#পাপ পর্ব ২
রাশেদের গ্রামের বাড়ি থেকে আসার দিন পনেরো পরের ঘটনা। এই কয় দিন নীলিমা বাসায় ফেরেনি। একটা হোটেলে রুম বুক করে থেকেছে।
আরও কিছু প্রমাণ, তথ্য জোগাড় করা দরকার ছিল। সেসব কিছু একত্র করতে করতে প্রায় অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল।
সেদিন ছিল ২৫ নভেম্বর। রাশেদ এর জন্মদিন। সেদিন বাসায় ফিরবে আগেই বলে রেখেছিল নীলিমা। বাসায় আসে সন্ধ্যার দিকে। ঢুকতেই রহিমা আপা জড়িয়ে ধরে নীলিমাকে।
– ভালা আছনি। কতদিন আছিলা না। বাসা ডা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আছিল।
– এইযে এসে পড়েছি। আপনি ভাল আছেন?
– হ আছি। আসো খাইবা। সব রাইন্দা থুইছি।
এরপর রাশেদ ফিরলে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করে। রাশেদের জন্য একটা বার্থডে কেক এনেছিল নীলিমা। সবাই একসাথে কেক কেটে রাশেদ কে উইশ করে।
এরপর সবকিছু শেষে ডাইনিং এর সাথে লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল নীলিমা।
প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছে। ভাল লাগছে নীলিমার। বৃষ্টির জন্য রাস্তার সামনের বাসাটাও দেখা যাচ্ছে না। অস্পষ্ট হয়ে আছে। কি অদ্ভুদ, এত কাছে অথচ তাও দেখা যাচ্ছেনা। মানুষও হয়ত তার ব্যতিক্রম না। চোখের সামনে থাকা বিষয়গুলোই অস্পষ্ট রয়ে যায় আমাদের কাছে।
– কি করেন আম্মা।
পেছনে রহিমা আপা এসে দাঁড়িয়েছে।
– কিছু করিনা আপা। বৃষ্টি দেখছি।
– শরীর ডা ভালা?
একটু হাসল নীলিমা।
– কেন আপা আমার কি শরীর খারাপ থাকার কথা?
– না না ছি ছি কি কন। এমনেই জিগাইলাম।
একটু চুপ থেকে খুব শান্ত কন্ঠে নীলিমা বলল,
– হিমিকা কে কেন মারলেন আপা?
রহিমা আপার সহজ সরল বোকা বোকা ভাব করে থাকা মুখটায় যেন আষাঢ়ের কালো মেঘ এসে পড়েছে।
– কি কইতেছেন। হিমিকা আম্মারে আমি কোনোদিন দেখিই নাই। আমি উনার মরণের অনেক পরে আইছি।
– আর মিথ্যা বলবেন না আপা। আমি সব জানি।
আমি দৌলতপুর গিয়েছিলাম। কাকলির কবর দুর থেকে দেখে এসেছি। অভাগী মেয়েটার জন্য অনেক দুয়া করে এসেছি।
এবার যেন হিংস্র হয়ে উঠলেন রহিমা আপা। চিরচেনা অমায়িক দৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই এই চাহনিতে।
হিংস্র, প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি এখন তার চোখে।
– তোর সাহস তো কম না। তুই আমার কাকলির কাছে গেছিলি কেন।
রহিমা আপার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে নীলিমা বলতে লাগল,
– আপা, আমি আপনাকে নিজের মায়ের মত শ্রদ্ধা করে এসেছি। আমি একজন মেয়ে। অন্যায় এর শিকার আমিও হয়েছি। আমি বুঝি। আপনার পরিবারের সাথে যেটা হয়েছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তাই বলে নিষ্পাপ হিমিকা কে আপনি এভাবে মেরে ফেলতে পারলেন! রিফাত এর জন্মের দুই বছর পরেই হিমিকা মারা যায়।
মৃত্যুর কারণ ছিল ফুড পয়জনিং। খাদ্যে বিষ ক্রিয়া। কিন্তু কারো ধরবার উপায় ছিল না কি খাবার, কিভাবে হল।
আমি আপনার গ্রামের বাড়িতে আপনার বাড়ির পেছন দিকটায় অজস্র জাতের মাশরুম দেখেছি। আপনি প্রতিবছর আগস্ট মাসের দিকে বাড়িতে যান। কাকলির মৃত্যু দিবস উপলক্ষে। কিন্তু আসল কারণ টা কাওকে জানান না। আপনার স্বামী বেশ নামকরা কবিরাজ ছিলেন। গাছ পালা এসব ব্যাপারে জ্ঞান আপনাদের ছিল। মাশরুম যেমন নানা রোগের ওষুধ হতে পারে তেমন জীবন নাশক ও হতে পারে। অজস্র জাত আছে এই মাশরুমের। একটি জাত আছে যা একটু খাওয়াই মানুষের জন্য যথেষ্ট এবং এটা সবচেয়ে বেশি বিপদজনক। কারণ এটি ১২ ঘন্টার আগে কোন লক্ষণ প্রকাশ করে না। এ কারণে ডায়াগনসিস করলেও কিছু ধরা পড়ে না। ১২ ঘণ্টা পর হাত পায়ে খিচুনি উঠে মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে মৃত্যু হয়। হিমিকা কে আপনি এই জাতের ই কোন একটা মাশরুম খাইয়েছিলেন তাইনা।
একটু থামল নীলিমা। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
রহিমা আপা হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আবার শুরু করল নীলিমা,
হিমিকা যে স্কুলে টিচার ছিল, সেই স্কুলের আয়া ছিলেন আপনি। আপনি প্রায়ই এটা সেটা রান্না করে নিয়ে যেতেন হিমিকর জন্য। অনেক বিশ্বাস আর ভালবাসত আপনাকে হিমিকা। খুব ভাল প্রতিদান দিয়েছেন আপনি। সুযোগ বুঝে একদিন খাইয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত খাবার। হীমিকার মৃত্যু ও হাত পায়ে খিচুনী দিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে হয়েছিল ঠিক কাকলির মত। কাকলির মৃত্যুও এই একই মাশরুম খেয়ে হয়েছিল তাইনা আপা?
– হ। মারছি আমি। খুব ভালা করছি। এই রাশেদ কুত্তার বাচ্চারে আমি সুখী হইবার দিমু না। হে যারেই আপন কইরা নিব হেরেই আমি শেষ কইরা দিমু। আমার কাকলি রে যেমনে শেষ করছে অমনেই শেষ কইরা দিমু।
রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে নীলিমাকে মারতে আসে রহিমা আপা। পেছন থেকে ধরে ফেলে রাশেদ। চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে রাশেদের। এতক্ষণ সবই শুনেছে সে। আগেই জানিয়ে রেখেছিল নীলিমা। নিজের উপস্থিতি গোপন করে সব শুনছিল।
চিৎকার করে গালি দিয়ে সজোরে আঘাত করে রাশেদ রহিমা আপাকে।
– রাশেদ ছেড়ে দাও ওনাকে। ওনার এই পরিস্থিতির পেছনে যদি কাওকে দায়ী করতেই হয় তাহলে তুমিই দায়ী।
পেছন ঘুরে তাকাল রাশেদ। রহিমা আপাকে ছেড়ে দিয়ে নীলিমার দিকে এগিয়ে আসছে অপ্রকৃতস্থ মানুষের মত।
– কি বললে তুমি আমি দায়ী?
– হ্যা। তুমি দায়ী। একটা অল্পবয়সী মেয়ের সর্বনাশ করে তাকে মরতে ফেলে এসেছ। ঘুরেও তাকাও নি তুমি। সবই জানি আমি। দৌলতপুর থানায়ও খবর নিয়েছি আমি। কাকলির মৃত্যুর ব্যাপারে গ্রামের মানুষ যা বলেছে আমাকে কোনোটাই মিথ্যে নয়। প্রমাণের অভাবে, আর তোমাদের টাকার দাপটে কেও কিছু করতে পারেনি তখন।
ক্ষিপ্ত হয়ে নীলিমার দিকে হাত ওঠাতে চায় রাশেদ।
চিৎকার করে ওঠে নীলিমা,
– খবরদার। এক পাও আগাবেনা। আমাদের বাসার নিচে পুলিশ ঘেরাও করে আছে। আমি আগেই তাদের খবর দিয়ে এসেছি। এখনকার সব কথা তারা শুনতে পারছে। নিজের যদি আরও বেশি অনিষ্ট না চাও যেখানে আছ সেখানে দাঁড়িয়ে থাক।
রহিমা আপাকে নিজের দোষ স্বীকার করানোর জন্য আমার এই নাটক সাজাতে হয়েছে।
আর কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ এসে পড়বে।
রাশেদ জানো একটা কথা আছে, পাপ কখনো বাপকেও ছাড়েনা। তুমি কি জানো তোমার একটা পাপ যা একদিন একটা পরিবারকে শেষ করে দিয়েছিল, সেটা আজকে তোমার নিজের পরিবার ও শেষ করে দিয়েছে।
তোমার ছেলে রিফাত একজন ভয়ানক মানসিক রোগী। তুমি কি জানো সেটা?
– মানে?
হতভম্ব হয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশেদ।
– হ্যা ঠিকই বলছি।
রিফাত প্রাণীদের টর্চার করে আনন্দ পায়। সে মানসিক ভেবে অসুস্থ। ওর ভেতর আর দশটা সাধারণ মানুষের মত আবেগ নেই। ভাল মন্দের পার্থক্য নেই। তার আনন্দ অন্য প্রাণীকে আঘাত করার মধ্যে। এরকম ভয়ানক মানসিক কন্ডিশন খুব রেয়ার। ওর চিকিৎসা অনেক আগে শুরু হওয়া উচিত ছিল। ওর লক্ষণ যতটা ভয়ানক সেটার চিকিৎসা এই দেশে হবেও না। আর চিকিৎসা করলেও ও সুস্থ হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। নিউই়য়র্কে আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত একজন বিশেষ নাম করা ডাক্তার আছেন, মিস রোজ উইলিয়াম। তার সাথে কথা বলে আমি এসব কিছু জেনেছি। আমি ঐ দেশে রিফাতের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তোমার পাপের সাজা এই বাচ্চাটার ওপর আরও ভয়ানক ভাবে যাতে না পড়ে তার সবটুকু চেষ্টা আমি করব।
আর অশিক্ষিত হলেও রহিমা আপা রিফাতের এই অসুস্থ্যতা ধরতে পেরেছিলেন। ধরতে পেরেও তিনি সেটা গোপন করে যান। প্রাণীদের টর্চার করার যাবতীয় সরঞ্জাম জোগাড় করে দেন। রিফাত এর অসুখটা আরও বাড়তে দেন।
রিফাত সুস্থ হলে হয়তো ওকেও মেরে ফেলত তিনি। এই ছেলে যদি এই অসুস্থতা নিয়ে বড় হয় তাহলে ও নিজ হাতে তোমাকেই যে কোন দিন মেরে ফেলবে। খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছিল এটা রহিমা আপা। রিফাত এর এই দিক দেখে ওনার প্রতিশোধ আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল। অথচ বাবা হয়ে তুমি নিজের ছেলের অসুস্থতার দিকে কোনোদিন ঠিকমত নজরই দাওনি। আরেকজনের ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিল।
এটাই আজকে তোমার নিয়তি রাশেদ। তোমার পাপের শাস্তি। তুমি তোমার পাপের জন্য হিমিকাকে হারিয়েছ, আজ থেকে আমাকে হারালে আর জীবনের জন্য তোমার ছেলেকেও হারালে।
একটু থামল নীলিমা। পাশে থাকা ডাইনিং এর চেয়ার টায় বসে পড়ল।
রহিমা আপা হাসছে নীলিমার দিকে তাকিয়ে। আবেগহীন, প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হওয়া এক বৃদ্ধার হিংস্র হাসি।
“তুই ও শেষ। আমার মেয়েরে যেমনে শেষ করছে এই জানোয়ার আমিও এই জানোয়ার এর জীবনের সবাইরে শেষ করমু।”
বলেই আবার অট্ট হাসি হাসতে লাগলেন তিনি।
নীলিমার শরীর ঘেমে উঠছিল,
– আমি জেনে শুনেই আজকে রাতের খাবারে আমার জন্য আপনার করা মাশরুমের খাবার টা খেয়েছিলাম আপা। আমি বাসায় এসে রান্নাঘরে মাশরুম দেখেই যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলাম। তাই একটি প্রতিষেধক আগেই খেয়ে নিয়েছিলাম বিষক্রিয়া টা ধীর করে দেবার জন্য। আপনার সাথে যা হয়েছে সেটা খারাপ হয়েছে অনেক আমি মানছি। কিন্তু তাই বলে আপনি যা করেছেন সেটা বিনা সাজায় আমি ছেড়ে দিতে পারতাম না। নির্দোষ একজন মানুষকে খুন করেছেন। আমাকে খুনের চেষ্টা করেছেন । একটা অসুস্থ বাচ্চাকে দিন দিন আরও অসুস্থ হতে দিয়েছেন।
একটু দম নিলো নীলিমা। কথা বলতে আরও কষ্ট হচ্ছে। গলাটা কেমন পুড়ে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কোনমতে বলতে লাগল,
আমি যদি আজকে নাও বাঁচি তবুও আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব। একটা পাপীকে সাজা দিতে পেরেছি আমি। প্রতিশোধ নিয়ে কি শান্তি পেলেন আপনি। আপনার কাকলি আপনার কাছে কোনোদিন ফিরে আসবেনা। উলটো মেয়েটার আত্মা হয়তো আরো কষ্ট পাচ্ছিল তার মায়ের এই অবস্থা দেখে।
এটুকু বলেই চেয়ার থেকে পড়ে গেল নীলিমা। পুলিশ এসে গিয়েছে। রহিমা আপাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উনি উন্মাদের মত চিৎকার করছে। রাশেদ হাউমাউ করে কাঁদছে রিফাতকে জড়িয়ে ধরে। পুলিশ রিফাতকে ও নিয়ে যাচ্ছে রাশেদের কাছে থেকে। এরপর আর কিছু দেখছিল না নীলিমা। শুধু শব্দ শুনছিল ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দ।
ভিতরটা কেমন শান্তি লাগছিল, গলার যন্ত্রণাটা ও আর অনুভূত হচ্ছিল না। একটা কবিতা মাথায় আসছিল শুধু,
“আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।”