
– হুম আমিও তাই চিন্তা করি।
ইরাদ কথা গুলো শুনে ভাবছে মেয়েটা কতো ম্যাচিউর হয়ে গেছে, আর কতটা অন্যায় করেছে রুহির সাথে খুন বেশি অপরাধী লাগছে আজকে নিজেকে, ইরাদ অনুতপ্ত ওর আচরণের জন্য। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে দেওয়া কষ্ট গুলো সব শুধে আসলে সুখ দিয়ে পূর্ণ করে দিতে।
( রুহি আর ইরাদের জীবনে এবার একটু রোমান্স আসলে কেমন হবে? আর রুহি কি ইরাদকে মাফ করে নিজের করে নিবে? সবাই অনুতাপ নিয়ে নিজের মতামত দিবেন আশা করছি আপনাদের মূল্যবান কমেন্টস এলে নিজের লিখালিখি স্বার্থক লাগে)